#তাহার_আগমন

পর্ব:০৭

হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল সানাউল মির্জার।তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভাবছেন,সত্যিই কি কেউ কাঁদছে?কিন্তু জমিদার বাড়িতে কান্নার তো কারণ হওয়ার কথা নয়।তিনি চুপচাপ শুয়ে রইলেন।নাহ,এবার সত্যিই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।অনেকগুলো মানুষের শোরগোলও শোনা যাচ্ছে।সানাউল মির্জা চোখ খুলে দেখলেন,জানালা দিয়ে সূর্যের রশ্মি সরু হয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছে।পর্দার কারণে চোখে আলো পড়ছে না।তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন,প্রায় আটটা বেজে গেছে।সানাউল মির্জা ভাবছেন,আজ এত বেলা হয়ে গেল,অথচ জমিদার সাহেব ডাকতে আসলেন না!নাস্তার জন্য তো এতক্ষণে বিশুকে দিয়ে নয়তো নিজে এসে কয়েকবার ডাকতেন।ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুদ লাগলো উনার কাছে।তিনি পাশে ঘুমিয়ে থাকা হাসিনকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন,এই শুনছো,মনে হচ্ছে বাইরে অনেক মানুষের উপস্থিতি।বেশ হট্টগোল শোনা যাচ্ছে।থেমে থেমে কান্নার আওয়াও ভেসে আসছে।হাসিন,আমি কি বলছি শুনছো।বেশ কয়েকবার ডাকাডাকি করার পর হাসিন চোখ খুলে তাকালো।সে চোখ মুছে উঠে বসে বলল,কি হয়েছে স্যার?এত সকালে ডাকছেন যে?

সানাউল মির্জা জানালার দিকে ইশারা করে বললেন,কান্নার শব্দ শুনতে পেলে?সঙ্গে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ?

হাসিন ভালো করে চোখ মুছে ঘুমঘুম ভাবটা কাটিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিল।সত্যিই কেউ যেন কাঁদছে।সে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,হ্যাঁ,থেমে থেমে কাঁদছে কেউ।কিন্তু জমিদার বাড়িতে আবার কি হয়েছে?

সানাউল মির্জা বললেন,বুঝতে পারছি না।কান্না আর হট্টগোলের শব্দ শুনেই তো ঘুমটা ভেঙে গেল।গতকাল হাঁটার পর সত্যিই ভালো ঘুম হয়েছে রাতে।

হাসিন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল,জমিদার বর্মণ মারা যায়নি তো?লোকটার বয়স তো অনেক হয়েছে।

-চলো,আমরা এখানে বসে না থেকে নিচে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসি,সানাউল মির্জা বিছানা থেমে নেমে পায়ে জুতো পড়ে বেরিয়ে গেলেন।হাসিন শরীরটা কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে সানাউল মির্জার পেছন পেছনে বেরিয়ে পড়লো।

জমিদার বর্মণ অজয়ের লাশ ধরে হাঁউমাউ করে কাঁদছেন।উনাকে গ্রামের কয়েকজন সামাল দিয়েও পারছে না।বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।সুজয়ও ভাইয়ের মৃত্যু দেখে পাগল প্রায়।বারবার নিজেকে দোষ দিয়ে বলছে,কেন সে গতরাতে অজয়কে যেতে বারণ করেনি?বারণ করলে হয়তো অজয়ের এই পরিণতি দেখতে হতো না।জমিদার বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীড় জমেছে।অনেকেই পাশের গ্রাম থেকে ছুটে এসেছে তাদের গ্রামপ্রধান জমিদার বর্মণের ভাগ্নের মৃত্যুর সংবাদ শুনে।কেউ কেউ নিজেদের ভাগ্যবান বলতেও কার্পণ্য করেনি।এই গ্রামে ভিটেমাটি নেই,সে তাদের চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য।নাহলে এমন অভিশাপে সবাই মারা যেতো।কেউ আবার জমিদারের শোকে আফসোস করতে করতে চোখে পানি চিকচিক করছে।

সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই সানাউল মির্জা দেখতে পেলেন,শ’খানেক লোকের সমাগম।সবার চোখেই ভয়ের ছাপ।কেউ আবার নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা বলছে।কান্নার উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন,এক জায়গায় ঘিরে মানুষের ঝটলা বেশি।একফাঁকে সুজয়ের মুখটাও দেখে ফেললেন।তিনি ভাবছেন,সুজয় কাঁদছে।তাহলে অজয়ও কাঁদবে।হাসিন যা বলেছে সেই কথাই কি সত্যি?জমিদার সাহেব মারা গেছেন?তিনি পেছনে ফিরে হাসিনকে বললেন,ঘটনাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।একটু সামনে গিয়ে দেখা যাক।তিনি ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে যেতেই জমিদার বর্মণকে কাঁদতে দেখলেন।বেশ অবাক হয়ে বললেন,জমিদার সাহেবের আত্মীয় বলতে তেমন কেউ তো নেই।তাহলে কে মারা গেছে?হঠাৎ হাসিন বেশ জোরেই চিৎকার দিয়ে বলল,মির্জা স্যার,অজয় আর বেঁচে নেই।একফাঁকে ওর লাশ দেখতে পেলাম মনে হচ্ছে।

সানাউল মির্জা এবার ভিড় ঠেলে দৌড়ে সামনে গিয়ে দেখলেন,সত্যিই অজয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে।সুজয় তার ভাইয়ের মাথার কাছে বসে কাঁদছে।সানাউল মির্জা জমিদার বর্মণের কাঁদে হাত রেখে বললেন,এসব কিভাবে হলো জমিদার সাহেব!আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

জমিদার বর্মণ কাঁদতে কাঁদতে বললেন,প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম থেকে আপনাকে ডাকার জন্য যাচ্ছিলাম।হঠাৎ জেলে পাড়ার শম্ভুকে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে আসতে দেখে নিচে নেমে দাঁড়ালাম।শম্ভু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,পূর্বের জঙ্গলের নদীর পাশে অজয়ের লাশ পড়ে আছে।আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি।ধমক দিয়ে বললাম,গাঁজা খেয়েছিস নাকি?আমার ভাগ্নে তো ভেতরে ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে আছে।শম্ভু একপ্রকার জোর করতেই আমি দোতলায় গিয়ে দেখি,সুজয় ঘুমিয়ে আছে।কিন্তু ওর পাশের বিছানা খালি।আমি তখন দৌড়ে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি আমার অজয় পড়ে আছে,জমিদার বর্মণ আর কথা বলতে পারলেন না।কান্নায় গলা ধরে আসে উনার।

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে এবার সুজয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।সুজয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,সুজয়,তুমি আর অজয় তো সবসময় একসাথে ঘুমাও।আমি যতদূর জানি,একজন অন্যজনকে ছাড়া কোথাও পা ফেলো না।কিন্তু গতকাল রাতে অজয় তোমাকে রেখে হঠাৎ বাইরে বের হলো কেন?তোমার জমিদার মামা তো দুজনকে বারণও করেছিল বের না হওয়ার জন্য।তাহলে অজয় হঠাৎ নদীর পাড়ে গেল কেন?

সুজয় একবার ওর মামাবাবুর দিকে তাকালো।অজয় সিগারেট খেতে বাইরে বের হয়েছিল শুনলে মামাবাবু বকা দিতে পারে।সেই ভয়ে চুপ করে রইল সুজয়।

ব্যাপারটা আন্দাজ করে সানাউল মির্জা বললেন,দেখো,এখন যেকোনো কথা লুকালে আমারই সমস্যা হবে তদন্ত করতে।আমি জানি,অজয় একটু দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে।কিন্তু তুমি চুপ করে থাকলে তো আরও ক্ষতি হতে পারে।

