ডাক্তার সাহেব পর্ব-৮
#শারমিন আঁচল নিপা

তাকে দেখে আমার চোখ কপালে উঠল। মনে হচ্ছিল না সে হাসপাতালে রোগী দেখতে এসেছে মনে হচ্ছে কোনো বিয়ে বাড়িতে কনে দেখতে এসেছে। লাল টুকটুকে একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। তার সাথে কনজাস্ট করে গোল্ডেন জুতা,গোল্ডেন ব্যাগ নিয়েছে,কপালে রক্তজবার মতো লাল টিপ। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। চেহারায় মেক আপের পরত স্তরে স্তরে সাজানো। আমি শুধু তার দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সে একটু হেল দুল খেয়ে মুচকি হেসে বলল

– সিঁথি আপু কেমন আছো?

আমার মতো ভ্যাবলাকান্ত তখন মুখ হা করে ছিল। কথার জবাব দেওয়ার মতো পরিস্থিতি যেন বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সিনেমার মতো চারদিকে তখন ধুম তানা শব্দ কানে আসছিল । আর আমাকে আপুই বা কেন ডাকছে! বয়সে তো সে আমার বড়। তিন ক্লাস ফেইল না করলে এখন অনার্সের স্টুডেন্ট থাকত। সে মেয়ে কী না, আমায় আপু বলছে। মেজাজটা না চাইতেও চড়ে গেল। হরহর করে বলে উঠলাম

– রিদি আমায় আপু ডাকছিস কেন? বয়সে তো তুই আমার বড়। সময় মতো পাস করলে তুই অনার্সে পড়তি আর বিয়ে করলে দুই বাচ্চার মা হতি। তুই আমায় আপু ডাকছিস কেন?

রিদি মুচকি হাসলো। তারপর হাত দিয়ে তার সামনে থাকা বিনুনিটা পেছনে নিয়ে বলল

– থাক না সেসব কথা। এখন তো ক্লাসে তুই বড়। তাই আপু ডাকছি।

– তুই কী মাকে দেখতে এসেছিস নাকি বিয়ে বাড়িতে?

– তুই বড্ড বেশি কথা বলিস। সর…

বলেই একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। এদিকে রাগে শরীরটা গিজগিজ করতে লাগল। নিজেকে অনেক কষ্টে শত চেষ্টার সমন্বয় ঘটিয়ে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করলাম। বাবা খাবার এনেছে সেটা নিয়ে কেবিনের এক পাশে বসলাম। রুটি পরোটা আর ডিম,সবজি ভাজি এনেছে। আমি খাবারটা প্লেটে নিয়ে খেতে লাগলাম। পেটে অনেক ক্ষুধা থাকায় আশে পাশে নজর দেওয়ার তেমন সময় হয়ে উঠল না। অর্ধেক খাওয়া শেষে পেটটা যখন ঠান্ডা হলো তখন একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলে পাশ ফিরে তাকাতেই হাতে থাকা পরোটার টুকরাটা ধপাশ করে নীচে পড়ে গেল। রিদি তার ছোট আয়না দেখে মুখে লিপস্টিকের দ্বিস্তর পরত দিতে লাগল। রিদির ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে আর সে তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোনোরকম পানিটা গদগদ করে খেয়ে তার পাশে গিয়ে বললাম

– কী রে তুই এক গাদা লিপস্টিক দিচ্ছিস কেন? তুই কী পাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি? এত সাজার কী হলো? বাবারও আক্কেল হলো না একে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। একে নিয়ে কাজী অফিসে ফেলে দিয়ে আসলেই হয়তো শুধু শুধু হাসপাতালে এনেছে। যত্তসব চিড়িয়াখানার পাবলিক। বাবা যে কোথায় গেল এ সময়।

আমার কথায় রিদির ভ্রূক্ষেপ ও হলো না। সে নিজের মতো করে লিপস্টিকের পরত ঠোঁটে দিতে লাগল। আমার শরীরে কেমন জানি জ্বলা অনুভব হচ্ছে। ইচ্ছা করছে একটা বড়সড় লাথি দিয়ে ফেলে দিই তাকে। তবে সব ইচ্ছা পূরণ করা যায় না। এ ইচ্ছাটাকেও চাপা দিয়ে পুনরায় বললাম

– রিদি তোর হয়েছে কী? এমন করছিস কেন?

