#তাহার_আগমন

পর্ব:০৬

সানাউল মির্জা জমিদার বর্মণের সাথে বাড়ির ছাদে বসে রয়েছেন।সকালের খাবারের আয়োজন আজ এখানেই করা হয়েছে।ভোরের আলো ফুটতেই জমিদার বর্মণ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সোজা ছাদে নিয়ে এসেছেন সূর্য দেখাবেন বলে।সঙ্গে ভোরের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সুধা পান করবেন।হাসিন এখনও ঘুম থেকে উঠেনি।তাকে কয়েকবার ডাকার পরও শুধু বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গেল।সানাউল মির্জার মনটা সত্যিই ভীষণ পুলকিত।সঙ্গে জমিদার বর্মণের পূর্ব পুরষের ইতিহাস শুনে উনার মনে হচ্ছে,তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে চলে গিয়েছেন।

জমিদার বর্মণ বললেন,জানেন,আমার বাপ-ঠাকুরদার আমলে প্রতিদিন ভোরবেলায় প্রজারা এসে ভীড় করতো নিচে।সবাই কোনো না কোনো সাহায্যের আশায় উনাদের মুখের দিকে চেয়ে ছুটে আসতো এখানে।তাদের দুঃখের গল্প বলতো।সেই দুঃখ শুনে দান করতেন বাপ-ঠাকুরদারা।উনারা খাজনার সময়ে প্রচন্ড অত্যাচারী হয়ে উঠতো,আবার অন্যসময়ে দু’হাত ভরে দান করতেন।তারপর জমিদারি উঠে গেল।কিন্তু আমি এখনও জমিদার বর্মণ নামেই সবার মুখে রয়ে গেলাম,কথাটা বলে হেসে উঠলেন তিনি।

সানাউল মির্জাও হেসে বললেন,আপনি এই বয়সে এখনও এতটা প্রাণচঞ্চল সত্যিই ভাবা যায় না।

-এই বাড়িতে একসময় মানুষ গিজগিজ করতো।এখন পুরো বাড়ি খুঁজেও আপনি দশজন পাবেন না।আমার কথা বলার মানুষ নেই।আপনাকে পেয়ে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।

হঠাৎ সানাউল মির্জার ফোনটা বেজে উঠলো।তিনি দেখতে পেলেন,শহর থেকে ফোন এসেছে।রিসিভ করতেই কারো উত্তেজিত কন্ঠ শুনে সানাউল মির্জার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো।হাত থেকে চায়ের কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

-কি হয়েছে মির্জা সাহেব?আপনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।কোনো খারাপ খবর?জিজ্ঞেস করলেন জমিদার বর্মণ।

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,হ্যাঁ,একটু আগে একজন ফোন করে বলল,গতকাল রাতে মনছুর সাহেব মারা গিয়েছেন।তবে স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে মনছুর সাহেবের দেহটাকে।

জমিদার বর্মণ আঁতকে উঠে বললেন,সে কি?কিন্তু এই মনছুর কে?

-মনছুর সাহেবই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল।নাহলে হয়তো এসব কখনোই জানতে পারতাম না।লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার।এই রহস্যের শেষটা নিজ চোখে দেখে যেতে পারলেন না তিনি।

জমিদার বর্মণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাকিটুকু নিঃশব্দে খেতে লাগলেন।

সানাউল মির্জা হঠাৎ বললেন,একটা প্রশ্ন করতে পারি,যদি আপনি কিছু মনে না করেন জমিদার সাহেব?

জমিদার বর্মণ ভাবলেশহীনভাবে বললেন,হ্যাঁ,বলুন না।কি মনে করার আছে?

সানাউল মির্জা কিছুটা ইতস্তত করে শেষে বলেই ফেললেন,নিতাইপুরে এখন পর্যন্ত অনেক মানুষই নিঁখোজ।বাকি যারা বাপ-দাদার ভিটেমাটি নিয়ে আঁকড়ে বসে আছে তারাও নিঁখোজ হওয়ার পথে।আমি জানি তাদের একটা জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছে।কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আপনার জমিদার বাড়িতে কারও শরীরে আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি।ব্যাপারটা রহস্যজনক নয় কি?

