#তিনি_আমার_সৎমা

পর্বঃ৫

“নীরা আসবো?”
আমি চমকে উঠলাম কণ্ঠস্বরটা শুনে। সেদিনের পর থেকে আমি ওই লোকটার মুখোমুখি হইনা। আমরা যে একই ছাদের নিচে বাস করছি এটা ভাবতেও আমার ঘৃণা লাগে মাঝে মাঝে। এই লোকটার জন্য, হ্যা শুধুমাত্র এই পিশাচটার জন্য আমার মায়ের ফুলের মতো জীবনটা এভাবে চলে গেলো। এই লোকটা আমার কাছে একটা নরকের কীট ছাড়া আর কিছুই না। এখন আমার কাছে কি চায় ও?
আমি কোনো কথা না বলে নিজের বইতে মনোযোগী হই। লোকটা আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আমার রুমে ঢুকে যায়। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে রাগে।
“কি ব্যাপার নীরা? আমার সাথে কথা বলো না কেনো তুমি বেশ কিছুদিন যাবৎ?”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,”আপনার সাথে কথা বলার কোনো রুচি আমার নেই মিস্টার আফজাল সাহেব।”
আমি লোকটা দিকে তাকাইনি, না তাকালেও আমি বুঝতে পারছি লোকটা হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“এসব কি বলছো নীরা? আমি তোমার বাবা। বাবার সাথে এভাবে কেউ কথা বলে?”
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি আমি। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে বলি,”বাবা? লজ্জা করে না আপনার নিজেকে আমার বাবা বলে পরিচয় দিতে? মেয়েকে একটা পরপুরুষের হাতে তুলে দেওয়ার সময় কোথায় ছিলো আপনার পিতৃত্ব আফজাল সাহেব? আপনি দয়া করে আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনার ছায়া দেখতেও ঘৃণা করছে আমার।”
“নীরা, বিহ্যাব ইওরসেল্ফ। তুমি মনে হয় ভুলে যাচ্ছো কার সাথে কথা বলছো তুমি।”
“চোখ রাঙাবেন না আফজাল সাহেব। এই চোখ রাঙানোকে অনেক ভয় পেয়েছি একটা সময়ে। পুরো একটা রাত আমাকে বাথরুমে অন্ধকারে আটকে রেখেছেন সাথে আমার মাকেও আটকে রেখেছেন অন্যঘরে যাতে সে আমাকে বাঁচাতে না পারে। ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতাম আমি, কাঁদতাম চিৎকার করে। তবুও আপনার মন গলেনি। দাদীকে ভয় দেখিয়ে বন্দী বানিয়ে রেখেছেন। দেখতে আমাদের সুখী মনে হলেও আমরা ছিলাম আপনার হাতের পুতুল ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু না, আর পারবেন না। লেবু বেশি নিংড়ালে তেতো হয়ে যায়। আপনি সম্পর্কটা তেতো করে ফেলেছেন। আর আমি ভয় পাইনা আপনাকে।”
লোকটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বিস্ময়ে হতভম্ব সে। হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মনে হয় বিশ্বাস করতে পারছে না, যে নীরাকে চিরকাল ভয় দেখিয়ে পুতুল বানিয়ে রেখেছে সেই নীরা আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ অনেক হিংস্র হয়ে যেতে পারে এটা তাকে বুঝতে হবে।
“নীরা, তুমি আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার সাথে এভাবে কথা বলছো? তুমি কি জানো তোমাকে আমি এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি? তখন কই যেয়ে দাঁড়াবে তুমি? একবারও ভেবে দেখেছো?”
উনার কথায় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসলাম আমি। আমার হাসি দেখে আরো একপ্রস্থ অবাক হলেন উনি।
“ও তাই নাকি আফজাল সাহেব? আপনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন? কিন্তু তার আগে তো আমিই আপনাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি।”
“মা মা মানে? কি বলছো কি তুমি?”
“এই বাড়িসহ আরো যে যে সম্পত্তি আমার আছে সব আমাকে বুঝিয়ে দেবেন। কিচ্ছু যেনো বাদ না থাকে। এসব কিছুর একমাত্র মালিক আমি, আপনি নন। আমার আসল বাবা এগুলো আমার জন্য রেখে গেছেন। তাই আমি যদি চাই আপনাকেই এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারি।”

