তুমি_আমারই_রবে
পর্ব_২১
#Nishat_Jahan_Raat (ছদ্মনাম)

“উইল ইউ মেরি মি রূপা?”

কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেহুলের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি হু হা করে হেসে পিছু ফিরে বললাম,,

“স্টপ দিজ ননসেন্স ড্রামা মেহুল। প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে আমার। দিন দিন আপনি একটু বেশিই রসাত্নক হয়ে উঠছেন। যা আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের জন্য হানিকারক।”

উনি বেশ সিরিয়াস হয়েই বললেন,,

“আমি কোনো ড্রামা করছি না রূপা। বিলিভ মি, আই লাভ ইউ এন্ড আই ওয়ান্ট টু মেরি ইউ।”

চোখ, মুখ কুঁচকে আমি আবারো পিছু ফিরে মেহুলের দিকে তাকালাম। উনার চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম এই চোখে কোনো ছলনা নেই। যা বলছেন একদম ঠিক বলছেন, মন থেকে বলছেন। মুহূর্তের মধ্যেই প্রচন্ড জেদ আমাকে গ্রাস করে নিলো। চোখের সামনে উনাকে একদম সহ্য করতে পারছি না। কি হলো আমার জানি না চোয়াল শক্ত করে আমি ঠাস করে মেহুলের গালে খুব জোরে এক চড় বসিয়ে দিলাম আর জোরে চিৎকার করে বললাম,,

“তার মানে এতো দিন আপনি আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন? এতোদিন আমার জন্য যা করেছেন কিছুই বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে করেন নি? পুরোটাই নিজের স্বার্থের জন্য করেছেন? আপনি ও অন্য সব ছেলেদের মতে হয়ে গেলেন? যারা শুধু মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মেয়েদের ব্যবহার করে?”

উনি গালে হাত দিয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,

“মেহুল কখনো রূপার দূর্বলতার সুযোগ নেয় নি। মেহুল শুধু রূপার ভাঙ্গা চূড়া জীবনটাকে দুহাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলো, রূপাকে অর্ধাঙ্গিনী করে নিজের সাথে রাখতে চেয়েছিলো। পৃথিবীর সমস্ত সুখ রূপার কাছে হাজির করতে চেয়েছিলো। অন্য সব ছেলেদের মতো রূপাকে ব্যবহার করতে নয়।”

“আপনার লজ্জা করছে না? বিবাহিত একটা মেয়েকে নতুন করে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিতে? এতোটাই নির্লজ্জ আপনি?”

“হ্যাঁ আমি নির্লজ্জ। রূপাকে পাওয়ার জন্য মেহুল চরম নির্লজ্জ হতে পারে। কারণ, মেহুল রূপাকে খুব ভালোবাসে। খুব বেশি ভালোবাসে।”

আমি আবারো ঠাস করে মেহুলের অন্য গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে বললাম,,,

“মেহুল, আপনি আমার সামনে থেকে সরে যান। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছি না। একদম পারছি না। আপনাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করতে ও আমার এখন লজ্জা লাগছে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে আপনাকে শেষ করে দেই। একেবারে জানে মেরে দেই।”

“এখন আমাকে খুব অসহ্য লাগছে তাই না? তাহলে এই তিন মাস আমাকে সহ্য করলে কিভাবে? একবারের জন্যে ও বুঝতে পারো নি, আমি তোমাকে ভালোবাসি? আমার চোখে, মুখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখো নি?”

“না দেখি নি। দেখার চেষ্টা ও করি নি। কারণ, আমি শুধু আপনাকে ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছি। কখনো অন্য চিন্তা আমার মাথায় আসে নি। আমার মাথায় সবসময় এটাই ছিলো, “আমি বিবাহিত, আমার স্বামী আছে, দূরে থাকলে ও আমি আমার স্বামীকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আমার স্বামীর জায়গা কেউ কখনো দখল করতে পারবে না। তাই আপনার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। মাঝে মাঝে আপনার জোরাজুরিতে আপনার কাছাকাছি থেকেছি। তা ও শুধুমাএ ভালো বন্ধু হিসেবে।”

“তাহলে বলছ, এই তিন মাসে তুমি শুধু আমার ভালো বন্ধু হিসবেই আমার সাথে মিশেছ? আমার প্রতি কোনো ভালো লাগা বা ভালোবাসা তৈরি হয় নি?”