সানাউল মির্জার কথায় বোধহয় জমিদারের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়লো।তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,তার মানে আপনি ইশারা করছেন যে এসব কিছুর পেছনে আমার হাত রয়েছে?

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে বললেন,তা বলতে যাবো কেন?আমি বলতে চাইছি যে,হতে পারেনা যে সবকিছুর পেছনে দায়ী সে আপনার বাড়িতেই বসে আছে।নাহলে এতকিছুর পরও এর রেশ জমিদার বাড়িতে পৌঁছায়নি।আর পাহারাদার নন্দলাল সে তো গ্রামেরই লোক।তাকে আপনার বাড়ির লোক বলে আমি মানতে নারাজ।

জমিদার বর্মণ কিছু না বলে হঠাৎ চায়ের কাপ রেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচে।সানাউল মির্জা চশমার ফাঁকে কিছু একটা আন্দাজ করে বিড়বিড় করে বললেন,মনে হচ্ছে জায়গামতো পড়েছে।এবার দেখা যাক কি হয়?

আট.

আবিদ রুমের এক জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে।তার প্রিয় বন্ধু মনছুরের গতকাল রাতে নৃশংসভাবে মৃত্যুর ঘটনা এখনও মেনে নিতে পারছে না সে।এখনও যেন রেশ কাটেনি কয়েক ঘন্টা আগের দৃশ্যগুলো।গতকাল একটু আমোদ-উল্লাসের কথা ভেবে মদের বোতল নিয়ে ফিরতেই বাসায় ঢুকে দেখে মনছুর বিছানায় নেই।খাবারগুলো প্যাকেট থেকে বের করে সোফায় বসে অপেক্ষার পরও যখন মনছুর বাথরুম থেকে বের হলো না তখনই সে উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজা নক করে।সেখানে মনছুরকে না দেখতে পেয়ে আবিদের এবার কেমন যেন লাগলো।বাসার ভেতরে যাওয়ার লোক তো সে নয়।আবিদ তখন মনছুর বলে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে আসতেই এই দৃশ্য দেখবে হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি।মনছুরের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে।ওর চোখদুটো উপড়ানো।মুখের মাংস খুবলে নেয়া হয়েছে।পুরো শরীরে আঁচড়ের ক্ষত।রান্নাঘর রক্তের স্রোতে লাল হয়ে আছে।তখনই আবিদের চোখ পড়লো রান্নাঘরের পাশের রুমে।পুরো রুম তছনছ হয়ে আছে।যেন কিছুক্ষণ আগে ছোটখাটো ঝড় বয়ে গেছে বাসার আশেপাশে।তখনই পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় তার।ঠাঁয় বসে পড়ে নিচে।ভোরের ফজরের আযানের সময়ে পাশের বাসার সোবাহান সাহেব দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে তিনি নিজেও থমকে যান।আবিদ রান্নাঘরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।এলোমেলো হয়ে আছে সবকিছু।টেবিলে মদের বোতল,সঙ্গে চানাচুুরের প্যাকেট।সোবাহান সাহেব আর দেরি না করে থানায় ফোন করেন।

আবিদকে সকাল থেকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে গেছে।ইন্সপেক্টর সাদমান নিজেই এই ঘটনা হাতে নিয়েছেন।বাসার এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ রাখছে না।একটু পরেই এসআই হারুনকে রান্নাঘর থেকে আসতে দেখে বলল,কি ব্যাপার,কি বুঝতে পারলেন?খুনী কোনো আলামত রেখে গেছে?

ইন্সপেক্টর সাদমানের কথা শুনে এসআই হারুন যেন কিছুটা অবাক মনে হলো।সে আশপাশে একবার তাকিয়ে আস্তে করে বলল,স্যার,আপনি অশরীরী বিশ্বাস করেন?

