#ডাক্তার সাহেব পর্ব-৩৯
#শারমিন আঁচল নিপা

অপেন করার সাথে সাথে মনে হলো আমার মাথায় বাজ পড়লো।

“আমি আমার বাচ্চাটাকে কী করব? এ বাচ্চা তো রাখার মতো কোনো উপায় নেই। সিঁথি আর আমি এক মাস আগে পরে প্র্যাগনেন্ট হলাম সিঁথি কত সুখী আর আমি? জীবন এতটা বিবর্ণ কেন বলতে পারেন?”

মেসেজটা পড়ার পরপরই আমার কষ্ট বাড়তে লাগল। রিদির সাথে নিশ্চয় অনীলের অবৈধ সম্পর্ক আছে আর নাহয় এমন মেসেজ দেওয়ার কথা না। রিদির মেসেজে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে প্র্যাগনেন্ট। ফোনটা হাত থেকে রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি আমি। কেনো কিছু বলার বালাই পাচ্ছি না। শরীর নিমিষেই বরফ শীতল হতে লাগল। মনে হচ্ছে হাত, পা কেটে নিলেও টের পাব না। বুকের ভেতরটায় কিছু একটায় যেন আগুন ধরে সেটা ঘুরপাক খাচ্ছে। খারাপ লাগছে ভীষণ। কোনো কিছু বলার বোধ পাচ্ছি না। নীল বাথরুম থেকে এসে আমার গায়ের সাথে গা টা ঘেষে বেশ রোমান্টিক সুরে বলতে লাগল

– বাবুর মায়ের মোড খারাপ নাকি? এত চুপচাপ হয়ে আছে যে। কী হলো বাবুর মা কথা বলছে না যে?

নীলকে কেন জানি না আমার সহ্য হচ্ছে না একটুও। বিষয়টা কী ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করব নাকি আরও একটু ঘাটব। নাহ! এ বিষয় নিয়ে ঘাটার শক্তি আমার নেই। এখন যতটা না কষ্ট হচ্ছে ঘাটতে গেলে আরও কষ্ট বাড়বে। এরচেয়ে বরং সরাসরি সব বলে দেওয়ায় ভালো। নীল গা টা আরও ঘেষে বলল

– বাবুর মায়ের গাল ফোলা কেন? চুপচাপ কেন? কিছু কী খেতে মন চাচ্ছে? এভাবে মন খারাপ করে থাকলে তো বাবু কান্না করবে।

নীলের ন্যাকামি কথা গুলোতে যেন আরও গা জ্বলে গেল। নীলের থেকে দূরে গিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বলে উঠলাম

– রিদির সাথে আকাম করে এসে আমার সাথে এসব করতে লজ্জা লাগে না।

– কী বলছো এসব?

– ন্যাঁকা ষষ্ঠী কিছুই বুঝো না তাই না?

– আরে বাবা… না বুঝলে কী করব? হয়েছে কী বলবে তো?

আমি মোবাইলটা এগিয়ে দিলাম নীলের দিকে।

– এটা কী? রিদি এসব কেন লিখেছে? তলে তলে এতদূর চলে গেছ তাই না?

নীল আমার কথাটা শুনে মোবাইলটা হাত নিল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে এবার বেশ জোরে আঁছড়ে ফেলল। নীলের এ গম্ভীর স্বভাবের সাথে আমি মোটেও পরিচিত না। আমি চমকে উঠলাম। নীল ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বেশ জোরেসোরেই চেঁচিয়ে বলল

