ডাক্তার সাহেব পর্ব- ১৪
#শারমিন আঁচল নিপা

সে বাবাকে বলল

– আংকেল এলার্জির সমস্যা আছে আমার। তাই ঠোঁটের চারপাশ চুলকানোর জন্য এমন লাল হয়ে আছে। সকালে গরুর মাংস আর চিংড়ি মাছ খেয়েছিলাম তো সেজন্য। বাসায় গিয়ে ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। খাবলার দাগও চলে যাবে।

বাবা সব গুলো কথায় স্বাভাবিক ভাবে শুনছিল। শেষের কথাটা শুনে কপালটা কুঁচকে নীলের দিকে তাকাল। বিস্ময়ের রেখা বাবার চোখে মুখে প্রস্ফুটিত। বাবা বিস্ময়টা বহাল রেখেই বলল

– খাবলা মানে?

এদিকে আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। নীলকে আমি মোটেও ভরসা করতে পারি না। কী থেকে কী করে বসে বলা যায় না। তার উপর সে বাবাকে বলে দেওয়ার একটা ফন্দি আটতেছে। এখন কী আমার উচিত বাবার সামনে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানা নাকি এতে বাবা আরও সন্দেহ করবে। বাবার চোখ মুখে প্রশ্নের বলি রেখা ফুটে উঠেছে। জিজ্ঞাসু চোখে এখনও নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল নিজেকে স্বাভাবিক করে হালকা হেসে বলল

– আংকেল এ খাবলা খুবলা দাগ মানে উঁচু নীচু লাল দাগ গুলো। আমাদের এলাকায় এরকম দাগকে খাবলা, খুবলা বলে।

বাবার চোখ মুখ থেকে প্রশ্নের বলি রেখা ঘুচে গেল। ভাঁজ করা কপালটাও স্বাভাবিক আকার ধারণ করল। বেশ জোর গলায় আমাকে বলে উঠল

– সিঁথি ফল কাটা কী হয়েছে? দ্রূত দে তো। বাসায় যেতে হবে। রাত হয়ে যাচ্ছে। দেরি হলে গাড়ি পেতে সমস্যা হবে।

আমি নিজেকে সামলে নিলাম। কিছুটা যেন স্বস্তি মিলল। স্বাভাবিক সুরেই জবাব দিলাম

– হ্যাঁ বাবা প্রায় শেষ। এখনই দিচ্ছি।

বলেই ফলগুলো দ্রূত কেটে বাবা আর নীলের সামনে দিলাম। নীলের মুখে লজ্জার বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে। নীলের এ চেহারায় শুভ্রতার শীতল সম্রভ ফুটে উঠেছে। কেন জানি না অযথায় এতটা সুন্দর ওকে লাগছে । মাঝে মাঝে দুটানায় পড়ে যাই আমার চোখের দৃষ্টি সুন্দর নাকি নীল সুন্দর। চুপ হয়েই পাশে দাঁড়ালাম। বাবার আর নীলের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। রিদি আমার দিকে সন্দেহের চোখে এখনও তাকিয়ে আছে। বুঝায় যাচ্ছে বাবা আর নীল বের হলে রিদির ছোবলে পড়তে হবে। তখন নিজেকে কী বলে বাঁচাব জানি না। বাবাকে বুঝিয়ে ফেললেও রিদিকে বুঝানো এত সহজ হবে না। আর যে কম্য করেছি সেটা এতটাও ভালো কম্যও না। কেন যে এমন করে ফেলেছি জানি না। শতবার নিজেকে বাঁধা দিয়েও কেন সামলাতে পারি না জানি না। এটা নিতান্তই আমার আবেগ না তো! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে কেঁপে উঠলাম। হাজার প্রশ্নের সমাচার মনের ভেতর জাগছে। কোনো কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না, শুধু ভেতরে প্রবল বর্ষণ বয়ে যাচ্ছে।

মিনিট দশেক দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল। নীল আর বাবার খাওয়া শেষ। বাবা, মায়ের পাশে বসে মায়ের কপালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে নীলকে বলল