সুজয় আড়চোখে একবার মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল,আমি শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম।অজয়ের একটু-আধটু সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল।গতকাল রাতে আমাকে বলল,সিগারেট না খেলে ওর ঘুম আসবে না।আমি অনেকবার বলেছি,মামাবাবু বারণ করেছে বের না হতে।ভাই আমাকে “গ্রাম্য কুসংস্কার” বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল।আমার চোখ লেগে আসতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।মামাবাবুর ডাকে ভোরে শুনি,ভাই আর নেই।

সানাউল মির্জা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,এখানে শম্ভু কে?একটু আমার সামনে এসে দাঁড়ান।আপনার সাথে কথা আছে।

গলায় গামছা পরিহিত রোগাটে শরীরে একজন সামনে এগিয়ে এসে বলল,জ্বি,আমি শম্ভু।

-আপনি ভোররাতে ঠিক কি দেখেছিলেন একটু খুলে বলুন তো আমাকে,বললেন সানাউল মির্জা।

শম্ভুকে বেশ উৎসাহিত মনে হলো এই ব্যাপারে।সে সবার দিকে একবার তাকিয়ে হাত নেড়ে বলতে শুরু করলো,খুব ভোরে প্রতিদিন মাছ ধরতে বের হই।আমি পাশের গ্রামের সাহেব।প্রতিদিনের মতো আজও জাল নিয়ে জঙ্গলের পথ দিয়ে নদীর দিকে যেতেই হঠাৎ নাকে পঁচা গন্ধ এসে ঠেঁকলো।আমি ভাবলাম মরা গরু হয়তো পড়ে আছে।ঝোপ ঠেলে একটু সামনে যেতেই দেখি,ওমা,আমাদের জমিদার মশাইয়ের ভাগ্নের লাশ পড়ে আছে।আমি তখন চিৎকার করতে করতে খবরটা দিতে আসি।

-তা আপনি এক দেখাতেই চিনে ফেললেন কিভাবে?আপনি তো পাশের গ্রামের,সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন সানাউল মির্জা।

-কি যে বলেন,সাহেব!কতবার অজয়বাবুকে নিয়ে নৌকা করে মাছ ধরেছি।এবার তো এই কান্ড হওয়ার পর থেকে ভয়ে ভয়ে মাছ ধরে চলে যাই।কখন আবার কি বিপদ আসে।

শম্ভুর কথা শেষ হওয়ার পর সানাউল মির্জা বললেন,আপনি এখন আসতে পারেন।তিনি এবার হাসিন কে ইশারা দিতেই হাসিন সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ঠেলে বাইরে চলে গেল।সানাউল মির্জা অজয়ের লাশের পাশে বসলেন।পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে পড়লেন।অজয়ের লাশের ক্ষতগুলো বেশ মনোযোগ সহকারে দেখছেন তিনি।পায়ের গোড়ালি থেকে বুক পর্যন্ত নখের আঁচড়।গলায় লালচে দাগ বসে গেছে।কেউ খুব জোরে গলা চেপে ধরলে ঠিক যেমনটা হয়।ঘাড়ের পাশে নখের আঁচড়ও আছে তবে গভীর নয়।তিনি অজয়ের চোখের দৃষ্টির দিকেও নজর দিলেন,চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়।

এমন সময়ে হাসিন ভিড় ঠেলে সানাউল মির্জার পাশে এসে দাঁড়ালো।হাতে একটা দিয়াশলাই এর কাঠি দিয়ে কানেকানে কি যেন বলল সে।

সানাউল মির্জা গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ কাঠির দিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করলেন।একটু পরে জমিদার বর্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন,আমার আন্দাজ বলে,গতরাতে অজয় সিগারেট খেতে গেইটের পাশে এসে দাঁড়ায়।কিন্তু নন্দলালের মৃতদেহের গন্ধে থাকতে না পেরে হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির একটু দূরে গিয়ে থেমে যায়।সেখান থেকে এই না জ্বালানো কাঠি কুড়িয়ে এনেছে হাসিন।অজয় যখনই সিগারেট ধরাতে গিয়েছিল,হয়তো সে কিছু একটা দেখে বা শুনে।তারপরই কৌতূহলের ছলে সেটার পিছু নেয় সে।নদীর ধারে আসতেই তার হুশ হয়।কিন্তু ততক্ষণে অজয় অনেক দেরি করে ফেলে।আর শিকার হয়ে যায় সে।

হঠাৎ জমিদার বর্মণ বললেন,আপনি তো গতকাল বলেছিলেন,গ্রামের সবাই নিঁখোজ হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এসবের মাঝেও কেন আমার বাড়িতে আঁচড় পড়েনি?এবার তো শুধু আঁচড়ই নয়,মেরে ফেলা হয়েছে।আমি ওর বাবা-মায়ের সামনে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবো?

