ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৫০/শেষ পর্ব
( ১ম অংশ)
#শারমিন আঁচল নিপা
– জীবনের শেষ অধ্যায় খুঁজতে যাচ্ছি।
রুবাইয়া পুনরায় মায়ের পিছু ডেকে বলল
– মা আমিও যাব।
সিঁথি কোনো উত্তর দিল না। ভাবলেষ এমন ছিল যে, সে না ও করেনি আবার সম্মতিও দেয়নি। রুবাইয়াও মায়ের অনুমতির আপেক্ষা আর করল না। মায়ের পিছু ছুট লাগাল। সিঁথি বাসা থেকে বের হয়েই একটা রিকশা নিল। সে উঠার পর পরই রুবাইয়া উঠল রিকশায়। রিকশা কোথায় যাবে সেটাও সিঁথি রিকশাওয়ালাকে বলেনি। উঠার পর রাস্তা দেখাতে লাগল সে। রুবাইয়া জানে না কোথায় যাচ্ছে সে। অজানা কোনো গন্তব্যে হয়তো। ভোর সকালে রিকশা পাওয়া ভীষণ কঠিন হলেও সিঁথির বাসার সামনে রিকশা পেতে তেমন বেগ পোহাতে হয় না। কারণ এ রাস্তাটায় সবসময় কোনো না কোনো রিকশা থাকে।
চারদিকে ভালো করে এখনও আলো ফুটেনি। আধো আধো অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে আছে।মৃদু মন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে চারদিকে। এ বাতাসটায় কেমন যেন গম্ভীরতা বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে এমন কিছু হতে চলেছে যার জন্য কেউ প্রস্তুত না। এ বাতাসটা রুবাইয়ার মোটেও ভালো লাগছে না। বেশ অস্থিরতা পরলক্ষিত হচ্ছে তার মাঝে। অন্যদিকে সিঁথি এখনও গম্ভীর হয়ে বসে আছে। আর রিকশাওয়ালাকে পথ দেখাতে ব্যাস্ত। খুব বেশি পথ পার হয়েছে তা ‘না তবে সিঁথির কাছে আজকের পথটা বেশ দীর্ঘ মনে হচ্ছে। যতই তাড়াহুড়ো করছে ততই যেন সময়ের হার সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। সে শুধু দ্রূত যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল।
খুব বেশি না আধা ঘন্টার স্বল্প দীর্ঘ পথ পার হয়ে রিকশাটা থামলো এক হাসপাতালে। রুবাইয়া কিছুটা চমকালো। কারণ হুট করে তার মা এ হাসপাতালে কেন আসলো? তার মা তো এ হাসপাতালে রোগী দেখে না। তাহলে কি তার বাবা অসুস্থ? কথাটা ভাবতেই যেন তার বুকটা কেঁপে উঠল। আবার হালকা ভালো লাগাও কাজ করতে লাগল এটা ভেবে যে, সে তার বাবাকে নিজ চোখে দেখবে। কারণ জন্মের পর সে তার বাবাকে দেখেনি। যদিও এটা বুঝতে পেরেছে তার বাবা তার চাচার মতোই দেখতে। তবুও তার বাবাকে এক নজর দেখার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সত্যিই কি তার বাবা এখানে আছে? অনেক ভাবনা তার মনে আসলেও সে তার মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস একটুও পাচ্ছে না। শুধু বিষয়টা এগিয়ে যেভাবে যাচ্ছে সে ও সেভাবে তাল মিলাচ্ছে। সিঁথি রিকশা থেকে নেমেই ছুট লাগাল আই সি ইউর দিকে। সেখানে যেতেই একজন নার্স দৌঁড়ে এসে বললেন
– ম্যাডাম রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। একটু আগে অনেক ভালো রেসপন্স করেছিল। ভেবেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। কারণ একদম সাধারণ ভাবে কথা বলছিল। সবকিছু খুব স্বাভাবিক ছিল। এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মিনেট পনের পরেই অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। এখন ট্রিটমেন্ট চলছে।
– এখন কি কথা বলতে পারতেছে?
