ডাক্তার সাহেব পর্ব-২১
#শারমিন আঁচল নিপা
বোরকাটা পরে মিহুর বাসা থেকে বের হতে যাব এমন সময় মিহু চেঁচিয়ে উঠল।
– আরে সিঁথি তুই এভাবে বের হলেও তোকে মানুষ চিনে ফেলবে। এভাবে বের হলে ধরা পড়বি নির্ঘাত।
খানিকটা বিস্মিত হলাম তার কথা শুনে। কারণ নিকাব পরার পরও কেউ কী করে চিনবে আমায় সেটাই মাথায় ঘুরপার খাচ্ছিল। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম
– কীভাবে চিনবে আমায়? আমি তো বোরকা পরে আছি। এরকম ভাবে তো আমাকে কেউ কখনও দেখেনি। আর চোখ ছাড়াও তো কিছু দেখা যাচ্ছে না তাহলে চিনবে কী করে?
– আসলেই তুই বোকা বোকাই রয়ে গেলি। আর বুদ্ধি সুদ্ধি তোর মাথায় হবে না। তোর তো মার্কা মারা নীল চোখ আছে৷ আমাদের এলাকায় এরকম চোখ কারও নেই। যে কেউ তোর চোখ দেখে চিনে ফেলবে তুই সিঁথি। আর কিছু লাগবে না তোকে চেনার জন্য তোর চোখেই যথেষ্ঠ।
আমি নিজের জিহ্বায় নিজেই কামড় দিয়ে বসলাম। মিহু যা বলেছে একদম ভুল বলেনি। কিন্তু এর উপায় হিসেবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হালকা গলায় বললাম
– চোখ কী করে ঢাকব এখন। চোখ বন্ধ করেও তো হাঁটা যাবে না।
মিহু তার ব্যাগ থেকে কালো সানগ্লাস বের করে বলল
– এটা পরে নে। তাহলে আর কেউ চিনবে না। আসার সময় আমার জন্য কিছু নিয়ে আসিস। এত রিস্ক নিয়ে তোকে বের করতেছি এর জন্য তো কিছু পাওনা আমি।
মিহুর কথায় মুচকি হেসে বললাম
– আগে তো যাই তারপর নাহয় বাকি কথা হবে। এমনিতেই ভয়ে বুক ধুকধুক করছে। কখনও তো এমন করিনি। এমন ভাবে পালিয়ে কারও সাথে দেখা করিনি। হার্টবিট বেড়ে চলেছে ক্রমেই।
– আরে…. তোর মতো মেয়ে ভয় পাচ্ছে! তোকে সবাই চিনে মাফিয়া নামে আর তুই কী না এসব বলছিস। তুই কী সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? দেখা গেল বাজির প্রেম বাস্তব রূপ ধারণ করল।
বলেই মিহু হাসতে লাগল। সে অবশ্য নীল আর আমার বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানে না। সে ভেবেই নিয়েছে আমি নীলের সাথে প্রেমটা বাজি জিতার জন্যই করতেছি। অবশ্য আমিই কাউকে কিছু বলছি না। একটা ছেলে বিরোধী মাফিয়া স্বভাবের মেয়ে কি না প্রেমে পড়ে ভীতু শান্তিশিষ্ট হয়ে গেছে সেটা বাকিরা জানুক আমি চাই না। মিহুর হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিলাম না। জোরে একটা থাবা কষিয়ে দিয়ে বললাম
– আমার মতো মেয়ে প্রেমে পড়বে। পাগল নাকি তুই? বাদ দে সেসব কথা। ভয় পাচ্ছি ধরা খেলে বাশ খাব বাসায় তাই। এর বাইরে কিছু না। এখন যাই আমি।
মিহু কপালটা ভাঁজ করে মলিন মুখে উত্তর দিল।
– তোর হাবভাব যদিও অন্যকিছু বলে। থাক সেসব কথা। সাবধানে যাস। আর সানগ্লাসটা যত্ন করে দিয়ে যাস। নিজের মনে করে রেখে দিস না।
– হুম ঠিকাছে।
বলেই বাসা থকে তড়িঘড়ি করে বের হলাম। মিহুর বাসা থেকে মূল রাস্তায় যেতে হেঁটে পাঁচ মিনিট সময় লাগে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যতই সামনে এগুচ্ছিলাম ততই ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সবাই আমাকে চিনে ফেলবে। নিস্তব রাস্তা তবুও যেন আশেপাশে মানুষের বিচরণ অনুভব করছিলাম। বেশ হন্তদন্ত হয়েই হেঁটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। বুকের কম্পন যেন থামছেই না। এত ভয় এত ভীতি এর আগে কখনও লাগেনি। জীবনে অকর্ম করেনি এমন কোনো কাজ নেই। তবুও কেন জানি না আজ ভীষণ ভয় লাগছে। শত ভাবনা শত ভয় নিয়েই মূল রাস্তায় আসলাম। রাস্তায় আসতেই রিকশা ওয়ালা বলে উঠল
– নানী কোথায় যাবেন?
