ডাক্তার সাহেব
শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব -১৬
আমি কিছু একটা বলতে যাব এর আগেই সে আমার হাতটা তার হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে জোরে মুচড়ে ধরল। বসানো থেকে টেনে দাঁড় করাল। ভয়ে বুক কাঁপছে। আশপাশ তাকিয়ে শুধু ভাবছিলাম কেউ দেখছে না তো? তাকানোর সুযোগ বেশি পেলাম না। এর আগেই টেনে ঘরে নিয়ে গেল। অপর হাত দিয়ে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিল। আমাদের বাসায় সারি করা তিনটা রুম। মাঝখানের টায় আম্মু থাকে। তার ডান পাশের টায় আমি আর বাম পাশেরটা মেহমানদের জন্য। তিনটা রুমের সামনে ড্রইং রুম আর ডাইনিং রুম। তিনটা রুমেই বাথরূম এটাচ করা। আমার রুমটার পাশেই ছাদে উঠার জন্য সিঁড়ি দেওয়া। সিড়ির সাথেই রান্নাঘর। বাসাটা দোতলা ফাউন্ডেশন করা না তবে উপরে টিনের চালের পরিবর্তে ছাদ ঢালাই করে দিছে। তিনটা রুমেরেই বাইরের দিকে তিনটা দরজা রয়েছে। যেটা দিয়ে সরাসরি বাইরে বের হওয়া যায় অথবা ড্রইং,ডাইনিং রুমের সাথে যে মূল ফটক আছে সেটা দিয়েও বাইরে বেরুনো যায়।
যাইহোক আমি বুঝতে পারছিলাম না নীল কী করতে চাচ্ছে। আমার বোধদয় ঘটার পূর্বে মুখ দিয়ে কিছু একটা বলতে যাব এমন সময় নীল আমার মুখটা তার হাত দিয়ে চেপে ধরল।
– সুুুউউউউ…..একদম চুপ। কোনো কথা না। একদম চেঁচাবে না। আগে আমার কথা শুনবে তারপর কথা বলবে।
আমি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের দৃষ্টি কেবল তার দৃষ্টি বরাবর। তার কোমল ঠোঁটগুলো নড়ে উঠল।
– সমস্যা কী তোমার? রিদির কথায় তাল মিলাচ্ছ কেন? আমাকে কী ভরসা করতে পারো না? আমাকে ভালোবাস কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে এত কষ্ট এত দ্বিধা? ভালোবাসা বুঝো, তবে এটা কেন বুঝো না ভালোবাসার প্রথম ধাপ হলো বিশ্বাস। বিশ্বাসটাকে কেন এত দূরে রেখেছো? সিঁথি রাণী তোমাকে ভালো না বাসলে তোমার এত পাগলামি সহ্য করতাম না। এত সময় কোথায় আমার বলবে? তবুও কেন সময় পেলে তোমার কাছে চলে আসি বলো তো? কারণ তোমাকে আমি গুরুত্ব দিই তোমার প্রতি থাকা ভালোবাসাকে অবহেলায় মুড়াতে দিই না। তবুও তোমার মনে এত অবিশ্বাস। তৃতীয় ব্যক্তির কথায় আমায় ছেড়ে দিচ্ছ! তুমি ছেড়ে দিলে জোর করব না তবে তোমার অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিবে যেটা এ কয়েক ঘন্টায় অনেক প্রখর করে দিয়েছে।
বলেই নীল মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নীলের চোখের দিকে তাকালাম। চোখগুলো তার রক্তবর্ণ। চোখের চারপাশটা জমাট বাঁধা রক্তের মতো লাল হয়ে আছে। চোখে জল নেই কিন্তু ভেতরের ক্ষতটা যেন চোখে লাল হয়ে ভেসে উঠেছে। আমি কী বলব জানি না। দুটানা আমাকে গ্রাস করছে। এদিকে ভয় ও করছে। কারণ ঘরের দরজাটা খোলা, কখন যে রিদি চলে আসবে জানিনা আর এসে আমাকে এভাবে দেখলে আরও বেশি কথা শুনাবে। তবে ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড়টা স্থিত হচ্ছে। হালকা গলায় বললাম
– আমাকে ছাড়ো। রিদি আসলে সমস্যা।
সে আরও টেনে তার কাছে নিল। হাতটা আরও মুচড়ে ধরল। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া মিষ্ট সুরে বলল
– আগে বলো কী চাও তুমি? চলে যেতে নাকি আমার হয়ে থাকতে। ২ টা বছর সময় কী আমাকে দেওয়া যাবে? আমি তোমার হয়ে তোমার পাগলামু গুলো দেখব। তুমি বয়সে ছোট অনেক, ধরে নাও না নিজের মতো করে বড় করে নিব তোমায়। পারবে তো এ বৃদ্ধকে বিশ্বাস করতে? অপেক্ষা করতে? ভালোবাসতে?