রিদি আমার দিকে তাকাল। তার মুখের রঙ মেকআপের আস্তরণে অত্যাধিক ফর্সার আবেশে ঘেরা। ছোট চোখগুলো হুট করেই যেন ভীষণ টানা টানা লাগছে। বোঁচা নাকটাও কেমন জানি সোজা সোজা লাগছে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছি। নিঁখুত মেকআপ সত্যিই মানুষকে অনেক সুন্দর করে তুলে। সেটা রিদিকে দেখে ভালোই বুঝায় যাচ্ছে। রিদির চোখে মুখে অজানা আভা ভেসে বেড়াচ্ছে। সেটা কিসের আমার জানা নেই। প্রথম প্রেমে পড়লে মন যেমন উড়ু উড়ু করে রিদিকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। যেমনটা নীলকে দেখে আমার মনের কথাগুলো মুখে ফুটেছিল রিদির ক্ষেত্রেও তাই মনে হচ্ছে। ওকে যতই দেখছি ততই নানাবিধ প্রশ্ন আমাকে আঁকরে ধরছে। প্রশ্নের জাল থেকে বের হলাম তার তীক্ষ্ণ কন্ঠ সুর শুনে।

– কী রে সিঁথি খাবার সামনে নিয়ে হা করে কী দেখছিস?

রিদির কন্ঠে নড়েচড়ে বসলাম। চাপা সুরে বললাম

– তুই এত সাজছিস কেন রে? এতক্ষণ মজা করে বললেও এখন সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করছি। আমার কাছে তোর আচরণটা অদ্ভুত লাগছে। তুই তো এমন ছিলি না। সাজ গোজের ব্যাপারেও গাফেল ছিলি। বরাবরেই তো তুই পরীক্ষা ডিব্বা পেয়ে ডাব্বা মেরে বসে থাকিস। আজকে কী এমন হলো তোর?

রিদির চোখে মুখে লজ্জার বিস্তরণ। মনে হচ্ছে লজ্জাবতী লতা গাছটা বাতাসে এদিক ওদিক দুলছে একটু স্পর্শ পেলেই নুইয়ে পড়বে। সামনে এসে পড়া বিনুনিটা সে ঝাঁপটা দিয়ে পেছনে নিল। আমার দিকে হালকা চোখে তাকিয়ে লজ্জা মাখা গলায় চেপে চেপে বলল

– আরে খালু বলেছে এক ডাক্তারের সাথে নাকি তোদের ভাব জমে গেছে। খালুর নাকি বন্ধুর ছেলে। খালুর মুখে এত প্রশংসা শুনেছি যে রিতীমতো আমি প্রেমে পড়ে গেছি। তুই তো জানিস ছোট বেলা থেকে আমার ডাক্তার পছন্দ। কেন জানি না এ ডাক্তারকে না দেখেই ভালো লাগতে শুরু করেছে। সন্ধ্যার পর নাকি আসবে। তাই একটু নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছি। যদি তার চোখে চোখ পড়ে। সিঁথি তুই একটু সাহায্য করবি আমায়। যাতে আমাদের প্রেম হয়ে যায়।

বলেই বিনুনিটা সামনে এনে তার লেজটা দিয়ে মুখটা চেপে ধরল। এদিকে তার কথা শোনে আমার বুকের ভেতরটায় পিয়ানোর করুণ সুর বাজতে লাগল সে সাথে রাগে শরীর কাঁপতে লাগল। মন চাচ্ছে কষিয়ে তাকে দুটো চড় দিয়ে বলি আমার নীলের দিকে তোর এত নজর কেন? তবে এত বোকা মেয়ে আমি না। আমাকে যা করতে হবে কৌশলে। বুঝতে দেওয়া যাবে না নীলকে আমি ভালোবাসি। তাকে সাহায্যের নাম করে গণধুলাই যদি আমি না দিয়েছি আমার নামও সিঁথি না। তার দিকে আমি তাকালাম। রাগ হয়ে উঠা রক্তবর্ণ চোখটা বন্ধ করে স্বাভাবিক করে নিলাম। তারপর মোলায়েম কন্ঠে বললাম

– অবশ্যই তোকে সাহায্য করব। আচ্ছা তার যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে তাহলে কী করবি?