– রুনুর কী ঘুমটা ছাড়বে না? কখন থেকে ঘুমুচ্ছে।

মায়ের পুরো নাম রাহনুমা। বাবা মাকে আদর করে রুনু বলে ডাকে। বাবার মুখে মায়ের প্রতি যে ভালোবাসাটা দেখছতেছি সেটা যেন এতদিন চোখে পড়েও আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। হয়তো এতদিন আমার চোখ ভালোবাসায় মগ্ন ছিল না যেটা নীলকে দেখে হয়েছে। নীল তার নম্র মোলায়েম গলায় জবাব দিল

– এটা স্বাভাবিক আংকেল। ১০-১৫ দিন পার হলে ঘুমের রেশ কেটে যাবে।

বাবার মলিন মুখটা এ কথা শুনে যেন একটু ভরসা পেল। আশ্বস্ত কন্ঠে জবাব দিল

– ঢাকায় চলে গেলে মাঝে মাঝে তোমার আন্টিকে দেখতে যেও।

– সে চিন্তা করতে হবে না। আমি সময় পেলেই আন্টির খুঁজ নিব।

– যাইহোক আটটার উপর বাজে। চলো বাসায় যাওয়া যাক।

নীল আর বাবা বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিল। দুজনেই কেবিনের দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। নীলের এ চলে যাওয়াতে কেন জানি না আমার বুকে করুন বীণার তাল বেজে উঠছে। মনে হচ্ছে সে আরেকটু থাকুক। সারাজীবন আমার হয়ে থাকুক। ওকে ছাড়া যেন নিজেকে ছন্নছাড়া আর অসহায় লাগছে। নীল আর বাবা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হচ্ছিল ততক্ষণেই আমি খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। শুনেছি চোখের আড়াল হলেই নাকি মনের আড়াল হয়। ব্যাখ্যাটা বেমালুম ভুল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কারও চোখের আড়াল হলেও তার অনুপস্থিতি মনের গহীনে উপস্থিতির জানান দেয়। যেমন নীলের অনুপস্থিতে আমাকে আরও বেশি নীলের উপস্থিতি অনুভব করাচ্ছে। আমার অনুভূতির সমান্তরালে শুধু নীলের বিচরণ। রিদির ডাকে নীলের ঘোর থেকে বের হলাম। আমার দুবাহু ধরে রিদি তার দিকে ফিরাল। বেশ কড়া করেই বলল

– তুই যা করছিস সেটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না সিঁথি। তোর এ আবেগ তোকে হ্যাংলা, বোহায়া বানিয়ে দিচ্ছে। নীল একটা ছেলে তার কাছে এসব ভালোই লাগবে। তবে প্রয়োজন শেষ হলে দেখবি তোকে ছুরেও ফেলে দিছে।

রিদির কথার মানে বুঝলেও আমি না বুঝার ভান ধরলাম। বেশ হেয়ালি করে জবাব দিলাম

– আরে কী বলছিস… আর কেন এমন বলছিস? কী এমন করেছি! এখানে হ্যাংলামোর কী আছে? আজিব…! নীলকে পছন্দ করি তার মানে এই না যা’ তা করব।

– তুই কী করেছিস সেটা তোর অজানা না। আশা করি আমার থেকেও ভালো জানিস। এসব আবেগ খুব খারাপ জিনিস। নীলকে ভালোবাসার চেয়ে তুই নীলের নেশায় ডুবে যাচ্ছিস। তোর বোধ শক্তি লুপ পাচ্ছে। তুই চিন্তা কর আমরা যদি দেখি কোনো মেয়ে কোনো ছেলের গায়ের উপর ইচ্ছাকৃত দুই দিনের পরিচয়ে হেলে পড়েছে তাকে কী বলব। তোর মনকে তুই প্রশ্ন কর। তারপর তুই যা করেছিস সেটা ভাব। সবমিলিয়ে যা হচ্ছে খুব খারাপ হচ্ছে। আর এগুস না এভাবে। আমি তোর থেকে স্টুডেন্ট খারাপ হলেও বয়সে বড় আর বুঝিও বেশি। তোর এ বয়সটা অনেক খারাপ। নিজেকে সামলা।