আমার চোখ দিয়ে জল টুপটুপ করে পড়ছে। নীলের এ কথাগুলো শোনার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। এত অল্প সময়ে কেউ কারও মন এত প্রখর করে দখল করে নিতে পারে জানা ছিল না। কলিজাটা ঢিপঢিপ করছে৷ মৃদু সুর গলা দিয়ে বের হলো। মাথাটা তার বুকে ঠেঁকিয়ে দিলাম।
– আমার পাগলামি তুমি সহ্য করতে পারবে তো? এ নাছোর বান্দাকে সামলে নিতে পারবে তো? কখনও বিরক্ত হবে না তো? কখনও বলবে না তো পাগলামি করো না।
আমার মাথাটা তার অপর হাত দিয়ে ধরে বলল
– শুধু বলব পাগলামিগুলো আমার জন্য বরাদ্দ রাখতে। তোমার সত্ত্বাকে কখনও বিলীন হতে দিব না। সবসময় আগলে রাখব।
“আমি প্রতিজ্ঞা করছি সবসময় তোমার পাশে থাকব। তোমার পাগলামি গুলো সহ্য করব। তোমার অস্তিত্বের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিব। বুকে জড়িয়ে আগলে রাখব। সকল কষ্ট দূর করে দিব। জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমার নীল তোমারেই হয়ে থাকবে। এ প্রতিজ্ঞা কখনও ভাঙব না”
আমার ভেতরে প্রশান্তের শীতল হাওয়া বইছে। এত শান্তি লাগছে মুখে প্রকাশ করতে পারছি না। ইচ্ছে করছে সময়টাকে থামিয়ে দিই। আর যেন সামনে না যেতে পারে। এটুকু সময় হয়তো ঠেঁকিয়ে রাখা যাবে না তবে স্মৃতির পাতায় ঠিকেই ফ্রেমবন্দী হয়ে থাকবে। মাথাটা নীলের বুক থেকে উঠিয়ে মৃদু গলায় বললাম
– ছাড়ো এবার, রিদি দেখতে পারলে ঝামেলা করবে। আর যদি বাবা, মা কে বলে দেয় তাহলে সমস্যা হবে।
নীল লম্বা লম্বা দম ছেড়ে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু মন চাচ্ছে এ সময়টাকে আর চলতে না দিতে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে তবে ভালোবাসার ছন্দতালে। চোখটা শুধু তার দিকেই তাক করা নামাতে যেন পারছি না। কোথায় ছিল এত মায়া! যাকে আমি কয়েকদিন আগেও চিনতাম না তাকে এত আপন কেন লাগছে! কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রিয়জনের তালিকায় কী করে চলে আসলো জানি না। নীল আবারও আমার কাছে আসলো। বাহু দুটো ঝাঁকিয়ে বলল
– এ হলো এক মহাবিপদ একটু আদর পেলেই হলো, মাথায় চড়ে বসো। নিজের মধ্যে ফিরে এসো। এত ডুবে গেলে চলবে না। অবিবাহিত পুরুষের দিকে এত সুন্দরী মেয়ের এভাবে তাকাতে নেই। যাও এক কাপ চা নিয়ে এসো। বেশ ক্লান্ত লাগছে। অনেক জ্বালিয়েছো এবার এক কাপ চা বানিয়ে দাও। আন্টি কেমন আছে?