“না তৈরি হয় নি। না কখনো হবে। কেনো জানি না আমি আপনার মাঝে আমার হিমুর ছায়া দেখেছি। আপনার প্রতিটা কাজে আমি আমার হিমুকে খুব ফিল করেছি। না চাইতে ও আপনার কাছে ছুটে গেছি। বারণ সত্ত্বে ও আপনার পাশাপাশি থেকেছি। আপনার থেকে একটু দূরে থাকলেই একটা অদ্ভুত টান অনুভব করেছি। সেই টানেই আমি বার বার আপনার কাছে ছুটে গেছি। জানি না এই টানের কারণ কি। তবে এখানে আমার ও ফল্ট ছিলো, আমি কেনো আপনার সাথে এতো ঘনিষ্ট হলাম, কেনো আমাদের বন্ধুত্বটাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিলাম, কেনো আপনার থেকে দূরে দূরে থাকতে পারলাম না!”

আমি হেচকি তুলে কেঁদে আবার বললাম,,

“হিমুকে ছেড়ে আসার পর পাড়া বলুন অফিস বলুন কোথাও না কোথাও রূপার জন্য ছেলেরা পাগল ছিলো। মূলত এই কারণেই আমরা আগের হল ছেড়ে আপনাদের ফ্ল্যাটে এসেছি। হিমুর পর কখনো কোনো ছেলের প্রতি আমি এতোটা টান অনুভব করি নি। আপনার জন্য যতোটা করেছি। এক্ষেএে আমি সর্বাধিক দোষী। কখনো কখনো হয়তো আমি ও আপনাকে আশকারা দিয়েছি। আর এজন্যই আজকের দিনটা আমাকে দেখতে হলো। ভুল যেহেতু আমারই ছিলো তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আজ, এই মুহূর্তে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। কোথায় যাবো জানি না, তবে যেখানে দু চোখ যায় সেখানেই চলে যাবো।”

কাঁদতে কাঁদতে আমি ছাদ থেকে বের হতে নিলেই পেছন থেকে মেহুল আমার হাতটা টেনে ধরে গলা জড়ানো কন্ঠে বললেন,,,

“যেও না রূপা। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি চাই তুমি হিমুকে ডিভোর্স দিয়ে এসো। আর নতুন করে আমার সাথে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নাও। এই মেহুল অন্তত হিমুর মতো তোমাকে ঠকাবে না।”

মেহুলের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে আমি পিছু ঘুড়ে ইচ্ছে মতো মেহুলের দু গালে চড় মারছি আর বলছি,,,

“তোর মতো বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। তুই ভাবলি কি করে? তোমার কথায় আমি হিমুকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো? জানিস, এজন্যই ছেলেদের বেশি মাথায় তুলতে নেই।তোকে মাথায় তোলাটাই আমার জীবনের সবচে বড় ভুল ছিলো।”

ননস্টপ থাপড়াচ্ছি আমি মেহুলকে। উনি শুধু টলমল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোনো রকম প্রতিবাদ করছেন না। না আমাকে উল্টে ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। ফর্সা গাল দুটো এতক্ষনে লাল হয়ে গেছে। এরপরে ও থাপড়ানো বন্ধ করছি না আমি। এক পর্যায়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শ্বাস বেড়ে অবস্থা খারাপ। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছি। মাথাটা ও কেমন ঘুড়ছে। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। থাপড়ানো বন্ধ করে আমি পিছু ফিরে ধীর পায়ে হেঁটে ছাঁদের দরজার কাছে যেতেই মেহুল চেঁচিয়ে পেছন থেকে বললেন,,,