রিদির কথা শুনে থমকে গেলাম।৷ সত্যিই তো আমি যা করছি সেটা কী আদৌ ঠিক? কেনই বা ইচ্ছাকৃত কোনো কারণ ছাড়াই নীলের কাছে নিজেকে লুটিয়ে দিচ্ছি। আমি কেন তাকে দেখে সামলাতে পারি না। কেন তার জন্য বুক থৈ থৈ করে। সত্যিই কী এটা আমার নেশা নাকি ভালোবাসা? প্রশ্নবিদ্ধ হলো মনের মধ্যে। বুকটা কাঁপছে। বাঁ পাশটায় প্রচন্ড ব্যথার অনুভব হচ্ছে। নীলের থেকে নিজেকে কীভাবে দূরে সরাব জানি না। আমি কী সত্যিই পারব নীলের থেকে নিজেকে দূরে সরাতে? কেন নীলকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছে। কেনই বা তাকে ছাড়তে পারছি না। কেনই বা তার অনুপস্থিতির কথা চিন্তা করলে আমি স্তবির হয়ে যাই। চোখ টলমল করছে। রিদি আমার দিকে তাকিয়ে এবার মোলায়েম কন্ঠে বলল

– জীবনের কিছু সময় বিবেক থেকে আবেগের বিস্তার বেশি লাভ করে। সেটা পার করতে পারলেই তুই সফল। ভেবে দেখিস। এসব আবেগে গা ভসিয়ে দিলে ভোগতে তোকেই হবে। তোর বড় বোন আমি তোর খারাপ চাইব না। নীল কেমন ছেলে আমাদের জানা নেই। তাকে কী তোর এতটা বিশ্বাস করা ঠিক হচ্ছে? নিজে নিজে ভেবে যা ভাল লাগে কর। বড় বোন হিসেবে এলার্ট করে দায়িত্ব পালন করলাম।

বলেই রিদি মায়ের পাশটাই গিয়ে বসল। আমার শরীরটা অসাড় লাগছে। বাস্তবমুখী হতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কেবিনের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। চোখটা বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করতে লাগলাম। রিদি যা বলেছে সেটা মিথ্যা না। তবে আমি আমাকে সামলাতে পারব তো? কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। করুণ হয়ে যাচ্ছে জীবন। এ জীবনের সুর এত বদলায় ক্ষণে ক্ষণে আগে জানা ছিল না। মোবাইলটা বেজে উঠল। নীল মেসেজ করেছে

” বাসায় যাচ্ছি। গিয়ে কল দিব। আর কিছু মনে করেনি। তবে এ পাগলামো আর করো না। ঠোঁটটা এখনও ব্যথা করছে। কালকে কলিগদের সামনে যাব কী করে সে চিন্তায় আছি”।

নীলের মেসেজটা দেখে বারবার মন চাচ্ছিল একটা রিপ্লাই দিই। কিন্তু রিদির কথাগুলো মনে হয়ে হাতটা কেঁপে উঠল। পারলাম না উত্তরটা দিতে। চুপ হয়ে মোবাইলটা পাশে রেখে দিলাম। বুকের ভেতরট চিড়ে যাচ্ছে। কষ্টে যেন কলিজাটা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। নীলকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে আমি পারছি না। চোখ বেয়ে জল টুপ টুপ করে গাল বেয়ে মেঝেতে পড়ছে।

ঘন্টা খানেক পার হলো। মোবাইলটা বেজে উঠল। নীল কল করেছে। ধরতে মন সায় দিচ্ছে না। কলটা কেটে দিলাম। সাথে সাথে মেসেজ আসলো

“কোনো সমস্যা”

উত্তর দিলাম না। মোবাইলটা বন্ধ করো শুয়ে পড়লাম। কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর জন্য যুদ্ধ করছিলাম। যখন চোখটা লেগে গেল তখন হালকা চেঁচামেচির আওয়াজে চোখটা খুললাম। অনেকটা হন্ত দন্ত করেই শুয়া থেকে উঠে বসলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে? বুকটা কাঁপছে থরেথরে।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here