ডাক্তার সাহেব পর্ব -৫
#শারমিন আঁচল নিপা

ঘন্টাখানেক বাইরেই বসে আছি। বাবা আসতেই শুধু সারপ্রাইজ না ভীষণ বড় একটা ধাক্কাও খেলাম। অযাচিত মনে প্রশ্নের সমাবেশ ঘটছে আমি যা দেখছি সেটা ঠিক তো নাকি কোনো কাল্পনিক ঘটনার বিস্তার থরে থরে সাজাচ্ছি। পরতে পরতে একটা থৃলার রহস্য অনুভূত হচ্ছে। বাজ পাখির মতো অবাধে চেয়ে বাবা আর নীলের কথোপকথন শুনছিলাম।

– অনীল কেমন আছো বাবা? অফিসের কাজে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বাসায় আসতে পারিনি। তাই তোমার সাথে তোমার আন্টির পরিচয় করিয়ে দিতে পারেনি। তোমার বাবাকে বলেছিলাম তোমাকে নিয়ে যেন আমাদের বসায় যায়। কিন্তু তোমার বাবা বলল আমি আসলে যাবে। তবে দেখো ঠিকেই পরিচয় হয়ে গেল। তোমার আন্টি কেমন আছে এখন?

নীলের মুখের দিকে তাকালাম। তার ঠোঁটের কোণে হাসির বিন্দু চক্ষুগোচর হলো। ঠোঁট দুটো নৌকার মতো প্রশস্ত করে বলল

– আংকেল, আন্টি আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছেন। আপনি যখন কল দিয়েছিলেন এর আগেই আপনার মেয়ে আন্টিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে। বাবা বেশ কয়েকবার আপনাদের বাসায় যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি সময় করে উঠতে পারিনি তাই যাওয়া হয়নি। ইনশাআল্লাহ এখন তো পরিচয় হলো। সময় পেলেই চলে যাব। আন্টিকে সিটে দিবে একটু পর, তখন দেখতে পারবেন।

– তোমাকে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। সিঁথি অনেক ছোট। আর আমাদের আশে পাশে কাউকে বলার আক্কেলটাও আমার তখন চলে গেছিল। বিপদে পড়লে এমন অনেক সহজ কাজ কঠিন হয়ে পড়ে। বুঝে উঠার আগেই তোমার বাবাকে কল দিই সেখান থেকে তোমার নম্বর নিয়ে তোমাকে কল দিই।

– আপনি কল দেওয়ার পূর্বে বাবাও কল দিয়েছিল। বাবা আপনার কথা অনেক বলে। আপনাদের ছোট বেলার কাহিনি অনেক শুনেছি। আগে আমাদের বাসায় আসতেন এখন অনেকদিন যাবত আপনি আসেন না তাই একটু দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছিল। আবার হয়তো সব দূরত্ব কেটে যাবে।

– তা যা বলেছো। তোমার বাবাও তো আসতে পারে। সে কবে এসেছিল।

– হুম… এখন তো আমার এখানেই পোস্টিং হয়েছে। বাবা, মা সবাই এখানেই থাকে। এখন যোগাযোগও সহজতর হবে।