“হিমু কখনো তোমাকে ভালোবাসে নি, কখনো বুঝে নি, স্ত্রী হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা ও দেয় নি। বরং তোমাকে সবসময় কষ্ট দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, পুড়িয়েছে। তা ও তুমি দীর্ঘ আড়াই বছরের ব্যবধানে ও হিমুকে ভুলতে পারো নি, ঠিক আগের মতোই ভালোবাসো, এখনো অনেক নির্ঘুম রাত হিমুর কথা ভেবে পাড় করে দাও, হিমুর জন্য কাঁদো। প্রতিটা ক্ষনে, প্রতিটা মুহূর্তে হিমুকে ফিল করো, ভালোবাসার কোনো কমতি নেই, না আছে কোনো অনীহা। অথচ তোমার কাছে হিমুর বিকল্প অপশন আছে। এই মেহুল হলো তোমার সেই বিকল্প অপশন। আমি জানি এই তিন মাসে আমি তোমার মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছি। আমার ভালোবাসা দিয়ে আমার ছোট ছোট কেয়ারিং দিয়ে। এই মেহুল তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, বুঝে, যথেষ্ট সম্মান ও করে, তুমি চাইলে হয়তো নিজের জানটা ও দিয়ে দিতে পারবে। এতো সুযোগ থাকা সত্ত্বে ও তুমি বিকল্প অপশনটা বেছে নিতে চাইছ না, মন থেকে আমাকে মানতে চাইছ না। তাহলে হিমু কেনো তার পাঁচ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে তার পাঁচ মাসের বিয়ে করা স্ত্রী রূপাকে মেনে নিবে? কিভাবে এতো সহজে রূপাকে তার কাছে টেনে নিবে, কিভাবে রূপাকে তার স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মানটা দিবে, কিভাবে রূপাকে নিয়ে ভাববে, কিভাবে রূপাকে নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করবে? “পাঁচ মাস” কি খুব বেশি সময়? “পাঁচ বছরের” ভালোবাসাকে ভুলার? যদি ও রূপা হিমুকে খুব ভালোবাসতো, কেয়ারিং করতো, খুব বুঝত, তা ও কি হিমুর পক্ষে সম্ভব ছিলো মৃত্যু পথযাএী ভালোবাসাকে ছেড়ে রূপাকে মেনে নেওয়া! হোক সে মেয়েটা ফ্লড, প্রতারক, ধোকাবাজ। হিমুর অজান্তেই যদি ঐ মেয়েটা হিমুর সাথে প্রতারণা করে থাকে তাহলে কি এতে হিমুর কোনো দোষ ছিলো? এই প্রশ্ন গুলোর ঠিকঠাক কোনো উত্তর আছে তোমার কাছে রূপা?”

ঘোলা ঘোলা চোখে আমি পিছু ফিরে মেহুলের দিকে তাকালাম। মাথাটা প্রচন্ড ঘুড়ছে আমার। মেহুলের কথা গুলো আমি ঠিক মানতে পারছি না। আসলে উনি কি বলতে চাইছেন, তাই আমার মাথায় ঢুকছে না। শরীরটা সাংঘাতিক খারাপ লাগছে আমার। বুঝতে পারছি না মেহুল কিভাবে হিমুর ব্যাপারে এতো কিছু জানলেন। মাথায় এতো প্রেশার নিতে পারছি না আমি। তাল সামলাতে না পেরে আমি মাথা ঘুড়ে পড়ে যেতে নিলেই মেহুল দৌঁড়ে এসে আমাকে বুকের মাঝে শক্ত করে ঝাপটে ধরলেন। বুকের বাঁ পাশটা খুব লাফাচ্ছে উনার। দ্রুত গতিতে হার্ট বিট করছে। আমি কান পেতে আওয়াজটা শুনছি। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে। এই ভালো লাগাটার জন্যই হয়তো লোকটার কাছে আমি বার বার ফিরে এসেছি। না চাইতে ও ছুটে এসেছি। আমার হিমুকে ফিল করেছি। আর এই ফিল করাটাই আজ আমার অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো!

