#তাহার_আগমন

পর্ব:০৫

রমিজ পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল,পাগল হয়েছেন আপনি?সেখানে যদি ওই শয়তানের সামনে পড়েন বেঁচে ফিরতে পারবেন?এত সহজভাবে ব্যাপারটা নেয়া উচিত হবেনা আপনার।

সানাউল মির্জা বললেন,আমার কিছুই হবেনা।কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে।সবাই যদি এভাবে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তাহলে এর পেছনের কারনটা কখনো জানা যাবে না।আর না জানলে মৃত্যুর মিছিল থামবে না।

-তারপরও,আপনার এখন যাওয়া ঠিক হবেনা।দিনের আলো ফুটলে আমি নিজেই আপনাকে নিয়ে যাবো,বলল রমিজ।

-দিনের আলোতে গিয়ে আমার জন্য কিছুই পড়ে থাকবে না।তুমি আমাকে জমিদার বাড়ির পথটা বলে দাও।

রমিজ সানাউল মির্জার জেদের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হলো।বলল,কি আর করার।আপনাকে বাধা দেয়ার সাধ্য আমার নেই।এখান থেকে বের হলে কিছুদূর যাওয়ার পর একটা তালগাছ দেখবেন।সেই গাছের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে।রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে পূর্বদিকে আরেকটা পথ দেখবেন।সামনেই জমিদার বাড়ির সীমানা চোখে পড়বে।

সানাউল মির্জা সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।হাতের টর্চ লাইটের আলো কিছুটা কমিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন।কিছুদূর যেতেই তালগাছের দেখা পেয়ে গেলেন তিনি।টর্চ লাইটের আলো বন্ধ করে দিলেন।চাঁদের আলোতে পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না সানাউল মির্জার।নিতাইপুর এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।বাড়িঘর সব জনশূন্য।দূরে দু’একটা কুকুর কান্না করছে।মনে হয়,মৃত্যুর ভয়টা বোবা প্রানীগুলোর স্পন্দন পর্যন্ত চলে গিয়েছে।আতঙ্কে প্রাণীগুলো কাঁদছে।চারপাশ আস্তে আস্তে ঘন হতে শুরু করেছে।ধানের জমি পেরিয়ে গাছের সারি ধরে হাঁটছেন তিনি।হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।চাঁদের আলোতে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে।ছায়াটি উনাকে অনুসরণ করেই পিছু নিয়েছে।সানাউল মির্জা পেছনে ফিরলেন।কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।তাহলে ছায়াটি কার ছিল?আবার পথ চলতে শুরু করলেন।নাহ,এবার আর ভুল শুনতে পাননি।মনে হচ্ছে,কেউ পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে।ঠিক রেহানাদের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সিড়িতে কাঁধের কাছে যেমন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন তিনি।তাহলে কি এবার তারই মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে?রহস্য বের করার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন?শয়তান পিশাচ তাহলে সানাউল মির্জার পেছনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর নিঃশ্বাস ফেলছে?

সানাউল মির্জা দমে যাওয়ার মানুষ নন তিনি।হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছেন।যখনি মনে হলো,হাতের নাগালে এসেছে, ঘুরে হাত দিয়ে আঘাত করতেই কারো আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি।টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে পেলেন,পাঁচ ফিট দূরে মাটিয়ে কেউ পড়ে আছে।তবে তাকে মানুষ বলেই মনে হলো।সানাউল মির্জা টর্চের আলো কমিয়ে কাছে যেতেই তাকে লাঠি দিয়ে শরীরে আঘাত করতে চেষ্টা করতেই তিনি লাঠি ধরে ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে।সানাউল মির্জা বুঝতে পারছেন না,তিনি এই মুহূর্তে কি করবেন?আঘাত করা মানুষটিকে একটি কম বয়সী ছেলে বলেই মনে হচ্ছে তার।কিন্তু হঠাৎ তাকে আঘাত করার ঝোঁক কেন উঠলো?বিপক্ষ দলের লোক নয়তো যে চায়,তিনি এই গ্রাম থেকে চলে যান?তাই লাঠি দিয়ে ভয় দেখাতে চাইছে।সানাউল মির্জা হ্যাঁচকা টান দিয়ে লাঠি হাত নিয়ে বললেন,কে তুমি?আমার পিছু নিয়েছো কেন?আর লাঠি দিয়ে মারার কারন কি?