আমি শুধু তাদের কথা শুনেই যাচ্ছিলাম। তার মানে নীলের বাবাকে আমার বাবা আগেই চিনে। আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। নীল আমাদের পরিবারের পূর্ব পরিচিত জানলে এ যুদ্ধক্ষেত্রে আমি নামতাম না। তার মানে নীল সবটা জানত। জেনেই আমার সাথে এমন করেছে। আর এজন্য বলেছে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। এটা সে সারপ্রাইজ দিল নাকি বাশ দিল সে ভাবনায় ডুবে আছি আমি। ঢুক গিলতে লাগলাম শুধু। বাবা আমার দিকে তাকাল। আমার মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। এ মুহূর্তে একটু পানি পেলে হয়তো ভালো হত, গলাটা ভিজিয়ে নিতে পারতাম। এমন সময় পানির একটা বোতল আমার চোখের সামনে ধরা হলো। বোতলটা কে ধরেছে উৎস খুঁজতে তার হাত বরাবর এগিয়ে মুখের দিকে তাকাতেই ভয়টা আরও বেড়ে গেল। নীল দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যের একটা হাসি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো অলৌকিক কাহিনি তার হাসিতে রচিত হচ্ছে। আমার মুখটা ততক্ষণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে মনে শুধু এটাই ভাবছিলাম নীল বাবাকে সবটা বলে দিবে না তো! আমার ভাবনা যত বাড়তে লাগল ততই বুকটা ছ্যাত করে উঠছিল। অনেকটা গরম তেলে পানি ছিটা দিলে যেমন বিস্ফোরণ ঘটে আমার বুকের বিস্ফোরণটাও একই রকম ভাবে প্রসারিত হচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা আমার বেরুচ্ছে না। বরাবরেই বাবা অনেক রাগী। এসব জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে। নীল মোলায়েম কন্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল

– সিঁথি রাণী পানিটা খাও। নাহয় তো ভয়েই মরে যাবে। আর সারপ্রাইজটা কেমন হলো!

আমি ভয় পাচ্ছি সে জানল কী করে। ঢুক গিলে তার হাত থেকে পানিটা নিয়ে ফিসফিস করে বললাম

– তোমার কী ধারণা আমি ভয় পাচ্ছি। তুমি কি বাঘ! নাকি ভাল্লুক! নাকি শ্যাওরা গাছের ভূত!

এর মধ্যেই একটা তেলাপোকা কোথায় থেকে উড়ে এসে আমার শরীরে পড়ল। তেলাপোকা পড়ার সাথে সাথে হাত থেকে পানির বোতলটা ফেলে দিয়ে এক লাফ দিলাম। তারপর দুহাত দিয়ে দুকান চেপে চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। বাবা আমার চেঁচানোতে বেশ ভয় পেয়ে আমার কাছে আসলো। আমার দু বাহু ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল

– সিঁথি চেঁচিয়ে উঠলে কেন? কী হয়েছে?

কোনোরকম নিজেকে সামলে দাঁত কামড়ি দিয়ে উত্তর দিলাম

– বাবা তেলাপোকা।

কথাটা বলার সাথে সাথে পাশ থেকে হাসির শব্দ ধেয়ে আসলো। বুঝতে আর বাকি রইল না এ লোভনীয় হাসির সুরটা ডাক্তার সাহেবের। আর এদিকে বাবাও আমাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে উদ্ধার না করে হাসতে লাগল। একদিকে বাবার প্রাণঢালা হাসি অন্যদিকে তার লোভনীয় হাসি। দুই হাসির মূর্ছনার ফলে আমার কানে এসে সে হাসি কর্কশ ভাবে ধাক্কা দিচ্ছে৷ নিজেকে বেশ সামলে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম

– হাসছো কেন এভাবে?

বাবা হাসিটা না থামিয়ে বলতে লাগল

– এত বড় হয়েছিস এখনও তেলাপোকা দেখে এত ভয় পাস?

আরও কিছু বলতে যাবে এমন সময় একজন ডাক্তার এসে জানাল মাকে সিটে দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র একজন দেখা করতে পারবে। যদিও মায়ের সাথে দেখা করার প্রবল ইচ্ছা আমার জাগছে তবে সে ইচ্ছা মলিন করে যে বাবায় মায়ের সাথে দেখা করবে সেটা আমি নিশ্চিত। তাই ইচ্ছার তালে তাল না মিলিয়ে মুখে বাস্তবতার মলিন রেখা চাপা দিয়ে হালকা হাসি এনে বললাম

– বাবা তুমিই যাও দেখা করতে। মা ও খুশি হবে।

বাবা আমার কাঁধে হালকা হাত বুলিয়ে বলল

– তাহলে তুমি থাকো এখানে। তোমার মাকে একটু দেখে আসি।

বলেই বাবা সে জায়গা থেকে প্রস্থান নিল। আমিও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নীলের দিকে তাকালাম। সে এখনও মুখ টিপে টিপে হাসছে। তার হাসিতে মনে হচ্ছে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। কর্কশ ভঙ্গিতে বললাম

– তুমি হাসছো কেন?