– প্রেমের শুরু থেকেই সন্দেহ। বিয়ের পরও সন্দেহ। এ সন্দেহের শেষ কোথায় সিঁথি? তুমি মাঝে মাঝে অসিডি রোগীদের মতো আচরণ করো তা কী তুমি জানো? আমাকে তোমার বিশ্বাস হয়না? আরে রিদির বি এফ এর সাথে এমন করে তার এ অবস্থা । আমি ডাক্তার তাই আমাকে ভরসা করে সে সবটা বলেছে। বাচ্চাটাকে অ্যাবর্সন করবে কীভাবে করবে সেটার জন্য। মাঝে মাঝে ডিপ্রেশনের দেয়ালে আটকে পড়ে এটা সেটা মেসেজ করে। বিষয়টা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিল বলেই বলিনি৷ রিদিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে বাকিটা জেনে নিবে। এভাবে সন্দেহ সম্পর্কে ফাটল ধরায়। পাগলামি আর সন্দেহের একটা সীমা থাকা দরকার। একটু বুঝতে শিখো। সরাসরি সন্দেহ না করে আমার উপর ভরসা রেখে তো জিজ্ঞেস করতে পারতে। আর আমি কী তোমাকে কখনও সন্দেহ করেছি বলতে পারবে? তোমার ক্লাসমেটদের সাথে তুমি কত দুষ্টুমি করো কখনও বলতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ বা তোমাকে কিছু বলেছি। যাইহোক তোমার এ ক্ষণে ক্ষণে সন্দেহ আমি নিতে পারছি না। আর আমাকে মাফ করো।

বলেই বেলকনীতে চলে গেল নীল। ভাঙা মোবাইলটা মেঝেতে পড়ে আছে৷ আমি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী বলব তার ভাষা আমার নেই। নীলকে আমি ভরসা করিনা এটা ভুল তবে অতিরিক্ত ভালোবাসায় হারানোর ভয়টা কাজ করে বেশি তাই সন্দেহ কেমন করে যেন চলে আসে। যদিও এটা নীলের উপর আস্তে আস্তে অনেক প্রভাব ফেলেছে যেটা আমি সহজে বুঝতে পারিনি। আজকে নীলের এ ব্যবহারের জন্যও একাংশ আমি দায়ী। কারণ আমি সবসময় নীলকে বুঝাতে চেয়েছি আমি কী চাই একবারও এটা বুঝতে চাইনি নীল কী চায়। অনুতপ্তের আগুনে পুড়ছি। মোবাইলটা মেঝে থেকে তুলে টেবিলের উপর রেখে খাটের এক কোণে বসলাম।

চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মিনেট পনেরো চলে গেল নীল এখনও বেলকনীতে। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বেলকনীতে গেলাম। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন কী ভাবছে। আমি তার কাঁধে হাত রাখতেই সে আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরল কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই। আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নম্র সুরে বলল

– আমি তোমাকে এভাবে বকতে চাইনি। কষ্ট দিলে সরি। এ সময় তোমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হয়নি। রাগ উঠে গিয়েছিল অনেক। মাঝে মাঝে তুমি এমন কাজ করো কী বলব। যদিও তোমার বয়স কম এটা স্বাভাবিক । তবুও রাগ করে ফেলেছিলাম। কষ্ট পেও না প্লিজ।

আমি শুধু নীলকে জোরে জড়িয়ে ধরে চুপ হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। মানুষটা আমাকে নিয়ে কত ভাবে সেটাই উপলব্ধি করছিলাম। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললাম

– আমিও সরি। তোমাকে বারবার এমন করে সন্দেহ করা আমার উচিত হয়নি। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। বারবার ভয় কাজ করে তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলব তাই এমনটা হয়। তুমিও আমাকে মাফ করে দাও। চলো বাবুর কথা ভেবে ঝগড়াটা মিটিয়ে নিই।

নীল আরও জোরে চেপে ধরে বলল

– বাবুর মা এই তো বাবু৷ আর ঝগড়া হয়নি একটু অভিমান জমেছিল তোমার স্পর্শে তা শেষ ও হয়ে গেছে। আই লাভ ইউ।

