ডাক্তার সাহেব পর্ব-৪৯ ( ২য় অংশ)

#শারমিন আঁচল নিপা

সিঁথি লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে পরের কাহিনি বলা শুরু করল।

– তোমার বাবার পরের কথাটা শুনে আমি পুরো জীবিত লাশ হয়ে গিয়েছিলাম।

নীল নীচু গলায় বলল

– সিঁথি মেয়েটাকে মেডিকেল টেস্ট করে জানা যায় যে মেয়েটাকে তিনজন ধর্ষণ করেছে। ঐ রুমে আমি শোভন আর রবিন ছিলাম। এছাড়া কেউ ছিল না। তৃতীয় কে এসে ধর্ষণ করেছে সেটা আমি জানি না। আমি তো অচেতন হয়ে পড়ে ছিলাম। একবার মনে হয় আমি কী অচেতন হয়ে নেশার ঘোরে কিছু করে বসলাম না তো? পরক্ষণেই মনে হয় এমন কিছু করলে একটু চিন্হ তো আমার শরীরে থাকত। মানে খামচির দাগ বা কোনো দাগ। কারণ মেয়েটা তো নিজেকে বাঁচাবার জন্য হলেও আমাকে ছুটাতে চাইত। আর আমিও এমন করার পর স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতাম না। আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি একদম স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম। তবে বিশ্বাস করো আমি এমন কিছুই করিনি। রবিন শোভন ছাড়া আর কে এ কাজ করেছে আমার জানা নেই। রবিন আর শোভনের সাথেও আমার যোগাযোগ নেই। নাহয় তাদের জিজ্ঞেস করলে একটা হদিস মিলত। আমার কাছে আর উপায় নেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার। আমি আজকে পুলিশের কাছে নিজেকে সমর্পণ করব। সিঁথি আমাকে মাফ করে দাও। আমি চাইনি কখনও তোমাকে ঠকাতে। আমি কিছুই করিনি। তবুও আমাকে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। এ নিষ্ঠুর পরিণতির সম্মুখীন হব কল্পনাও করতে পারিনি৷ নেশা মানুষকে পশু বানিয়ে দেয়। বানিয়ে দেয় উন্মাদ মাতাল।

নীল পুনরায় বলল

– সিঁথি আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও৷

বলেই তোমার কপালে দুটো চুমু দিয়ে চলে গেল। আমি শুধু তোমার বাবার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পিছু ডাকবার কোনো উপায় আমার ছিল না। পিছু হটারও কোনো উপায় ছিল না। কলিজায় মনে হলো কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে আমায়। আমার কষ্টটা সেদিন চাপা দিয়েছিলাম তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে। নাহয় হয়তো এ জীবন আমি রাখতে পারতাম না। আমি শেষ হয়ে যেতাম। সেদিন বাসায় ফিরি অনেক রাত করে। বাসায় আসার পর থেকেই তোমার বাবার কথাগুলোই যেন মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। শুধু ভাবছিলাম এ দুঃস্বপ্নের ঘোর কবে কাটবে। তবে তিতা হলেও এটাই সত্য যে দীর্ঘ ১৬ বছরেও এ দুঃস্বপ্নের বেড়াজাল থেকে আমি বের হতে পারছি না। সব যেন আরও ঘিরে ধরেছে।

রুবু চুপ হয়ে আছে। বাবাকে কত কিছুই না সে ভেবেছিল। মায়ের কষ্টটা যেন রুবুকে আরও ঘিরে ধরেছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে তার। নিজেকে সামলাবে নাকি মাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না। অতি কষ্টে মানুষ নীরব হয়ে যায়। সিঁথি আর রুবুর মধ্যেও একই বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। নীরবতা বিরাজ করল অনেকক্ষণ। নীরবতা কাটিয়ে রুবু তার মাকে প্রশ্ন করল

– মা দাদু কেন মারা গিয়েছিল?