– আগের চেয়ে ভালো। তুমি ড্র ইং রুমে বসো আমি চা করে নিয়ে আসছি। আমি কিন্তু রান্না বান্না পারি না। চা কেমন হবে বলতে পারব না।
– এক রকম হলেই হলো।
বলতে বলতে নীল সোফায় বসলো। মায়ের রুমে গিয়ে মাকে বললাম নীল এসেছে। মা হালকা সুরে বলল নীলকে নাস্তা দেওয়ার জন্য রিদিকে বলতে। আমি মথা নেড়ে গেলাম। যদিও নীলকে নাস্তা দিতে রিদিকে বলব না কারণ তাকে আমার মোটেও সহ্য হয় না। নীলকে নিয়ে যত ঝামেলা সে করেছে, মাঝ খান দিয়ে দুজনেই কষ্ট পেয়েছি।
মায়ের পাশ থেকে উঠে রান্না ঘরে গিয়ে চা বসালাম। যদিও চা বানানোতে এত পটু না। তবুও জোর গলায় জিজ্ঞেস করলাম
– দুধ চা খাবে নাকি রঙ চা?
– তুমি যা ভালো পারো তাই নিয়ে এসো।
– আমি সব পারি। তুমি কোনটা খাবে?
– দুধ চা বানিয়ে নিয়ে এসো তাহলে।
আমি দুধ চা বসালাম। চা আমি কখনই ভালো বানাতে পারি না। রান্না বান্নায় বেশ কাঁচা। তবুও চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। অনেকটা সাধনার পর আমার কাঙ্ক্ষিত চা তৈরী। চা টা নিয়ে নীলের কাছে গেলাম। চা টা বাড়িয়ে দিয়েই গড় গড় করে বললাম
– কোনো ভুল ধরা যাবে না। অনেক কষ্ট করে চা বানিয়েছি। শুধু প্রশংসা করবে। বলবে আমার চা অনেক মজা। আমার হাতের চায়ের সাথে কারও হাতের চা এমন মজা হবে না। তোমার খাওয়া শ্রেষ্ঠ চা আমার হাতের চা।
নীল চা টা হাতে নিয়েই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বলল
– ভালো না হলেও কী এগুলো বলতে হবে?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা দেখা যাক।
বলেই নীল চা টা মুখে নিয়ে চুমুক দিল। মুখে দিয়েই পরক্ষণেই আবার দ্বিতীয় চুমুক দিল। তারপর আমার দিকে চা টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
– একটু খাও।
আমি তার হাত থেকে চা টা নিয়ে মুখে দিলাম। এতটাও খারাপ হয়নি যেমন হয়েছে চলে। আর আমার মতো রান্না পারে না মেয়ের এমন চা বানানোটায় স্বাভাবিক। আমি দৃঢ় গলায় বলে উঠলাম
– চা তো ঠিকেই আছে। আমার কাছে খারাপ লাগেনি। দ্রূত প্রশংসা করো।
নীল চা টা হাতে নিয়ে কপালটা কুঁচকে বলল
– তা ঠিক আছে। তবে দুধ চায়ে লবণ দিছো কেন?
আমি মুখটা বাঁকিয়ে বললাম
– লবণ দিলে চিনির স্বাদটা টের পাওয়া যায়। নাহয় চিনির স্বাদ বুঝা যায় না।
– তাই বলে দুধ চা এ লবণ? কে বলেছে লবণ দিলে চিনির স্বাদ টের পাওয়া যায়। এ থিওরি কোথায় পেয়েছো?
– এ থিওরির বিজ্ঞানী আমি৷ আর এত কথা বলছো কেন? না খেলে চায়ের কাপ দাও। খেতে হবে না তোমার।
নীল চায়ের কাপটা পেছন দিকে নিয়ে বলল
– বানিয়েছো যখন খাই। কারও বানানো জিনিস যত্ন করে খেলে মহব্বত বাড়ে। মুরুব্বিরা বলে।
– জোর করে খেতে হবে না।
– মজা করেই খাব। জোর করে না।
– তাহলে প্রশংসা করো চায়ের।
– এ সাত সকালে মিথ্যা প্রশংসা শুনতে চাচ্ছ! সকাল বেলা এত মিথ্যা বলা কী ঠিক হবে?
আমি চোখটা রাঙিয়ে উত্তর দিলাম।
– প্রশংসা করতে বলেছি সুতরাং প্রশংসা করো। তাড়াতাড়ি করো।
নীল চায়ে চুমুক দিতে দিতে চায়ের প্রশংসা করা শুরু করল। তার অতিশয় মনোমুগ্ধকর প্রশংসা শুনে আমার হার্ট এটাক হবার উপক্রম হচ্ছে। নিঃশ্বাসটাও যেন ঝট পাঁকিয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষের প্রশংসা এমন হয় নীলকে না দেখলে জানা ছিল না।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)