– ইংরেজিতে বললে মনে হয় অনুভব কম হয়। বাংলায় বলো।

নীল হালকা হেসে বলল

– আমি তোমাকে ভালোবাসি, বড্ড ভলোবাসি, চরম ভালোবাসি আমার গ্রাসকার্প মাছটা।

আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুকোমরে দুহাত দিয়ে নীলের দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে বললাম

– আবারও আমাকে গ্রাসকার্প মাছ ডাকা হচ্ছে। ভালো হবে না কিন্তু।

নীল তার দুহাত দিয়ে আমার কোমরে থাকা হাত দুটো ধরে আমাকে ঘুরিয়ে আমার পিঠটা তার বুকের সাথে মিশিয়ে কানের কাছে তার মুখ এনে বলল

– ভালোবেসে কিছু ডাকলে রাগ করতে হয় না।

– তাই বলে গ্রাসকার্প ডাকবে?

– একটু নাহয় ডাকলামেই।

– বাবু রেগে যায় কিন্তু৷

– তাহলে আর ডাকব না প্রমিস।

অভিমানের দেয়াল ভেদ করে নিমিষেই খুশির রশ্নি ফুটে উঠল দুজনের মাঝে। হাসির লিরিক ফুটে উঠেছে দুজনের মুখেই। খলখল করে হাসছি, আকাশ দেখছি চোখ বন্ধ করে একে অপরকে অনুভব করছি। ভালোবাসার ছন্দতলে দুজন দুজনকে মিশিয়ে নিচ্ছি বারংবার। বাইরে কোনো গানের সুর না থাকলেও মনে বেজে উঠছে রোমান্টিক সুরের মূর্ছনা। নীলের ঠোঁটের গভীর স্পর্শে কপালটা রাঙিয়ে নিচ্ছি। ইশ পবিত্র ভালোবাসা কতই না মধুর। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কতই না খাটি। বিয়ের আগে তো এ স্বাদ পাইনি। নীলের ভালোবাসার আরশতলে নিজেকে কীভাবে যেন বারবার শপে দিচ্ছি। এ ভালোবাসার শেষ কোথায় পরিণতি কী কেউ জানি না। শুধু জানি দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতে হবে৷

//

বাইরে থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ফজরের আজান পড়েছে। নীল আর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। অজু করে নামাজে দাঁড়ালাম। নীল সামনে দাঁড়িয়েছে আমি পেছনে। নামাজটা শেষ করে আমি খাটে বসলাম। নীল আমার কোলে মাথা রাখল৷ আমি মাথার চুলগুলো আলতো টেনে বললাম

– কী হয়েছে?
– কিছুনা। যদি কখনও মারা যাই তোমার কোলেই যেন মরতে পারি।

নীলের এ কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার চোখের বাঁধ ভাঙা জল নীলের মুখে পড়ল। চোখের জলের গরম স্পর্শে নীল উঠে বসলো। আমি কথা বলতে পারছি না। নীলকে ছাড়া নিজেকে ভাবার ক্ষমতা আমার নেই।

– কাঁদছো কেন তুমি?

– এমন কথা কখনও বলো না। তোমাকে ছেড়ে থাকার মতো ক্ষমতা আমার নেই। এমন আর কখনও বলো না আমি সইতে পারব না।

নীল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের জলটা তার হাত দিয়ে মুছে বলল

– আল্লাহ কখনও সহ্যের বাইরে কোনো কষ্ট বান্দাকে দেয় না। কান্না থামাও এবার।

নিজেকে সামলে চোখের পানিটা মুছে নিলাম। দরজায় বেশ জোরেসোরেই কড়া নাড়ছে কেউ। এত সকালে কে দরজায় কড়া নাড়ছে বুঝতে পারছি না। আমার বোধগম্য হওয়ার আগেই নীল গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খোলার সাথে সাথে লক্ষ্য করলাম থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। বুঝতে পারছি না কী হয়েছে। বুঝার জন্য খাট থেকে উঠে একটু এগিয়ে গেলাম।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here