তবু মনে রেখো
৬ষ্ঠ পর্ব

হারুন সাহেবের মনটা আজ ভালো নেই। মেয়েটা আজ নিজের বাড়ি চলে যাবে, কিছুতেই নিজেকে সামাল দিতে পারছেন না। এতোদিন শুধু ভাবতেন মেয়েটার বিয়ে কবে হবে, কিন্তু এখন যখন মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে তখন আফসোস হচ্ছে। ইশ মেয়েটাকে যদি তার কাছে রেখে দিতে পারতেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে, মেয়েটা চলে গেলে কিভাবে নিজেকে আটকে রাখবেন কে জানে। বাবারা বুঝি এমনই হয়, নিজের কলিজার টুকরোকে আদরে সোহাগে বড় করে, নিজের সবকিছু দিয়ে তাকে আগলে রাখে। তারপর একদিন একটা রাজকুমারের হাতে তাকে সপে দেয় এই ভরসায় যে তার মেয়েকে দেখে রাখবে সে। তার মতোই মাথায় করে রাখবে সেই রাজকুমার। তখন নিজের বুকটা খালি হয়ে যায়, নিজের বুকে রক্তক্ষরণ হয় অথচ কাউকে দেখাতে পারে না। আজ হারুন সাহেবের অবস্থাটাও তাই। উনার আছেই এই একটা সম্বল, সারাজীবনের পুজি। এখন তার সেই জমানো পুজি ইফতির ঘর আলো করবে।কিন্তু ইফতি কি তার এই রাজকুমারীর যোগ্য খেয়াল রাখবে? তার কলিজার টুকরোকে তার মতোই আগলে রাখবে?
– খালুজান, আফারা রেডি। এহনি বাইর হইবো।

লোকমানের কথায় খেয়াল থেকে বের হন তিনি। চোখ জোড়া মুছে বললেন,
– তুই যা, আমি আসতেছি।
– জে, আইচ্ছা।

লোকমান চলে গেলে, টেবিল থেকে মোটা ফ্রেমের চশমাটা হাতে নেন হারুন সাহেব। তাকে শক্ত হতে হবে। মেয়ের বাবা হতে গেলে এগুলো তো মেনে নিতেই হবে। শিমুল খাওয়ার পর অথৈকে রেডি করিয়ে দিতে লাগলো। ইফতি রুমে এসে দেখে শিমুল অথৈকে নিয়ে ব্যস্ত। বারবার কথা বলার ট্রাই করেও কিভাবে বলা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শেষমেশ সব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে বলেই দিলো,
– শিমুল তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত শিমুল ইফতির সাথে সোজা মুখে কথা বলে নি, খানিকটা এড়িয়ে চলছিলো। এখন ইফতির কথা শুনে মনের মাঝে খচখচ করা শুরু করলো, না জানি ইফতি কি বলবে!!
– কি হলো, শুনছো আমি কি বলছি??
– জ..জ্বী, বলেন শুনতেছি।
– আচ্ছা বাসায় যেয়েই বলবো। রেডি হয়ে নাও।

বলেই শার্ট,প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো ইফতি। শিমুল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। শিমুলের সকালবেলার ঘটনা মনে পড়তে মুখ,নাক লাল হয়ে গেলো। এইটা ইচ্ছাকৃত না কিন্তু ইফতি ঘটনাগুলোকে কিভাবে নিচ্ছে কে জানে।

সকাল ১০টা, ইফতিরা সম্পূর্ণ রেডি। ইফতি গাড়িতে বসে ওয়েট করছে। শিমুল লোকমানকে যাবতীয় সব বুঝিয়ে দিচ্ছে, এখন লোকমানের দায়িত্ব হারুন সাহেবের দিকে খেয়াল রাখা। হারুন সাহেব বারবার চোখ মুছছেন যাতে শিমুলের চোখে না পড়ে, কিন্তু শিমুলের চোখে বাবার চোখের পানি এড়ালো না। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার চোখ মুছে বললো,
– আমার কথা মনে পড়লেই আমাকে ফোন দিবা, আমি আর পুচকু চলে আসবো।( অথৈকে আদর করে পুচকু নামে ডাকে শিমুল)
– তুই নিজের খেয়াল রাখিস।
– চোখ মুছো, এভাবে কাঁদলে আমার ভালো লাগবে??
– আচ্ছা আর কাঁদছি না, সাবধানে যাইস।
– হুম, লোকমানকে বুঝিয়ে দিছি। সাবধানে থেকো বাবা।
– হুম, আয় তোরা।

বাবাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো শিমুল। গাড়িতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলো। সারারাস্তা কোনো কথা বলে নি। অথৈর কথাতে শুধু হুম, হ্যা এগুলোই বলেছে। মনটা তার ও ভালো নেই, বুড়ো মানুষটা না জানি কিভাবে থাকবে। ইফতি ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলো শিমুলের মন খারাপ, তাই কোনো কথা বলে নি। সারাটা রাস্তা নিশ্চুপ ছিলো দুটো মানুষ। বাসায় ঢুকতেই, সিকান্দার সাহেব জানিয়ে দিলেন ইফতিকে পাঁচ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে নিতে, অফিসে আরজেন্ট যেতে হবে। শিমুল অথৈর রুমে যেতে নিলে ইফতি বলে উঠে,
– কোথায় যাচ্ছো?
– রুমে, ফ্রেশ হবো।
– আজ থেকে এই রুমে থাকতে পারো তুমি।
– জ্বী?
– হুম, এভাবে করে আমি অথৈর কাছে থাকতে পারবো। এই দুই মাসে আমি ওর ধারে কাছে থাকি না বিধায় মেয়েটা আমার কাছে ও আসতে চায় না।
– আচ্ছা।
– হুম
– শুনুন, একটা কথা বলার ছিলো।
– কি?
– আমি কাল থেকে জয়েন করতে চাচ্ছি হসপিটালে।
– হসপিটালে জয়েন করলে অথৈর কি হবে?
– এই দু মাস যেভাবে সামলেছি, সেভাবেই সামলাবো। আমি নাইট ডিউটি করা ছেড়ে দিয়েছি। তাই সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।
– না না। তুমি জব ছেড়ে দাও। অথৈ তোমাকে বাদে এতো সময় কি করবে?
– মা তো আসেন ই আর আমি ৫ টার মধ্যে বাড়ি চলে আসবো। শুক্রবার অফ ডে তাই সমস্যাও হবে না।
– না মানে না। এটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।

বলেই ভেতরে চলে গেলো। শিমুলের রাগ হতে লাগলো। এই লোকটা এতো জিদি কেনো, কোনো কথাই বুঝতে চায় না। অথৈকে সে ভালোবাসে কিন্তু নিজের প্রফেশনকেও ততোটাই ভালোবাসে। লোকটা না করে চলে গেলো, একবার এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দিলো না। অথৈকে ফ্রেশ করিয়ে, খাটে বসে আছে শিমুল। রাগ লাগছে কিন্তু এক্সপ্রেস করতে পারছে না, শুধু চোখে গোল গোল করে ইফতির দিকে তাকিয়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার ইফতি চুল ঠিক করছে, আয়না থেকে শিমুলের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
– কি হয়েছে? এভাবে ভুতুম পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছো কেনো?
– আমি ভুতুম পেঁচাই কোনো সমস্যা?
– না কোনো সমস্যা নাই শুধু আমার সামনে থেকো না। এই মুখ দেখলে দিনটাই খারাপ যাবে।

ইফতির টন্টিং এ কোনো কথা বললো না শিমুল, অথৈর খাবার আনতে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলো। ইফতি খুব ভালো করে বুঝতে পারলো শিমুলের মন কেনো খারাপ, কিন্তু সে এতে তার মতামত বদলাবে না। অথৈর মা হতে হলে সঠিক ভাবেই অথৈর মা হতে হবে। ইফতি অফিসে যাবার পর সারাদিন অথৈকে নিয়েই কেটে গেলো শিমুলের। সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ ইফতি এবং সিকান্দার সাহেব বাড়ি ফেরেন। ইফতি বাসায় ঢুকেই রুমে চলে আসে। রুমে আসতেই যা দেখলো তাতে কিছুক্ষণের জন্য মাথা কাজ করা বন্ধ দিলো।

