#জুনিয়র_পদ্ম
পর্ব-০৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

জল ও জঙ্গলের কাব্য বা পাইলট বাড়ি রিসোর্টটি গাজীপুর জেলাস্থ টঙ্গীর পোবাইলে নব্ব‌ই বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই রিসোর্ট টি প্রকৃতিকে প্রায় অবিকৃত রেখে বাঁশ ও পাঠখরি দিয়ে সুনিপুণ ডিজাইনের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে। রাজধানী ঢাকার কাছেই খুব অল্প সময়েই একটি মোহনীয় দিন কাটানোর জন্য “জল ও জঙ্গলের কাব্য” একটি চমৎকার স্থান।ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়।জায়ানরা অবশ্য একদিন এক রাত থাকবে। শহরের আবদ্ধ স্থানে থেকে, কখনো সখনো এরকম গ্রামিন পরিবেশের ছোঁয়া মন্দ হয় না। সবাই খুব খুশী এখানে এসে। পদ্ম’র মন খুব ফুরফুরে হয়ে আছে এখানে আসার পর থেকে, নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে। সাথে নিজের ছোট্ট গ্রামের কথা মনের কোণে ভাসছে।

বাঁশ,পাঠখরির বেরা,ছনের ছাউনি,দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এখানে জন্ম দিয়েছে পরিছন্ন গ্রামিন ছোঁয়া। অনাবিল সবুজ আর বিলের শান্ত জলে বরশি হাতে একটি দুপুর নিবৃতচারী মনের স্বপ্ন স্বাদ পূরনের জন্য যথেষ্ট।পদ্ম বৈঠা হাতে বিলের নৌকায় চড়ে বসে।জায়ান পদ্ম কে জিজ্ঞাসা না করেই সেও নৌকায় ওঠে! অনেক সাহস সঞ্চয় করে তাকে নৌকায় উঠতে হয়েছে কারণ জায়ান সাঁতার জানে না! এদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অসমি! কিছু বলতে যাবে তার আগেই জান্নাত আর অর্পিতা বললো,
–“চলুন আমরা ওদিকটায় যাই, খুব সুন্দর ছনের ছাউনি আছে।

অসমি এখান থেকে মনোযোগ সরিয়ে, তাদের সাথে যায়।জায়ান প্রশান্তির হাসি হাসে।
_______

জায়ানদের বাসায় অসমির আসার কারণ ছিল জান্নাত! পদ্ম’র এ বাসায় থাকা নিয়ে অসমি ঝামেলা করবে ভেবে,অসমি এবং তার ছেলে মেয়ের জন্য বসন্তের পোশাক পাঠানো হয় এবং জান্নাত’দের সাথে বেরাতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়।অসমির তখন খুশি আকাশ ছোঁয়া। নতুন পোশাক তার উপর বেরাতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ খুবই খুশি হয়, তাইতো তৈরি হয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে আর মনে মনে ধন্যবাদ দেয় পদ্ম কে।আর অনিতা আর ইরা প্লান করে অসমি কে জানায় যে ইরা পদ্ম’র বন্ধু! পদ্ম প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়,যেখানে রাহি কে গতকাল প্রথমবারের মতো দেখেছে পদ্ম! তাছাড়া রাহি পদ্মর থেকে সিনিয়র।
অসমি যখন জানতে পারে পদ্ম বোরকা পরে যেতে চায় তখন সে ই পদ্ম’কে রাজি করিয়ে, তৈরি করে নিয়ে আসে। তারপর গাজিপুর জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে র‌ওনা হয়ে আসে।
_______

পদ্ম নৌকা খানিকটা দূরে নিয়ে বিল থেকে পদ্ম ফুল তুলে নেয়।পদ্ম কে এই মূহুর্তে ইউলোকুইন লাগছে, হলুদ রঙের গাউন এর সাথে হলুদ রঙের ফুলের গহনা, মাথায় ফুলের ক্রাউন। গায়ের রঙের সাথে একদম মিলে মিশে একাকার।
আর জায়ান বাচ্চাদের মত নৌকার মাঝ খানটায় বসে নিজের ফোনে পদ্ম’র এই নির্মল হাসি আর দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে।
পদ্ম রাগি মুখশ্রী করে বলে,
–“কি করছেন আপনি?
–“একটা “ইউলোকুইনের” ছবি তুলছি!
–“আমি বলছি আপনাকে ছবি তুলতে?
–“আমার বউ এর ছবি আমি তুলবো, এতে আমি অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে নাকি?

“আমার বউ”
সামান্য একটা সাইন করে,ব‌উ হয়ে গেলাম কি আজব দুনিয়া!

পদ্ম হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ায়, জায়ান জিজ্ঞাসা করলো,
–“কিছু বলছেন না যে?

