ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৬

#শারমিন আঁচল নিপা

– কী হলো চুপ কেন? তুমি কী কলেজে গিয়েছিলে নাকি না? উত্তরটা দাও।

কী উত্তর দিব বুঝতে পারছি না থরথর করে কাঁপছি আমি। নিজেকে একটু গুছিয়ে উত্তর দিতে যাব এমন সময় একটা শব্দ পেলাম। শব্দটার উৎস খুঁজতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম নীলের দেওয়া লাল মোবাইলটা ব্যাগ থেকে ছিটকে নীচে পড়ে গেছে। মা মোবাইলের দিকে শুকুনের মতো চেয়ে আছে। মায়ের নজর এড়াতে মোবাইলটা ঝটপট হাতে নিতেই মা বলে উঠল

– ওটা কী এদিকে আনো।

মায়ের কথায় কাঁপতে কাঁপতে বললাম

– মা ক্যালকুলেটর, তোমার দেখতে হবে না।

– আরে আনো দেখি। এরকম ক্যালকুলেটর তোমার ছিল নাকি? এদিকে আনো বলছি।

পড়ে গেলাম আরও বিপাকে। শরীর তো কাঁপছেই সে সাথে বুক ও কাঁপছে ভীষণ। কাঁপা হাতে মোবাইলটা এগিয়ে দিলাম। মা মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাগী চোখে আমার দিকে তাকাল।

– তোমার তো মোবাইল ভেঙে গেছে। এ মোবাইল কোথায় পায়েছো? কে দিয়েছে তোমায়? বা তুমি টাকা পেলে কোথায় মোবাইল কেনার?

কোনো বুদ্ধিই যেন মাথায় আসছে না। চট করে বলে উঠলাম

– মোবাইলটা মিহুর ভুল করে আমার ব্যাগে রেখে গেছে।

আমার মুখের বচনে মা বেশ বুঝতে পেরেছিল আমি মিথ্যা বলছি। মা কিছুটা বিলম্ব করে উত্তর দিল

– মিহুর ফোনে তোমার সিম ভরা কেন? আমি তোমার পেট থেকে জন্ম নিছি নাকি তুমি আমার পেট থেকে জন্ম নিছো? ঠিক করে বলো কোথায় ছিলে।

আমি একদম চুপ। কথা বলার অবকাশ যেন পাচ্ছি না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মা আমার মোবাইলটা ঘেটে বলতে লাগল একটা নম্বর থেকে বেশ অনেকবার কল দেওয়া নেওয়া হয়েছে। এখানে লিস্টে এ একটা নম্বরেই আছে। সেভ নেই যদিও। বলেই মা নীলের নম্বরটা ডায়াল করে লাউড দিয়ে বলল

– কল ধরলে হ্যালো বলবে।

আমার শরীর মাত্রারিক্ত কাঁপছে। মনে মনে চাচ্ছিলাম নীল যেন কল না ধরে। তবে আমার চাওয়া বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। এর আগেই ওপাশ থকে হ্যালো শব্দ চলে আসলো। বিষাদের সুর মনের গহীনে বাজছে আমার। মা আমাকে ইশারা করতে লাগল হ্যালো বলতে। আমি ঢুক গিলে হ্যালো বলতেই নীল বলে উঠল

– ঠিক মতো বাসায় পৌঁছাতে পেরেছো তো! তোমাকে আন্টি কিছু বলেনি তো? সব স্বাভাবিক তো? ভেজা কাপড় পাল্টে নিয়েছো কী?

