ডাক্তার সাহেব পর্ব- ৪০
#শারমিন আঁচল নিপা

দরজা খোলার সাথে সাথে থমথমে এক ঘটনার সম্মুখীন হলাম। চারপাশ বেশ চুপচাপ। মা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই মা আরও চুপসে গেল। মায়ের এ মতিগতির সাথে আমি পরিচিত না৷ নীল মাকে কিছুটা ভাবান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করল

– আম্মা কিছু কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?

মা দম টেনে পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিয়ে বলল

– তোর মোবাইল কোথায়? সিঁথির মা তোকে কল দিচ্ছে, তোর ফোন বন্ধ কেন?

– মোবাইলটা হাত থেকে পরে ভেঙে গেছে। কেন কী হয়েছে বলো। সিঁথির নম্বরে কল দিলেও তো পারত।

মা নীলের হাতটা টেনে ঘর থেকে বের করল। হয়তো বেশ গোপন কথা। কিন্তু কী কথা? সেটা শুনলে কী আমার অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে? আমি কী এগিয়ে গিয়ে শুনব কী বলছে মা নীলকে। নাহ! মা ছেলে কথা বলছে এ জায়গায় আমার যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ মা তো কখনও আমাকে অন্য চোখে দেখেনি৷ তবে মা নীলকে কী বলছে যা আমার সামনে বলা যাচ্ছে না! কৌতুহল আর দমাতে পারলাম না। আমিও খানিক এগিয়ে গেলাম। এবার কানে যে কথাটা আসলো তা শুনে বুকের স্পন্দন অনেক বেড়ে গেল।

– সিঁথির খালাত বোন রিদি আত্মহত্যা করেছে। সিথিঁর মা তোকে ফোনে পাচ্ছিল না তাই আমাকে কল করেছে। আর বিষয়টা সিঁথিকে জানাতে নিষেধ করেছে। এ সময়ে এসব খবর ওর উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

– সে কী মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে?

– সেটা খোলাসা করে বলেনি। সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তিনমাসের বাচ্চা পেটে ছিল। আর সে কারণেই এমনটা করেছে। কার সাথে এমন করেছে তা জানা যায়নি।

মা কথাটা শেষ করে একটু সামনে তাকাতেই আমাকে দেখতে পেল। আমি যে কথাটা এভাবে শুনে ফেলব মা বুঝতে পারেননি। এ সময়ে আমাকে কোনো চিন্তা দিতে চায়নি বলেই মা কথাটা আমার আড়াল করে বলতে নিয়ে গিয়েছিল। এদিকে রিদির অবস্থার কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। হয়তো রিদি হতাশায় পড়ে এ কাজ করেছে। রিদির একমাত্র ভরসা ছিল নীল। গতকাল মোবাইলটা ভেঙে যাওয়ায় নীলের সাথে হয়তো রিদির যোগাযোগ আর হয়নি। রিদির আত্মহত্যা করার পেছনে কেন জানি না নিজেকে বেশ দায়ী মনে হচ্ছে। আমি হুহু করে কেঁদে উঠলাম। দাঁড়ানো থেকে ধপাশ করে বসে পড়লাম। বেশ জোরেসোরেই বলতে লাগলাম

– মেয়েটা মরে গেলে আমাকে আমি ক্ষমা করতে পারব না।

মা আমার কান্না দেখে হতবাক। আমার চেঁচানোতে বাসার বাকিরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত। নীলের বাবা বুঝতে পারছে না ঘটনা কী। আর এদিকে আমি ছন্নছাড়া হয়ে কাঁদছি। নীল আমাকে ধরে বসা থেকে দাঁড় করাল। রুমে নিয়ে খাটের এক কোণে বসিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল

– এ ব্যাপারে তুমি নিজেকে কেন দায়ী করছো? তুমি একটু শান্ত হও আমি আগে সদর হাসপাতালে যাই। এদিকের কাজটাও অন্য কাউকে দিতে হবে। সব সামলে নিচ্ছি। একটু স্থির হও।