কাঁপা কাঁপা শরীরে আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি আর বলছি,,,

“মেহুল প্লিজ ছাড়ুন। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। আমাকে এক্ষনি হিমুর কাছে যেতে হবে। হিমুর খোঁজ নিতে হবে। আপনার কথা মতো নাবিলা হিমুকে ধোঁকা দিয়েছে। প্রতারণা করেছে হিমুর সাথে৷ নাবিলার মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হবে। প্লিজ ছাড়ুন আমায়।”

হঠাৎ আমি চোখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“আচ্ছা…হিমুর ব্যাপারে আপনি এতোকিছু জানলেন কিভাবে? আপনি কি হিমুকে আগে থেকেই চিনেন?”

উনি আমাকে টাইট করে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জোরে চিৎকার করে বললেন,,,

“বুকের এই ধুকপুকুনির আওয়াজ শুনে ও কি তুমি বুঝতে পারছ না রূপা এই মেহুল ই তোমার হিমু? শুধু চেহারা পাল্টালেই কি মানুষটা পাল্টে যায়? তার ভেতর, বাহির, ব্যবহার, আচরণ, ব্যক্তিত্ব, অনুভূতি এ সব কিছুই কি পাল্টে যায়?”

আমি অতি আশ্চর্য হয়ে নিবার্ক চাহনীতে মেহুলের দিকে তাকালাম। মেহুল চিৎকার করে কেঁদে বলছেন,,,

“দীর্ঘ সাতানব্বই দিন আমি তোমার কাছে ছিলাম, পাশাপাশি ছিলাম একবারের জন্যে ও বুঝতে পারো নি এই মেহুলই তোমার হিমু? কতো বার আমি তোমাকে হিন্টস দিয়েছি! কতোভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছি এরপরে ও তুমি বুঝলে না রূপা?”

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে উনার পুরো মুখে আলতো করে ডান হাতের সবগুলো আঙ্গুল ছোঁয়াচ্ছি আর বলছি,,,

“সসসত্যি আআআাআপনি আমার হিমু?”

“হ্যাঁ রূপা। আমিই তোমার হিমু!”

শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে আমি নিজেকে উনার থেকে সরিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,,

“তাতাতাহলে আপনার মুখটা পাপাল্টালো কিভাবে? আপনার চেহারার সাথে তো আমার হিমুর চেহারার কোনো মিল নেই। তার মানে আপনি আবারো আমার সাথে মিথ্যে বলছেন? নিশ্চয়ই আবার আমার সাথে ড্রামা করছেন?”

হঠাৎ পেছন থেকে আমার শ্বাশুড়ী মায়ের গলার আওয়াজ শোনা গেলো। চরম আশ্চর্যিত হয়ে আমি পিছু ঘুড়ে তাকাতেই দেখলাম শ্বাশুড়ী মা আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছেন,,,

“আমার ছেলে সব সত্যি বলছে রূপা। তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার ছেলে হিমু। “তোর স্বামী হিমু।”

শ্বাশুড়ী মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে আমি আমার সামনে থাকা লোকটার দিকে আবার তাকালাম। নিস্তেজ মুখটার দিকে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এবার বিশ্বাস না করে থাকতেই পারলাম না যে, উনি আমার হিমু। আস্তে আস্তে উনার কাছে এগিয়ে আমি উনার সমস্ত মুখে হাত বুলিয়ে বললাম,,

“আআআপনার এ অবস্থা কিভাবে হলো হিমু? কেকেকেনো আপনাকে মুখটা পাল্টাতে হলো?”