নীলের কথা গুলো শুনে আমার শরীর কাঁপতে লাগল আরও। শক্তি যেন পাচ্ছিলাম না। আমার নীরবতা শুনে নীল বলে উঠল

– পাগলি বুড়িটা কথা কেন বলছে না।

মা এবার ফোনটা নিজের কানে নিয়ে বলল

– তুমি তো অনীল তাই না? আমি তোমার পাগলি বুড়ি না পাগলি বুড়ির মা।

নীলের তুতলানোর আওয়াজ কানে আসতে লাগল। নীল গলাটা ভারী করে মুখে জড়তা এনে বলল

– সরি আন্টি বুঝতে পারিনি আমি।

– তোমাকে সব না বুঝলেও চলবে। এটুকু একটা মেয়ের সাথে তুমি কেনই বা এমন সম্পর্কে জড়ালে? তুমি কী তাকে ভালোবাসো?

নীল চুপ। নীলের এ চুপ থাকাটা আমাকে ভীষণ নাড়া দিচ্ছে। কেন সে বলছে না সে আমাকে ভালোবাসে। মা আবার জিজ্ঞেস করল। এবারও নীল চুপ। মা বিরক্ত মুখে বলল

– তুমি সন্ধ্যার পর আমাদের বাসায় আসবে তোমার সাথে আমার কথা আছে।

নীল হালকা গলায় জবাব দিল

– ঠিক আছে আন্টি।

মা এবার আমার দিকে তাকাল। রাগী গলায় বলে উঠল

– তোর বয়স কত হয়েছে যে তুই এখনই এসবে জড়ালি। নীল আর তোর বয়সের ডিফারেন্স তুই জানিস? পাগল তুই? তোদের কে মেনে নিবে? তোর বাবা জানলে তোর হাড় গুড় ভেঙে পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে।

মাথাটা নীচু করে বেশ সাহস নিয়েই বললাম

– মা আমি নীলকে ভালোবাসি।

মা আমার কাছে এসে আমার গালে কষিয়ে চড় দিয়ে বলল

– লজ্জা থাকা দরকার। কার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছিস সেটা বুঝা দরকার। নীল যোগ্য ঠিক আছে তবে তোর সাথে পারফেক্ট না।

চড় দেওয়া গালে নিজের হাতটা চেপে ধরে বললাম

– একটা ডাক্তার কীভাবে পারফেক্ট না হয় মা।

জানি না আমি এত সাহস নিয়ে কীভাবে কথা বলছিলাম। তবে কথাগুলো বেশ অকোপটেই বলে ফেলছি। কোনো জড়তা যেন কাজ করছে না। মা আমার মোবাইলটা মাটিতে আঁচড়ে ফেলে দিয়ে বলল

– প্রেমের সম্পর্ক সবচেয়ে তিক্ত সম্পর্ক। এ সম্পর্কে কষ্ট ছাড়া কিছু দেয় না৷ তোর ছোট খালা প্রেম করে বিয়ে করেছিল এক ব্যারিস্টারকে। বিয়ের এক বছরের মাথায় আত্মহত্যা করে মারা যায়। তোর খালাকে দেখেও শিক্ষা হয় না। এসব ছেলেরা আসেই আবেগী মেয়েদের মনে জায়গা করে নিতে। একটা সময় তাদের আবেগ কাজ করে তখন সব বাধা পার করে বিয়েও করে। আবেগ শেষ তো সব ভালোবাসা ও শেষ। মেয়েটার উপায় থাকে না, উপায় না পেয়ে তখন করে আত্মহত্যা। শুন বিয়ে হওয়া লাগে সমানে সমানে। নীলের পরিবার অনেক উচ্চ। ওর বাবার টাকা,পয়সা আমাদের থেকে কয়েক গুন। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো ঠিক না। সব কিছুর নিয়ম নিতী আছে।

– নীল যদি আমাকে মেনে নেয় তাহলে তো সমস্যা দেখছি না। আর নীল তো এর আগে বলেছে তার পরিবারে এখন আয়ের উৎস একমাত্র নীল। তার বাবা নিশ্চয় তার কথা মেনে নিবে।

– সিঁথি বিষয়টা মেনে নেওয়া না নেওয়া না। বিষয়টা সমান্জস্যতার। নীলের পরিবারের সাথে আমাদের কখনও মিলবে না। আর ওর পরিবার মেনে না নিলে তুই কী ভেবেছিস নীল ডাক্তার তাই তোকে ওর হাতে তুলে দিব। অসম্ভব। তোকে বেঁধে ঘরে রেখে দিব তবুও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দিব না।

– মা আমি নীলকে ভালোবাসি।

কথাটা বলার সাথে সাথে মায়ের চড় একটার পর একটা পড়তে লাগল। মাকে, নানু ধরে বেশ জোর গলায় বলল

– থাম তুই। ওরে কী মেরে ফেলবি নাকি?