আমি পাগলের মতো নীলকে ধরে বলতে লাগলাম

– আমিও যাব তোমার সাথে। আমাকে নিয়ে যাও।

– বাবুর জন্য হলেও তোমাকে ঘরে থাকতে হবে। সিঁথি একটু শান্ত হও। আমি তো বললাম দেখতেছি বিষয়টা। রিদির কিছু হবে না। নিজেকে সামলানো শিখো। বাবুর কষ্ট হবে নাহয়৷ বাবুর জন্য হলেও একটু শান্ত হও।

নীল যতই শান্ত হতে বলছে ততই আমার ভেতরে হাহাকার বেড়ে চলছে। আমি নিজেকে মোটেও শান্ত করতে পারছি না। তামান্না আর মিহু আমার রুমে প্রবেশ করতেই নীল তাদের দিকে তাকিয়ে বেশ তাড়া দিয়ে বলল

– তামান্না তোর ভবীর জন্য কিছু নিয়ে আয় যাতে কিছু খায়। আর মিহু তুমি ওকে একটু দেখো আমি একটু রিদির অবস্থা দেখে আসি। তুমি ওকে একটু সামলাও কেমন।

মিহু কিছুটা নম্র গলায় উত্তর দিল

– আমি দেখতেছি ভাইয়া আপনি জলধি যান। আর আমাকে জানাবেন কী হয়েছে।

– তামান্না কোথায়? ওর মোবাইলটা আমাকে দিতে বলো আমার সিমটা ওর ফোনে ভরতে হবে।

কথাটা শুনতেই তামান্না তার মোবাইলটা নিয়ে হাজির হয়ে গেল। নীল তাড়াহুড়ো করে সবটা গুছিয়ে বের হয়ে গেল। মিহু পাশে বসেই সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাবা আর মা হতবাক। কী করবে তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। অন্যদিকে আমিও আমার বাবা মাকে কল দিয়ে খোঁজ নিতে বেমালুম ভুলে গেলাম।

ফজর থেকে সকাল ১১ টা পর্যন্ত নীলের মোবাইলে শতবার কল দেওয়ার পরও সে তুলছে না। আর এদিকে আমি মোটেও শান্ত হতে পারছি না। যতদূর জানি আমার বাবা,মা ও রিদির কাছে আছে। মিহু আমার পাশে বসে আমাকে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু গলা দিয়ে কিছুই নামছে না আমার।

সকাল বাজে ১১ টা ৩০। আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করে দেখলাম নীল কল করেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে কলটা ধরে কান্না করেই রিদির কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওপাশ থেকে নীল বলে উঠল

– কান্না থামাও রিদি এখন ভালো আছে। যা হয়েছে তার জন্য রিদির মানসিক অবস্থা তেমন ভালো না। আমি এদিকটা গুছিয়ে আসতেছি। তুমি একটু খাওয়া দাওয়া করে নাও।

ভেতরটায় মনে হলো প্রশান্তিময় বাতাস বইলো। এত শান্তি লাগছে সেটা ভাষায় বর্ণণা করা দুষ্কর। মিহু আমার দিকে তাকিয়ে হালকা ধমক দিয়ে বলল

– এবার শান্তি হয়েছে তোর? কতবার বলছি সব ঠিক হয়ে যাবে নিজেকে সামলে নে। বাবুকে এতক্ষণ না খাইয়ে রেখেছিস তুই। তোর নাহয় ক্ষুধা লাগেনি তাই বলে কী বাবুর ক্ষুধা লাগবে না? ঝটপট খেয়ে নে। আর বায়না করেছিস তো মাথা ফাটিয়ে দিব।

বলেই রুটিটা আমার মুখে ধরল। কেন জানি না রুটির প্রতি আমার কোনো টান কাজ করছে না। আমি হুট করেই বলে উঠলাম

– আমার জন্য কাঁচা চাল আন। কাঁচা চাল খাব। কাঁচা চাল খেতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।

– পাগল নাকি! চাল খাবি কেন?

