#ডাক্তার সাহেব পর্ব -৬
#শারমিন আঁচল নিপা
আমি বলে উঠার আগেই তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। বাবার দ্বিমুখী চোখের চাহুনিতে আমি দ্বিধান্বিত যে বাবা কথা গুলো রাগ করে বলছেন নাকি রাগের প্রতিফলন না ঘটিয়ে বলছেন।
– সিঁথি কী বিড়বিড় করতেছিলে এতক্ষণ?
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে উত্তর খুঁজতেছিলাম
– সিঁথি…..
দীর্ঘ টান সুরে বাবার কন্ঠে আমার নাম উচ্চারিত হলো। আমি যেন সম্ভিত ফিরে পেলাম। নম্র গলায় জবাব দিলাম
– কিছু না বাবা। কী যেন ভাবছিলাম তাই বলছিলাম।
দ্রূত প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য মায়ের কথা জাহির করলাম।
– বাবা, মা কেমন আছে? মায়ের জ্ঞান ফিরেছে? কথা বলতে পেরেছো?
পূর্বের প্রসঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে বাবা মৃদু হেসে বললেন
– তোমার মা ভালো আছে। একটু পর সবাই দেখতে পারব। মুখে খাবার নিষেধ। সাত দিনের মতো হাসপাতালে থাকতে হবে। তোমার খালাত বোনকে কল দিয়েছি সে এসে হাসপাতালে থাকবে তোমার সাথে। আর সকাল থেকে মনে হয় নাস্তা করোনি। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
তারপর নীলের দিকে তাকাল। নীল তখন বাধ্য ছেলের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট বেলায় যখন স্কুলে স্কাউটে ছিলাম তখন লিডার যখন বলত সোজা হও ঠিক এমন করেই আমরা সবাই সোজা হতাম। নীলের সোজা হওয়ার ধরণটাও এর ব্যতিক্রম না। আমি শুধু নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখছিলাম। যতই দেখছি ততই যেন এর মায়ায় তলিয়ে পড়ছি। এ মায়া কাটানো বড্ড দায়। শুনেছি সময়ের পরিক্রমায় ভালোবাসা কেটে গেলেও মায়া কাটে না। মায়া থেকে যায় চিরকালের জন্য। হয়তো মায়ার পরিসর মৃদু হয় তবে এক কোণে অবশিষ্ট রয়ে যায়।
– অনীল তুমি কী খাবে বলো?
বাবার কথায় আমি যেন মায়ার জগত থেকে বেরিয়ে আসলাম।
– আংকেল আপনি আপনার মতো করে কিছু নিয়ে আসুন। হোস্টেলে থেকে সব ধরণের খাবারেই খেতে শিখে গেছি।
বাবা হালকা হেসে হাত দিয়ে একটা সম্মতি সূচক ইশারা দিয়ে করিডোর থেকে বের হলেন। আমি নীলের দিকে পুনরায় তাকালাম। গাল জুড়ে যে খোঁচা দাঁড়ির সমাবেশ সেটা লক্ষ্য করতে লাগলাম। সিনেমার মতো চারপাশে যেন সুর বাজছে আমার কানে। খোলা চোখ থাকা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি। নীল ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার মুখ থেকে ভারী নিঃশ্বাস এসে আমার মুখে লেপ্টে পড়ছে। শ্যামলা ছিপছিপে ছেলেটা যেন আমার সারা অস্তিত্ব দখল করে ফেলল তার অসীম অনুভূতি মিশ্রিত নিঃশ্বাস দিয়ে। বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাট আসতে লাগল। বৃষ্টির ছাটগুলো আমার গালে এসে ঝাঁপটে গাল বেয়ে পড়ছে। হাত গুলো থরথর করে কাঁপছে। নীল ঠিক আমার সন্নিকটে। আমার বাহু দুটো তার দু হাতের মুষ্টির অধীনে। মায়াময় সে চোখ গুলো আমার দিকেই তাক করা। ঘন নিঃশ্বাস গুলো তার কাছে যেতে যেন আরও ডাকছে। সামলাতে কষ্ট হচ্ছে খুব। তাকে কী জড়িয়ে ধরব? এর মধ্যেই পানির প্রবল ঝাপঁটা এসে আমার চোখে মুখে পড়ল। বাইরে কী ঝড় হচ্ছে নাকি! এত প্রবল বর্ষণ মুখে লেপ্টে এসে একাকার হলো যে! নিজেকে সামলে চোখের থেকে কল্পনার পর্দা সরিয়ে বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসলাম। তার মানে এতক্ষণের ঘটনা সব আমার কল্পনা মিশ্রিত আবেগের ঘনঘটা ছিল। আমি যেটাকে বৃষ্টির ছাট ভেবেছিলাম বাস্তবিক পক্ষে সেটা ছিল পানির ঝাঁপটা। আমাকে অবলীলায় তাকিয়ে থাকতে দেখে নীল আমার চোখে মুখে পানির ঝাঁপটা দিতেছিল। প্রচন্ড অভিমানে বলে উঠলাম
– পানি দিতেছো কেন এভাবে?
– এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কী ভাবতেছিলে? মনে হচ্ছিল এ বুঝি খেয়ে ফেলবে তাই পানির ঝাঁপটা দিয়ে তোমার হুঁশ ফিরিয়ে আনছিলাম। যদি খেয়ে ফেলো তাহলে তো হজম ও করতে পারবে না। বরং উল্টো বদহজম হবে।
নীলের কথায় চুপ হয়ে গেলাম। ফর্সা সাদা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। লালের পরত পরতে পরতে যে, এটা নীল হয়ে যাবে সেটাও বুঝতে পারছি। খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ভীষণ ব্যস্ততায় দেখতে দেখতে সারাটাদিন পার করে ফেললাম। বাবা বাসায় গেছে। আমি মায়ের কেবিনে, নীচে বিছানা পেতে শুয়ে আছি। কালকে থেকে খালাত বোন সাথে থাকবে আজকে রাতটা আমাকে একাই পার করতে হবে। নীলের সাথে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। রাত এখন ১২ টা ৩০। সে ঘুমিয়ে গেছে। আর আমি চুপচাপ শুয়ে তার কথা ভাবছি। মেসেজটার কথা মনে আসলো। ফোনটা হাতে নিয়েই মেসেজটা ওপেন করলাম।
“ধরো রাত ঠিক ১২ টা। রাতের আকাশটায় প্রশস্ত চাঁদ উঠেছে। তুমি সাগর পারে দাঁড়িয়ে আছো। ঢেউ গুলো মাটির বুকে এসে আঁচড়ে পড়ছে। আঁচড়ে পড়ার সময় ঢেউয়ের কিছু পানি বিন্দু তোমার গায়ে লেগে শীতলতার অনুভূতি দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললে তুমি। মাটির পৃষ্ঠে থুবরে পড়া ঢেউয়ের শব্দ আর বাতাসের শব্দ তোমার কানে শোঁ শোঁ করে ভাসছে। অবাধে বেড়ে উঠা চুল গুলো এ বাতাসে গুল্ম উদ্ভিদের ন্যায় ছন্দ তুলে এপাশ ওপাশ উড়ে হেলদুল খাচ্ছে। ঠিক এমন সময় কেউ তোমার পাশে। তুমি কাকে দেখতে পারছো?”
মেসেজটা পড়েই আমি চোখটা বন্ধ করে ফেললাল। নীলের মুখ অবয়বটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ কেবিনে যেন প্রতিধ্বনি তুলছে। নিঃশ্বাসটাকে ক্ষুদ্র করে পুনরায় তাকিয়ে পরের মেসেজটা পড়লাম।
“এবার তোমার ভাবনায় আসা প্রিয়তম তোমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তোমার কানের ঠিক পাশে তার মুখটা এনে তার ঠোঁট গুলো কানে ছুয়ালো। মৃদু মুহুময় সুরে বলল ভালোবাসি তোমায়। তখন তোমার উত্তর কী আসবে?”
চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। আমার কল্পনার জগতে শুধু নীলের বাস। এক ফালি চাঁদ আকাশে। আমি সাদা শাড়ি নীল ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছি সাগর পারে। অচেনা এক যুবক সাদা পান্জাবি পরে আমার সামনে দাঁড়াল। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। চিনতে ভুল হলো না আমার। কারণ এ আর কেউ না এ আমার স্বপ্নে বিচরণ করা সে পুরুষ। যার নাম অনীল যাকে আমি ছোট্ট পরিসরে নীল বলে ডাকি। তার চোখে চোখ রেখে আমি বলে উঠলাম
” আমিও ভালোবাসি তোমায়। আরও ভালোবাসতে চাই। এক জীবনের জন্য না বরং সহস্র বার জন্ম নিলেও আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই। তোমার সেই ঠোঁটে আমার ঠোঁট মিশাতে চাই। দখল করে নিতে চাই তোমাকে। তোমার চোখের নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে মাতাল হয়ে যেতে চাই। তোমার বাহু ডোরে আবদ্ধে নিজেকে বিলীন করে দিতে চাই। ”
আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসতে লাগল। লাজ সরম উচ্ছুন্নে দিয়ে নীলকে ভালোবাসি বলতে ইচ্ছা করল। কিন্তু সাহস হয়ে উঠছিল না। নিজেকে সামলে নিলাম। পরবর্তী মেসেজ পড়ার জন্য চোখটা খুললাম।
“তৃতীয় এবং আজকের জন্য শেষ মেসেজ। তোমাকে এর উত্তর আমাকে দিতে হবে না। তোমার কল্পনার বিচরণ করা সে রাজপুত্রকে উত্তরটা দিয়ে দিও। ভালো থেকো।”