ইন্সপেক্টর সাদমান অন্যমনস্ক হয়ে বলল,এতদিন হয়তো করিনি।কিন্তু গতকাল রাতে আমার সাথে…

ইন্সপেক্টর সাদমানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এসআই হারুন উত্তেজিত হয়ে বলল,গতকাল রাতে কি হয়েছিল,স্যার?ভূত দেখেছেন নাকি?

হারুনের কথা শুনে ইন্সপেক্টর সাদমান বলল,না,কিছু না।আপনি হঠাৎ অশরীরীর প্রসঙ্গ তুললেন কেন?

-স্যার,আপনিও তো মনছুর সাহেবের লাশটা দেখলেন।আমার কাছে তো মানুষের কাজ বলে মনে হচ্ছে না।চোখ উপড়ানো,মুখের মাংস খুবলে নেয়া,আঁচড়ের দাগও আছে।এসব তো মানুষের কাজ বলে মনে হয়না।

ইন্সপেক্টর সাদমান এসআই হারুনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,ধরে নিলাম,আপনার কথা অনুযায়ী অশরীরীর কাজ।কিন্তু আমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এখানের অবস্থা দেখেছেন?পুরো রুম তছনছ হয়ে আছে।মনছুর সাহেব তো এই রুমে এসে আর গড়াগড়ি খায়নি।

-স্যার,তাহলে কি এই বাসায় চোর এসেছিল?

ইন্সপেক্টর সাদমান মাথা নেড়ে বলল,না,আমার কাছে অন্যকিছু মনে হচ্ছে।চোর যদি এসেও থাকে তাহলে বাসার কিছুই নিয়ে যায়নি।এই যে দেখুন,এত দামি ঘড়ি পড়ে আছে।বাজারমূল্য অনুযায়ী দশহাজারের কম তো হবে না।তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় হারুন সাহেব?

এসআই হারুন মাথা চুলকে বলল,আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।এটা তো গভীর রহস্য বলে মনে হচ্ছে,স্যার।

ইন্সপেক্টর সাদমান কিছু বলতে যাবে এমন সময়ে দেখতে পেল,রেহানা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নিজের বাসার এই অবস্থা দেখে বুঝতে পারছে না,কি হয়েছে?রেহানাকে দেখে ইন্সপেক্টর সাদমান যেন কিছুটা আতঙ্কিত।তার কাছে মনে হচ্ছে রেহানার সামনে দাঁড়ালে হয়তো কিছুক্ষণ পর সে নিজেকে উত্তপ্ত কোনো মরুভূমিতে আবিষ্কার করবে।সাদমান কিছুটা ভয়ে ভয়ে রেহানার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,আপনি গতকাল রাতে কোথায় ছিলেন?

রেহানা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,আমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।কেন আবিদ কিছু বলেনি?সন্দেহ হলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ইন্সপেক্টর সাদমান আর কিছু বলার সাহস পেল না।রেহানাকে এড়িয়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো সে।একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবছে,এটা মানুষের কাজ হতে পারেনা।এভাবে আঁচড় দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়।তাহলে কি অশরীরীর কাজ?আর যদি অশরীরীর কাজ হয়েই থাকে তাহলে রুমের এমন অবস্থা কেন?আর মনছুর সাহেবকে হঠাৎ এভাবে মেরে ফেলার কারন কি?উনার মৃত্যুর পর রুমের তছনছ হওয়াটা কোনো রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি?

অজয় আর সুজয় দুজনের সাথে হাঁটতে বেরিয়েছেন সানাউল মির্জা।নাস্তা সেরে দুজনেই এত বায়না করলো যে না এসে পারলেন না।অবশ্য হাঁটার একটা কারনও আছে।কারনটা হলো জমিদার বাড়ির আশপাশটা ভালো দেখে নেয়া।বলা তো যায় না,কখন কি কাজে আসে।অবশ্য দুজনের সাথে হাঁটতে মন্দ লাগছে না সানাউল মির্জার।দুজনে দুদিকের যাত্রী।সুজয় সারাক্ষণ বিভিন্ন দেশের মজার ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ করে তার মতামত দিচ্ছে।সানাউল মির্জাও সুজয়ের কথায় বুঝতে পারলেন,ছেলেটা বেশ বুদ্ধিসম্পন্ন।অনেক বিষয় নিয়ে সে গভীরভাবে চিন্তা করে।অন্যদিকে অজয় তার প্রতিভার গুণগান করছে।সে এবছর কয়টা প্রাইজ পেয়েছে,কয়টা ছেলেকে টপকে ফাস্ট হয়েছে এসব।দুজনের সঙ্গে বেশ গল্পসল্প করে সময় কাটছে।