ছেলেটি ঠিকমতে উঠে দাঁড়াতে পারছে না।ব্যাথা জায়গামতো পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।সে কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলল,হয়তো আমার শরীরে তোমার মতো শক্তি নেই।কিন্তু সুযোগ আসতে দাও,তখন ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো।এই গ্রাম নিয়ে কেউ খেলতে পারবে না।

ছেলেটির কথা শুনে সানাউল মির্জার মনে হলো,সে বিপক্ষ দলের লোক নয়।তবে ছেলেটির ভেতর প্রচন্ড জেদ কাজ করছে।সেই জেদের বশেই মারার চেষ্টা করেছিল তাকে।হয়তো সে ভুল বুঝেছে।সানাউল মির্জা ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে বললেন,তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে।আমার ধারনা,আজ গ্রামে আসতেই তুমি আমার উপর নজর রাখছিলে আড়ালে।ভেবেছিলে,এই গ্রামে যা হচ্ছে তার পেছনে বাইরের অপরিচিত কেউ জড়িত।সেই রাগেই আমাকে তুমি সহ্য করতে না পেরে পিছু নিয়েছিলে মারার জন্য তাই তো?

সানাউল মির্জার কথায় ছেলেটি ভীষণ অবাক হয়ে বলল,আপনি কিভাবে জানেন?

সানাউল মির্জা বুঝতে পারলেন,ছেলেটি তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।বললেন,তুমি কি ভেবেছিলে,আমি তোমাকে দেখিনি?গাড়ি থেকে নামতেই দুটো চোখের দৃষ্টি আমার নজরে পড়ে।তারপর কখনো গাছের আড়ালে,কখনো বা দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আমার কথা শুনছিলে।আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও কিছু বলিনি।কিন্তু তুমি কি যেন প্রতিশোধের কথা বলছিলে তখন?কিসের জেদে তুমি সবার উপর আড়ালে নজর রাখছো?

সানাউল মির্জা ছেলেটিকে উঠতে সাহায্যে করলেন।পাশেই একটা গাছের গুঁড়ির উপর বসলেন দুজনে।সানাউল মির্জা চাঁদের আলোতে ছেলেটিকে ভালো করে খেয়াল করলেন।ছেলেটির বয়স বিশ-বাইশ বছরের বেশি হবে না।তবে চোখ-মুখ দেখে ভীষণ সাহসী মনে হচ্ছে।চোখের কোণে মায়ার ঝলকের রেখায় হিংস্রতার ছাপও স্পষ্ট।ছেলেটি একবার উনার দিকে তাকিয়ে বলল,এই বয়সে আপনার শরীরে জোর কম নয়!অবশ্য বিপদের সময়ে মানুষের মাঝে অদৃশ্য শক্তি সঞ্চারিত হয়।বেশ জোরেই লেগেছে আমার।

সানাউল মির্জা ছেলেটির কথায় মুচকি হেসে বললেন,আমি নিয়মিত শরীরচর্চা করি।তবে তোমাকে আঘাত করার জন্য সত্যিই দুঃখিত।আমি ভেবেছিলাম,শয়তান আমার পিছু দাঁড়িয়েছে।যাই হোক,এবার তোমার কথা বলো।

-আমার নাম হাসিন।আমি এই গ্রামেরই ছেলে।আপন বলতে শুধু মা-বাবাই ছিল।গত কিছুদিন ধরে এই গ্রামে যে শয়তানের কুনজর পড়েছে।একের পর এক মানুষকে নিঁখোজ হতে দেখে তাদের যখের ধনকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দিন কাটছিল।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।একরাতে আমার মা-বাবাও শিকার হয়ে যায়।তাদের দুজনের মৃত্যুর পর একটা জেদ চেপে বসে,হয় সেই শয়তানকে মারবো আর নাহয় নিজে মরবো।তারপর থেকেই এই গ্রামে সবার উপর নজর রাখতে শুরু করি।কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমার চোখে কিছু পড়েনি।আজ আপনাকে গ্রামে ঢুকতে দেখে আমার সন্দেহ হয়।তারপরই আপনার পিছু নেয়া শুরু করি।কিন্তু আপনি হঠাৎ এই গ্রামে কেন?