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,হ্যাঁ তা অবশ্য বলেছিলাম বটে।কিন্তু জমিদার সাহেব একটা জিনিস খেয়াল করেছেন আপনি?এবারের শিকারের ধরন একটু আলাদা।এতদিন যাদের খুঁজে পাওয়া যেতো,আঁচড়ের সাথে খুবলে খাওয়া দেহ পড়ে থাকতো।পাহারাদার নন্দলাল তার জলন্ত উদাহরণ।কিন্তু অজয়ের মৃত্যু দেখে মনে হচ্ছে,শুধু গলায় শ্বাসরোধ করে শিকার করা হয়েছে।তাহলে এতদিন যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের সাথে অজয়ের পার্থক্য কি?শিকারী পাল্টে যায়নি তো?নতুন রহস্যে মনে হচ্ছে ফেঁসে গেছি আমরা।

দশ.

আবিদ থানায় ইন্সপেক্টর সাদমানের সামনে বসে আছে।থানায় কেন ডাকা হয়েছে সে বিষয়ে কিছুই জানে না আবিদ।ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেছে অথচ কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি।কিছুক্ষণ পরপর একজন ফাইল নিয়ে আসে,সে ফাইলে ইন্সপেক্টর সাদমান চোখ বুলিয়ে ইশারা করলেই চলে যাচ্ছে।মাঝে এক কাপ চায়ের সাথে বিস্কুটও খাওয়া হয়ে গেছে।অথচ একবার জিজ্ঞেসও করেনি,আবিদ সাহেব,চা খাবেন?নাহ,আবিদের এবার বেশ বিরক্ত লাগছে।এভাবে কিছু না বলে এক জায়গায় বসে থাকার কোনো মানেই হয়না।আবিদকে উসখুস করতে দেখে ইন্সপেক্টর সাদমান বলল,কি ব্যাপার বিরক্ত লাগছে মনে হচ্ছে?

আবিদ সঙ্গে সঙ্গেই বলল,তো লাগবে না?এক ঘন্টার উপরে হয়ে গেছে।অথচ কোনো কারণ ছাড়া বসিয়ে রেখেছেন।কিছু জিজ্ঞেসও করছেন না,কেন ডাকা হয়েছে সেটাও বলছেন না।এদিকে আমার অফিসেরও বারোটা বেজে গেছে।এতবার অফিসে ছুটি দিলে চাকরি থাকবে?

ইন্সপেক্টর সাদমান মুচকি হেসে গ্লাসে চুমুক দিয়ে বাকি পানিটুকু শেষ করে বলল,আর এদিকে আপনি আর আপনার স্ত্রী রেহানা যে আমার নাকে দড়ি দিয়ে টানছেন সে জন্য একবারও কি আমি আপনার উপর রাগ করেছি?

আবিদ ইন্সপেক্টর সাদমানের কথায় অবাক হয়ে বলল,মানে কি বলছেন আপনি?আপনার নাকে দড়ি দিয়ে টানতে যাবো কেন?

ইন্সপেক্টর সাদমানের কথাটা বোধহয় পছন্দ হলো না।ভ্রুঁ কুচকে সামনে ঝুঁকে বলল,এটা মোটেও মজা করার সময় নয়।আর আমিও কোনো জোকস বলছি না।আপনাদের দুজনের জন্য উপর থেকে কত চাপ সৃষ্টি হয়েছে জানেন?