অজয় বলল,হাসিন ভাইকে দেখছি না যে?আমাদের সাথে এদিকে আসলে তো ভালোই হতো।উনি গ্রামের ছেলে।গ্রাম নিয়ে কত গল্পই হয়তো উনি জানে।

সানাউল মির্জা বললেন,সে একটু বাইরে গেছে।দুপুর নাগাদ ফিরবে।দুপুরে আমাদের সঙ্গেই খাবে।কি একটা কাজ আছে বলল,সানাউল মির্জা আসল কথাটা এড়িয়ে গেলেন।হাসিনকে আসলে বিশুর প্রতি নজর রাখতে পাঠানো হয়েছে।লোকটা ইদানিং কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়।আবার দেখা যায় পাশে বসে আছে।ব্যাপারটা হাসিনও বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে।এবার দেখার বিষয়,কি বেরিয়ে আসে?

তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির পেছনে চলে এসেছে।বিশাল এরিয়ে নিয়ে বাড়ির সীমানা করা হয়েছে।কত রকমের গাছ যে আছে গুনেও শেষ করা যায়না।এদিকটায় মাঝেমাঝে ছোটখাটো দালানও চোখে পড়ছে।সম্ভবত সেগুলো এখন পরিত্যক্ত।সানাউল মির্জা দুজনকে সাবধান করে বললেন,এদিকে সাপের ভয় বেশি।তোমরা সাবধানে পা ফেলে হাঁটবে কিন্তু।

-হ্যাঁ,আমিও শুনেছি।কিন্তু মাঝেমাঝে পরিষ্কার করা হয় এই যা ভরসা,বলল সুজয়।

সানাউল মির্জা বললেন,আচ্ছা তোমার মামার কি কোনো সন্তান নেই?উনার মুখে তো তাদের নাম নিতে শুনিনি।

সুজয় বলল,আসলে মামার দুই মেয়ে ছিল।আমি বাবার কাছ থেকে শুনেছি অনেক বছর আগে দুজনেই অদ্ভুদভাবে মারা যায়।আর তারপর থেকেই মামাবাবু বেশ ভেঙে পড়েন।বাবার থেকে আরও জেনেছিলাম,একসময় মামাবাবুর বেশ গর্জন ছিল।উনার গর্জনে প্রভাবশালী লোকও চুপসে যেতেন।কিন্তু দুই মেয়ের মৃত্যুর পর একেবারে চুপ হয়ে যান তিনি।

সানাউল মির্জা কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলেন,একটি মেয়ে পুকুরে বসে মাছ কেটে পরিষ্কার করছে।আড়চোখে একবার সানাউল মির্জার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল।সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি চোখ নামিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিল।সানাউল মির্জার কাছে ব্যাপারটা কিছুটা সন্দেহজনক মনে হলো।তিনি অজয়কে জিজ্ঞেস করলেন,এই মেয়েটি কে?

অজয় বলল,শর্মিলাদি।জমিদার বাড়ির সব কাজ সেই করে।মাস দুয়েক আগে বিশুদাই কাজে এনেছে।বলল,বেশ ভালো মেয়ে।তিনকুলে কেউ নেই।শেষে মামা রান্নার কাজে রেখে দিলেন।অবশ্য সবার সামনে খুব একটা আসেনা।

সানাউল মির্জা এবার উল্টোপথ ধরে বললেন,আমরা বেরিয়েছি অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।এবার না ফিরলে তোমার মামা আবার আমাদের জন্য চিন্তা করবেন।এমনিতেও উনার মন খুব একটা শান্তিতে নেই।এবার ফেরা যাক।