সানাউল মির্জা ছেলেটির কথা শুনে বেশ মর্মাহত হয়ে পড়লেন।বললেন,তোমার ভাগ্য সত্যিই বড্ড খারাপ।আসলে আমি শখের বসে অশরীরী বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত করি।এমনই এক তদন্তে জড়িয়ে পড়ে শেষে নিতাইপুরে আসতে হলো।কিন্তু এখানে এসে দেখি,মানুষজন সব পাথর হয়ে আছে।কেউ খুব একটা কথা বলছে না।

-আসলে সবাই নিজের চোখে এসব দেখে কথা বলতেই ভুলে গেছে।অনেকে তো নিজের আপন ভিটা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে।আপনি ওই জমিদার বাড়ির রাস্তার দিকে কেন যাচ্ছিলেন?পাহারারত রক্ষীরা দেখতে পেলে তো সোজা গুলি করবে।এমনিতে সবাই আতঙ্কে আছে,বলল হাসিন।

-দোকানদারের ছেলে রমিজ বলল,জমিদার বাড়িতে চিৎকার শুনেছে সে।হয়তো পিশাচের নজর সেখানেও পড়েছে।

হাসিন আঁতকে উঠে বলল,তাহলে তো আমাদের এখনি সেখানে যেতে হবে।আর দেরি করা ঠিক হবেনা।

সানাউল মির্জা হাসিনের এমন সাহসে অবাক না হয়ে পারলেন না।যেখানে রমিজ ভয়ে তাকে যেতে বারবার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল,সেখানে হাসিন তার সঙ্গে পা ফেলে বিপদের দিকে ছুটছে!হয়তো আপনজনের মৃত্যু ছেলেটাকে এমন সাহসী বানিয়েছে।সানাউল মির্জা জমিদার বাড়ির রাস্তা ধরে বেশ দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন।

ছয়.

জমিদার বর্মণ নিজের কামড়ায় হেঁটে পায়চারি করছেন।অধিক চিন্তায় উনার কপালে ঘাম জমেছে।গভীর ঘুমে হঠাৎ চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যায় উনার।তারপর থেকে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি।জমিদার বাড়ির একবারে কোণায় শহর থেকে আসা উনার দুই ভাগ্নে ঘুমিয়ে আছে।জমিদার বর্মণ দুইজনের চিন্তায় স্থির হতে পারছেন না।সাহস করে বের হয়ে দেখবেন সেটাও মন সায় দিচ্ছে না।তবে ভরসার কথা হলো,দুজনকেই বলে দেয়া হয়েছিল যাই হোক রাতে বের হবে না।দুইজনে এখন কি করছে কে জানে?নাকি ঘুমে কাভু হয়ে আছে?যেভাবেই থাকুক সুস্থ হলেই হয়েছে।হঠাৎ লাইটের আলো জানালায় পড়তেই চমকে উঠলেন জমিদার বর্মণ।এই সময়ে এদিকে আসবে কে?গ্রামের মানুষ বলে তো মনে হয় না।জমিদার বর্মণ ভয়ে ভয়ে জানালার পর্দা কিছুটা সরালেন।একটু পরেই অন্ধকার কেটে যাবে।রাতের শেষ প্রহর।আলো খুঁজতে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন,দুজন হেঁটে জমিদার বাড়ির দিকেই আসছে।তিনি ভাবছেন,আসলেই কি তারা মানুষ?নাকি অন্যকিছু?তিনি আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার জন্য মনস্থির করলেন।

সানাউল মির্জা জমিদার বাড়ির সামনে আসতেই দেখতে পেলেন,মাটিতে কে যেন শুয়ে আছে।তবে নড়াচড়া নেই।তিনি হাসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,এই লোকটাই চিৎকার দেয়নি তো?