সিঁথি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল

– পরদিন সকালে নীল আত্মসমর্পণ করে। আর সেটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তোমার দাদু নিজের ছেলের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারেনি। তাই খবরটা শোনার সাথে সাথেই স্ট্রোক করে মারা যান। সুখের সময় যেন খুব দ্রূতই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখনও সে বিষের প্রভাব বিরাজ করছে। সবকিছু ঠিক চললেও মনের গহীনের শূন্য জায়গাটা যেন আজও তোমার বাবাকে ছাড়া শূন্যই রয়ে গেছে৷ তোমার নানা নানু নীলকে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারা ভেবেই নিয়েছে নীল এমন করেছে। তাই বহুবার বলেছিল আরেকটা বিয়ে করে নিতে। কিন্তু আমি নীলকে ছাড়া অন্য কাউকে কীভাবে ভালোবাসব বলো! আমার ভেতরে বাহিরে প্রতিটা শিরায় উপশিরায় যে শুধু নীলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমি অন্য জায়গায় বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তেমার নানা নানুও আমার সাথে তেমন কথা বলে না। তুমি তোমার রুমে যাও এবার। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। রাত তিনটে বেজে গেছে।

রুবাইয়ার মনে অনেক প্রশ্ন এখনও আছে যেমন রবিন আর শোভন ধরা পড়েছিল কী না? তাদের কী পরিণতি হয়েছে? তৃতীয় কোন ব্যাক্তি মেয়েটাকে আবার ধর্ষণ করেছিল? এত প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও সে আর কোনো কথা বাড়াল না সোজা উঠে তার রুমে চলে গেল। সিঁথি চুপ হয়ে বসে আছে। এর শেষ কোথায় সিঁথি জানে না। সিঁথির বুকে কেমন জানি ব্যথা হতে লাগল। ডায়রি বের করে পুনরায় লিখতে শুরু করল। দীর্ঘ ১৬ টা বছর এ ডায়রিটায় তার সঙ্গী ছিল। নীল বলেছিল সিঁথিকে ডাক্তার হতে সিঁথি নীলের কথা রেখেছে। তার শ্বশুর বাবা যদি পাশে না থাকত তাহলে হয়তো এ কঠিন পথ পারি দেওয়া আরও কঠিনতর হয়ে যেত। একটা ভুল যেন সব ধ্বংস করে দিল। আজকাল রিদির কথাও সিঁথির খুব মনে পড়ে। বারবার জানতে ইচ্ছে করে রিদিকে কে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিল। যদি একটা বার জানতে পারত তাহলে হয়তো মনে শান্তি পেত। রিদির অকাল মৃত্যুটাও সিঁথিকে বছর খানেক আগে বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। নীলকে আজ কেউ বিশ্বাস করছে না। পুরো দুনিয়া নীলের বিরুদ্ধে এমনকি সিঁথির বাবা মাও, তবুও সে নীলকে বিশ্বাস করেছে। মনের গহীনে এখনও আলিঙ্গন করে রেখেছে তাকে। মাঝে মাঝে নীলকে কল্পনা করে। নীলকে নিয়ে সুখের সংসার কল্পনায় বুনে। সে কল্পনাতেও যেন কোনো এক কালো ছায়া এসে সব তছনছ করে দেয়। আজকাল কল্পনা করতেও সে ভুলে গেছে। ডায়রিটার পাতা ভর্তি করে মান অভিমানের শত কথা লিখে শেষ করল সিঁথি। এবার মাথাটা এলিয়ে দিল বিছানায়। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে বন্ধ হলো তার। ভীষণ অশান্তি হচ্ছে তার। পুরনো ক্ষতটা যেন আবারও তাজা হয়ে উঠেছে। এ ক্ষতের রক্তক্ষরণ যেন কমছেই না।