কিছুক্ষণ আগে, অথৈ ভরপেট খাবার পর দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিলো। শিমুল বারণ করার পরও সে তার মতোই খেলছিলো। এক পর্যায়ে তিনি শিমুলের গায়ে বমি করে ভাসায়ে দিলেন। শিমুলের আর কি করার, অথৈকে চেঞ্জ করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। দূর্বল হয়ে গেছে বমিটা করে। নিজেও গোসল করে নিলো। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে বিধায়, শাড়িটা রুমে এসে পড়ছিলো। শিমুলের খেয়াল ছিলো না সে দরজা লক করেনি শুধু লাগিয়ে রেখেছে। কুচি সামলাচ্ছিলো ঠিক তখনই ইফতি রুমে ঢুকে। ইফতি দরজা বন্ধ দেখেও নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লো। সে ভুলেই গেছে এখন তার রুমে শিমুল নামের নারীর ও আসা যাওয়া হবে। শিমুলের এই অবস্থা দেখে এক মিনিট দেরি না করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো ইফতি। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি তারই হবে। মানুষ তাকে টাকলা বলবে। ঘটনার আকর্ষিকতায় শিমুল বেকুব বনে গেলো। আজকে দিনটাই তার বিরক্তিকর কাটছে। দ্রুত শাড়িটা পড়ে সখিনাকে ডাক দিলো। সখিনাকে অথৈর পাশে বসিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো সে। আফসানা বেগম তখন চা বানাচ্ছিলেন। শিমুল পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
– মা বিকেলে নাস্তাটা আমি করি?
– তুমি করবে, ঠিক আছে করো তবে।
– মা একটা কথা ছিলো।
– বলো মা
– আমি তো বিয়ের কারণে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছিলাম হসপিটাল থেকে। কাল থেকে আমি আবার কাজ শুরু করতে চাচ্ছি।
– ইফতিকে জানিয়েছো?
– জ্বী মা, উনি মানা করে দিয়েছেন।
– তাহলে আমি কি বলবো মা। তবে তোমার শ্বশুর মশাই এর সাথে কথা বলে দেখতে পারো।
– আচ্ছা মা।
– তাহলে এক কাজ করো, পিয়াজু বানাও আবহাওয়াটা একটু নরম। উনার গরম চায়ের সাথে পিয়াজু বেশ ভালো লাগে। উনি যদি সম্মতি দেয় তাহলে ইফতি দ্বিমত করবে না। আর হ্যা শুনো, অথৈর খেয়ালে ত্রুটি রাখবে না। তাহলে ইফতি কিন্তু কথা ছাড়াতে ছাড়বে না।

শাশুড়ীর কথায় শিমুলের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তার আপত্তি নেই। এখন শ্বশুর মশাই কে রাজি করাতে পারলে কেল্লাফতে। তখন ওই মাথামোটা লোকটা কিছুই বলতে পারবে না। সিকান্দার সাহেব সম্মতিও দিয়ে দিলেন, কারণ শিমুল একজন ভালো ডাক্তার। তার ব্রাইট ফিউচার আছে। তিনি তাকে বাধা দিলে মেয়েটার সারাজীবন আফসোস থাকবে। একেই অনেক স্যাক্রিফাইস সে করছে। অপরদিকে ইফতির খুব রাগ লাগছে। রীতিমতো রাগে ফুসতে ফুসতে ঘরে চলে গেলো সে। মেজাজ অত্যধিক খারাপ, রাগে নাক লাল হয়ে আছে। শিমুল কোনোমতে রাত পর্যন্ত ইফতিকে এড়িয়ে চললো। সে জানে সামনে গেলেই তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। রাতে খাবার পর খুব করে দোয়া ইউনুস পড়ে রুমে গেলো সে। অথৈ তখন ইফতির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর ইফতি মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটছে। আবহাওয়া ঠান্ডা দেখে চুপচাপ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আছড়াতে লাগলো শিমুল। ইফতি খেয়াল করেছে শিমুল তাকে এড়িয়ে চলছে। তাই নিজেই আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,
– বাবাকে ভালোই হাত করা শিখে গেছো তাই না??
– জ..জ্বী?
– এখন কিছু বলবো না, তবে আমার মেয়ের যদি অযত্ন করেছো তো দেখবে আমি কি করি। আর এরপর থেকে দরজা যে লক করা যায় এটা শিখে নিও। সখিনাও লক করতে পারে। মানুষ বুঝবে না ভেতরের অবস্থা যদি দরজা লক না করে জাস্ট এমনেই লাগিয়ে রাখো।

বলেই অথৈ কে শুইয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়ে ইফতি। আর শিমুল এখনো আয়নার সামনেই বসে আছে। তার গাল লাল, গোলাপী, বেগুনি হয়ে আছে ইফতির কথা শুনে। না জানি ইফতি তাকে কি ভাবছে, এটা ভেবেই শিমুলের আজকের মতো ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here