হাসিন বলল,আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।চলুন ওর কাছে গিয়ে দেখা যাক ব্যাপারটা।

সানাউল মির্জা হাসিনকে বাধা দিয়ে বললেন,একটু অপেক্ষা করো।আমার মনে হচ্ছে,লোকটা আর বেঁচে নেই।আর যে তাকে মেরেছে সে স্বাভাবিক মানুষ নয়।হয়তো নতুন শিকারের আশায় আশপাশে বসে আছে।

হাসিন মাথা নেড়ে বলল,ঠিক আছে।আশপাশ ভালো করে দেখে তারপর যাবো।

বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সানাউল মির্জা বললেন,মনে হচ্ছে এবার যাওয়া যেতে পারে।তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে লোকটার সামনে যেতেই মুখ দিয়ে আর্তনাদ করে বললেন,যা ভেবেছি তাই।আধঘণ্টা আগেই মারা গেছে।গায়ের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে,গেইটে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল সে।

হাসিন বলল,আমরা এখন তাহলে কি করবো?

-আমাদের আগে বের করতে হবে,হঠাৎ করে গ্রামের মানুষদের শিকার করছে কেন?আর কারনটা বের করতে পারলে সমাধানও পেয়ে যাবো।কিন্তু আমি যতটুকু জানতে পারলাম,এখনও জমিদার বাড়িতে কেউ মারা পড়েনি।তাহলে এমনটা নয়তো যে,জমিদার বাড়িতেই সে লুকিয়ে আছে?

হাসিন মাথা নেড়ে বলল,আসলেই তো।ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি।কিন্তু জমিদার বাড়িতে ঢুকতে না পারলে তো আমরা জানতেও পারবো না।

সানাউল মির্জা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই ভেতর থেকে বাজখাঁই গলায় কে যেন বললেন,ওইখানে কে দাঁড়িয়ে কথা বলে?নন্দলাল তুই কোথায় রে?আমি কি মশা মারতে তোকে গেইটের সামনে দাঁড় করিয়েছি?

হাসিন ফিসফিস করে বলল,মনে হচ্ছে জমিদার বর্মণের গলা।বাইরে এতবড় কান্ড ঘটে গেল অথচ ব্যাটা কিছুই জানে না!

সানাউল মির্জা বললেন,উনার গলা শুনে মনে হচ্ছে,কথাগুলো ইচ্ছে করেই বলছেন।উনি হয়তো ভয় পেয়ে আছেন কোনো কারনে।

চারদিকে তখন আলো ফুটেছে।আস্তে আস্তে দু’একটা পাখির আনাগোনা চোখে পড়ছে জমিদার বাড়ির ছাদে।দুজনে তখনও লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।একটু পরে লাঠির ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেল দুজনে।জমিদার বর্মণ গেইটের সামনে আসতেই লাশ দেখে চিৎকার দিলেন,এটা যে নন্দলালের মৃতদেহ।আর আপনি কে?হাসিন তো এই গ্রামের ছেলে।

-উনি সানাউল মির্জা।এই গ্রামে এসেছেন বেড়াতে।কিন্তু গতকাল রাতে চিৎকার শুনে আমরা দুজনে এসে দেখি,এই অবস্থা,বলল হাসিন।

সানাউল মির্জা মনে মনে হাসিনের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলেন না।বললেন,আপনাদের গ্রাম তো মনে হচ্ছে মৃত্যুপুরী।আমি এসেই ফেঁসে গিয়েছি।

জমিদার বর্মণ দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,কি যে করবো বুঝতে পারছি না।পুলিশও হাল ছেড়ে দিয়েছে।

-আপনার কি দেহরক্ষী একজনই,জিজ্ঞেস করলেন সানাউল মির্জা।

-সাতজন ছিল,কিন্তু সবাই পালিয়েছে।আর নন্দলাল আমার খুব বিশ্বস্ত।আমাকে ছেড়ে যায়নি।আর দেখলেন তো,পরিণতি কি হয়েছে?