আমি জোরগতিতে কয়েকটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ছাড়লাম। ইতোমধ্যে কল্পনায় থাকা রাজপুত্রকে আমি উত্তরটা দিয়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে নীলকে ডাক্তার মনে হয় না। মনে হয় কোনো কবি তার সাহিত্য রচনা করছে। যার সাহিত্যের এক কোণে বিচরণ করছি আমি আর বাকি সব জায়গায় বিচরণ করছে সে। ভালোলাগার আবেগগুলো বেশ ভিন্ন হয়। এ আবেগের কাছে সব হেরে যায়। চোখের পাতায় যেন একটা মুখের খন্ড আটকে আছে আর সেটা হলো নীল। চোখ বন্ধ করতেই তার চেহারা ভেসে আসে আর বুকের মধ্যে মনে হয় টুংটাং করে গিটারের আওয়াজ বাজে। শরীরের অদ্ভুত অনুভূতিগুলোও যেন বলে দিচ্ছে আমি বড্ড বড় হয়ে গেছি। আমার এমন কাউকে চাই যার সাথে মিশে গিয়ে নিজেকে একাকার করে ফেলতে পারব।
দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলো জানান দিচ্ছে আমি পাগলের মতো হন্নে হয়ে নীলকে চাচ্ছি। আচ্ছা এটা কী কেবলেই আমার নেশা নাকি ভালোবাসা! এত আবেগের টানপূরাণে নিজেকে সামলে রাখা বড় দায়। মনে হয় সবচেয়ে বড় বেহায়া হয়ে যাই। নীলের কাছে গিয়ে নিজের ভালোবাসা উজার করে দিয়ে দিই। ভাবনার গতি আর সামনের দিকে এগুতে পারলাম না। পরক্ষণেই বাস্তবের কথা চিন্তা করে নিজেকে দমিয়ে নিলাম। চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেছে। মায়ের হাতে স্যালাইন লাগানো। বেশ মায়াময় ভাবে মা ঘুমুচ্ছে। কেবিনের জানালাটা খুলে দিতেই বাইরের শীতল বাতাস মুখে এসে লাগল। প্রেমে পড়লে হয়তো গরমও শীতল অনুভূতি দেয়। নীলকে ভীষণ মিস করছি। তার চোখের চাহনী যেন আমাকে আরও তীব্র করে ডাকছে। আমার কানে বারবার তার দৃঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। স্তরে স্তরে তার জন্য অনুভূতি গুলো যেন অবলীলায় সাজিয়ে ফেলেছি। না চাইতেও যেন সব এলোমেলো হয়ে মাতাল অনুভূতি দেয়। কী এক মায়ার টান। যে টানের ঘুড়ি আমি আর নাটাই নীল। আমি বেসামাল হয়ে ঘুরছি আর নীল যেন নাটাইয়ের সূতাটা অবাধে ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো এভাবে উড়ার পর বেসামাল ভাবে থুবরে পড়ব আর নাহয় অনীল নাটাইয়ে সূতোটা টেনে ঘুড়িটাকে নিজের কাছে এনে সযত্নে রাখবে। কী অদ্ভুত অনুভূতি আর চিন্তার বিকাশ। কোথায় ছিল এ চাওয়া, এ চিন্তা, এ অনুভূতি।
কেবিনের দরজাটা নক করলো কেউ। ভাবনার অসীমতট সীমাহীন ময়দান থেকে নিজেকে বের করে আনলাম। বুকের বা পাশটা হালকা ব্যথার সঞ্চার হচ্ছে। ধুকধুক করছে। কেবিনের দরজার দিকে যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনে হচ্ছে অনীল ঠিক আমার আরও কাছে আসছে। তাহলে কী অনীল এসেছে? হন্তদন্ত হয়ে পড়লাম। কিছুটা দ্রূত গতিতে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই আয়ার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো আমার চক্ষুগোচর হলো। আবেগের ডানাটা নিমিষেই ভেঙে থুবরে পড়ল। নিজের প্রতি রাগ বেড়ে গেল। কী থেকে কী ভাবছি আর কী থেকে ঘটছে। আয়া দাঁত কেলিয়ে বলতে লাগল
– সব ঠিক আছে তো।
– হুম
নিশ্চুপ গলায় মৃদু আওয়াজের ন্যায় উত্তর আসলো। আয়া ঘরটা পরিষ্কার করে চলে গেল। আর আমি নিজের কাছেই নিজেকে কেমন জানি বিষন্নতায় ডুবিয়ে দিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে অনীলকে একটা মেসেজ দিলাম
” ভালোবাসা আর এক্ট্রাকশন কী এক? কাউকে দেখলে যদি মনের অজান্তেই তার প্রতি থাকা অনুভূতি বিকশিত হয় তাহলে কী সেটা আবেগ নাকি ভালোবাসা? হার্টবিট উঠানামার প্রক্রিয়া দ্রূতগতিতে হলে সেটা কী ভালোবাসার প্রথম ধাপ? অযথায় কাউকে চিন্তা করলেই কী সেটা ভালোবাসার সরোবরে হাবুডাবু খাওয়া?”
মেসেজটা দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তার কথায় চিন্তা করেত লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্লাই আসলো। আমার হাত কাঁপতে লাগল। মেসেজটা ওপেন করতেই যেন বুকের ভেতর তুমুল আবেগের বর্ষণ উঠা নামা করে থুপ করে থেমে গেল।
(কপি করা নিষেধ)