ডাক্তার সাহেব পর্ব-৩০
#শারমিন আঁচল নিপা

আস্তে আস্তে শরীর ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে গেল।

বেলা বাজে ১ টা। মাথার উপর সূর্যটা ঢলে পড়েছে। শরীরে কেমন জানি জ্বলুনি অনুভূত হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ ঠাডা পড়া রোদে আমাকে কেউ দৌড়াচ্ছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম একটা কুকুর। কুকুরটা আমার দিকে ধেয়ে আসছে আর আমি জোরে জোরে দৌড়াচ্ছি৷ একটা সময় মাটিতে থুবরে পড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

উঠার সাথে সাথে লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালের বেডে। এটা নতুন একটা রুম। আগে যে রুমে ছিলাম সেটা না। আমার চিৎকারে একজন ডাক্তার চলে আসলো। বেশ হাসি মুখে বলল

– আপনি এবার রিস্ক ফ্রি।

বলেই বের হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আমি জানতে পারলাম টানা ৬ দিন আমি আই সি ইউ তে ছিলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাকে ঢাকায় আনা হয়। মায়ের অবস্থা এটা শোনার পর থেকে ভালো না। মাকে মফস্বলেই হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে৷ আমার অবস্থার উন্নতি হওয়ায় আমাকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হলো। আমার কেবিনে একে একে নীল বাবা আর কিছু অপরিচিত মানুষ প্রবেশ করল। আমি নীলের পাশে থাকা মানুষ গুলোর দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম। একজন মধ্য বয়স্ক লোক আর একজন অল্প বয়স্ক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্য বয়স্ক লোকটা আমার পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে বলল

– আমি তোমার হবু শ্বশুর আব্বা মানে নীলের বাবা। ওর মতো আহম্মকের জন্য এমন একটা কাজ কী করে করলে! ও নিজেই তো একটা গাঁধা। ওর মতো গাঁধার জন্য এত বড় গাঁধামী করার আগে নিজের কথা কেন ভাবলে না? আমাকে ভীষণ ভয় পায় তাই বিষয়টা আমাকে না জানিয়ে তার মা কে জানিয়েছিল। তার মা সরাসরি না করে দেয়। তোমার অবস্থা খারাপ হওয়ার পর সম্পূর্ণ ঘটনা আমার কানে আসে। আমি রাগী বটে তবে এতটাও না। তোমার বাবা আমার বন্ধু। এ সম্পর্ক আমাদের বন্ধুত্বকে আরও গভীর করে দিবে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠো আগে। এরকম বোকামি আর কখনও করবে না। জীবনের সব সমাধান যদি আত্মহত্যায় হত তাহলে কেউ দুঃখ সহ্য করত না বরং আত্মহত্যায় করত। তবুও মানুষ আত্মহত্যা কেন করে না জানো? সফল হওয়ার জন্য। কারণ তারা জানে এ কষ্টের পরই রয়েছে তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা।

তারপর নীলের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ইশারা দিয়ে বলল

– এ হলো তামান্না নীলের ছোট বোন। তোমার সাথেই পড়ে। একই বয়সী তোমরা তবে তোমার আর ওর মধ্যে ম্যাচুরিটির অনেক ফারাক। এত পাগলামি যদিও এ বয়সে সবাই করে। তবুও নিজেকে যে এ বয়সে সামলাতে পারবে সেই সফল। যাইহোক সার্বিক দিক বিবেচনা করে তোমাদের সম্পর্ক আমি মেনে নিয়েছি। দুই বছর পর বিয়ে হবে। এখনই দিতে পারতাম তবে সার্টিফিকেটে তোমার বিয়ের বয়স হয়নি এখনও। আর তোমাকে বিয়ে করাতে গেলে কোনোভাবে বাল্য বিবাহের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে নীলের চাকুরি চলে যাবে। তুমি কথা দাও এ দুই বছর মন দিয়ে পড়বে। এমন ভাবে পড়বে যেন মেডিকেলে চান্স পাও।