– মা তুমি কী জানো না তোমার ছোট মেয়ের কী হয়েছিল। এসব ছেলেরা আবেগে পড়ে বিয়ে করে তারপর আবেগ শেষ হলেই অত্যাচার শুরু করে দেয়। তখন মরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তুমি কী চাও আমার মেয়ের একই দশা হোক।

– তাই বলে এভাবে মারবি। তুই এখন ঘরে যা। অনীলকে বুঝাইয়া বললেই হবে৷ ওকে না করে দিলেই হবে। একে আর মারিস না। ওর বয়সেই বা কত। এগুলো বুঝার বিবেক কী তার হয়ছে। থাম তুই এবার।

মা চেঁচাতে চেঁচাতে নিজের রুমের দিকে গেল। আমি ভেজা কাপড় নিয়ে থরথর করে কাঁপছি। নানু আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। কাপড় পাল্টে আনমনে বিছানায় বসে পড়লাম। ছোট খালার আত্মহত্যার কথা জানতাম তবে কেন করেছে সেটা জানতাম না। কেন জানি না চোখ বেয়ে জল পড়ছে। এ সম্পর্কের শেষ কী এখানেই হয়ে যাবে। যতবার একথা ভাছিলাম ততবারেই কলিজা ফেটে কান্না আসছিল। নানু আমার হাতটা ধরে হালকা কেঁদে দিয়ে বলল

– বু… রে কান্দিস না। ভালোবাসা মারাত্মক খারাপ জিনিস। তোর মা তোরে মারছে তোর ভালোর জন্য। বয়স ও কম তোর। বিয়ের বয়সও হয়নি এখন এসব নিয়ে ভেবে নিজেরে কষ্ট দিস না।

নানুর কথাটা শুনে আমি নানুকে জড়িয়ে ধরে বললাম

– আমি যে ওরে ছাড়া ভাবতে পারব না। ওরে ছাড়া যে আমার কষ্ট হয়। আমি থাকব কেমনে? মনের গহীনে আগলে রাখা মানুষটাকে ভুলবই বা কী করে। আমাকে বলো গো নানু। আমি যে পারছি না সইতে এ মরণ ব্যথা। নীলকে ছাড়া আমি মরেই যাব।

নানু আমার মুখটা চেপে ধরে বলল

– এমন কথা বলিস না। তুই শান্ত হ। এর মধ্যে তোর মায়ের মন পরিবর্তন হতে পারে। আর নীল তো সন্ধ্যার পর আসতেছেই। তখন নীলের কথাতেও গলে যেতে পারে। তুই সবুর কর। সবুরের ফল মিঠা হয়।

নানুর কথায় কান্না যেন আরও বাঁধ ভেঙ্গে আসলো। কাঁদতে কাঁদতে অস্থির আমি। সময় যেন কাটছে না। কখন যে সন্ধ্যা হবে সে চিন্তায় বুক ধরফর করছে।

বিয়োগ যন্ত্রণার রেশ নিয়েই সন্ধ্যা নেমে আসলো। আনুমানিকে ৭ টা বাজে। নীল বাসায় উপস্থিত হলো। নীল আর মা মুখোমুখি বসে আমি কিছুটা দূরে। কী হতে চলেছে এখনও অজানা। অদৃষ্ট কোথায় কাহিনি নিয়ে ঠেকাবে জানি না।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here