দোতলায় পা রাখতেই সানাউল মির্জা দেখতে পেলেন,জমিদার বর্মণ দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছেন।তিনি অজয় আর সুজয়কে তাদের কামড়ায় যাওয়ার ইশারা দিয়ে জমিদার বর্মণের পেছনে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিলেন।জমিদার বর্মণ দু’চোখ মুছে বললেন,আপনি এসেছেন তাহলে?আমিতো এখনই লোক পাঠাতে চেয়েছিলাম আপনাদের খোঁজে।

-আপনি আপনার মেয়েদের খুব ভালোবাসতেন তাই না?জিজ্ঞেস করলেন সানাউল মির্জা।

জমিদার বর্মণ মাথা নেড়ে বললেন,হ্যাঁ,একটু বেশিই।

সানাউল মির্জা বললেন,সুজয়ের থেকে জানতে পারলাম আপনার দুই মেয়ে খুবই অল্প বয়সে মারা গেছে।বোধ করি,সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।কিছু মনে না করলে জানতে পারি,দুজনের মৃত্যু কিভাবে হয়েছে?

জমিদার বর্মণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।হেঁটে ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।আমি তখন নতুন বিয়ে করি।সেই দূর গ্রাম থেকে আমার বাড়ির রাজরানি হয়ে আসে ইন্দুমতী।ইন্দুমতী যেন আমার জন্য আর্শীবাদ হয়ে পা রাখে এই বাড়িতে।চারদিকে আমার জমিদারি ফুলে ফেঁপে উঠেছে তখন।জমিজমা চাষাবাদ করে শুধু টাকা আর টাকা।কিন্তু আমার একটি দুঃখ ছিল।তা হলো আমার স্ত্রী নিঃসন্তান।এই দুঃখে মাথা পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।আমার এত সম্পত্তি কে দেখবে তাহলে?অবশেষে অনেক সাধনার ফলে আমার স্ত্রীর পেটে সন্তান আসে।আমার আনন্দ তখন দেখে কে!পুরো এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের সব মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানোর আয়োজন করি।কিন্তু এরই মাঝে আমার গ্রামে এক সাধু পা রাখে।আমাদের ধর্মে সাধুকে অনেক উঁচু আসনে দেখা হয়।আমি তখন খুশি হয়ে উনার সেবা করা শুরু করি।যত্নের কোনো ত্রুটি রাখিনি।কিন্তু যাওয়ার সময় তিনি যা বললেন তা আমি কল্পনায়ও ভাবিনি।আমার দুটি মেয়ে হবে।দুই মেয়ের বয়স যখন আঠারো পূর্ণ হবে তখন তাদের একটি কঠিন বিপদ আসবে।এই বিপদ আমার কাছের মানুষই করার চেষ্টা করবে।তাই আমাকে সাবধান করে তিনি চলে যান।

আশ্চর্য হলেও সত্যিই আমার স্ত্রীর পেটে দুটি মেয়ে হয়।এই সংবাদ আমার জন্য যেমন ছিল আনন্দের,আবার ছিল বিষাদেরও।তারপর থেকে আমার চোখে ঘুম ছিল না।একসময় দুজনের বয়সই আঠারো পূর্ণ হলো।একদিকে উত্তরাধিকার হতে যাওয়া,অন্যদিকে বিপদের শঙ্কা।সবমিলিয়ে আমি গোটা বিশেক পাহারাদার বসিয়ে দিলাম দুজনের দেখাশোনার জন্য।কিন্তু ওইযে,কপালে লেখা থাকলে কার সাধ্য?একদিন সকালে দুইজনের লাশ পুকুরে ভেসে উঠে।এত পাহারাদারের চোখ পেরিয়ে তারা সেখানে কিভাবে গেল সে রহস্য আজও অজানাই রয়ে গেল।

জমিদার বর্মণ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।সানাউল মির্জা এগিয়ে গিয়ে উনার কাঁধে হাত রেখে বললেন,সত্যিই বড্ড দুঃখজনক।জমিদার বর্মণের হাতের আঙুলে একটি আংটি দেখে বেশ কৌতহূ্লী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা,আপনার হাতের এই আংটি কি বিশেষ কিছুর নির্দেশ করে?

