ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৪৫
#শারমিন আঁচল নিপা
ক্রমশেই অস্থিরতা বর্ধমান হতে লাগল। দম নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবুও অনেকটা শক্তি খটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– আগে বলুন আমার সন্তান কেমন আছে? আপনি কথা এড়িয়ে কেন যাচ্ছেন?
নার্স আমার উত্তেজনা টের পেয়ে আমার কাছে এসে বেশ নম্র গলায় উত্তর দিলেন
– আপনার মেয়ে হয়েছে। সাতমাসে বাচ্চা হলে একটু জটিলতা তো থাকেই। তবে চিন্তা করবেন না যা হবে ভালোর জন্য। উত্তেজিত হয়ে আপনি আপনার শরীর খারাপ করবেন না। আপনার শরীর যথেষ্ট দূর্বল। আমি ডাক্তার অনীল সাহেবকে আপনার জ্ঞান ফেরার কথাটা জানিয়ে আসি। তিনি অনেক চিন্তায় ছিলেন। আপনাকে অনেক ভালোবাসেন উনার চেহারায় তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল।
নীলের কথা এখন আমার মাথায় একটুও আসছে না। আমার মাথায় শুধু আমার মেয়ের চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি নিজেকে একটু শান্ত করে বললাম
– আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে চলুন।
– আপনি আরও শান্ত হোন। আপনার মেয়েকে এখন আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে। সেখানে একমাসের মতো রাখতে হবে। নাহয় বাচ্চার অবস্থা খারাপ হবে। একটু ধৈর্য ধরুন আর আল্লাহকে ডাকুন।
নার্সের কথায় আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম আমার মেয়ে বেঁচে থাকলেও অবস্থা বেশ জটিল। মেয়ের চিন্তায় যেন আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মন থেকে শুধু এ দোয়ায় করছিলাম আমার মেয়েটাকে যেন আল্লাহ সুস্থ করে দেন। নীলকে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসার বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে আমার সন্তান। কী মায়া সেটা বর্ণাণা করা বরাবরের মতো কঠিন।
বেলা বাজে ১ টা। বাইরে ভর দুপুর। গরমও পড়েছে বেশ। তবে আমার ভীষণ শীত করছে। মাথায় কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। ভেবেছিলাম নীল কিন্তু চোখটা মেলে লক্ষ্য করলাম মিহু। মিহুকে দেখেই অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলাম
– আমার মেয়েকে দেখেছিস? মা, বাবা, নীল, তামান্না কোথায়? আমার বাবা,মা এসেছে?
মিহু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জবাব দিল
– সবাই ঠিক আছে৷ বাইরে অপেক্ষা করছে।
ভেতরটায় কেন জানি হালকা কষ্ট অনুভূত হলো মিহুর কথায়। নীল বাইরে আছে তবুও আমার কাছে আসলো না! মুখটা মলিন করে মিহুকে বাকি কথা বলতে না দিয়েই বলে উঠলাম
– নীল বাইরে থেকেও আমাকে দেখতে আসলো না?
মিহু হালকা ধমক দিয়ে উত্তর দিল
– আরে বোকা ভাইয়া ব্লাড আনতে গেছে৷ তোকে তো ব্লাড দেওয়া লাগবে। ডোনারের সাথে কথা বলতে গেছে। বাকিরা বাইরেই আছে। একজন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিবে না। আমার সাথে তো তুই ফ্রি তাই আমাকে বলেছে তোর সাথে কথা বলতে। কোনো সমস্যা হলে জেনে নিতে।
আমি উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– আমার মেয়েকে দেখেছিস? কার মতো হয়েছে রে? ওর বাবার মতো নাকি আমার মতো? আমার মেয়েটা ভালো আছে তো? খুব চিন্তা হচ্ছে।
মিহুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। চুপ হয়ে ছিল কতক্ষণ। তারপর নীচু সুরে উত্তর দিল
– হুম দেখেছি। তবে বাবুকে গ্লাসের ভেতর রেখেছে। চোখ ফুটেনি এখনও। তুই এত চিন্তা কেন করছিস?
