ডাক্তার সাহেব পর্ব-৪২
#শারমিন আঁচল নিপা
বাবা বেশ বিচলিত গলায় বললেন
– সিঁথিকে একটা মানসিক ডাক্তার দেখাও। ঐদিন লক্ষ্য করলাম দেয়ালের রঙ হাত দিয়ে খুটে তুলে তা খাচ্ছে। ভাবলাম হয়তো আমার মনের ভুল বা দেখার ভুল। কিন্তু পরে নিশ্চিত হলাম এটা আমার মনের ভুল না। পর পর কয়েকদিন এমন দেখলাম। এরপর দেখলাম তোমার মায়ের দাঁতের ছাই ঢেলে ঢেলে খাচ্ছে। এরপর লক্ষ্য করলাম বেলকনীর টব থেকে শক্ত মাটি তুলে মুখে দিচ্ছে। গতকালকের আগের দিন লক্ষ্য করলাম দাঁতের পেস্ট খাচ্ছে। প্রথম দিন বিষয় টা আমার চোখে পড়তেই ওর উপর তদারকি করেছিলাম আমি, তারপর এগুলো আবিষ্কার করলাম। এটা তো ভালো লক্ষ্যণ না। পেট খারাপ করবে যেকোনো সময়। এসময় এসব খেলে তো বাচ্চারও ক্ষতি হবে। সে তো আর বাচ্চা না, এমন কেন করছে? নিশ্চয় কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগতেছে। অল্প বয়সে মা হতে চলেছে তো তাই হয়তো মানসিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে এমনটা হয়েছে।
বাবা যা বলেছে মিথ্যা না। তবে ইদানিং আমার এরকম অদ্ভুত খবার খেতে বেশ মন চায়। কেন মন চায় বলতে পারব না। বিষয়টা কাউকে না জানিয়ে সবার আড়ালে গিয়েই খেতাম। কখন যে বাবার নজরে চলে গেলাম টের পাইনি। আমি চুপ হয়ে মথা নীচু করে বসে আছি। বাবার দিকে তাকাবার সাহস হচ্ছে না। লজ্জায় আমার মাথা একদম অবনত হয়ে আছে। নীল বাবার কথার উত্তরে বলল
– এ সময়টায় হরমোনের সমস্যার জন্য এরকম হয়ে থাকে। তুমি চিন্তা করো না আমি বিষয়টা দেখতেছি। ওকে একটু নজরে রাখতে হবে । তামান্না আর মিহুকে আমি বলে দিব।
– সেটা তুমি যা ভালো বুঝো করো। আজকে শুনলাম ও নাকি ভাতের সাথে চাল খেয়েছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার। তোমরা এতগুলো ভাই বোন হয়েছো তোমার মাকে তো এমন করতে কখনও দেখলাম না।
– বাবা বিষয়টা সবার হয় তা না। কারও কারও হয় এমন। সিঁথিও সে অল্প কয়েকজনের মধ্যে পড়ে গেছে। তুমি চিন্তা করো না আমি বিষয়টা দেখতেছি।
– আচ্ছা গেলাম।
কথাটা বলে চলে যেতে নিয়েও পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– মামনি তোমার যা খেতে মন চায় আমাকে বলবে। এসব মাটি, পেস্ট হাবিজাবি খেয়ো না। তোমার বাবা শুনলে তো ভাববে আমি তার মেয়েকে খাওয়াই না। এমন আর করো না কেমন?
আমার মুখ লজ্জায় যেন এবার লাল হয়ে গেল। চুপ হয়ে বসে শুধু মাথাটা নেড়ে গেলাম। বাবা রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। এদিকে আমার অবস্থা কতটা সমিচীন আমি বুঝতে পারছি। অখাদ্য খাই সেটা তো আর ইচ্ছা করে না। বিশেষ করে লোভ সামলাতে পারি না। এসব কেন জানি না অনেক ভালো লাগে। এত ভালো লাগা কাজ করে কী বলব। সব মিলিয়ে হয়ে যায়। নীল আমার পাশে বসে নম্র গলায় বলল
– সিঁথি এগুলো খাওয়া ঠিক না। বাবা ভুল কিছু বলেনি যেকোনো সময় তোমার পেট খারাপ করতে পারে। এতে বাবুর সমস্যা হবে৷ খেতে মন চাওয়াটা অস্বাভাবিক না তবে এরকম টা আর করো না কেমন। দরকার হলে চাল খাও তবুও ঐসব অখাদ্য আর খেয়ো না কেমন।
নীলের দিকে তাকালাম। চোখে আমার জল ছলছল করছে তবে কষ্টে না লজ্জায়। আজকাল কেন জানি না আগের মতো নিতে পারি না কিছু। আগে যেটা ভালো লাগত এখন সেটা চরম বিরক্ত লাগে। নীল আমার চোখের জলটা পড়ার আগেই আমার চোখ দুটো তার হাত দিয়ে চেপে ধরে মুছে বললো
– কিছু বলার আগেই প্যাকপ্যাক করে কাঁদা শুরু করে। হয়েছে কাঁদতে হবে না। আমি কিছু মনে করেনি। এমনটা হয়েই থাকে। বাবাও কিছু মনে করেনি। এখন কান্না বন্ধ করে ঘুমাও। সকাল বেলা আমার কাজ আছে অনেক।