সারাঘরে পিনপতন নীরবতা। লোকটার মুখ ঝুলে গেছে হতভম্ব হয়ে। সে এখনো জানে না আমি সেদিনই সব সত্যির মুখোমুখি হয়ে গিয়েছি।
“তোমাকে এসব কে বলেছে? ওই বুড়িটা?”
“কেনো? দাদী যদি বলেও থাকেন তো আপনি কি করবেন? তাকে আর কোনো ভয় আপনি দেখাতে পারবেন না। কারণ এই বাড়িটা আমার। আমার বাড়িতে আমি যা বলবো তাই হবে। আর কারো কোনো কথা শোনা হবে না।”
আমার এই কথা শুনে পিশাচের মতো একটা হাসি হাসে লোকটা। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাই সে হাসির দিকে। আবার কি চাল দিতে চাচ্ছে ও?
“নীরা, তোমার বয়স যেনো কতো?”
আমি কোনো কথা না বলে তাকাই উনার দিকে। কি বলতে চাচ্ছে ও বুঝতে পারছি না।
“শোনো, স্কুলে তোমার দুই বছর গ্যাপ গেছে সংসারের বিভিন্ন অশান্তির জন্য। তোমার মা ছিলো বোকা, সে বিভিন্ন ঝামেলা করতো। যার ফলে তোমার এই অবস্থা। তো যাই হোক, এখনো কিন্তু তোমার বয়স আঠারো হয়নি। তোমার বয়স এখন সতেরো বছর দশ মাস। তার মানে আঠারো বছর হতে তোমার এখনো দুই মাস বাকি। বয়স আঠারো না হওয়া পর্যন্ত তুমি এই সম্পত্তির কিছুই পাবে না। সে পর্যন্ত তোমার রক্ষনাবেক্ষন এর দায়িত্ব আমার। এটা তোমার মায়েরই স্বাক্ষর করা রয়েছে দলিলে। তুমি চাইলে দেখাতেও পারি। দুই মাস কিন্তু অনেকটা সময়। অনেক কিছু হতে পারে দুই মাসে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,”মানে? কি হতে পারে এই দুইমাসে?”
“অনেক কিছুই হতে পারে। এই যেমন ধরো তুমি স্বেচ্ছায় তোমার নামের সব সম্পত্তি আমার নাম লিখেও দিতে পারো, তাইনা?”
এই বলে লোকটা বিশ্রী করে হাসলো। আমার বুক কেঁপে উঠলো। এই লোকটা কি করতে চাচ্ছে আমার সাথে?
“তাই ভালোয় ভালোয় বলছি আমার কথামতো চলো। আখেরে তোমারই লাভ হবে। তা না হলে….”
“তা না হলে কি আফজাল? কি করবে তুমি আমার মেয়ের সাথে?”
রুনা আন্টি এসে দাঁড়িয়েছেন দরজায়। আমার বুকে একটু সাহস ফিরে আসে। উনার মুখে মিটিমিটি হাসি। সবসময় একটা রহস্যের হাসি দেন উনি। আমি বুঝতে পারিনা সেই হাসিটাকে ভালোমতো।
“তোমার মেয়ে? হাসালে রুনা। সবাই যখন জেনেই গিয়েছো বলতে তো দ্বিধা নেই। নীরার সাথে বস্তুত কোনো সম্পর্ক নেই তোমার। এমনকি এই বাড়ির কারো সাথেই ওর কোনো সম্পর্ক নেই।” তাচ্ছিল্যের হাসি লোকটার মুখে।
“হুম সে তো হবেই। কারণ ও এই বাড়ির মালকিন। আর আমরা ওর বাড়িতে আছি।”
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আফজাল সাহেবের। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”এখনো নয়। আরো দুইমাস পর থেকে। এই দুই মাসে কেউ মালকিন থেকে আশ্রিতা হয়েও যেতে পারে। কে বলতে পারে।”
“আবার কেউ চিরতরে এই বাড়ি থেকে বিদায়ও হয়ে যেতে পারে। কে বলতে পারে।”
“বাহ! মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি দেখতে পাচ্ছি। তুমি আমার স্ত্রী। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে তুমি। নাহয় তোমার অবস্থাও খারাপ হবে।”
“আমি রাত্রি নই আফজাল। আমি রুনা। আমাকে ওই লাল চোখ দেখিয়ে তোমার গোলামী করাতে পারবে না।”
এই প্রথম আমি রুনা আন্টির চোখে আগুন দেখলাম। এই আগুন আমার মায়ের চোখেও আমি দেখেছি। কিন্তু সেই আগুন এই লোকটা ছাইচাপা দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলো। রুনা আন্টির সাথেও এমন কিছু করবে না তো? কিন্তু উনি বা আমার জন্য নিজের জীবনকে এভাবে ঝুঁকিতে তুলছেন? কি লাভ উনার? কি উদ্দেশ্য উনার? এই লোকটা কে বিয়েই বা কেনো করেছেন উনি এতকিছু জেনেও? এইসব প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতেই হবে।