আবিদ বলল,আমরা তো কিছুই করিনি।অযথা আপনার উপর চাপ পড়ার কারণ ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-আপনার স্ত্রীর অফিসের দারোয়ান খুন হয়েছে।শুধু হাত ছাড়া কিছুই পাইনি।সন্দেহের বশে আপনার স্ত্রীর উপর নজর রাখতে গিয়ে আমি তো একটু হলে ড্রেনে পড়ে।যাই হোক,সে কথা আমি আর বলে লজ্জা পেতে চাইনা।

আবিদ বলল,আপনি ড্রেনের কাছে গেলেন কেন?ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বলুন।

-এত পরিষ্কার করে বলার সময় আমার নেই।এবার আপনার কাছে আসি।সেদিন আপনার বাসায় মনছুর সাহেব খুন হয়েছে।যদিও খুন বলতে নারাজ।কারণ খুন না বলে শিকার বললে ভালো মানায়।তো ধরে নিলাম,ডাকাতি করতে এসে খুন হয়েছে।

ইন্সপেক্টর সাদমানের কথার মাঝে আবিদ বলল,ডাকাতি হতে যাবে কেন?আমার বাসায় তো সবই অক্ষত আছে।

-সেটাই তো।সবকিছু অক্ষত হলে মনছুর সাহেব কারণ ছাড়া মারা গেলেন কেন?ধরে নিলাম,কোনো অশরীরীর হাতে উনার মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু অশরীরী তো আপনার বাসায় চুরি করতে আসেনি।তাহলে বাসার অবস্থা তছনছ হলো কিভাবে?

-তা আমি কি করে বলবো বলুন তো?বলল আবিদ।

-ওই তো,সবকিছু পুলিশের উপর।আমি এখন পর্যন্ত এর কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারিনি বলে উপর থেকে চাপ পড়ছে।আচ্ছা আমার চাকরি না খেয়ে আপনাদের দুজনের শান্তি হচ্ছে না তাই না?আর চাকরি কি বলছি,ওইদিন তো আপনার স্ত্রী আমার প্রাণটাই নিয়ে যেতো,কথাটা ভাবতেই আরেক গ্লাস পানি খেল ইন্সপেক্টর সাদমান।

আবিদ কি বলবে বুঝতে পারছে না।সে চায় না,সানাউল মির্জা ছাড়া রেহানার ব্যাপারে আর কেউ সন্দেহ প্রকাশ করবে।

ইন্সপেক্টর সাদমান বলল,কি ভাবছেন?আচ্ছা এই কয়দিনে আপনার চোখে সন্দেহজনক কিছু পড়েছে?হোক সেটা আপনার অফিসে কিংবা বাসার সামনে।একটু ভেবে বলুন তো।

আবিদ মাথা নেড়ে বলল,এমন কিছু তো চোখে পড়েনি।হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল,একটা ঘটনা অবশ্য আমার সাথে ঘটেছে।আপনার কতটুকু কাজে লাগবে জানিনা।তবে শুনুন,কিছুদিন আগে রেহানা তখনও অফিস থেকে ফিরেনি।আমি বারান্দায় বসে পায়চারি করছিলাম।হঠাৎ বাসার সামনের ঝোপের দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো,দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ব্যাপারটা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার মোবাইলে সঙ্গে সঙ্গে একটা ছবি তুলে ফেলি।আর ছবিটা একটু কাছে টেনে দেখতেই আমার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হলো।একটা খাকি পোশাক পড়া লোক ওই ঝোপে বসেছিল।আমি ব্যাপারটা বুঝতে নিচে নেমে দেখি,সেখানে তখন কেউ নেই।

ইন্সপেক্টর সাদমান এবার বেশ জোর দিয়ে বলল,এই কথাটা আগে বলতে পারলেন না?পেটে চেপে বসে আছেন।এখন বের করতে হবে,সেই লোকটি কে ছিল?আর খাকি পোশাকে এখানে কেউ চাকরি করে বলে আমার জানা নেই।লোকটা কি তবে বাইরের ছিল?আর হলেও কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিল?অশরীরী তাহলে মনছুরকে মারার কারন কি?আর লোকটা যদি আপনার বাসায় তখন ঢুকেই থাকে,তাহলে মূল্যবান কিছুতে হাত দেয়নি কেন?