সানাউল মির্জা বললেন,আমার প্রশ্নের জট তাহলে খুলছে।

জমিদার বর্মণ কিছু বুঝতে না পেরে বললেন,আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে চলুন।সকালের নাস্তাটা আমার সাথেই করবেন।

জমিদার বর্মণ টেবিলে বসে উনার পূর্ব পুরুষদের বীরত্বের কাহিনী বুক ফুলিয়ে বলছেন।গর্বে কতবার যে চোখ মুছলেন হাসিন নিজেও গুনে শেষ করতে পারলো না।টেবিলে এত খাবারের আয়োজনে সানাউল মির্জা বিবর্ত।কে বলবে একটু আগেই জমিদার বাড়ির বিশ্বস্ত পাহারাদারের মৃত্যু হয়েছে।হয়তো জমিদার শ্রেণীর মানুষগুলো এমনই।সানাউল মির্জা বললেন,আপনি ছাড়া এই বাড়িতে আর কে কে থাকে?

-শহর থেকে আমার দুজন ভাগ্নে এসেছে।এসেও বিপদে পড়েছে।ওর বাবা-মা কিছুদিনের জন্য বাইরে গেছে।ছুটিতে নিরুপায় হয়ে আমার এখানেই পাঠিয়ে দিয়েছে।এখন এখানে তো বিপদ বাড়ছেই।ওদের দুজনকে ফেরত পাঠাবো সে উপায়ও নেই।শহরে গেলে কে রান্না করে খাওয়াবে?তাই দুজনকেই বলে দিয়েছি,সারাদিন কষ্ট করে হলেও এক জায়গায় বসে থাকতে।যত খেতে চাও সব দিবো।কিন্তু আমি তো দুজনের কষ্ট বুঝতে পারি,একজায়গায় আর কতক্ষণ?

-কিন্তু ওদের দুজনকে তো দেখতে পাচ্ছি না,বললেন সানাউল মির্জা।

-মনে হচ্ছে,বিছানায় পড়ে ঘুমাচ্ছে।সারাদিন বই আর ঘুম।আমি গেলে দু’একটা কথা বলে এই আরকি।

সানাউল মির্জা কিছু বলতে যাবেন এমন সময়ে দুটি ছেলে এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে।বয়স দুজনের সমান বলেই মনে হচ্ছে।একজনের ঝাঁকড়া চুল,অন্যজনের ঘনকালো।সানাউল মির্জা জিজ্ঞেস করলেন,এরাই কি আপনার ভাগ্নে দুজন?

জমিদার বর্মণ মাথা নেড়ে বললেন,হ্যাঁ।ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটিকে দেখিয়ে,ওর নাম অজয় বর্মণ।আর অন্যজন সুজয়।দুজনেই সমবয়সী।আগেপিছে হয়েছে।ভাগ্নে দুজনকে জিজ্ঞেস করলেন,তা তোমরা ঠিক আছো তো?কোনো সমস্যা হয়নি তো গতরাতে?

অজয় বলল,কি হয়েছে মামাবাবু?আমরা তো কোনো গোলমাল শুনিনি।গতরাতে কি হয়েছে?

সানাউল মির্জা একবার হাসিনের দিকে অবাক হয়ে তাকালো।এরা বলে কি?

জমিদার বর্মণ হেসে বললেন,কেমন কুম্ভকর্ণ দুজনে দেখেছেন এবার?এত গভীর ঘুম যে এতকিছু হয়ে গেছে অথচ দুজনের একজনও টের পায়নি।আর আমি অন্যদিকে দুজনের চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম।

সানাউল মির্জা বললেন,একদিকে ভালোই হয়েছে।দুজনে ভয় পায়নি।হঠাৎ খাকি পোশাকে একজনকে ঢুকতে দেখে সানাউল মির্জা কথা থামিয়ে বললেন,উনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না জমিদার সাহেব?

