#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা

পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মিহু। কানের কাছে এমন জোরে চিৎকার করেছে যে ভয় না পেয়ে উপায় ছিল না। মিহুর এ কাজটায় কিছুটা বিরক্ত হয়ে চোখ গুলো খানিকটা উপরে তুলে বললাম

– খেয়ে ধেয়ে কাজ নেই তোর?এভাবে কেউ চিৎকার দেয় নাকি। হার্ট এটাক হলে কী হত?

মিহু হালকা হাসলো। মিহুর চেহারাটা বেশ মিষ্টি, হাসি দিলে তার গালে টুল পড়ে। টুল পড়াটা স্থায়ী রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– ডাক্তার সাহেব আছে কী করতে? কিন্তু এখনও তুই এভাবে হা করে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস? ২ টা বাজতে চলল তোর মা তো সেই কখন থেকে তোর খামখেয়ালিপনা নিয়ে বকবক করছে৷ তুই এত দেরি কেন করছিস? তৈরী হবি না? এক ঘন্টা পরেই তো উনারা চলে আসবেন।

মিহুর কথায় আমার টনক নড়ল। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললাম

– কথা তো ভুল বলিসনি। ঐদিকে যা শাড়ি পড়তে হবে।

– কোনটা পরবি?

– দেখি মাকে জিজ্ঞেস করে।

বলেই মায়ের কাছে যেতে নিচ্ছিলাম, মিহু আটকে দিয়ে খাটের উপরে রাখা একটা প্যাকেট দেখিয়ে বলল

– তোমার নাগর তোমার জন্য শাড়ি পাঠিয়েছে আর মায়ের কাছে যেতে হবে না।

শাড়ির প্যাকেটটা খাটের উপর দেখে খুশিতে আমার মন নেচে উঠল। দ্রূত শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিলাম। প্যাকেটটা খুলে দেখলাম লাল জামদানি শাড়ি। পুরো শাড়িতে হালকা সৌখিন কাজের বুনন। নীলকে কোনো একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম আমার বিয়েতে আমি জামদানি শাড়ি পরব। নীল কথাটা মনে রেখেছে। আমরা মেয়েরা সত্যিই অদ্ভুত । ছোট ছোট বিষয়গুলো দিয়ে আমাদেরকে খুব সহজেই অনেক বেশি খুশি করা যায়। একটু মায়া ভালোবাসার কাছে তখন ভরি ভরি টাকা অনেকটায় মূল্যহীন হয়ে যায়। মেয়েদের একটা স্বভাবগত ধর্মই হলো অল্প মায়াতে, অল্প যত্নে গলে যাওয়া।

খুব বেশি দেরি করলাম না শাড়িটা হাতে নিয়ে ঝটপট পরে ফেললাম। নীলের কথা মতো মোটা করে কাজল দিলাম চোখে , ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিপ। মনে হচ্ছে না এটা ঠোঁট , মনে হচ্ছে ঠোঁট দুটো রক্তজবা ফুল। নিজের প্রশংসা নিজেই করে ফেলতেছি। বিয়ের সময় মেয়েদের রূপে আলাদা সৌন্দর্য ফুটে উঠে। তখন হয়তো মেয়েদের রূপ লাবণ্য না চাইতেও বেড়ে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছিলাম আর নীলকে কল্পনা করছিলাম। এমন সময় মনে পড়ল নীল তো বলেছিল কপালে টিপ দিতে কিন্তু আমার তো টিপ নেই। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷ অনেকক্ষণ ভেবে লাল লিপস্টিক দিয়েই কপালে গোল করে টিপ এঁকে নিলাম। এর মধ্যেই মিহু কানের কাছে এসে আস্তে করে বলল

– নীল ভাইয়া চলে এসেছে। একটু পরেই তোদের দুজনের আশা পূরণ হবে। শোন তোর বিয়ে হলে নীলের সাথে নীলের ভূতটাকে আমার সাথে সেটিং করিয়ে দিবি বুঝছিস।

আমার বুকটায় হালকা কম্পন দিল নীল এসেছে শুনে। হার্টবিট কেন জানি আজকে অযথায় উঠানামা করছে বেশি। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সবকিছুই স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো স্বপ্নের জোয়ারে আমি ভাসছি। এর মধ্যেই বাইরে থেকে নানু হালকা ডেকে বলল

– সিঁথি বের হ তাড়াতাড়ি । নাগরের সামনে যাবি না? একদম কথা বলবি না বেশি। কাজী বিয়ে পড়ানোর সময় আবার আবেগে হেসে দিস না। সুন্দর করে তাদের সামনে যাবি। সবাইকে সালাম দিবি। ভদ্র মেয়ের মতো থাকবি।

