ডাক্তার সাহেব পর্ব -১৫
#শারমিন আঁচল নিপা
বুকটা কাঁপছে থরেথরে। আচমকা এরকম ঘুম ভাঙলে শরীরটা ভারী লাগে ভীষণ। লক্ষ্য করলাম রিদি কাকে যেন ফোনে যা’ তা বলছে। আমি ঘুম থেকে উঠেছি বিষয়টা লক্ষ্য করেই সে তড়িঘড়ি করে কলটা কেটে দিল। আমার সন্দেহ বাড়াল তার ভাবভঙ্গী। সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম
– কী রে কাকে গালি দিচ্ছিলি?
সে ঢুক গিলতে লাগল। আমার সন্দেহ তাতে আরও বেড়ে গেল। প্রশ্নটা আরও গভীর করে বললাম
– উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কাকে গালি দিচ্ছিলি? তোর চিৎকারের শব্দে আমার বুক কাঁপা শুরু হয়ে গেছিল। মায়ের পাশে বসে এভাবে চেঁচামেচি করছিলিস কেন? মা উঠে গেলে কী হত। আর কাকে গালি দিচ্ছিলি বল।
রিদির মুখটা চুপসে গেল। অনেকটা চুপ থেকে বলল
– অনীলকে।
উত্তরটা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। মনে হলো ঝড়ের আগে যে দমকা হাওয়া বয়ে বেড়ায় সেটা এসেই আমার বুকে জোরেসোরে ধাক্কা দিয়েছে। অনীলকে রিদি কেন বকবে! কী ই’বা কারণ! প্রশ্নের জড়তা বাড়তে দেইনি মনে। ঝটপট জিজ্ঞেস করে বসলাম
– নীলকে কথা শুনাচ্ছিলি কেন?
– কেন আবার। কল দিয়ে তোকে চাচ্ছে।
– মানে?
– তোর মোবাইল বন্ধ তাই আমাকে কল দিয়ে তোকে চাচ্ছে।
– সেটা চাইতেই পারে তাই বলে যা’তা বলবি? তুই কী নীলকে পছন্দ করিস?
– আমার বয়েই গেছে নীলকে পছন্দ করতে। আমি তোর ভালোর জন্যই কথা গুলো শুনিয়েছি। তুই অবুঝ। উনি তো অবুঝ না। তোর এসবে কেনই বা উনি সায় দিবে? এমন তো না তোকে বিয়ে করবে। বিয়ের কথা বলতেই বলল
– ১৮ এর আগে বিয়ে করলে বাল্য বিবাহ হবে, মামলায় ফেঁসে যাব। চাকুরিও চলে যেতে পারে। ঝামেলায় ফেঁসে যাব। সিঁথির বয়স ১৮ হলেই বিয়ে করবে। সে পর্যন্ত বিষয়টা গোপন থাকবে। কারণ মফস্বলে এসব জানাজানি হলে মানুষ অনেক কথা শোনায়। আমি তো আর চলে যাচ্ছি না।
উত্তরে বললাম
– তাহলে এনগেজড করে রাখুন।
উনার প্রত্তুত্বর আসলো
– এনগেজড করতে গেলেও বিপদ। পরিবারের চাওয়ার মতো না মিললে ঝামেলা হবে। তাই যা করব একেবারে বিয়ে করব। সে পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব। আর সিঁথি একটু বড় হোক। বুঝদার হোক। স্ট্যাবল হোক। আমি নাহয় ওর পাশে থেকে ওর পথচলার সাথী হলাম। আর দিনশেষে ওরেই রয়ে গেলাম।
কথাটা শোনার পর মনে হলো নীলের মধ্যে ঝামেলা বা ত্রুটি রয়েছে নাহয় সে এনগেজমেন্টে রাজি কেন হবে না। বুঝতেই পারছিলাম তোর সাথে মজা লুটবে তাই তোকে উস্কে দিচ্ছে। তাই মুখে যা এসেছে বলে দিয়েছি।