লোকটিকে দেখিয়ে জমিদার বর্মণ বললেন,আমাদের বাড়ির পুরাতন মালি বিশু।খুব বিশ্বস্ত লোক।আমার বাবার আমল থেকে এই বাড়িতে আছে।ওর বাবাও এখানে কাজ করতো।

সানাউল মির্জা ভ্রু কুঁচকে বললেন,তা এত সকালে এই পোশাকে কোথায় গিয়েছিলেন বিশুদা?

লোকটি আমতাআমতা করে বলল,ইয়ে মানে একটু শহরে গিয়েছিলাম।

সানাউল মির্জা ভাবছেন,এখান থেকে শহর তো অনেক দূর।হিসেব করে দেখলে,গাড়ি করে রওনা দিলেও তো অনেক আগেই যেতে হবে।কমপক্ষে সন্ধ্যার দিকে রওনা দিতে হবে নিতাইপুর থেকে।তাহলে রাতের বেলায় শহরে লোকটি কি করছিল?লোকটার দিকে নজর রাখতে হবে।বললেন,শহরে আজকাল মানুষ খুব একটা নেই তাই না?

বিশু সাথে সাথেই উত্তর দিল,কে বলেছে?মানুষ তো এখন শহরেই সব।রাস্তায় এত গাড়ি!

সানাউল মির্জার আন্দাজই ঠিক।লোকটার শহরে অবাধ যাতায়াত আছে।দেখে বেশ চটপটে মনে হচ্ছে।বয়স হলেও এখনও কেমন উসখুস চোখ।এদিক ওদিক নজর দেয়।

জমিদার বর্মণ বললেন,তোমরা সবাই এখন যাও।আমি নাস্তা সেরে আসছি।

সবাই চলে যেতেই সানাউল মির্জা বললেন,জমিদার সাহেব,আমি এখানে বেড়াতে আসিনি।এই বিষয়ে তদন্ত করতেই গ্রামে আসা।আপনি কি আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করবেন?

সানাউল মির্জার কথা শুনে খুশিতে জমিদার বর্মণের চোখদুটো যেন ঝলঝল করে উঠলো।তিনি বললেন,সত্যিই আপনি এইজন্যই এসেছেন?যাক অন্তত কেউ একজন এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।আপনাকে আমি সবরকমের সাহায্য করতে রাজি আছি।

সানাউল মির্জা জমিদারের চোখে মিথ্যার কোনো রেশ দেখতে পেলেন না।তিনি ভাবছেন,তাহলে এসবের পেছনে দায়ী কে?কি এর কারন?

সাত.

ইন্সপেক্টর সাদমান গাড়িতে বসে আছে।অপেক্ষা করছে রেহানার জন্য।ইন্সপেক্টর সাদমানের কাছে রেহানা এখন রহস্যময়ী নারী।সায়মার থেকে সেদিনের ঘটনা শোনার পর প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল তার।ভেবেছিল,সায়মা মিথ্যা বলছে।কিন্তু রেহানার অফিসের অনেকেই ইদানিং রেহানার আচরণে একটু বিস্ময় প্রকাশ করেছে।কেউ বলছে,রেহানা আগের মতো খুব একটা কথা বলে না।কেউ বলছে,সারাক্ষণ কি যেন চিন্তা করে।ইন্সপেক্টর সাদমান শেষে রেহানার পিছু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।ঘড়িতে সময় অনুযায়ী রেহানার এখনই বের হওয়ার কথা।হাতের সিগারেট শেষ করে গাড়ির থেকে নেমে পড়ল ইন্সপেক্টর সাদমান।একটু পরেই রেহানাকে দেখতে পেয়ে সাদমান গাড়ির আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল।রেহানা গাড়ি পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই সঙ্গে সঙ্গে আড়াল থেকে বেরিয়ে পিছু নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ইন্সপেক্টর সাদমান।চেনা রাস্তা পেরিয়ে এবার অন্ধকার পথ ধরে হাঁটছে রেহানা।সাদমানের বারবার মন বলছে,দৌঁড়ে গিয়ে রেহানাকে ধরে ফেলতে।ধমকে জিজ্ঞেস করতে,এটা তো আপনার রাস্তা নয়।মতলবটা কি?কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হয় তা না জেনে ধরে ফেলাটা মস্তবড় বোকামির কাজ হবে।হঠাৎ কেউ একজন সাদমানকে হ্যাঁচকা টেনে একপাশে নিয়ে বলল,ওই মিয়া,অন্ধ নাকি?এতবড় ড্রেনে পড়লে উঠতে পারবেন?ওই ময়লার ড্রেনের দিকে কই যান?