পদ্ম কোন জবাব না দিয়ে নৌকা তীরে নিয়ে এসে, নেমে আসে নৌকা থেকে।জায়ান ধীরে ধীরে নৌকা থেকে নেমে এসে, দুপুরের খাবার নিয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে যায়।

পদ্ম নৌকা ভ্রমণ শেষ করে মামাতো বোন ফারিহা আর মামাতো ভাই ফারুক কে নিয়ে,বড় একটা আম গাছে দোলনা তৈরি করে! ফারুক গাছে চড়ে রসি লাগিয়ে দেয়। নিজেদের তৈরি করা এই দোলনার দোল খেতে খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের ছেলে মেয়েরা এই পদ্ধতিতে দোলনা তৈরি করে। প্রথমে ফারিহা আর ফারুক ওঠে দোলনায়।ওরা বায়না করে ওদের বিশ বার দোল দিতে হবে। পদ্ম মেনে নেয়, ওদের বিশ বার করে দেওয়া হলে পদ্ম ওঠে দোলনায়। কয়েকবার দোল দেওয়ার পর খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে দোল দেওয়া হয় পদ্ম কে যার দরুন পদ্ম’র জান যায়যায় অবস্থা। এরকম একের পর এক দিতে দিতে পদ্ম ভয়ে চুপসে যায় যার দরুন হাত ফসকে দোলনা থেকে খানিক দূরে ছিটকে পড়ে!পদ্ম’র শেষ কথা শুনা যায় আব্বুওওওওও!
জায়ান রিসোর্টের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে, পদ্ম কে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে ছনের ছাউনীর কাছে আসে কিন্তু এখানেও পদ্ম নেই। তারপর জান্নাতের কাছে যায়,জান্নাত আর এরশাদ হোসেন পানিতে পা ডুবিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যাস্ত।জায়ান দূর থেকে জানান দেয় তার উপস্থিতি। জান্নাত আর এরশাদ হোসেন ছেলের চিন্তিত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
–“আম্মু পদ্ম কোথায় দেখেছো?

জান্নাত আর এরশাদ বিগলিত হাসে ছেলের এই বেহায়াপনা দেখে।জায়ান বুঝতে পেরে বললো,
–“প্লিজ এভাবে হেসো না বলো না দেখেছো কিনা?

জান্নাত হাসির রেশ কাটিয়ে বললো,
–“দেখ হয়তো ওর মামির সাথে আছে।
–“আচ্ছা দেখছি।

জায়ান চলে যাওয়ার পর, এরশাদ বললো,
–“আমার ছেলে ঠিক আমার মতোই হয়েছে।

জান্নাত খানিক ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে বললো,
–“কি রকম?

এরশাদ গর্বের সাথে বললো,
–“প্রেমিক পুরুষ!
–“আসছে আমার প্রেমিক পুরুষ।
–“তুমি কি অস্বিকার করছো জানু? মনে নেই তোমার বাবার সামনে থেকে তোমাকে কিভাবে তুলে নিয়ে এসেছিলাম!
–“সে আর বলতে, কি পাগলামী টাই না করেছিলে।বাবা তো তোমাকে জেলে ও দিতে চেয়েছিলেন! সেদিন মায়ের জন্য বেঁচে গিয়েছিলে।
–“হুম, শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তা’আলা ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন আমিন।
–“সুম্মা আমিন।
–“দেখতে পঁচিশ টা বছর কেটে গেল তাই না? সময় যে কখন চলে যায় বলা যায় না।
________

জায়ান কিছুটা হেঁটে গিয়ে দেখে, অসমি ভিডিও কলে কাউকে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখাচ্ছে। হয়তো তার প্রবাসি স্বামী কে দেখাচ্ছে।জায়ান এক পা এগিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে গেল, ভাবলো অসমি কে পদ্ম’র কথা জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না। উল্টো পাল্টা চিন্তা ভাবনা করলে, পদ্ম কে কথা শুনতে হবে।তাই এখান থেকে প্রস্থান করে।
অনিতার ফোনে কল দেয়, সাথে সাথে রিসিভ করে অনিতা।বললো,
–“ভাইয়া বল?
–“কোথায় তুই?
–“এই তো পুকুর পাড়ে,বাঁশের খুঁটির এখানে। কেন বলোতো?
–“পদ্ম কোথায়?
–“আমি তো জানি না,ভাবীমনি তো আমাদের সাথে নেই।

জায়ান আর কিছু না বলে কল কেটে দেয়। তখন দেখতে পায় ফারিহা আর ফারুক কি যেন নিয়ে দৌড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে ফারুক কিছু নিয়েছে আর ফারিহা তা উদ্ধার করার মিশনে নেমেছে!জায়ান‌ও ওদের পিছনে দৌড়ায় এক পর্যায়ে দুজনের নাগাল পায়।
–“তোমরা তোমাদের আপু কে দেখেছো?

জায়ানের প্রশ্ন শুনে দুজনেই সচকিত হয়ে বললো,
–“,আপু খুঁজছেন কেন আপনি?

জায়ান নিজেকে ধাতস্থ করে নরম গলায় বললো,
–“আচ্ছা তোমরা কি নিয়ে দৌড়াচ্ছিলে?