অজয়ের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সানাউল মির্জা।সঙ্গে হাসিনও এসেছে।দুজনে জায়গাটা ভালো করেই দেখছে।জঙ্গলের ঝোপ এড়িয়ে একটু পরেই নদী।নদীতে খুব একটা স্রোত নেই।মাঝেমাঝে দু’একটা ছোট নৌকা দেখা যায়।অতটা গভীরতা নেই বললে চলে।সানাউল মির্জা বললেন,অজয় এতদূর চলে আসে ব্যাপারটা সত্যিই তাজ্জব?

হাসিন এগিয়ে এসে বলল,আর অজয়কে যতদূর জানি,খুব সাহসী প্রকৃতির।হয়তো কৌতূহল সামলাতে না পেরে চলে এসেছে।

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,হুম তাই তো।এবার বুঝলে,বেশি সাহস ভালো নয়।প্রতিটা জিনিসের একটা ওজন আছে।এবার যাওয়া যাক।বিকাল গড়িয়ে একটু পর সন্ধ্যা নামবে।তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে।সন্ধ্যা হলে তো সব আবার ভূতুড়ে হয়ে যায়।

সানাউল মির্জা আর দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটতে শুরু করলেন।একটু সামনে যেতেই থেমে গেলেন তিনি।গাছের আড়ালে একটা গেইটের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন,এইদিকে আবার কি?এই জঙ্গলের মাঝে গেইট কেন?আর ওই লাল কাপড়গুলো বাঁশের গায়ে লাগিয়েছে কেন?

হাসিন গ্রামের ছেলে।গ্রামের ইতিহাস সবই তার জানা।সঙ্গে সঙ্গেই বলল,ওইটা হলো জমিদার বাড়ির কয়েদখানা।জমিদার বর্মণের পূর্বপুরুষরা খাজনা না দিলে এখানে নিয়ে এসে বন্দী করে রাখতো।ইচ্ছে হলে আবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সবাইকে খাজনার জন্য ভয় দেখিয়ে বেড়াতো।জমিদার বর্মণের আমলেও প্রথম প্রথম শাস্তি হিসেবে ফাঁসি হয়েছে কয়েকজনের।তবে প্রভাব খাটিয়ে চাপা দিয়েছে সেসব ঘটনা।একসময় কয়েকখানা বন্ধ হয়ে যায়।মানুষজনের যাতায়াত কমতে কমতে কয়েদখানার পথ জঙ্গলে পরিণত হয়।কিন্তু হঠাৎ ঘটলো বিপত্তি।কেউ কেউ বলতে শুরু করলো,রাত হলে এখানে নাকি অনেকজনকে একসঙ্গে কাঁদতে দেখা যায়।কেউ আবার ফাঁসির মঞ্চতে আলোও জ্বলতে দেখেছে।শুনেছি,গ্রামের দু’একজন অতি উৎসাহি হয়ে ব্যাপারটা দেখতে যাওয়ার পর মারা গেছে।তখন সবাই মিলে এই লাল কাপড় বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে টাঙিয়ে দিল।এখন অবশ্য কেউ তেমন যায় না।

হাসিনের কথা শুনে সানাউল মির্জা বেশ খুশি হয়ে বললেন,বাহ!তুমিতো খুব সুন্দর করে ঘটনাটা বললে আমাকে।সত্যিই কত নির্যাতন আর নিরীহ মানুষের আর্তনাদের কান্না মিশে আছে এই কয়েকখানায়,ভাবতেই শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।আচ্ছা আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবে?খুব পিপাসা পেয়েছে।

-হ্যাঁ,অবশ্যই।একটু সামনে গেলেই একটা টিউবওয়েল আছে।পানিগুলো বেশ খেতে।চলুন, আমার সঙ্গে।