সাদমানের যেন হঠাৎ জ্ঞান ফিরলো।সে তাকিয়ে দেখতে পেল,সত্যিই সে ময়লার স্তুপে চলে এসেছে।একটু হলেই শহরের বড় ড্রেনে পড়ে যেতো।তার সামনে পাগল টাইপের এক লোক দাঁড়িয়ে আছে।এরা নেশাখোর।তবুও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল,ওইদিকে যাওয়ার আর রাস্তা নেই?

লোকটি বলল,মাথা খারাপ নাকি?এর আশপাশেও কেউ থাকে না।আবার রাস্তা,আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে লোকটি অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

ইন্সপেক্টর সাদমানের ঘোর যেন কাটছে না।একটু আগেই তো সে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটছিল।মুহূর্তে আবার ময়লার স্তুপে নিজেকে আবিষ্কারের ঘটনায় সত্যিই সে হতভম্ব।তাহলে কি সায়মার কথাই ঠিক?রেহানা মেয়েটি আসলেই রহস্যময়ী নারী!

আবিদ বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছে।ওর পাশে বসে আছে মনছুর।মনছুরের স্ত্রী আজ বাসায় না থাকায় এখানেই চলে এসেছে।অফিসের ছুটি শেষে সোজা রেস্টুরেন্ট গিয়ে ডিনার সেরে দুজনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে।আবিদ খেয়াল করলো,মনছুর অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে আছে।কোনো কথাই বলছে না।টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন সেখানে নেই।আবিদ বলল,কি ব্যাপার,মনছুর ভাই,কি ভাবছেন আপনি?

মনছুর বলল,কিছু না তো।

-কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে,অনেক চিন্তায় আছেন,বলল আবিদ।

মনছুর কেমন মনমরা হয়ে বলল,আপনার ভাবিকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়ার পর থেকে মনটা কেমন যেন করছে।মন বলছে,আমার খুব বড় একটা বিপদ আসতে চলেছে।কিছুতেই স্থিরভাবে বসতে পারছি না।

আবিদ মনছুরকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,রেহানাকে নিয়ে চিন্তা করার কারন নেই।সে আজকে বাসায় থাকবে না।ওর বান্ধবীর বাসায় যাবে।আপনি শুধুশুধু চিন্তা করবেন না তো।

-না,ভাবিকে নিয়ে ভাবছি না।তবুও আমার মনটা কেমন যেন খচখচ করছে,বলল মনছুর।

আবিদ মনছুরের এমন অবস্থা দেখে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করতে বলল,দূর,এসব কুসংস্কার বাদ দিন তো।এই আজকে একটু ঠান্ডা খেলে কেমন হয়?দুজনে তো বাসায় একা।চলুন,একটু মজা করা যাক।বিয়ের পর থেকে এসব খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি।খাবেন নাকি?