নানুর ডাকে আর তর সইল না সোজা উঠে বের হতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে ততই তাড়াতাড়ি নীল আমার হয়ে যাবে। এখন একটু দেরি করা মানে বিয়েটা অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া। আমার অস্থিরতা আর তাড়াহুড়ো দেখে মিহু আমার হাতটা ধরে চিমটি কেটে বলল

– সিঁথি সাবধানে যা। শাড়ির কুচিতে লেগে পড়ে যাবি নাহয়। আর এত অস্থিরতা ভালো না একটু স্থির হ। আর শোন পাশে তোর দেবরটা কিন্তু আমার।

মিহুর কথা শোনার পর মনে হলো আমি একটু বেশিই ছটফট করছি। মনে হচ্ছিল আমার মনে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। শিলা গুলো আমার অন্তরের দেয়ালে লেগে কম্পন তুলছে। আর সে কম্পনের গতিবেগে আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই। নিজেকে একটু সামলে নিলাম। মিহু ঘরেই বসে রইল। আমি নিজেকে স্থির করে আস্তে করে তাদের সামনে গেলাম। নীলের বাবা,মা,তিন বোন আর নীল আর সুনীল আরও তিনজন অচেনা মানুষ বসে আছে। নীলের মা আজ আমায় সামানাসামনি প্রথম দেখেছেন। এর আগে ফোনে কথা হলেও সামনাসামনি দেখা হয়নি। চোখ পড়ল সুনীলের দিকে। তাকাতেই কেমন জানি মুচকি মুচকি হাসছে। দুজনই আজকে একই রকম পাঞ্জাবি পরে এসেছে। কে নীল কে সুনীল বুঝা ভীষণ কঠিন। তবে আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ ব্যপার না। সুনীলের কানে একটা তিল আছে যেটা নীলের নেই।

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সবাইকে সালাম দিয়ে। নীলের মা উনার পাশে জায়গা করে দিয়ে বললেন

– মা আমার পাশে বসো। তোমাকে ভারি মিষ্টি লাগছে। চোখগুলো মাশআল্লাহ। ছবির চেয়েও তুমি হাজার গুণ সুন্দরী। চিন্তায় ছিলাম আমার এ কালো ছেলেটার একটা সুন্দর বউ পাব কিনা। তবে আজকে বুঝলাম আমার বউমা শুধু সুন্দর না বরং অনেক সুন্দর। পরীর মতো একদম। অনি এতদিনে একটা কাজের কাজ করেছে। আসো মা পাশে এসে বসো।

নীলের মায়ের কথা গুলো শুনে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল। আমি আস্তে পায়ে উনার পাশে বসলাম। পাশ থেকে তামান্না মুচকি হেসে বলল

– ভাবী বলেন তো অনি ভাইয়া কোনটা?

আমি হালকা হেসে বললাম

– তোমার ডান পাশের প্রথম টা তোমার অনি ভাইয়া।আমার চিনতে মোটেও ভুল হয়নি।

নীলের বাবা হালকা হেসে বলল

– আমিই তো আমার ছেলেদের গুলিয়ে ফেলি তুমি তো মা ভালোই আলাদা করতে পেরেছো৷

আমি মুচকি হাসলাম। তবে বিপত্তি একটাই আমি অনীলকে নীল বলে ডাকি আর তাদের বাসায় সুনীলকে নীল বলে ডাকে আর অনীলকে অনি বলে ডাকে। দেখা যাবে আমি অনীলকে নীল সম্বোধন করে কিছু বলব আর সবাই ভেবে নিবে সুনীলকে বলছি। এটা যে ওদের বাসায় যাওয়ার পর মহা মসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এখন বুঝতে পারছি।

তামান্নার পাশেই বসে আছে রুবা আর রুনা আপু। নীলের বড় দুবোন৷ যারা দুজনেই বিবাহিত এবং ঢাকায় স্যাটেল। মজার ব্যপার হলো তাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে আপন দুই ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ারা ব্যবসায়ী কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আজকে আসতে পারেনি। এর পাশেই দুজন পুরুষ এবং একজন বেশ রূপবতী মধ্যবয়স্ক মহিলা বসে আছেন। তাদের সম্পর্কে এতটা আমার জানা নেই।