জমিদার বর্মণ হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,আমাদের বংশের ঐতিহ্য এই আংটি।যখনই কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করে,বংশের গৌরবময় ইতিহাস রক্ষার্থে এমন সিংহের সিলযুক্ত আংটি তাকে উপহার দেয়া হয়।

সানাউল মির্জা বললেন,তাহলে তো সুজয় আর বিজয়ের কাছেও এমন আংটি থাকবে?

-অবশ্যই থাকবে।কিন্তু ওই দুই কুম্ভকর্ণ হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব হাতেই রাখবে না।

-আচ্ছা যদি বাইরের কারো হাতে এই আংটি থাকে তাহলে?মানে আমি বলছিলাম,আপনার বংশের কেউ না এমন কারো হাতে এই আংটি থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?

জমিদার বর্মণ বেশ জোর দিয়ে বললেন,অসম্ভব।জমিদার বংশ ছাড়া এই আংটি আর কারো কাছেই থাকবে না।কারন এই আংটি শুধুমাত্র বংশের কেউ জন্ম নেয়ার পরই তার হাতে দেয়া হয়।তাই বাড়তি আংটি চুরি করা কখনই সম্ভব নয়।

সানাউল মির্জা কি যেন ভাবলেন।তাহলে তো আমার জন্য ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল জমিদার সাহেব।

জমিদার বর্মণ বোধহয় শেষের কথাটি বুঝতে পারলেন না।আপনি কি সহজের কথা বললেন?

সানাউল মির্জা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,অনেক কিছু যা আমাদের চোখে খুব সহজে ধরা পড়েনা।

নয়.

রাতের খাবার সেরে বিছানায় শুয়ে আছে অজয় আর সুজয়।সুজয় ইংরেজী ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে কি যেন পড়ছে।মাঝেমাঝে মোবাইল হাতে নিয়ে কয়টা বাজে খেয়াল রাখছে।জমিদার মামার কড়া হুকুম,রাত এগারোটার আগেই কামড়ার লাইট বন্ধ হওয়া চাই।নাহলে দুজনকেই বকা শুনতে হবে।সুজয় অবশ্য রাতে মোবাইলের আলোতে চুপিচুপি ম্যাগাজিন পড়ে।সুজয়ের মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয়,দুনিয়ার সব ম্যাগাজিন দিয়ে একটি বাড়ি বানাবে।পাশে থাকবে খাবারের বাটি,আর সঙ্গে ম্যাগাজিন।আহা!পুরো জীবনটাই কত সুন্দরভাবে কেটে যাবে।এমনসব স্বপ্ন প্রতিদিনই সুজয় দেখে।কিন্তু তার হিটলার বাবা এসব দু’চোখে দেখতেই পারেন না।”শয়তানের বই” বলে কত যে বিদ্রুপ করে।তখন সুজয়ের বলতে ইচ্ছে করে,তুমি বোকা বাবা।জানো,কত মজার মজার ঘটনা জানা যায়।কিন্তু মনের কথা মনেই থেকে যায় সুজয়ের।মামার বাড়িতে আসার পর বেশ আরামেই কাটছে তার।সারাদিন ম্যাগাজিনে ডুবে থাকা যায়।অনেকক্ষণ ধরে ভাই অজয়ের বিছানার উপর গড়াগড়ির জন্য ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছে না সে।আর থাকতে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলল,আহা ভাই,এত নড়াচড়া করছিস কেন?তোর জন্য ঠিকমতো পড়তেও পারছি না।শান্তিমতো পড়তেও দিবি না তুই?

অজয় বলল,দূর,তোর মতো ম্যাগাজিনের পোকা আমি জীবনে দুটো দেখিনি।সারাদিন ওইসব পড়ে কি মজা পাওয়া যায় শুনি?