রিদির কথা শুনে কেমন জানি চুপ হয়ে গেলাম। রিদি ঠিক নাকি নীল ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। দু’টানা কাজ করছে মনে। তবে যা করেছি আমি করেছি। নীল কখনও এসবে আমাকে জড়াতে চায়নি। সবচেয়ে বড় কথা নীলের সাথে যোগাযোগও হয়েছে আমার মাধ্যমেই। আমি চেয়েছি তাই। এখানে নীলের কোনো দোষ আমি দেখছি না। তাই নীলকে কথা শুনানোর কোনো অর্থও নেই। কিছুটা রেগেই উত্তর দিলাম
– সে যাইহোক। আমাকে বলেছিস আমি মেনে নিয়েছি। নীল যদি বাজে হয় নীল কে সায় না দিলেই হলো। তুই কেন এতগুলো কথা শুনাবি? তুই আমার ভালো চাইতে গিয়ে অন্য মানুষকে না বুঝে অপমান তো করতে পারিস না। একটা মানুষকে যা’তা বলতে গেলেও অধিকার লাগে। কোন অধিকারে তুই যা’তা বলেছিস? তোকে তো সে অধিকার কেউ দেয়নি। যা হয়েছে সেটা তো আর নতুন করে ঠিক করা যাবে না। তুই নীলকে সরি বলবি। আর আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিই যে নীলের সাথে যোগাযোগ অফ করে দিব। তারপর এমন করাটা তোর অন্যায় হয়েছে বলে আমার মনে হয়। তুই বড় হতে পারিস তবে আমার বিষয়টা আমি ছাড়া অন্য কারও অনুধাবন করার ক্ষমতা নেই। তাই বাহিরে যা দেখছিস ভেতরে তো তার উল্টাটাও চলতে পারে। কারও বাহির দেখে ভেতর কেন বিবেচনা করবি? আর সেটা আদৌ উচিত না। আশাকরি নীলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবি।
রিদি আমার কথা শুনে আর কোনো উত্তর দিল না। চুপ হয়ে বসে রইল। তার উত্তরের অপেক্ষাও আমি করলাম না। ধপাশ করে মেঝেতে পুনরায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। চোখটা যেন বাঁধা মানছে না। অল্পতেই কেঁদে দেওয়া মানুষ আমি। তাই চোখের পাতায় জলের অভাব নেই।।মোবাইলটা হাতে নিয়ে খুললাম। পরপর তিনটা মেসেজ নীলের
“দোষটা কী আমার? এভাবে রিদি কথা কেন শোনাল? কী করেছি বলবে একটু? তোমার প্রতি ভালোলাগা থাকা কী অন্যায়? আর পরিস্থিতিও এমন যে তোমাকে বিয়ে করতে পারছি না। এখন বিয়ে করলে চাকুরি চলে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। কারণ ১৮ এর আগে বাল্য বিবাহ ধরা হয়। একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে এমন কাজ করলে বিষয়টা অভিযুক্ত হলে চাকুরি চলে যাবে। বিসিএস টা আমার সাধনা ছিল। অনেক কষ্ট করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। আর আমার পরিবার এখন আমার আয়ের উপর নির্ভরশীল। আশাকরি বুঝবে।”
“মোবাইলটা অন করলে প্লিজ রিপ্লাই করো। আমার অনুভূতি গুলো তোমাকে প্রকাশ করতে পারি না তাই বলে ভেবো না তোমার থেকে দূরে সরে গেলে আমি ভালো থাকব।”
” সময় হলে সব ঠিক হবে। একটু সময় দরকার। আশাকরি বুঝবে।”