এবার নীলের দিকে তাকালাম। নীল ও আমার দিকে তাকাল। নেশায় মিশ্রিত এ চোখগুলো আমাকে আরও কাছে টানছে। কোনো বাঁধায় যেন মানছে না । মন চাচ্ছে এ নেশায় এখনই ডুব দিয়ে তলিয়ে যাই৷ আফিমের নেশার থেকে বড্ড বেশি নেশা ধরে এ চোখের নেশা। যদিও কখনও আফিম খাইনি বা চোখেও দেখিনি তবে তুলনা করার জন্য এটা ছাড়া সুন্দর উপমা আর পেলাম না। এর মধ্যে হবু শ্বশুড় বাবার কথা কানে আসলো। তিনি আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন

– শফিও কাজী ডাকো। আগে শুভকাজ সাড়ব তারপর মিষ্টি মুখ করব, খাওয়া দাওয়া করব৷

কথাটা বলেই উপস্থিত সবার সম্মতি জানতে চাইলেন। উপস্থিত সবাই উনার কথায় সম্মতি দিলেন। আমি মাথা নীচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে আছি। লজ্জাবতী লতা লাগছে একদম। মনে হচ্ছে এখনই নীলের স্পর্শে নুইয়ে থুবরে পড়ব। কাজীর কথা শুনে যেন বুক আরও ধুকধুক করছে৷ এ আবেগ এ অনুভূতির প্রকাশ করার সঠিন উপমা আমার জানা নেই। জানা নেই কীভাবে তার প্রকাশ করে অনুভূতিকে উপভোগ করতে হয়।

বেলা বাজে চারটে। উপরে ফ্যানটা জোরগতিতে চলছে তবুও আমি ঘামছি। গরমে না বরং ভলোবাসায় উষ্ণ আবেশে। কাজী বসে আছে। বিয়ের সকল ব্যাপারগুলো সুন্দর করে সাজানো হলো। রেজিষ্ট্রেশন এখন করা যাবে না কারণ আমার বিয়ের বয়স কম শুধু কাবিন নামা তৈরী করেছে আর বিয়ের কালিমা পড়ানো হবে।

বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। আমার কানে কাজীর কথা ভেসে আসলো

– বলো মা কবুল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কী করব? এখন কবুল বলব নাকি অপেক্ষা করে বলব। জোরে বলব নাকি আস্তে বলব। কেমন জানি ছটফট লাগছে। অস্থির লাগছে। কিছুটা স্তবির হয়ে গেলাম। পুনরায় কাজী বললেন

– বলো মা কবুল?

আমি শুধু চুপ হয়ে গেলাম। পাশ থেকে দুটো অচেনা কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো যতদূর জানতে পারলাম উনি নীলের মামা, মামি এবং আমাদের উকিল বাবা, মা হয়েছে। উনারা দুজনই নম্র গলায় বললেন

– কী ব্যাপার সিঁথি আমার ছেলের জন্য এত পাগলামি করে কবুল বলছো না যে?

উনাদের কথায় বুঝতে পারলাম আমাকে কবুল বলতে হবে। আমি নিজেকে সামলে চোখটা বন্ধ করে বললাম

– কবুল,কবুল,কবুল।

আরও বলতে যাব নানু থামিয়ে দিয়ে বলল

– বু রে একবার বললেই হয় তুই এতবার বলতেছিস কেন? তিনবার হয়ে গেছে আর বলিস না। এত ভালোবাসা আমার নাতনি জামাই সহ্য করতে পারবে না।

নানুর কথায় যেন সে সমাবেশে হাসির হিরিক পড়ল। হাসির হিরিক বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। এবার নীলের কবুল বলার পালা। নীলকে বলার সাথে সাথেই কবুল শব্দটা কানে আসলো।

অদ্ভুত শীতলতার বাতাস যেন শরীরে এসে দোলা দিল। এত শীতল কেন লাগছে! আমার নীল আমার হয়ে গেল! ভাবতেই যেন বুকটায় অস্পষ্ট অনুভূতি গুলোও বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনের অজান্তেই আমার হাসিটা মুখে প্রস্ফুটিত হলো। সবাই এক সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। মনে হচ্ছিল জীবনের সকল বাঁধা অতিক্রম করে আমি আমার নীলকে পেয়ে ফেলেছি। এখন আমার জীবনে কোনো বাঁধা নেই, নেই কোনো আশঙ্কা,নেই কোনো ভয়। ভালোবাসার পূর্ণতা আমি পেয়ে ফেলেছি। এ ভালোবাসা আমি কখনও হারাব না। কখনও এ ভালোবাসা আমার থেকে দূরে যাবে না।। তবে আমার এ ভাবনাটা তাৎক্ষণিক মলিন হয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনায়।

চলবে?

কপি করা নিষেধ

(গল্প আবারও মোড় নিবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here