– চিন্তা কী আর ইচ্ছা করে করি। চলে আসে৷
– ভাবিস না বাবু একদম তোর মতো হয়েছে। চোখ তো ফুটে নি তাই বলতে পারছি না চোখ কার মতো হয়েছে। বাবুর নাক, মুখ,গায়ের রঙ একদম তোর মতো। যদিও ভালো করে দেখতে পারিনি।
আমি মুচকি হাসলাম। শান্ত গলায় বললাম
– বাবুর একটা ছবি তুলে এনে দেখাবি।
– সময় দে সিঁথি। আর তো কিছুদিন। আর বাবুর কাছে কাউকে যেতে দিবে না এখন।
– আচ্ছা বাবু খাচ্ছে কী?
– বাবু তো দুধেই খাবে। তোর অবস্থা ভালো ছিল না তাই আরেকজন মহিলা তোর বাবুকে দুধ দিয়েছে।
– আমার বাচ্চাটা আমার দুধ পাচ্ছে না। ইশ কত কষ্টই না আমার বাচ্চাটা করছে।
– সব ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। নাহয় তোর বাচ্চার দুধের কষ্ট হবে। তুই না খেলে বাবু দুধও পাবে না৷ আর ঐ মহিলা তো সবসময় দুধ দিবে না। খাবি কী?
– খুব ভাত খেতে মন চাচ্ছে। আমি কী ভাত খেতে পারব?
– এখন নরম খাবার খেতে হবে। স্যুপ এনে দিই তোকে?
মাথা নেড়ে আচ্ছা বললাম। মেয়েটাকে দেখার জন্য মন যেন ছটফট করছে আমার। উঠতে পারলে নিজেই হেঁটে চলে যেতাম। সে সৌভাগ্য আমার নেই এখন।
দেখতে দেখতে দুদিন পার হলো মেয়েটার মুখ এখনও দেখতে পারলাম না৷ বাচ্চার দুধ লাগলে আমার কাছ থেকে এসে নিয়ে যাচ্ছে। আমার শারিরীক অবস্থা উন্নতি না হওয়ায় বাচ্চার কাছে যেতে পারেনি৷ আমাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলো। দুইজন মা আমার পাশে বসে আছে। তাদের দিকে তাকালাম। অপলক দৃষ্টিতে তাদের কিছুক্ষণ দেখলাম।
– মা হওয়া কতটা সংগ্রামের মা না হলে বুঝতে পারতাম না। সন্তানের টান কত প্রখর এখন সেটা টের পাচ্ছি।
আমার মা হালকা হেসে জবাব দিল
– আমার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। অথচ তোকে দেখলে মনে হয় এই তো কিছুদিন আগে আমার কোল আলো করে এসেছিলি। আর এখন তোর কোলেই সম্তান চলে এসেছে। সময় কত দ্রূত চলে যায়।
নীলের মা ও দম ছেড়ে বলল
– একে একে পাঁচটা বাচ্চার জন্ম দিয়েছি। কত বড় হয়ে গেছে সবাই। তবুও মনে হয় সবাই কত ছোট। মায়ের কাছে সব সন্তানেরাই নাড়ি ছেড়া ধন। এ মায়া কাটানো যায় না কখনও৷ সন্তান ফেলে দিলেও মা কখনও সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না।
তারপর তিনি দম টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বললেন
– সিঁথি তোমার বড় আপারা এসেছিল। তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে তাই ঘুম থেকে আর ডাকে নি৷ কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছে। হাসপাতালে ভীড় জমিয়ে তো লাভ নেই। মিহু আর তামান্নাও তাদের সাথে গেছে৷ তোমার দুই বাবাও তোমার বড় আপাদের বাসায়।
আমি নম্র গলায় বললাম
– নীল কোথায়? দুদিন যাবত নীলকে দেখছি না। মিহু বলেছিল ব্লাড আনতে গিয়েছিল এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি৷ শরীর খারাপ থাকায় খোঁজ নেওয়ারও সুযোগ পাইনি৷ নীলের কী কিছু হয়েছে?