রিকশাওয়ালার কথা শুনে আমার রাগ বেড়ে গেল৷ আমার মতো বাচ্চা মেয়েকে নানী বলছে! পরক্ষণেই মনে হলো আমার যে সাজগোজ এর থেকে বেশি ভাবার কথা না। গলাটা কিছুটা ভেঙে বললাম
– তিন রাস্তার পেছনে যাব।
বলেই রিকশায় উঠে বসলাম। এ প্রেম যে আমাকে কত কিছু করাচ্ছে সেটাই চিন্তা করতেছি। এ প্রেমে মগ্ন হয়ে যে অবাধ্য পথে হাঁটছি সে পথ কী ঠিক নাকি ভুল সেটাই বুঝে পাচ্ছি না। অবাধ্য এ প্রেমের শেষটা আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে। ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমে উঠেছে। অশ্রুটা পড়বে পড়বে এমন সময় রিকশাওয়ালা মামা ডেকে উঠলেন
– নানী চইলা আইছি নামেন।
আমি নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরিয়ে আনলাম। অবাধ্য এ চোখের পানিটা আর গড়াতে দিইনি আটকে দিলাম চোখের মধ্যেই। রিকশা ভাড়াটা এগিয়ে দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। নীলকে কল করলাম সাথে সাথেই।
– কোথায় তুমি?
নীল উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল
– তুমি কোথায়?
– আমি তো কোচিং এর পেছনে।
– দাঁড়াও ২ মিনিট এখনই আসতেছি।
মোবাইলটা ব্যাগে রাখলাম। দুই মিনিটও হয়নি নীল আমার সামনে চলে এসেছে। বাইকে বসে আছে সে। পরনে নীল শার্ট, কালো প্যান্ট। মাথায় নীল হ্যালমেট। নীল যেন নীলে একাকার। হ্যালমেটে তার মুখ স্পষ্ট না তবে তাকে চিনতে আমার ভুল হলো না। নীল সামনে এসেই মুগ্ধ কন্ঠে বলল
– বাইকে উঠো।
আমি বাইকে উঠতে যাব এমন সময় সে বাঁধা দিয়ে বলল
– দাঁড়াও হ্যালমেটটা পরে নাও।
মুখটাকে মলিন করে জবাব দিলাম
– আমি হ্যালমেট পরতে পারি না।
নীল হালকা হাসলো, হ্যালমেটটা নিজ হাতে পরিয়ে দিল। আমি বাইকে উঠে বসলাম। নীলের কাঁধে শক্ত করে ধরলাম। বাইকটা স্টার্টের শব্দ কানে আসলো আর শুর শুর করে চলতে লাগলা। বাইরে বাতাস এসে আমার বোরকায় ঝাঁপটা দিতে লাগল। প্রথম কোনো অল্প পরিচিত ছেলের সাথে বাইকে উঠেছি। এর আগে যতবার উঠেছি বাবার সাথে। তবে নীলের সাথে বাইকে উঠার অনুভূতি ভিন্ন। উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলাম
– আরও জোরে চালাও। আস্তে চালালে হবে নাকি৷
– এত উৎকন্ঠা কেন তুমি? আরে বোকা মেয়ে বেশি জোরে চালালে পড়ে যাবে।
– পড়ব না তোমাকে তো জড়িয়ে ধরে রেখেছি। আচ্ছা আমরা যাব কোথায়?
– দেখি দুচোখ যেদিকে যায়। কেন তোমার বাইক চড়তে ভালো লাগছে না?
– ভীষণ ভালো লাগছে। আমি তোমাকে আরও শক্ত করে ধরি?
– ধরো।
– কাতুকুতু দিই?
– একদম না। পরে যাব তাহলে।
কিন্তু আমার নাছোরবান্দা মন কেন জানি না নীলের কথায় বাধ্য হতে পারল না। বেশ উৎকন্ঠা আর উৎফুল্লতা নিয়েই কাতুকুতু দেওয়া শুরু করলাম। নীল বারবার বারণ করছিল আর আমি অবাধ্যের মতো বারবার কাতুকুতু দেওয়া বহাল রাখছিলাম। সে সাথে খিলখিল করে হাসছিলাম। হাসতে হাসতেই মনে হলো সজোরে শব্দ হলো। শব্দটা যেমন হলো তেমনি কোমড়েও জোরে আঘাত পেলাম। বুঝতে আর বাকি রইল না বাইকটা রাস্তার একপাশে পড়ে গেছে। নিজেকে সামাল দিলাম। কোমড়টা ব্যথায় টনটন করছে তবুও উঠলাম। নীল ও উঠে দাঁড়াল। ব্যথা পেলেও বড় ধরণের কোনো সমস্যা হয়নি কারও। আমি উঠে দাঁড়াতেই নীল কর্কশ গলায় বলে উঠল
– না করেছিলাম তোমাকে কাতুকুতু দিতে। সবসময় ফাজলামি তাই না?
কী উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে উত্তর দেওয়ার জন্য বেগ পোহাতে হলো না তেমন। কারণ উত্তর দেওয়ার পূর্বেই সে জায়গায় পুলিশের আগমণ ঘটল। নীলের কাছে বাইকের চাবি আর ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইল। নীল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাইকটা থানায় নিয়ে গেল। দুজনেই বসে আছি থানায়। নীলের রাগ আমার উপর ক্রমশ বেড়ে চলছে। যেটুকু অকম্য হয়েছে সেটার দায় যে আমার সেটা নীল তার চোখের রাগী চাহুনি দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। পিনপনা নীরবতা থানায়। পুলিশ অফিসার আসার অপেক্ষায় বসে আছি দুজন। পুলিশ অফিসার আসলে যে বড়সড় একটা কান্ড ঘটবে সেটা দুজনেই আন্দাজ করতে পারছিলাম। অপেক্ষার প্রহর বেশিক্ষণ গুণতে হলো না, দুজনের সামনে এসে বসলেন এক যুবক। বুঝতে বাকি রইল না ইনিই হলেন সে পুলিশ অফিসার। দুজনেই ভয়ে ঢুক গিলতে লাগলাম। ভয়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল পুলিশ অফিসারের আচমকা প্রশ্নে।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)