টিউবওয়েলের পানিতে পিপাসা মিটিয়ে সানাউল মির্জার শরীর যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলো।তিনি বললেন,একটু আগে থানা থেকে ফোন এসেছিল।আমি যার উপর তদন্ত করতে করতে এখানে এসেছিলাম,সেই আবিদ সাহেবের বাসার সামনে কিছুদিন আগে এক অদ্ভুদ ঘটনা ঘটেছে।ঝোপের আড়ালে খাকি পোশাকে কেউ বসে উনার দিকে তাকিয়ে ছিল।আর তারপরই রহস্যজনকভাবে মনছুর সাহেবের মৃত্যু।

হাসিন বলল,খাকি পোশাক তো জমিদার বাড়ির বিশুদাও পড়ে।আর লোকটাকে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হয়না।তাহলে ঝোপের আড়ালে বিশুদা ছিল না তো?

সানাউল মির্জা বললেন,হতে পারে আবার নাও হতে পারে।খাকি পোশাক তো কতজনই পড়ে।আর তাছাড়া যদি মনছুর সাহেবের স্বাভাবিক মৃত্যু হতো,তাহলে লোকটাকে সন্দেহ করার একটা সুযোগ ছিল।হতে পারে,সে চুরি করার জন্য বসেছিল।

হাসিন শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

সানাউল মির্জা বেরিয়ে যাওয়ার পথে এবার ভালো করে আশপাশটা দেখলেন।একটু পরেই একটা বাড়ি।দরজায় তালা দেয়া।আশপাশে ঘাসের স্তুপ জমে আছে।হাসিনকে বললেন,এই বাড়িতে কেউ থাকেনা?আশপাশে তো ঘাস উঠে জঙ্গল হয়ে গেছে।কিন্তু টিউবওয়েল দেখে তো মনে হচ্ছে,লাগানো হয়েছে বেশিদিন হয়নি।

হাসিন মুচকি হেসে বলল,স্যার,এই বাড়িরও একটা ইতিহাস আছে।শুনবেন আপনি?

সানাউল মির্জা হেসে বললেন,এখানেও ইতিহাস?নিতাইপুর কি ইতিহাসের বই নাকি?এত ইতিহাস জানতে পারলে যাদুঘর কমিটি তো গোটা নিতাইপুর তুলে নিয়ে যাবে।তা শুনি তোমার ইতিহাস।

-আজ থেকে ঠিক দুইমাস আগে এখানে এক ভদ্রলোক আসে।গ্রামের সবার সাথেই বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যে।কিন্তু হঠাৎ করে কিছু না বলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।বাসার ভেতরের সবকিছু ঠিক আগের মতই ছিল।শুধু সেই দুজন মানুষ নেই।শেষে আমরাই বাধ্য হয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলাম।মালামালগুলোর দায়িত্ব তো আমাদের।যদি কখনো আসে তখন সবকিছু আবার বুঝিয়ে দেয়া হবে।কিন্তু ততদিনে বেঁচে থাকলে তো?আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো,ভদ্রলোক যাওয়ার পর থেকেই গ্রামে অভিশাপ শুরু।

সানাউল মির্জা বললেন,এমনটা নয়তো ওই দুইজনই প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছিল?আচ্ছা আমি একটু ভেতর থেকে ঘুরে আসি।নিশ্চয়ই এতদিনে কাঠের জানালাগুলো ভেঙে পড়েছে।তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখো,কেউ আসে কিনা?

সানাউল মির্জার আন্দাজই ঠিক।কাঠের জানালাগুলো প্রায় অকেজো হয়ে গেছে।বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে খুলে নিচে পড়ে আছে।একটু চেষ্টা করতেই ভেতরে ঢুকতে পারলেন তিনি।ভেতরে ঢুকে উনার চোখে ছানাবড়া।বিছানার চাদর হতে শুরু করে আলমারি সবই নতুন।সব আগের মতই পড়ে আছে।যেন মনে হচ্ছে,এখানে কেউ ছিল।কিন্তু অজানা শক্তির জোরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।সানাউল মির্জা পুরো ঘরটা হেঁটে দেখছেন।কোথাও কিছু পাওয়া যায় কিনা।অনেকক্ষণ খোঁজার পরও কিছুই চোখে পড়েনি সানাউল মির্জার।পুরোটাই ফাঁকা।শেষে হতাশ হয়ে জানালা দিয়ে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পায়ে কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলেন।একটু সরে গিয়ে নিচে তাকাতেই সানাউল মির্জার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তিনি আনন্দে বলে উঠলেন,এবার রহস্যের শেষ পর্যায়ে হয়তো চলে এসেছি।শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

এগারো.