মনছুর কি যেন ভেবে বলল,আপনি যখন এত করে বলছেন তাহলে আমি আর বাধা দিতে যাবো কেন?হয়ে যাক আজকে।

মনছুর রাজি হতেই আবির বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,আমি এখনই যাবো আর আসবো।আপনি বসে টিভি দেখুন।দারুন একটা সিরিয়াল চলছে টিভিতে।

আবিদ চলে যেতেই মনছুর টিভিতে সিরিয়ালের দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু কিছুক্ষন দেখার পর রিমোট দিয়ে বন্ধ করে দিল।টিভি দেখতে তার ভালো লাগছে না।নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মনছুর ভাবছে,হঠাৎ এমন লাগছে কেন?সামনে কোনো বিপদ আসছে আমার?তারপরই মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটু ঘুমানোর চিন্তা করলো।আবিদ না আসা পর্যন্ত ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।মনছুর চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো,তার দিকে কেউ যেন রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে।গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে তার।কেমন যেন ভয় পেল সে।আবিদ তো বাসায় নেই।তাহলে পাশে বসে নিঃশ্বাস ফেলছে কে?চোখ খুলে দেখে,সামনে কেউ নেই।বরং মেঝেতে একটা তেলাপোকা হাঁটছে।তেলাপোকা দেখে মনছুর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।কিন্তু তেলাপোকা কি মানুষের মত শ্বাস নিতে পারে?কানে স্পষ্ট শুনতে পেলাম,কোনো মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ।হয়তো মনের ভুল ছিল।আর বাসায় একা থাকলে স্বাভাবিক শব্দগুলোও কেমন যেন একটু বেশি শুনতে পাওয়া যায়।মনছুর মনের সন্দেহ দূর করে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।

কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই এবার রান্নাঘর থেকে প্লেট পড়ার শব্দ শুনতে পেল।চমকে উঠলো মনছুর।বাসায় তো আবিদ নেই।তাহলে রান্নাঘরে কে আওয়াজ করছে?মনছুর বলল,আবিদ ভাই কি বাসায় এসেছেন?

রান্নাঘর থেকে কোনো আওয়াজ আসল না।পুরো বাসা নিস্তব্দ।বাথরুম থেকে টপটপ পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে।

মনছুর ভাবছে,বাসায় কি বিড়াল ঢুকেছে নাকি?এই উপরে বিড়াল আসবে কিভাবে?আমার সাথে এমন হচ্ছে কেন?সবকিছু কেমন অস্বাভাবিক লাগছে।একবার কি উঠে গিয়ে দেখবো রান্নাঘরে?কিন্তু সত্যি যদি সেখানে কেউ থাকে তাহলে?মনছুর বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে পা ফেলছে।সামনে এগিয়ে যেতেই শব্দ এবার তীব্রভাবে কানে আসছে।রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়াতেই মনছুর চমকে উঠলো।দেখতে পেল,রান্নাঘরে একজন মহিলা মেঝেতে বসে কি যেন করছে?রেহানা ভাবি বলে মনে হচ্ছে না তার।

মনছুর কাঁপা গলায় বলল,কে আপনি?এখানে বসে কি করছেন?এটা তো আপনার বাসা না।

কথাটি শুনে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।মনছুর মহিলাটির চেহারা ঠিকমতো দেখতে পারছে না।আবার সামনে গিয়ে যে দেখবে সে সাহসও তার নেই।মনছুর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কি হয় দেখার জন্য।মহিলাটি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে মনছুরের দিকে তাকাতেই মনছুরের আত্মা যেন উড়ে যাবে।মহিলাটির মুখের এক অংশ থেকে রক্ত পড়ছে।পোঁড়া মুখ থেকে মাংস খসে পড়ছে মেঝেতে।দেখতে কেমন বিভৎস!এটা তো রেহানা ভাবি নয়।

মনছুরের শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে।দৌঁড়ে পালাবে সে শক্তিও নেই।বুঝতে পারলো,মন খচখচ করার কারন।একটু পরেই হয়তো তার মৃত্যু হবে।বিভৎস চেহারার মহিলাটি কুৎসিত হাসি হাসছে।আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসছে।মৃত্যুর আগে মনছুরের একটি প্রশ্ন জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে,এই ভয়ঙ্কর মহিলাটি কে?রেহানা ভাবির পর নতুন রূপে ভয়ঙ্কর সাজে কার আগমন?এই আগমনে নতুন শিকার কে হতে চলেছে?

……….চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here