চোখ গুলো কটমটিয়ে তাকিয়ে বললাম

– বলেছি তো কাঁচা চাল খেতে ইচ্ছা করছে। কাঁচা চাল আন তো।

মিহু আর কথা বাড়াল না। রান্না ঘর থেকে এক মুঠো চাল এনে আমাকে দিয়ে বলল

– নে খা। আর কী কী খেতে মন চাচ্ছে বল।

আমি চাল গুলো মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে খেতে লাগলাম। এত মজা লাগছিল কী বলব। অথচ ছোট থেকে এত বড় হয়েছি চাল খাওয়ার অভ্যাস কখনও ছিল না। এদিক দিয়ে মিহু কপাল ভাঁজ করে আছে। মিহুর এহেন তাকানো দেখে তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললাম

– কী হয়েছে তোর? এভাবে শয়তানের মতো তাকিয়ে আছিস কেন?

– শাঁকচুন্নির মতো চাল খাচ্ছিস তো তাই। এবার রুটিটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। নাহয় নীল ভাইয়া এসে জানতে পারলে আমাকেই কাণ্ডজ্ঞানহীন বলবে।

মিহুর কথায় তেমন পাত্তা আমি দিলাম না। একদিক দিয়ে একটু একটু চাল খাচ্ছিলাম আবার রুটি খাচ্ছিলাম। চালের সাথে রুটি বেশ ভালোই লাগছে। চাল খেতে এত মজা আগে টের পেলে ছোট থেকে চালেই খেতাম। মিহুর তাকানোর দৃশ্যটা এখনও বিদ্যমান। ওর তাকানোতে বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম

– কী হয়েছে তোর?

বিরক্ত গলায় জবাব আসলো

– কিছু না চাল খা।

বলেই রুম থেকে চলে গেল। এদিকে সারাটাদিন আমি চালের উপরেই আছি। চাল এত খাচ্ছি তবুও যেন চাল খওয়ার মজা যাচ্ছে না। যতই খাচ্ছি ততই যেন লোভে পড়ে যাচ্ছি। মা কয়েকবার বলল এত চাল খেয়ো না। কে শুনে কার কথা ভাতের সাথে খানিক চাল মাখিয়ে খেয়েছি আজ। সারাদিনটা আজ আমার চালময় হয়ে আছে।

ঘঁড়ির কটায় সন্ধ্যা সাতটা। নীলের সাথে বারকয়েক কথা হয়েছে। সব কাজ সামলে বাসায় ফিরতে আজ একটু দেরিই হচ্ছে। রোগী দেখায় ভীষণ ব্যস্ত। কল দিলেও তেমন ধরছে না। ধরলেও তেমন কথা বলছে না। সবমিলিয়ে আমিও তাকে তেমন বিরক্ত করলাম না। উড়নার এক কোণে কিছু চাল রেখে চিবুতে লাগলাম। ৮ টা বাজতেই নীল বাসায় আসলো। বাসায় আসার পর নীলকে কেমন জানি বিষন্ন লাগছে মনমরা লাগছে। চাল চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলাম

– কী হয়েছে তোমার।

নিরাশ গলায় জবাব আসলো

-কিছু না। তোমার শরীর কেমন?
– ভালো। আর আমার বাবা,মা কোথায়? কল দিলাম ধরল না যে।
-ব্যস্ত ছিল হয়তো।
-রিদি তো এখন মোটামোটি সুস্থ তাহলে কী নিয়ে এত ব্যস্ততা যে আমার কল ধরতে পারছে না।

নীল কোনো কথায় বলছে না। নীলের নীরবতায় মনে প্রশ্ন ঝেঁকে বসলো রিদি মারা গেল না তো? এমনও তো হতে পারে আমাকে সবটা লুকানো হয়েছে। প্রশ্নটা মনে আসতেই কেমন জানি ভেতরটায় দম মেরে বসলো। অনিশ্চিয়তা নিয়ে নীলকে জিজ্ঞেস করলাম

– আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ না তো?

নীলের পাশ থেকে বেশ নীচু গলায় জবাব আসলো।

চলবে?

কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here