হাসির লিরিকটা প্রশস্ত করে বলল

– তেলাপোকা দেখেই এ হাল সে নাকি ভয় পায় না।

মুখটা হালকা ভেঙচি কেটে বললাম

– আমি তেলাপোকাকে ভয় পাইনি। আচমকা গায়ে পড়েছিল তাই একটু চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। কে বলেছে তেলাপোকা ভয় পেয়েছি। এতটাও ভীতুর ডিম আমি না।

কথাটা শুনে সে ভেঙে ভেঙে শব্দ তুলে হাসছিল৷ মৃদু আওয়াজে বলল

– তোমার ঘাড়ের পাশেই আবার তেলাপোকাটা উড়ছে। সত্যিই তুমি অনেক সাহসী।

কথাটা বলার সাথে সাথে পাশ ফিরে তাকাতেই তেলাপোকাটা দেখে তার হাত দুটো চেপে ধরে দাঁত কামড়ি দিয়ে মাথাটা তার বুক বরাবর ঠেঁকিয়ে বললাম

– তেলাপোকাটা সরাও প্লিজ। প্লিজ লাগে সারাও।

তার হাসি বাড়তে লাগল। হুইসেলের শব্দ যেমন আস্তে থেকে উচ্চ হয় তার হাসির শব্দটাও ঠিক তেমন হচ্ছে। আর এদিকে আমি মাথা ঠেঁকিয়ে তেলাপোকা সরানোর জন্য বলেই যাচ্ছি। সে হাসির বিচরণ ভূমিতে অবস্থান করেই বলল

– আগে স্বীকার করো তুমি ভীতু তারপর তেলাপোকা সরাব। এর আগে না।

আমার ভাবান্তরের সমাবেশ হওয়ার পূর্বেই বলে উঠলাম

– আমি ভীতু,ভীতুর ডিম, ঘোড়ার ডিম, সব আমি। শুধু তেলাপোকাটা সরাও প্লিজ। আর কিছু লাগবে না।

নীল আমার হাত থেকে তার হাত দুটো ছাড়িয়ে হালকা হেসে বলল

– তেলাপোকা চলে গেছে এবার বুক থেকে মাথা উঠাও। এরকম একটা তরুণী মেয়ে বৃদ্ধের বুকে মাথা রাখলে সে বৃদ্ধও সজীব হয়ে তরুণ হতে চাইবে।

নীলের কথা শুনে আমি তার বুক থেকে মাথাটা উঠিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। ফ্যানের বাতাসে আমার সামনের চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সেগুলো কপালের কাছে এসে একত্রিত হয়ে আছে৷ নীলের কোমল হাত আমার কপালে পড়ল। চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে তার নেশায় আসক্ত চোখ গুলো দিয়ে আমার দিকে তাকাল। নিস্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ। কল্পনায় থাকা সে প্রেমিকার সত্ত্বা জেগে উঠেছে আমার মাঝে। ভারী ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে অবলীলায় বললাম

– মাথাটা কী ঠেঁকিয়ে রাখা যায় না। তোমার বুকের হার্টবিট পরিমাপ করব। মাথাটা এলিয়ে দিলে কী খুব সমস্যা?