উনি অশ্রুসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

“জানতে হবে না তোমার। আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে হবে না তোমার। তুমি তো হিমুকে একেবারের জন্যই একলা ছেড়ে এসেছ তাই না? হিমু কেমন আছে, কোথায় আছে, ভালো আছে কিনা, কখনো তো খোঁজ নিয়ে ও দেখো নি। তাহলে এখন তোমার এসব জেনে কি লাভ বলো?”

আমি কাঁদতে কাঁদতে উনাকে টাইট করে জড়িয়ে ধরে বললাম,,,

“আর একটা ও কথা বলবেন না আপনি। আজ বুঝতে পারলাম, কেনো আমি বার বার আপনার কাছে ছুটে যেতাম। আপনাকে আমার হিমু ভাবতাম। হিমুর সব অভ্যাস, পছন্দ, অপছন্দ সব আপনার মধ্যে খুঁজে পেতাম। আপনার পাশাপাশি থাকলে নিজেকে পূর্ণ মনে করতাম। এজন্যই আপনাকে দেখলে আমার বুকের বাঁ পাশটা খুব জোরে জোরে ধুকপুক করত৷ আর সেই টানেই আমি আপনাকে আমার এতোটা কাছে আসতে দিয়েছি।”

“এতো মিল খুঁজে পেয়ে ও তো আমাকে চিনতে পারো নি রূপা। তোমার এতো কাছে থাকার পরে ও তুমি হিমুকে চিনতে পারো নি।”

আমি ঢুকড়ে কেঁদে বললাম,,,

“কিভাবে আপনাকে চিনবো বলুন? আপনার মুখটা তো সম্পূর্ণ আলাদা। হিমুর মুখের সাথে কোনো মিল ই নেই। বার বার আপনাকে হিমু ভাবতে গিয়ে ও থেমে গেছি। বুঝার ভুল হিসেবে বার বার নিজেকে সংশোধন করেছি। প্লিজ হিমু, বলুন আপনার কি হয়েছিলো? কেনো আপনাকে নিজের রূপ পাল্টাতে হলো? প্লিজ এইবার অন্তত বলুন!”

উনি গলা জড়ানো কন্ঠে বললেন,,,

“আগে তুমি আমার ঐ প্রশ্ন গুলোর উত্তর দাও। কেনো তুমি আমাকে সময় না দিয়ে এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে এলে? কেনো আর একটা দিন আমাকে সময় দিলে না? কেনো সত্যিটা সবার মুখোমুখি আনতে দিলে না! তুমি ও সত্যিটা জানতে পারলে না। আর একটা দিন সুযোগ দিলে হয়তো রূপা আর হিমুর মাঝে এই দীর্ঘ আড়াই বছরের বিচ্ছেদটা আসত না। হিমুকে পাগলের মতো হন্ন হয়ে দিন, রাত এক করে রূপাকে খুঁজতে হতো না!”

আমি চোখে জল নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

“কি সত্যি হিমু? আপনি কোন সত্যির কথা বলছেন?”

“নাবিলার কোনো ক্যান্সার ছিলো না রূপা। নাবিলা দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়েছে, আমার মা-বাবাকে ঠকিয়েছে, এমনকি তোমাকে ও ঠকিয়েছে। এই সমস্ত কিছু নাবিলা টাকার জন্য করেছে। আর তাকে ইন্ধন যুগিয়েছিলো রাহাত। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

“কিকিকিভাবে জানলেন এসব?”

“ঐদিন বাইক আনার জন্য আমি যখন আবার হসপিটালে যাই, তখন আমার মনে হলো নাবিলাকে আরো একবার দেখে আসা উচিত। নাবিলার কেবিনটাতে যেতেই আমি খুব অবাক হয়ে যাই। কারণ, নাবিলা বেডে নেই। নাবিলার জায়গায় বৃদ্ধ একজন মহিলা বেডে শুয়ে আছেন। প্রথমে মনে করেছিলাম কেবিন নাম্বার ভুল ছিলো। হয়তো ভুল করে অন্য কারো কেবিনে চলে এসেছি। কেবিন থেকে বের হয়ে যখন কেবিন নাম্বারটা আবারো চেইক করলাম তখনই আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। কেবিন নাম্বার সম্পূর্ণ ঠিক আছে। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমি দু তালা থেকে নেমে সোজা রিসিপশানে চলে এলাম। রিসিপশানে নাবিলার কথা জিগ্যেস করতেই রিসেপশনিস্ট বললেন,,,