নীলের মেসেজ পড়ে বুকের ভেতরটা কেঁদে উঠল। সত্যিই কী আমি এ সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করব নাকি এ সম্পর্ক আমাকে ব্যথা দিবে। কেনো উত্তরেই আমি পাচ্ছিলাম না। সারা শরীর অবশ অবশ লাগছে। শুধু একটা রিপ্লাই দিলাম
“ডাক্তার এসে দেখে গেছে মাকে কালকে রিলিজ দিবে। বাবাও চলে যাবে। আমি জানি না তোমার ব্যপারে কী বলব। মন বলছে তোমাকে চাই সবাই বলছে আমি ভুল। দু’টানা নিয়ে এগুনো যায় না। পথ নাহয় আলাদা হয়েই যাক।”
আর কোনো মেসেজ এর উত্তর আসলো না। মোবাইলটা পাশে রেখে প্রবল ভাবে কাঁদতে লাগলাম। এতদিনের করে যাওয়া সব পাগলামি যেন এখন ফিকে মনে হচ্ছে। এ কষ্টের দাবনাল থেকে বের হতে পারব কী না জানি না। এমন কী কোনো আলাদিনের চেরাগ নেই যেখানে তিনটা শর্ত দেওয়া হবে আমি তিনটার উত্তরেই দিব নীলকে চাই। চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে। চোখটা বন্ধ করলেই যেন নীলের মুখটা ভেসে আসছিল। নীলের চোখটা,তার নিঃশ্বাসের শব্দ,মিষ্টি সুর,চোখের চাহনী সব যেন আমাকে আরও কাছে ডাকছে। সত্যিই কী আমি পারব তাকে ছাড়া থাকতে। ভাবনার কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না।
পরদিন সকালে মাকে রিলিজ দেওয়া হলো। বাবা,মা আর রিদিকে নিয়ে বাসায় আসলাম। একমাস মাকে বিশ্রাম নিতে হবে। বাবা রিদিকে বাসায় রেখে গেছে। নীলের সাথে ফোনে কী যেন কথা বলেছে জানি না। তবে বাবার পাশে গিয়ে নীলের কন্ঠটা শুনতে প্রবল ইচ্ছা করছিল। সে মেসেজের পর নীল আর কল বা মেসেজ কিছুই দেয়নি। শত কিছুর মধ্যেও যেন বড্ড শূন্য আর একা লাগছে। সেদিন বিকেলবেলায় বাবা জরুরী কাজে ঢাকায় চলে গেল। আর আমি যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। নীলকে হারিয়ে ফেলেছি ভাবতেই যেন বুক কেঁপে উঠছে আমার। মায়ের পাশেই শুলাম সেদিন। মাকে ধরে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। একটু যেন স্বস্তি মিলছিল। মায়ের নিঃশ্বাসের অনেক শক্তি। শত কষ্টটাও যেন এ পরম মমতা মাখা নিঃশ্বাসের ছোয়ায় হালকা হয়ে যায়। এটা হয়তো মায়েদের দেওয়া সৃষ্টিকর্তার বিশেষ শক্তি। অনেক শান্ত মনেই ঘুমালাম।
ভোর ৬ টা। চারপাশে সবে আলো ফুটেছে। পূর্ব আকাশে সূর্যটা এখনও লাল। পাখি গুলো কিচিরমিচির করে উড়ছে। বাতাসটা বেশ মৃদু ভাবে বইছে। ঘরের দরজটা খুলে দরজার পাশে বসে দরজায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে আকাশ দেখছিলাম। এর মধ্যেই কারও কন্ঠস্বর আমার কানে আসলো। চিনতে ভুল হলো না। এ কন্ঠস্বর চিনতে কখনও ভুলও হবে না। কারণ এ কন্ঠস্বর শুনলে আমার বুকের বা পাশটার গতিবেগ বেশ জোরে উঠানামা করে।
আমি পাশ ফিরতেই নীলের মুখ অবয়বটা দেখলাম। আমি কিছু একটা বলতে যাব এর আগেই সে…
(কপি করা নিষেধ)