ফারিহা অভিযোগের স্বরে বললো,
–“এই বেয়াদব টায় আমার চকলেট নিয়ে গেছে,

ফারিহার কথা শেষ না হতেই ফারুক বললো,
–“তুমি যে আমার নামে বাবার কাছে বিচার দিসো সেটার কি হবে? আমিও তোমাকে চকলেট দিব না।
ব্যাস আবার দুই ভাই বোনের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়!
ফারিহা এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে আর ফারুক পঞ্চম শ্রেণীতে। এখনো এদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক! একজন আরেকজনের ছায়া ও যেন সহ্য করতে পারে না।
জায়ান দু’জনের ঝগড়া থামিয়ে বললো,
–“আমি তোমাদের অনেক চকলেট কিনে দিব,তোমরা শুধু বলো পদ্ম আই মিন তোমাদের আপু কোথায়?

ফারিহা আর ফারুক খুশি হয়ে বললো,
–“আপু ঐখানের একটা গাছে বসে দোল খাচ্ছে।
–“আমাকে নিয়ে চল দুজনে।

তারপর ওদের সাথে জায়ান সেই গাছের কাছে যায়। কাছাকাছি গিয়েই দেখতে পায় পদ্ম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে! এই দিকটায় মানুষের আনাগোনা না থাকায় কেউ দেখতে পায়নি পদ্ম কে।জায়ান মাটিতে বসে পদ্ম’র মাথা কোলে রাখে, কপালের কিছু অংশ কেটে রক্ত ঝরছে,ঘ্রাণেন্দ্রিয় রক্ত জমাট হয়ে আছে। পদ্ম’র এরকম অবস্থা দেখে জায়ানের ভিতরটা যেন পুরে যাচ্ছে। ফারিহা আর ফারুক বোনের এই অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ায়!জায়ান কোন রকমে কোলে তুলে নেয় পদ্ম কে।
এর ঘন্টা খানেক পর পদ্মর জ্ঞান ফিরলো।ডাক্তার ক্ষত স্থান ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন।সবাই নানান প্রশ্ন করছে কিভাবে কি হলো? পদ্ম বলতে পারলো না হঠাৎ কি হয়েছিল। তাই সবাই ভেবে নিল দোলনা থেকে বেকায়দায় পড়ে গেছে হয়তো।

জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে নিজস্ব জমিতে চাষ করা শাকসবজি,ধান এবং বিলের ধরা মাছ দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়।জল ও জঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে দেশিও খাবার ও পিঠা পরিবেশ করা হয়।
দুপুরে খাবার তালিকায়,ভাত,মুরগির গোশত,চালতা দিয়ে ডাল, তেঁতুল দিয়ে কচু মুখি,রুই মাছ, আলুর ভর্তা,ডাল ভর্তা, ছোট মাছ ইত্যাদি আরো বেশ কিছু মজাদার খাবার। সবাই খুব তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে, আর জায়ান প্লেটের খাবার নারছে ও আর চোখে পদ্ম কে দেখছে।জায়ানের বাবা সবাই কে ভর্তা দিয়ে খাবার শুরু করতে বলেছেন,তো জায়ান পরেছে বিপদে!জায়ানের গোশত খুব পছন্দ, বিশেষ করে গরুর গোশত। সেখানে ভর্তা দেওয়া হয়েছে, বেচারা কিছু বলতে পারছে না। জান্নাত ব্যাপার টা বুঝতে পেরে, জায়ান কে মুরগির গোশত ভুনা দিল। এতে মায়াভরা চোখে তাকায় জায়ান, তার মায়ের থেকে বেশি কেউ তাকে এভাবে বুঝতে পারে না।
এদিকে পদ্ম খেতে চাচ্ছে না,অসমি অনেক জোর করে পদ্ম কে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। খাবার খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে।

_________

দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করে,কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে সবাই ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। কথা ছিল আজকে এখানে থাকার কিন্তু পদ্ম’র কথা চিন্তা করে আর থাকলো না জায়ানের পরিবার।
রিসোর্ট থেকে ফিরে জায়ান এবং পদ্ম’র পথ আলাদা হয়ে যায়! দুজন দুজনের বাসায়। জান্নাত অসমি কে কল করে জেনে নেয় তারা ঠিক মতো বাসায় পৌঁছেছে কিনা?

এর এক সপ্তাহ পর,
জায়ান পদ্ম’র মামির বাসায় আসে! এসে তালা ঝুলানো দেখে বাসায়। এই এক সপ্তাহে পদ্ম কোন রকম যোগাযোগ রাখেনি জায়ানের সাথে।
একজন মহিলা বললো,
–“বাড়িওয়ালার ভাগ্নির বিয়ে!সে জন্য তারা সবাই গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।

জায়ান আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
–“ভাগ্নির নাম কি আপনি জানেন?
–“জানবো না কেন?ও তো এখানেই ওর মামার বাসায় থাকতো!

#চলবে,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here