কিছুদিন গেলো এভাবেই। রুনা আন্টির সাথে আমার সম্পর্ক কিছুটা ভালোর দিকে। আমার অনেকরকম বদঅভ্যাস উনার জন্য পরিবর্তন হয়েছে। আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করছি। বাইরের খাবার এখন খাইনা বললেই চলে। একদম রুটিনমাফিক জীবন চালাচ্ছি আমি। মাঝে অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাই। বড্ড আপন লাগে উনাকে। মনে হয় কতো জনম জনম ধরে উনাকে চিনি আমি। উনার মধ্যে মা কে খোঁজার চেষ্টা করি আমি। কোনো মিল পাইনা তেমন। আমার মা ছিলেন লম্বা,চিকন আর উনি ছোটখাটো, গোলগাল। তেমন কোনো মিল দুইজনের মধ্যে পাইনা আমি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে যেয়েও উনার মধ্যে মাকে খোঁজার চেষ্টা আমার চলতেই থাকে। কখনো তার হাসিটা, কখনো তার কপট রাগ দেখানো। আমার অবচেতন মন যেনো ভেবেই নিয়েছে উনিই আমার মা। হয়তো নতুন রূপে ফিরে এসেছেন আমার কাছে। অনেকবার চেয়েছি উনার রহস্য উদঘাটন করার। বারবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরেছি। এখন সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি। হয়তো রহস্য উদঘাটন করার পর জানবো উনি আমার কিছুই নন। কি দরকার? আমার অবচেতন মন ভেবে নিক না উনাকে আমার মা হিসেবে। ক্ষতি কি? কিন্তু জীবন কোনো রূপকথা তো নয়। রূপকথায় হয়তো রাজকন্যার কাছে তার মা নতুন রূপে ফিরে আসে। কিন্তু সত্যিকার জীবনে এমনটা হয়না। এখানে যারা একবার চলে যায়, একেবারেই চলে যায়। তারা আর ফিরে আসে না।

এরইমধ্যে আমার জীবনে আবারও একটি দুর্ঘটনা ঘটতে গেলো। যা আমার সাজানো গোছানো জীবনটাকে আরো একপ্রস্থ এলোমেলো করে দিলো।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে শুয়ে আছি লাইট অফ করে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। রুনা আন্টি গিয়েছেন পাশের ওষুধের দোকানে আমার জন্য ওষুধ আনতে। সাথে গিয়েছে আমার ছোট ভাই রনি। দাদী গিয়েছেন ছাদে। সন্ধ্যার পর তার ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে উঠে বসি আমি। এখন আবার কে এসেছে? রুনা আন্টির কাছে তো চাবি আছে। সে নিশ্চয়ই কলিংবেল দিবে না। এখন ঘরে শুধু আমি আর আফজাল সাহেব। কে আসবে এই অসময়ে? এমনিতে আমাদের বাড়িতে বাইরের কেউ তেমন আসে না। ওই লোকটাই আসলে চায়না কেউ আসুক। আসলেই যে ওর কীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে।
আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না। পুনরায় এসে শুয়ে পড়লাম। ক্লোস্টোফোবিয়া থাকার কারণে আমি কখনো ঘরের দরজা আটকাতে পারিনা। সবসময় খোলাই থাকে তাই।
চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। হঠাৎ আমার পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাই আমি। স্পর্শটা অপরিচিত। আমরা মেয়েরা খুব ভালো করে বুঝতে পারি কোন স্পর্শের কি মানে। হঠাৎ দেখলাম ঘর অন্ধকার। এতোক্ষণ দরজা খোলা থাকার কারণে আমার ঘর অন্ধকার হলেও পাশের ঘরের আলো আসছিলো। এখন এতো অন্ধকার কেনো? কে দরজা দিয়েছে? আমি চিৎকার করে দাদীকে ডাকতে গেলে একটা শক্ত হাত আমার মুখে চেপে ধরলো। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো।

হঠাৎ দরজার বাইরে ঠকঠক শব্দ শুনলাম। আফজাল সাহেব বাইরে থেকে চিৎকার করছে,”হাশেম ভাই। আপনি নীরার ঘরের দরজা কেনো দিয়েছেন? কখন গেলেন আপনি ওর ঘরে? ও বদ্ধ দরজার ভিতর থাকতে পারে না। দরজা খুলুন আপনি। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি করবেন না এখন হাশেম ভাই। দরজা খুলুন প্লিজ।”
আমি ছটফট করছি বদমাশটার বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। নরকের কীটটার পৈশাচিক হাসি শুনতে পাচ্ছি আমি। কিন্তু আফজাল সাহেব আমাকে বাঁচাতে কেনো চাচ্ছে এখন?
আমি চিৎকার করে রুনা আন্টিকে ডাকতে চাচ্ছি। কোথায় মা তুমি?

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here