সুজয় বিছানার এক কোণে বসে আছে।সুজয়ের চোখে পানি।বারবার অজয়ের কথা মনে পড়ছে তার।এখন কাছে থাকলে কত কথাই বলতো সে।একদম বিরক্ত করে তবেই চুপ হতো।কিন্তু এখন সুজয়কে বিরক্ত করবে কে?কে খেলার প্রাইজ জিতে এসে বলবে,জানিস,আমি আজ দারুন খেলেছি।আর একটি সুন্দরী মেয়ে আমার সাথে খেলার শেষে কথা বলেছে।মেয়েটার ফোন নাম্বারও দিয়েছে।এমন কথা শুনে সুজয় আর কখনো ভাইকে বকতে পারবে না ভাবতেই সুজয় কেঁদে উঠলো।চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালো সুজয়।সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি।এখন বসে থাকতেও বিরক্ত লাগছে তার।সুজয় ভাবছে,একবার হেঁটে আসলে কেমন হয়?বেশি নয়,গেইট পর্যন্ত হেঁটে এসে ঘুমিয়ে পড়বে সে।রাত অবশ্য খুব বেশি হয়নি।তবে সবাই লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।সুজয় আর দাঁড়িয়ে না থেকে চুপেচুপে বের হয়ে গেল।

পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে।শুধু দুটো বড়বড় আগুনের মশাল জ্বলছে।সারারাত জ্বলবে।ভোরে এসে মামাবাবু নিজে নিভিয়ে দিবে।উনার বিশ্বাস,আগুন দেখলে কোনো খারাপ কিছু কাছে আসেনা।সুজয় সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই চোখ পড়ল অজয়ের লাশ রাখার জায়গাটায়।সুজয়ের এখনও মনে হচ্ছে অজয় বেঁচে আছে।সে চোখ বন্ধ করে মজা করছে।সুজয়ের মন যেন হঠাৎ বলে উঠল,অজয় ভাই আমার,আর কত ঘুমাবি?এবার তো উঠে কিছু খেয়েনে।

সুজয় কোনো উত্তর পেল না।আবারও চোখদুটো ভিজে আসল তার।হাঁটতে হাঁটতে গেইটের কাছে আসতেই মনে হলো,কেউ তাকে আড়াল থেকে দেখছে।সুজয় আশপাশে একবার ঘুরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না।সুজয় আবার উল্টোদিকে ঘুরতেই মনে হলো,কেউ তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে।এবার সুজয়ের মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে।সে তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করলো।কিন্তু গেইট থেকে জমিদার দালানের দূরত্ব যেন কয়েক মাইল বেড়ে গেছে।হঠাৎ সুজয়ের সামনে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো।সুজয় এবার ভয়ে পেছনে যেতে শুরু করলো।তার ঠোঁট কাঁপছে।গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।ইচ্ছে করছে,মামাবাবুকে চিৎকার করে ডাকতে।কিন্তু পারছে না সে।

হঠাৎ শায়নকে দেখতে পেল সুজয়।শায়ন বিশুদার ছেলে।এতরাতে সে এখানে কি করছে?এবার ঝাপসা চোখে দেখতে পেল,সায়ন মাটিতে পড়ে গেছে ধপাস করে।রক্তে মাটি ভিজে রক্তিম আভা ছড়িয়ে গেছে মুহূর্তে।শায়নও তাহলে শিকারে পরিণত হয়েছে।

তবে কি বিশুদার সাথে এই রহস্যের কোনো হাত নেই?থাকলে তার ছেলেকেই প্রাণ দিতে হলো কেন?

………..চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here