– অনেক সমস্যা। আশে পাশে অনেক মানুষ তারা চিড়িয়াখানার বানর ভেবে তোমাকে সেখানে দিয়ে আসবে। আর হার্টবিট মাপার জন্য তোমার মাথা এলিয়ে দিতে হবে না স্ট্যাথোস্কোপ আছে সেটা দিয়েই মাপা যাবে। এক পাশে একটু বসো। তোমার বাবা এসে এভাবে দেখলে তোমার প্রেম ছুটাবে।

বাবার কথা বলতেই আমার জেগে উঠা প্রেম সত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটল। দ্রূত পরিসরে মাথাটা সরিয়ে নিলাম। তারপর গজগজ করে বললাম

– তুমি আমার বাবাকে বলে দেওয়ার ফন্দি আটতেছো?

নীলের ঠোঁটের কোণে ইষৎ হাসি।

– অকালে পেকে গেছ সেটা তো বাবাকে জানাতেই হয়… কী বলো?

ভয়ে ঢুক গিলতে গিলতে বললাম

– প্লিজ বাবাকে এসব কিছু বলো না। দরকার নেই আমার ফেক প্রেমের। দরকার নেই আমার বাজি জেতার। তুমি যা চাও তাই হবে। আমার এতে কোনো দোষ ছিল না। বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে বিগড়ে গেছিলাম এই আর কী।

নীল আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখের নেশায় আরও আসক্ত হচ্ছি। এ চোখ আমায় এত টানছে কেন? কেন এ চোখ আমায় তার আড়ষ্ঠে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেনই বা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে মন চাচ্ছে আমি তোমাকে অস্তিত্বে মিশিয়ে বিলীন করে দিতে চাই। সে বলে উঠল

– যত দোষ নন্দঘোষ। এখন সব বান্ধবীদের দোষ তাই না? বলো বান্ধবীরা তোমার পাল্লায় পড়ে বিগরে গেছে। আর মেসেজটা তো এত তাড়াহুড়োই পড়তেই পারো নি। একদম বাসায় গিয়ে যখন একা থাকবে তখন মেসেজটা পড়ে চোখ বন্ধ করে থাকবে। এখন কিন্তু একদম পড়বে না। আর এমন পাকামো আরও করলে তোমার বাবাকে বলতে বাধ্য হব।

– তুমি যা ইচ্ছা করো আমার কী। তোমার বলাতে আমার কিছুই হবে না।শুধু শুধু সময় নষ্ট করবে আর কী। আর আমাকে এত সাহায্য করেছো তাই মেসেজ পড়ার বিষয়টায় তোমার কথা মেনে নিলাম। বাসায় গিয়েই পড়ব। আর বাবাকে নালিশ দিলেও লাভ নেই। কারণ বাবা আমার, আমি জানি বাবা কতদূর যাবে।

– সে দেখা যাবে কার বাবা আর কে কী করবে। এত ফুসফুস করো না সাপের মতো। এমনিতেই চোখ গুলো নীলবর্ণের, দেখতে সাপের মতোই লাগে।

নীল কথা গুলো বলে মুচকি হাসলো। কথাগুলো শুনার সাথে সাথে গালটা ফুলিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে পড়লাম। কোনো কথা নেই দুজনের মধ্যে। নীরব নিস্তব্ধতার সুর বেজে উঠছে। বীণার তাল লয়ে কী এক অদ্ভুত ছন্দ কল্পনায় এসে কানে বাজছে। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখগুলো বড় বড় করে আছে। কপালে ইষৎ ঘামের সমাবেশ তার। আমি শুধু তার তাকানোতে সায় দিয়ে বললাম

– কখনও হারিয়ে খেলে আমায় খুঁজবে তো?

সে আমাকে চোখে দিয়ে ইশারা করে পাশে ইঙ্গিত করল। আমি সে দিকে নজর না দিয়ে পুনরায় বললাম

– আমাকে কী আপনার অনুভূতির কোনো শাখায় মনে পড়বে না হারিয়ে গেলে, নাকি তলিয়ে যাব হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে।

সে আবার পাশে ইঙ্গিত করল। বিরক্তির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকিয়েই থমকে গেলাম। আমার পিতা মহোদয় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দিকে সন্দেহের ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বলে উঠার আগেই তিনি কথা বলতে শুরু করলেন।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here