– নীল একটা কাজে গেছে মা। ও আজকে রাতে আসবে। ডাক্তারদের তো জীবন এমনই মা। কী আর করার। তুমি মন খারাপ করো না। আজকে রাতেই আসবে বলল। তখন নাহয় মান অভিমানের পালা শেষ করে নিও৷ এখন একটু স্থির হও৷
– তাই বলে কী একটা বারও কল দিয়ে কথা বলবে না? আমাকে তো একটা বারও কল দিয়ে চাইনি ও। একটা বারও তো কল দিয়ে খোঁজ নিল না৷ আমার সাথে কথা বলল না। এত ব্যস্ততা কিসের ওর। আপনাদের সাথে কী কথা হয়েছে?
মা নীচু গলায় বলল
– ও মনে হয় ভীষণ ব্যস্ত। যখনই কল দিয়েছি কেটে দিয়েছে। একবার ধরে বলল আজকে রাতে আসবে। এরপর আর কল ধরেনি৷ হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমিও বুঝতেছি না ব্যপারটা কী। জটিল কোনো কাজে ফেঁসে গেছে হয়তো। তুমি চিন্তা করো না।
মা খুব স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টা নিলেও আমি নিতে পারছিলাম না। নীল হয়তো কোনো বিপদে পড়েছে নাহয় এমন করার কথা না। আমার মেয়েকে আর আমাকে না দেখে থাকতে সে পারবে না। আমি মোবাইলটা নিয়ে বেশ কয়েকবার কল দিলাম নীলকে। কিন্তু নীল ফোনটা তুলল না। আজকে শরীরটা বেশ ভালো লাগলেও নীলের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে৷ এর মধ্যেই একজন নার্স এসে বললেন
– বাবু কান্না করছে। মাকে নিয়ে আসুন। মা তো সুস্থ এখন। বাবুকে খাওয়াতে হবে৷
নীলের মা আমার হাতটা ধরে শুয়া থেকে তুলে বলল
– হাঁটতে পারবে নাকি হুইল চেয়ার আনব?
আমি নিজেকে একটু সামলে বললাম
– আস্তে করে হেঁটে যাই আশা করি সমস্যা হবে না।
অতঃপর আস্তে করে হেঁটে বাবুর কাছে গেলাম। ছোট পুতুলের মতো আমার মেয়েটা। চোখটা বন্ধ করে আছে। আমি আজ তাকে প্রথম দেখলাম। প্রথম তাকে স্পর্শ করলাম। বিশাল অনুভূতির সমাবেশ ঘটল। কান্না করছে এক নাগারে। মুখটা লাল হয়ে গেছে। আমি কোলে নিলাম৷ বাচ্চা কোলে নেওয়ায় এত অভ্যস্ত না হলেও আমার মেয়েকে আমি কোলে নিতে পেরেছি বেশ ভালোভাবেই। আমার বুকের সাথে একদম মিশে আছে৷ বাবুকে কিছুক্ষণ খাওয়াতেই বাবু কান্না থামিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বাবু ঘুমুতেই পুনরায় বাবুকে কাঁচের ঘরে রাখা হলো আর আমি চলে আসলাম কেবিনে।
কেবিনে আসার পর থেকেই নীলের জন্য মনটা কাঁদতে লাগল। আমার মা ও বড় আপাদের বাসায় গেছে। আর নীলের মা কেবিনের নীচে বিছানা পেতে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। নীল আজকে আসার কথা থাকলেও আসেনি। আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করলাম নীল কল দিয়েছে। আমি কলটা ধরে হ্যালো বলতেই নীলের অগোছালো কন্ঠ কানে আসলো। নীলের কন্ঠ শুনে যেন আমার বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠল।
চলবে?
কপি করা নিষেধ।