নীলের বাবার কথা শুনে আমি শুধু বিস্মিত হচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কোনো সুস্বপ্ন আমি দেখছি। অবাক চোখে তাকিয়ে আছি৷ বাস্তব আর কল্পনার তফাৎ যেন বুঝতে পারছি না। আমাকে পুনরায় বলা হলো

– কী ব্যপার চুপ কেন? পারবে তো কথা রাখতে।

আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসলাম। হালকা গলায় জবাব দিলাম

– হুম পারব।

উনি হালকা হেসে বাবাকে বললেন

– শফিও চলো বাইরে গিয়ে যাওয়া যাক। মেয়ে তো সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। এবার দুজন মিলে কড়া করে এক কাপ চা খেয়ে আসি।

বাবার নাম মূলত শফিকুর রহমান তবে তিনি বাবাকে ছোট করে শফিও বলে ডাকছেন। বাবার হাসিটা মুখে প্রকাশিত হলো। অনেকটা বাঁকা চাদের মতো নিশব্দ হয়ে ঠোঁট দুটো প্রশস্ত হলো। তারা দুজন কেবিন থেকে বের হলো। এখন কেবিনে শুধু নীল, আমি আর তার ছোট বোন তামান্না। তামান্না বুঝতে পেরেছিল আমাদের একটু স্পেস দরকার। তাই সে বেশিক্ষণ কেবিনে না থেকে বের হয়ে গেল। নীল আমার পাশে বসে চোখের জল ফেলছে। আমার কাঁধের কাছে তার মাথাটা গুজে দিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি হালকা হাতে নীলের চুলগুলোয় আলতো হাত বুলালাম। মোলামেয় কন্ঠে বললাম

– কী হয়েছে কাঁদছো কেন?

– তোমার কিছু হলে আমি কী করে থাকতাম বলো? জীবনটা তো বিবর্ণ হয়ে যেত। কেন এমন করলে তুমি? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমিও তোমায় অনেক ভালোবাসি। আর কোনো চিন্তা নেই। সবাই মেনে নিয়েছে। এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে পড়াশোনায় মন দাও।

নীলকে ধরেই শুয়ে ছিলাম আমি। কত অনুভূতিমিশ্রিত ভালোবাসা আমি ছুরে ফেলে দূরে চলে যেতে চেয়েছিলাম সেটাই ভাবছিলাম। সহজ বিষয়টা কতই না জটিল করে ফেলেছি। জীবন তো কখনও কারও জন্য হতে পারে না। এ অকাজটা না করে সুন্দরভাবেও এর পরিসমাপ্তি টানা যেত। তবে কিছু ভুল মানুষকে বুঝতে শেখায়। এ ভুলটাও আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে জানতে শিখিয়েছে অনেক কিছু।

দেখতে দেখতে ৫ দিন কেটে গেল। হাসপাতাল ছেড়ে আজকে বাসায় আসলাম। মাথা মাঝে মাঝে ঘুরপাক খায় আর শরীর দুর্বল লাগে। এছাড়া আর কোনো সমস্যা বর্তমানে হচ্ছে না। মা ও আগের চেয়ে সুস্থ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পরিবেশ বেশ শীতল।

দেখতে দেখতে ১৫ দিন পার হলো। নীলের সাথে সম্পর্ক আমার ধীরে ধীরে সুন্দর হতে লাগল। দুই পরিবারেই দুজনকে মেনে নিয়েছে। সবাই চাচ্ছে বিয়েটা অতিদ্রূত হোক। কিন্তু বয়সের কারণে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না। বাজির একটা মাস কী করে যে চলে গেল টেরেই পেলাম না। আজকে অনেকদিন পর কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরী হলাম। এর মধ্যেই নীলের কল আসলো। কলটা ধরতেই বলে উঠল

– কী করতেছো?