রিদি আমার কথা শুনে নুইয়ে পড়ল। কিছুটা লজ্জা নিয়ে বলল

– আমি জানি তার গার্লফ্রেন্ড নেই।

আমি বিস্মিত হলাম তার কথা শুনে। সে কী করে এতটা নিশ্চয়তা নিয়ে বলতে পারছে যে তার গার্লফ্রেন্ড নেই। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে, তীব্রগতিতে জিজ্ঞেস করলাম

– তুই এত নিশ্চিত কীভাবে যে তার গার্লফ্রেন্ড নেই।

সে তার লজ্জাটাকে আরও বিস্তৃত করল। চোখ মুখ নুইয়ে নিল। সুতীক্ষ্ণ সুরেলা নম্র গলায় বলল

– সকালে খালুর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল দিয়েছিলাম। পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করার পর বলল তিনি সিনগেল। কোনোদিন প্রেম করেনি।

রিদির কথাটা শুনার সাথে সাথে অভিমানে বুক ফেটে গেল। আমি থাকা সত্ত্বেও সে এমন বলতে পারল! চোখের কোণে হালকা পানিবিন্দু।।শীতের সকালে যেমন ঘাসের পাতায় শিশিরবিন্দু প্রতীয়মান হয় আমার চোখের কোণেও সে একই অবস্থা প্রতীয়মান হচ্ছে। কথা যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। চুপ করে ঠাঁই বসে রইলাম। চাপা কষ্টটাকে বুকে চেপে রেখে মলিন হাসি দিয়ে বললাম

– আর কী বলেছে?

– বেশি কথা হয়নি। সামান্য কথা হয়েছে। ব্যস্ত ছিল তাই ফোনটা কেটে দিয়েছে। তবে বলেছে সন্ধ্যায় আসলে অনেক কথা বলবে। ভালোভাবে পরচিত হয়ে নিবে।

– আর কিছু?

– কী আর কিছু?

– মানে আর কিছু বলেনি? তোকে ভালো লাগে বা কিছু।

– ধুর বোকা মেয়ে। তুই ক্লাসে টপার হলে কী হবে আক্ষরিক অর্থে তুই সত্যিই বোকা। ছেলেরা কী এত সহজে কিছু বলে? তবে কথায় মনে হলো আমাকে উনার ভালো লেগেছে।

আরও অনেক কিছুই বলতেছিল রিদি। তার কথা শুনে বুকের ভেতর মোচর দিতে লাগল। বাকি কথায় চাইলেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। শরীরটা অসাড় লাগছে। মুখে জমে থাকা রুটিটাও আর গিলতে সক্ষম হলাম না। নীল রিদির সাথেও কথা বলেছে আবার সন্ধ্যার পর দেখা করবে বলোছে আর আমাকে একটা বারও বলল না। কীভাবে পারল। চাপা অভিমানটা ক্ষোভে পরিণত হলো। রিদি বকবক করেই যাচ্ছে। আর আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি। চোখে জমে থাকা শিশির বিন্দুটা যেন এখনেই পড়ে যাবে মনে হচ্ছে। অযাচিত মন তাকে গড়িয়ে দিতে চাইলেও পরিবেশ বিবেচনায় গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিলাম। আচ্ছা নীল তো আমার সত্যি সত্যি প্রেমিক না তাহলে তার জন্য আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে। এত মায়া ভালোবাসায় বা, কেন অযথা কাজ করছে। কেনই বা কষ্টে বুক ফেটে চৌচির হচ্ছে। এক মাস পর তো এ খেলার শেষ ও হয়ে যাবে। হয়তো নীল অন্য কারও স্বামীও হবে তখনও কী আমার এমন কষ্ট হবে। তার জন্য চোখের জল ভিজবে। মনের গহীনে থাকা লুকোচুরির পর্দাটা সরে যাবে নাকি তার কথা ভেবে শুধু বুক কেঁপে উঠবে। এতটা অস্থির কেন লাগছে। কেনই বা নীলের সাথে রিদির কথা মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে শর্টসার্কিট হয়েছে আমার মনে সেটার কম্পন বা রেশ এখনও কাটছে না। রিদি কথা বলতে বলতে কখন চুপ হয়ে গেছে জানি না। আমি নিজেকে সামলে মায়ের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম।

চলবে

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here