সুজয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল,খবরদার ভাই,আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে বল।কিন্তু ম্যাগাজিন নিয়ে কিছু বলবি না।খুব খারাপ হয়ে যাবে।

সুজয়ের রাগে অজয় কিছুটা দমে গেল।দুজনে পিঠাপিঠি ভাই হলেও শরীরের স্বাস্থ্যে সুজয়ের বেশ পেটানো শরীর।সুজয়ের সাথে অত সহজে পারবে না তা অজয় ভালো করেই জানে।সুজয় রেগে গেলে কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।অজয় ইতস্তত করে বলল,আমি কি তাই বলেছি নাকি?আমি মরছি আমার জ্বালায়।

সুজয় ম্যাগাজিন রেখে ভ্রুঁ কুচকে বলল,সত্যি করে বল তো কি হয়েছে?তখন থেকে দেখছি, না ঘুমিয়ে পায়চারি করছিস।নিজেও না ঘুমিয়ে আমাকে বিরক্ত করছিস।মতলবটা কি তোর?

অজয় কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল,এখানে আসার পর থেকে সিগারেটও খেতে পারছি না।সারাক্ষণ মামাবাবু নজরে রেখেছেন।নেশায় ঠোঁট আমার জ্বলে গেলো।

-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রে?এখানে এসেও ওই ছাইপাঁশ খাবি?একবার যদি মামাবাবুর নাকে গন্ধ যায় তো পিটিয়ে ছাল তুলে ছাদে টাঙিয়ে রাখবে।উনি কেমন রাগি জানিস না,বলল সুজয়।

অজয় আরও খানিকটা শরীর ঘেঁষে বলল,আমি কি এখানে খাবো বলেছি নাকি?এতটা বোকা আমি নই।আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসবো।আর আজ গেইটে পাহারাদারও নেই।মাত্র পাঁচ মিনিটের তো ব্যাপার।

-গ্রামে কি হচ্ছে সে খেয়াল মাথায় আছে?মামাবাবুর কড়া হুকুম,রাতে একদমই দরজা খুলে বের হওয়া যাবে না।

অজয় বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,ছাড় তো তোর কুসংস্কার।গিয়ে দেখ,জঙ্গল থেকে বাঘ এসেছে।রাতে গোটা মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।আর দোষ পড়ছে বেচারা ভূতের উপর।

সুজয় কিছু বলার আগেই অজয় দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেল।সুজয় জানে,একবার যখন নেশা উঠেছে না খেয়ে অজয় আর ফিরবে না।মুখ দিয়ে একবার যা বলবে তা না করে শান্তি নেই।সুজয় একবার মোবাইলের তাকিয়ে তাড়াতাড়ি লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।কিছুক্ষণ পর ঘুমে চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল সুজয়ের।

অজয় বেশ আস্তে আস্তে পা ফেলে নিচতলায় এসে দাঁড়ালো।দোতলার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল,সুজয় লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।অজয় বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।যাক,আলো না দেখলে তাদেরকে কেউ দেখতে ভেতরে ঢুকবে না।একটা সিগারেটের ব্যাপারই তো।গেইট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েক টান দিয়েই চলে আসবো।অজয় বেশ সাবধানে পা ফেলে সদর দরজা পেরিয়ে গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো।পাহারাদার নন্দলালের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,শালা,নেই ভালো হয়েছে।একটু কোথাও বের হলেই চেঁচামেচি শুরু করে দিতো।বাবু,আপনাদের বাইরে যাওয়া নিষেধ আছে।আরে ব্যাটা,আমার মামার গ্রামে আমি হাঁটবো।তুই কেরে,আমাকে না যেতে দেয়ার।বেশি পাঁকামু করতে গেলো বলেই মরতে হলো।আরও কিছুক্ষণ আপনমনে গালমন্দ করে অজয় গেইট ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো।গতকাল রাতে নন্দলালের লাশের জায়গায় এখনও মাছি ভোঁ ভোঁ শব্দ করছে।গন্ধে অজয় নাক ছিটিয়ে বলল,মরেও দেখি শান্তি দিচ্ছে না।একটু ওপাশে গিয়ে খেয়ে আসি।অজয় হাঁটতে হাঁটতে প্রায় জমিদার বাড়ির শেষ সীমানায় এসে থেমে গেল।পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দিয়ে দিয়াশলাই থেকে আগুন জ্বালাবে এমন সময়ে কান্নার শব্দ শুনতে পেল অজয়।সিগারেট মুখ থেকে সরিয়ে ভাবছে,এতরাতে এই নির্জন জায়গায় কে কাঁদছে?গ্রামে যা অবস্থা,কেউ বের হবার সাহসও তো করবে না।সেখানে কাঁদবে কে?আওয়াজটা সামনে থেকে আসছে দেখে অজয় সামনে পা ফেলে আশপাশে খুঁজতে লাগলো।বলল,কে কাঁদছে?অজয় হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ঝোপের কাছে আসতেই দেখতে পেল,গাছের পাশে একটি শাড়ি পড়া মেয়ে বসে আছে।মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।অজয় কাছে গিয়ে বলল,এই মেয়ে তুমি এতরাতে এখানে বসে কাঁদছো কেন?