– কলেজে যাব। আজকে একটা মজার ব্যপার কী জানো?

– কী?

– বাজির সময় শেষ হওয়ার পর আজ প্রথম কলেজ যাচ্ছি। দেখতে দেখতে পরিচয়ের দুই টা মাস হয়ে যাচ্ছে। বাজি অনুযায়ী আমি জিতে গিয়েছি।

– আমার মনে হয় না তুমি জিতে গিয়েছো?

– কেন মনে হয় না। বাজিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে আমি তোমাকে পটিয়ে ১ মাস প্রেম করতে পারলে ১ হাজার টাকা আমি পাব।

– কিন্তু কাজটা হয়েছে উল্টা পটাতে গিয়ে নিজেই পটে ছাড়খাড় হয়ে গেছ। যাইহোক বের হবে কখন?

– এই তো এখনই।

– মোড়ে দাঁড়ালাম তাহলে। দ্রূত এসো। একটু দেখি কেমন লাগে তোমায়।

আমি হালকা হেসে কলটা কাটলাম। হুমড়ি খেয়ে বাসা থেকে বের হলাম। হাসপাতালের মোড়েই নীলের সাথে আমার দেখা। তার চোখে চোখ পড়ল। সেই নেশা যেন আমাকে আবারও ঘিরে ধরল। এ চোখে যতবার আমি তাকিয়েছি ততবারই আমাকে তলিয়ে নিয়ে গেছে। এ চোখের নেশা কাটানো বড্ড দায়। সামনে এগুতে এগুতেই মনে হলো কিছু একটায় ধাক্কা খেয়েছি। নীলের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম সে মুচকি মুচকি হাসতেছে। নীলের হাসি উপেক্ষা করে সামনে তাকিয়ে বুঝতে চাচ্ছিলাম কিসে ধাক্কা খেয়েছি। সামনে তাকানোর পর আমার কলিজার পানি যেন শুকিয়ে যেতে লাগল। এক পাগল উন্মাদ লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে খিল খিল করে হাসছে। আর আমার দিকেই এগিয়ে আসছে৷ আমি খানিক পিছিয়ে উনাকে দেখে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আশেপাশের সব লোক জড়ো হয়ে গেল৷ লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে কেলেজের দিকে দৌড় লাগালাম। মনে মনে নিজেকে বেশ বকতে লাগলাম আর নীলকেও গালি দিতে লাগলাম।

খানিক দৌড়ে কলেজের কাছে যেতেই মোবাইলটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করলাম নীল কল করেছে। নীলের কলটা ধরে হালকা ঝাড়ি দিয়ে বলতে লাগলাম

– তুমি আমাকে দেখে ঐভাবে হেসেছো কেন? পাগলের দৌড়ানি খেলে বুঝতে কেমন লাগে। বিপেদে পড়েছি কোথায় উদ্ধার করবে তা না উল্টা হেসে মজা নেওয়া হচ্ছিল৷

নীলের খল খল হাসির ধ্বনি কানে এসেও থেমে গেল। মৃদু সুরে বলল

– কথায় আছে পাগলে পাগল চিনে রতনে রতন। পাগল বুঝতে পেরেছিল তুমিই তার পারফেক্ট সঙ্গী।

নীলের কথা শুনে ক্রুদ্ধ গলায় বলে উঠলাম

– নীলললললললললল…

বলেই সামনে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। নীল আমার সামনে দাঁড়ানো তাহলে কার সাথে আমি কথা বলছি। মোবাইলের ওপাশে কে? আমি কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– তুমি আমার সামনে তাহলে মোবাইলে কে কথা বলছে?

ওপাশ থেকে বিস্ময় সুরে উত্তর আসলো

– বিমরতি ধরেছে নাকি তোমার? আমি তো হাসপাতালে বসে আছি। রোগী দেখতে বসব একটু পর। কাকে দেখে কী বলছো?