এদিকে রুবাইয়া কেমন জানি নীরব হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে ভীষণ বড় একটা পাথর তার বুকে চেপে ধরেছে শত চেষ্টা করেও নামাতে পারছে না। একটু কাঁদলে হয়তো ভালো লাগত। তবে কান্না যেন নামছেই না চোখ দিয়ে। পাথরের মতো স্তবির হয়ে আছে সে। নিজের বাবার এমন করুণ পরিণতি শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কেন যে শুনতে গেল। এখন মনে হচ্ছে কিছু সত্য অপ্রকাশিত থাকলেই হয়তো ভালো হত।

মসজিদ থেকে আল্লাহু আকবার বলে আজানের শব্দ রুবাইয়া আর সিঁথির কানে আসলো। আজানের শব্দটা শুনেই সিঁথি তার গালে গড়িয়ে পড়া চোখের জলটা মুছে অজুর জন্য ওয়াশরুমে গেল। রুবাইয়াও নিজেকে সামলে ওয়াশ রুমে গিয়ে অজু করে নামাজে দাঁড়াল। ফজরের নামাজ শেষে দুহাত তুলে বলল

” হে আমার রব আপনাকে ডেকে আমি কখনও নিরাশ হয়নি। কখনও আপনি আমায় হতাশ করেননি। সবসময় আমার জীবনে যেটা উত্তম সেটা দিয়েছেন। আপনার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি আমার একমাত্র রব। আপনাকে ছাড়া আমার চাওয়ার কেউ নেই। একমাত্র দেওয়ার মালিক আপনি। আল্লাহ আপনি তো রহমান, আপনি তো ক্ষমাশীল। আমাদের কোনো ভুল থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন। আমার বাবাকে মুক্ত করে দিন। আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই। আমি অন্য সবার মতো বাবার বুকে মাথা রাখতে চাই। আমি জানি আপনি আপনার বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। আমি এটাও জানি আপনি আপনার বান্দার নেক ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না। আপনার প্রিয় বান্দাদের কঠিন পরীক্ষা দেন। হয়তো আমার বাবা, মা আপনার প্রিয় তাই এত পরীক্ষা নিচ্ছেন। আল্লাহ আপনি দয়ালু আমার বাবা,মা কোনো ভুল করে থাকলে তাদের ক্ষমা করে এক করে দেন।”

বলতে বলতেই রুবাইয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল।এতক্ষণের চাপা কান্না যেন এখন বিস্ফোরিত হয়ে বের হলো। মোনাজাত শেষে রুবাইয়া খাটে বসে শুধু বাবার কথায় ভাবতে লাগল।

অপরদিকে সিঁথি দুহাত তুলে বলল

– আল্লাহ আমি জানি আমার এ কষ্টের প্রহর অতিদ্রূত শেষ হবে। আমি সবর করতেছি আপনি আমাকে ধৈর্য দিন। আপনার কাছে একটায় চাওয়া শেষ অধ্যায়টা শুধু সুন্দর করে দিয়েন। আপনি মহান, আপনি আপনার এ অসহায় বান্দার সহায় হোন।

এদিকে নীলের বাবার রোজকার চাওয়াও তার ছেলের মুক্তি। সিঁথি নামাজটা শেষ করে চেয়ারটা টেনে বসলো। শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না তার। মাইগ্রেনের ব্যথাটাও চড়াও দিচ্ছে। চোখ দুটো ফুলে আছে কাঁদতে কাঁদতে। এর মধ্যেই সিঁথির ফোনে একটা কল আসলো। সিঁথি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে কিছুর আভাস পেল। রুবাইয়া তখন মায়ের রুমে এসেছে সবে। মায়ের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে কেউ হয়তো জটিল কিছু বলছে। সিঁথি মোবাইলটা রেখেই যেরকম ছিল সেরকমেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়তে নিল। রুবাইয়া তার মায়ের পিছু ডেকে বলল

– মা কোথায় যাচ্ছ?

সিঁথি শুধু একটা উত্তরেই দিল

– জীবনের শেষ অধ্যায় খুঁজতে যাচ্ছি।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here