অজয়ের কথা শুনে মেয়েটি কান্না থামিয়ে উঠে দাঁড়ালো।হাঁটতে শুরু করলো সামনের দিকে।মেয়েটির শাড়ির আঁচল মাটির সঙ্গে লেগে আছে।

অজয়ের যেন জেদ ছেপে গেল।শহরে কত মেয়ে পাগল তার জন্য।আর এই সাধারন মেয়ে তার কথায় পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছে।অজয় মেয়েটির পিছু নিয়ে হাঁটছে।মেয়েটি এবার করুণ সুরে কাঁদতে শুরু করলো।অজয় আবারও বলল,আরে তুমি কাঁদছো কেন বলবে তো?ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?

মেয়েটি এবার জোরে হাঁটতে শুরু করলো।সঙ্গে কান্নার আওয়াজও বাড়ছে।অজয় খেয়ালই করেনি,সে জমিদার বাড়ি পেরিয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে।সে জেদের বসে মেয়েটির সাথে পেরে উঠছে না দেখে এবার দৌঁড়াতে শুরু করলো।কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেল,মেয়েটি একটি জায়গায় গিয়ে বসে আছে।আগের মতোই ফুঁপিয়ে কাঁদছে।অনেকক্ষণ দৌঁড়ানোর পর অজয় বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে।সে থেমে দম নিয়ে বলল,অনেক হয়েছে।এবার না বললে তোকে এখানেই যা খুশি করে ফেলবো।এতক্ষণ ভালো করে বলেছি,কানে যায়নি।শেষবারের মতো বলছি,কি হয়েছে?কান্না করছো কেন?কি চাই তোমার?

মেয়েটির কান্না এবার থেমে গেল।মেয়েটি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,তোকে চাই।দিবি আমাকে?

মেয়েটি ঘুরতেই অজয় বেশ লাফিয়ে উঠলো।তার ধারনাটা ভুল ছিল।এই মেয়ে সাধারন কেউ নয়।মেয়েটির কাঁধ থেকে গলা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে আছে।গলার ফিনকি দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে।অজয় এতক্ষনে বুঝতে পারলো,সে কি ভুলটাই না করেছে।অজয় উল্টোদিকে ঘুরতে যাবে এমন সময়ে কে যেন তার পা চেপে ধরেছে।নিচে তাকাতেই দেখতে পেল,মেয়েটি কুৎসিতভাবে হেসে বলছে,পালিয়ে কোথায় যাবি?একবার বললাম তো,তোকে আমার চাই।

অজয় আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।নখের আঁচড় পায়ের নিচ থেকে গলায় এসে থেমেছে।গলা বেশ জোরে চেপে ধরেছে অশরীরী মেয়েটি।শেষবারের মতো চিৎকার দিল অজয়।অজয়ের চিৎকারে কোথায় যেন হুতুম পেঁচা বিপদের শঙ্কায় কয়েকবার ডেকে উঠলো।

তবে কি এবার জমিদার বাড়ির দিকে চোখ পড়েছে?

………..চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here