– একদম সেন্স নেই। আগে তো তবুও একটু নড়াচড়া করতে পারত এখন সেটাও পারছে না। সেন্স আনার চেষ্টা চলছে।
সিঁথি আর কথা বাড়াল না। সরাসরি আই সি ইউর ভেতরে চলে গেল। সেখানে দুইজন ডাক্তার অবিরত রেগীকে সুস্থ করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে রুবাইয়া মোটেও বুঝতে পারছে না আই সি ইউ তে কে? তার ভেতরে ঢুকার পারমিশন না থাকায় সে মোটেও ঢুকতে পারছে না। তবে তার ভেতরে অনেক প্রশ্নের সমাচার ঘটছে। সে চুপ হয়ে বাইরে বসে আছে। কী হচ্ছে সব অজানা তবে একটা আশার আলোর সন্ধান পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা তার মনে জাগছে।
এদিকে সিঁথি আই সি ইউ তে ঢুকল। বেডে শুয়ে আছে সেই ধর্ষিতা মেয়েটা। মেয়েটা মারা যায়নি। তবে মেয়েটার এমন অবস্থা হয়েছিল যে সে সাক্ষী দেওয়ার অবস্থায় ছিল না। কথা বলতে পারত না শুধু মৃতের মতো শুয়ে থাকত। ১৬ বছর পর আজকে মেয়েটা একটু কথা বলতে পারলেও সে সময়টায় সিঁথি সঙ্গে ছিল না। নাহয় তাকে জিজ্ঞেস করা যেত সেদিন নীল ছাড়া আর কে ধর্ষণ করেছিল তাকে। আজকে সিঁথির বুক ফেটে কান্না আসছে। এরকম আশার আলো কয়েকবার দেখলেও মেয়েটার সুস্থতা স্থায়ী না হওয়ায় সাক্ষী নিতে পরেনি সে।
সেদিন নীলের কথা শেনার পর সিঁথি নীলের বাবাকে সবটা বলে। নীলের বাবা আইনের সাহায্য নিয়ে মেয়েটার সমস্ত চিকিৎসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কারণ সিঁথির বিশ্বাস ছিল মেয়েটা একদিন সুস্থ হবে আর নীলের পক্ষে সাক্ষী দিবে। সেদিনের সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণণা করবে। এ আশা নিয়েই সিঁথি এতগুলো বছর পার করেছে। আর আজকে মেয়েটার অবস্থার এতই অবনতি হয়েছে সে বাঁচবে নাকি মরে যাবে সিঁথি বুঝতে পারছে না। সিঁথির ডাক্তার হওয়ার পেছনেও এ কারণটা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। কারণ সে ডাক্তার হওয়ার পর মেয়েটার চিকিৎসার দায়িত্বও নিজে নেয়। তবে আজ যেন তার সব চাওয়া সব আশা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। নিজের সামনে নিজের আশাটা এভাবে নিভতে দেখে তার চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। তবে আবেগ দিয়ে ভাবার সময় এটা না। সে এখন একজন ডাক্তার তার দায়িত্ব রোগীকে সুস্থ করে তোলা।
তাই সেও বাকি দুজন ডাক্তারের সাথে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল মেয়েটাকে সুস্থ করার জন্য। সিঁথির এ কাহিনি কয়েকজন ডাক্তার জানে। তারা তার এ আত্মত্যাগের কথা জানার পর থেকে সাহায্য করে আসছে। আজকেও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না।
মেয়েটার অবস্থা ক্রমান্বরে খারাপ দিকে যাচ্ছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখা হচ্ছে না। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। মেয়েটার সকল ক্রিয়া আচমকায় বন্ধ হয়ে গেল। পাশের দুজন ডাক্তার বলে উঠল
– শেষ রক্ষা সম্ভব হলো না।
সিঁথির মাথায় যেন আকাশটা ভেঙে পড়ল।।এত যন্ত্রণা হচ্ছে তার সেটা সে ছাড়া হয়তো কারও উপলব্ধি করা সম্ভব না। নীলকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর কোনো পথেই যেন খোলা নেই। আত্মচিৎকারটা বুকের ভেতরেই জমাঁট বেঁধে রইল। কিছুই প্রকাশ করতে সে পারছে না। পাশেই একটা সিটে বসে কাঁদতে লাগল। জীবন্ত লাশকে হয়তো চিকিৎসা করে জাগিয়ে তোলার আশা করা যায় তবে মৃতলাশকে সেটা করার সুযোগ নেই। আজকের এমন একটা দিন সে দেখবে সে আশাও করেনি। এত বছরের আশা যেন নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। পাথরের মূর্তির মতো হয়ে বসে আছে। পাশের দুজন ডাক্তারও সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এ মুহূর্তে মেয়েটার মৃত্যুর বিষয়টা কোর্টে জানাতে হবে।
লাশটাকে আই সি ইউ থেকে বের করা হলো। বের কারার সময় রুবাইয়ার দৃষ্টি গেল লাশের উপর। সে লক্ষ্য করল লাশটা একটা মেয়ের। এতক্ষণের জমে থাকা আশাও তার মলিন হয়ে গেল। সে ভেবেছিল হয়তো তার বাবা ভেতরে আছে। তবে এটা তার ভুল ধারণা ছিল এখন সেটার প্রমাণ পেল। কিন্তু মেয়েটা কে? রুবাইয়ার মনে প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে লাগল।
সিঁথিও আই সি ইউ থেকে বের হলো। রুবাইয়াকে সামনে পেয়ে হাইমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
– আমি তোমার বাবাকে আর নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলাম না। আমার শেষ অধ্যায়টা যে কালো ছায়ায় ডেকে গেছে মা। আমি আমার নীলকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আমি পৃথিবীকে বুঝাতে পারলাম না আমার নীল নির্দোষ। আমার নীলের অস্তিত্ব জুড়ে শুধু আমি সেটা আমি প্রমাণ করতে পারলাম না। সবাই তোমার বাবাকে ভুল বুঝলেও আমি জানি তোমার বাবা কিছু করেনি। আমি এখন কী করব? আমার নিভু নিভু করে জ্বলা আশার আলোটাও যে নিভে গেল চিরতরে।
রুবাইয়া মায়ের কথা শুনে পুরো কাহিনি বুঝতে না পারলেও একটু হলেও আঁচ করতে পারছে। সেও মায়ের সাথে কাঁদতে লাগল। আর সিঁথি বেশ জোরে জোরে চিৎকার করে বিলাপ করতে করতে বলল
– ডাক্তার সাহেব আমি যে পারলাম না তোমাকে সবার সামনে নির্দোষ প্রমাণ করতে। পারলাম না তোমার বুকের চেপে থাকা ভারী পাথরটা নামাতে। আমার অন্তর জুড়ে তুমি ছিলে। তোমার জন্য এক জনম না হাজার জনম আমি অপেক্ষা করব৷ পুরো পৃথিবী তোমায় ভুল বুঝলেও আমি তোমায় বিশ্বাস করব। ডাক্তার সাহেব তোমার কোলে মরার শখটা কি আমার পূরণ হবে না?
মায়ের বিলাপ শুনে রুবাইয়া শুধু কাঁদতে লাগল। হাসপতালাটায় যেন হাহাকার বিরাজ করছে। ঠিক এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করল সিঁথি। সে পেছন ফিরে তাকাতেই…
২য় অংশ কাল দিয়ে শেষ করে দিব।
চলবে?