আমার মনটা তখন খারাপ হয়ে গেল। বেশ রাগ নিয়েই শুয়ে পড়লাম। ইদানিং মনের ও তেমন গতি বুঝি না। এই ভালো লাগে আবার এই অযথায় খারাপ হয়ে যায়। পড়াশোনা তো ডাব্বা হয়েই আছি। মিহু কত সুন্দর করে মন দিয়ে পড়ছে, রেগুলার ক্লাসে যাচ্ছে সেখানে আমি সারাদিন শুধু বাসায় বসে সময় পার করছি। পরীক্ষা গুলোতে কোনোরকম এটেন্ড করে আসা হয়। এ অসময়ে বাচ্চা নেওয়া সত্যিই উচিত হয়নি আমার এখন মনে হচ্ছে। আমি মন খারাপ করে অনেক কিছুই ভাবতে লাগলাম। নীলের একটা হাত আমাকে জড়িয়ে নিল। নীল ঘুমে তলিয়ে পড়েছে। কীভাবে যেন শুতেই নীল ঘুমিয়ে যায়। এদিকে আমার ঘুম হচ্ছে না। এখন একা একা শুয়ে থাকতেও মন চাচ্ছে না। নীলকে জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বললাম
– উঠো। উঠে আমার সাথে গল্প করো। একা একা শুয়ে থাকতে মন চাচ্ছে না। প্লিজ উঠো।
বড় একটা হাই তুলে নীল শুয়া থেকে উঠে বসলো। ঘুমে তার চোখ ভার হয়ে আছে। ঘুম ঘুম চোখে বলল
– কী বলবে বলো। কাল কাজ আছে বললাম তবুও শুনলে না। একটু ঘুমালে ভালো হত।
– আচ্ছা ঘুমাও।
নীল পুনরায় শুয়ে পড়ল। এদিকে কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর আমার মনটা আবারও আনচান করতে লাগল। আবারও নীলকে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে শুরু করলাম। নীল পুনরায় উঠে ঘুম ঘুম গলায় বলল
– একটু ঘুমানো দরকার নাহয় কাল সারাদিন কাজ করতে পারব না।
পুনরায় গম্ভীর গলায় বললাম
– আচ্ছা ঘুমাও।
কিছুক্ষণ পরে আবারও নীলকে ডাকলাম। এ ডাকাডাকির পালার ক্রম চললো অনেকক্ষণ। একটা সময় ডাকতে ডাকতে আমি নিজেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল বেলা উঠতে একটু দেরিই করে ফেলেছি। ফজরের নামাজটা কাযা পড়তে হলো৷ নীল উঠে কাজে চলে গেছে অনেক আগেই। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তাই হয়তো ডাকেনি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে লক্ষ্য করলাম নীলের এস এম এস।
“ঘুমন্ত পরী উঠে নাস্তা করে নিও৷ আর হাবিজাবি খেয়ো না। বাবার নজরে তুমি। ভুলে যেও না।”
মেসেজটা পড়ার পর পুনরায় গতকালের ঘটনা মনে করে লজ্জা লাগছিল ভীষণ। তামান্নার কন্ঠ কানে আসলো।
– ভাবি আসবো কী।
– আরে আসো। মিহু কোথায়?
– কোচিং এ গেছে।
– তোমার কোচিং নেই।
– আমি তো অন্য গ্রূপে। আম্মা জিজ্ঞেস করতেছিল আপনি কী খাবেন জানার জন্য। আর গতকাল বাবা বলল আপনি নাকি দাঁতের পেস্ট খান। এগুলো খাওয়া ঠিক না ভাবি।
লজ্জায় মাথাটা কেটে ফেলতে মন চাচ্ছে। আমার এ কুকর্মের কথা এখন সবাই জানে। তবুও নিজেকে একটু সামলে হেসে উত্তর দিলাম
– বাদ দাও না সেসব কথা।
তামান্না শুধু মুচকি হাসলো। তামান্নার হাসির তালের সাথে আমি যোগ দিয়ে বললাম
– আমার জন্য ঝাল করে ভর্তা ভাত করতে বলো। মরিচ পিঁয়াজ ভর্তা হলে অনেক ভালো হয়।
তামান্না আমার কথা শুনে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি তামান্নার বিস্ময় দেখে জিজ্ঞেস করলাম
– কী হয়েছে এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন?
– আপনি না ঝাল খেতে পারেন না।
– এখন ঝালেই ভালো লাগে।
তামান্না আর কোনো কথা বলল না। সোজা চলে গেল খাবার আনতে। আর আমিও বসে বসে ভাবছিলাম প্রেগনেন্সি একটা অদ্ভুত টার্ম। কখন কী করতে মন চায় বলা যায় না। সবসময়ের স্বাভাবিক রুটিনটাও এসময় বদলে যায়। একটা সন্তান জন্ম দিতে একটা মাকে কতই না ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
তামান্না আধা ঘন্টার মধ্যেই খাবার নিয়ে আসলো। সরিষার তেল দিয়ে মরিচ পিঁয়াজ ভর্তা আর গরম গরম ভাত। আর তর সইছে না। তামান্নার হাত থেকে ভাতের থালাটা নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। বেশ তৃপ্তি নিয়েই খেলাম। খাওয়া শেষ করে শুতে যাব এমন সময় মনে হচ্ছে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করল।
চলবে?
কপি করা নিষেধ।