“স্যরি স্যার। নাবিলা নামের কেউ রিসেন্টলি এই হসপিটালে এডমিট হন নি। আর ক্যান্সার রোগী তো ভুলে ও না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার।”

“না ম্যাম। আমি ঠিক আছি। আমার মনে হচ্ছে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

তখনই আমার চোখ গেলো নাবিলাকে ট্রিটমেন্ট করা ডক্টরের দিকে। উনি দুতালার দিকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। মূলত এই ডক্টর ই নাবিলা সম্পর্কে সমস্ত ইনফরমেশান আমাকে দিয়েছিলেন। উনার থেকেই জেনেছিলাম নাবিলা এই হসপিটালের কতো নম্বর কেবিনে আছে। আমি হম্বিতম্বি হয়ে দৌঁড়ে গেলাম উনার কাছে। উনার মুখোমুখি দাঁড়াতেই উনি হঠাৎ হকচকিয়ে গেলেন। নাবিলার ব্যাপারে উনাকে জিগ্যেস করতেই উনি অন্য এক জরুরি অপারেশনের বাহানা দিয়ে আমাকে এভোয়েড করে চলে গেলেন। ডক্টরের আচরণে আমি খুব অবাক হলাম। হসপিটাল থেকে বের হয়ে আমি সোজা নাবিলাদের বাড়ি চলে এলাম। নাবিলাদের ড্রইং রুমে ঢুকতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। নাবিলা আর রাহাত দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে খুব হাসি ঠাট্টা করছিলো। আর কিসব প্ল্যান নিয়ে যেনো বলাবলি করছিলো। তখনই নাবিলা আর রাহাতকে আমার খুব সন্দেহ হয়।

কৌতুহল নিয়ে আমি নাবিলা আর রাহাতের মুখোমুখি দাঁড়াতেই থতমত খেয়ে দুজন দুজনকে ছেড়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল। নাবিলা আর রাহাত আমাকে যা তা বুঝিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিয়েছিলো। বলেছিলো, নাবিলার শরীরটা একটু সুস্থ লাগছিলো, তাই রাহাত নাবিলাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে৷ আমি ও ওদের সামনে ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই নি। ঐ দিন অনেক রাতে আমি বাড়ি ফিরি। বাড়ি ফিরে বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পরের দিন সকালে উঠেই আমি ঐ ডক্টরের মুখোমুখি হবো৷ ডক্টরের পেট থেকেই আসল সত্যিটা বের করব। তোমাকে এই বিষয়কে কিছু জানাই নি। ভেবেছিলাম সব সত্যি উদঘাটন করে তারপর তোমাকে সম্পূর্ণ বিষয়টা জানাবো৷ কিন্তু.. তুমি তো আমাকে সেই সুযোগটা দাও নি রূপা। ঐ রাতেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে এলে। আমাকে সারা জীবনের জন্য অপরাধী বানিয়ে!”

আমি কাঁদতে কাঁদতে হিমুর বুকে মাথা রেখে বললাম,,,

“আমাকে মাফ করে দিন হিমু। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি বুঝতে পারি নি আমার অগোচড়ে এতোকিছু ঘটে গেছে। ঐ দিন রাতে আমি ও নাবিলাকে হসপিটালের কেবিনে দেখি নি। নাবিলার বেডে অন্য একজন বৃদ্ধ মহিলা ছিলেন।”

#চলবে…..

(আশা করি পাঠকদের সামান্য হলে ও কনফিউশন দূর হয়েছে? আগামী পর্বে পুরো কনফিউশনটাই দূর হয়ে যাবে। আর একটা দিন অপেক্ষা করুন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here