আমি ওপাশের কথা শুনে পুনরায় সামনে তাকালাম। নাহ! আমার তো ভুল হচ্ছে না এটা তো নীলেই তাহলে ফোনে কে? আমি ফোনটা রেখে উনার সামনে গেলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ হালকা গলায় বলল

– কিছু বলবেন?

আমি উনার কথা উপেক্ষা করে বুঝতে চাচ্ছিলাম এটা কী আমার ভ্রম নাকি। কিন্তু না এটা বাস্তব প্রতিবিম্বই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু নীলের মতো দেখতে এ কে? হালকা গলায় বললাম

– আপনি কে?

– আমি নীল। বাসার সবাই ভালোবেসে নীল বলেই ডাকে।

উনার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এটা কী কোনো জিন। শুনেছি ভর দুপুরে জিন থাকে কিন্তু এই সাত সকালে জিন কী করছে! আমি চোখ বড় বড় করে বললাম

– নীলের জিন না তো আপনি? দেখেন জিন হোন আর ভূত হোন কান চাপায় চার পাশটা বসিয়ে সোজা করে দিব। নীলের বেশ ধরে আমার সামনে আসা! আপনার কী ধারণা আমি জিন ভয় পাই? মোটেও না। নীল তো হাসপাতালে। তাহলে আপনি ওর বেশ ধরে এখানে কী করছেন? যেই না সুন্দরী মেয়ে দেখেছেন তখনই তার প্রিয়জনের বেশ ধরে চলে এসেছেন। তাজ্জব জিন। জিনদের চরিত্র এত খারাপ হয় জানতাম না।

উনার কপালটা ভাঁজ হয়ে গেল। বেশ বিরক্ত গলায় জবাব আসলো

– নিজেকে কোন দিক থেকে আপনার সুন্দরী মনে হয়? নিজেকে ভাবতেছেন ক্যাট্রিনা আসলে তো একটা জরিনা। আর জিন হব কোন দুঃখে! আমার প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে দেয়নি যে তার জন্য মরে ভূত হয়ে জিন হব। আর আমার পুরো নাম সুনীল। আপনার ভালোবাসার অনীলের জমজ ভাই। বাসায় আমাকে সবাই নীল বলে ডাকে আর আপনার নাগরকে অনি বলে ডাকে। যদিও সবাই চেহারার সাথে নামেও গুলায়। আমি জব করি ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে তাই এ পর্যন্ত এখানে আসা হয়নি। তজ্জব হয়ে যাচ্ছি অনীলকে আপনি এত ভালোবাসেন তবুও তার পরিবার সম্পর্কে অবগত না। যান গিয়ে ক্লাস করুন। সারাদিন থাকেনেই জিন ভূতের চিন্তা নিয়ে তাই যাকে তাকে জিন ভূত বানিয়ে দিচ্ছেন। তাজ্জব তো আমি না তাজ্জব মেয়ে আপনি।

বলেই তিনি হনহন করে সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। আমি বেয়াকুবের মতো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথা মোটেও কাজ করছে না। এ জিন ধুর এ সুনীলের কথা তো কেউ বলেনি আমায়। এমনও হতে পারে এ জিনটা আমায় বোকা বানাচ্ছে। তাই নীলকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– তোমার কী কোনো জমজ ভাই আছে?

নীল স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল

– না৷

নীলের জবাব শুনে আমার ভয় বাড়তে লাগল। এতক্ষণের সাহস যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল। চুপসে মুখটা শুকিয়ে গেল। অনেকটা চিপসের প্যাকেট ফুটো করলে যেমন চুপসে যায় আমার অবস্থাও একই রকম। অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগছে তাহলে এ লোক কে? এমন সময় মিহু এসে ধাক্কা দিয়ে যা বলল তা শুনে শরীর আরও কাঁপতে লাগে।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here