#জুনিয়র_পদ্ম
#অন্তিম পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
সকাল থেকে পদ্ম অন্য মনস্ক হয়ে আছে,জায়ান কলেজে চলে গেছে। জান্নাত এটা ওটা বলে পদ্ম কে হাসানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পদ্ম’র এতে কোন ভাবান্তর নেই। জান্নাত রোদের বেলা ঝাল ঝাল করে পাকা তেঁতুল, ধনেপাতা দিয়ে ভর্তা করে এনেছে। কিন্তু এতেও পদ্ম’র মুখশ্রী পরিবর্তন দেখলো না! অথচ অন্য সময় পদ্ম কতো খুশি হয়ে খাওয়া শুরু করতো, এখন তেমন খাচ্ছে ও না। জান্নাত বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেও কোন উত্তর পেল না।পেট ব্যথা করছে কিনা তাও বলছে না। বাড়ি থেকে ইলোরা কল করেছে তাও একটু কথা বলে জান্নাত কে দিয়ে দেয়। জান্নাত ইলোরা কে জানায় পদ্ম আজকে কারো সাথে তেমন কথা বলছে না। ইলোরা ভাবে হয়তো জামাইয়ের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে,তাই পদ্ম কে আবার কল করে বোঝায় যাতে জায়ানের সাথে ঝগড়া ঝাটি না করে। মায়ের এরকম উল্টো পাল্টা ধারনা শুনে পদ্ম’র মেজাজ বিগড়ে যায়,তাই ইলোরার কথার মাঝেই কল কেটে দেয়। শাওয়ার নিয়ে এসে খুব কষ্ট করে চেয়ারে বসে যোহর নামায আদায় করে পদ্ম! তারপর জান্নাত এর জোরাজুরি তে একটু খানি খেয়ে শুয়ে থাকে। নিজের রুমে ফ্লুরে বালিশ নিয়ে শুয়েছে পদ্ম, পদ্ম’র যখন খুব খারাপ লাগে অসুস্থ অনুভব হয় তখন ই এরকম করে।ফ্লুরে শুয়ে থাকলে নাকি তার কাছে অনেক ভালো লাগে।
বিকাল চারটায় বাসায় ফিরে জায়ান, কলেজে প্রথম সেমিষ্টার পরিক্ষা শেষ হলো আজকে। তাছাড়া প্রিন্সিপাল স্যার মিটিং রেখেছেন পরীক্ষা শেষে যার দরুন এতো দেরি করে বাসায় ফিরতে হলো জায়ান কে। পদ্ম কে এভাবে ফ্লুরে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়। কিন্তু ঘুমিয়ে আছে বলে কিছু বলে না।ফ্রেশ হয়ে আসলে জান্নাত খাবার খেতে দেয়। খাবার খেয়ে এসে পদ্মর পাশে শুয়ে পরলো জায়ান। পদ্ম’র মলিন মুখে হাত ছুঁয়ে দেয় জায়ান, কিছু চুল চোখের সামনে পরে থাকায় সরিয়ে দেয় সেগুলো। তারপর নিজেও চোখ বন্ধ করে।
________
জায়ান পরিক্ষার খাতা দেখছে। খাতা দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছে গান শুনতে, কিন্তু তা কখনোই সম্ভব নয়।পদ্ম এখন আর জায়ান কে গান শুনতে দেয় না।জায়ান অবশ্য বিয়ের আগে বলেছিল, আপনাকে পেলে আমি গান শুনা ছেড়ে দিব ঘুমবাবু।আর সেই কথা রাখতেই জায়ান এখন আর গান শুনে না, মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে শুনতে কিন্তু তাও শুনে না।
জায়ান গানের চিন্তা বাদ দিয়ে পুনরায় খাতায় মনোনিবেশ করে,তখন পদ্ম এসে বললো,
–“আচ্ছা আপনি আমাকে এখনো আপনি করে কেন সম্বোধন করেন?
জায়ান খাতায় চোখ রেখেই বললো,
–“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
–“বলেন না?
জায়ান এবার পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমার ও একই প্রশ্ন, এবার আপনি বলেন?
পদ্ম হাতে থুতনি ভর করে রেখে বললো,
–“আমার বিয়ের অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে বর কে আপনি করে সম্বোধন করবো, তাই বলি। এবার আপনার টা বলেন?
জায়ান পদ্ম’র কাছে গিয়ে, গাল দুটো ধরে বললো,
–“আপনাকে সেই প্রথম থেকে আপনি করে সম্বোধন করে আসছি, এটাতে কেমন একটা অভ্যস্থ হয়ে গেছে।তাই আপনি করেই বলতে ভালো লাগে আপনাকে। বুঝাতে পারলাম?
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে হা বুঝায়।জায়ান তখন বলে,
–“আমার লক্ষী বউ টা। এবার আমি খাতা গুলো দেখি?
–“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসি।
–“আম্মু ই নিয়ে আসবে, আপনাকে যেতে হবে না। আপনি আমার পাশে বসে থাকুন, তাহলেই আমার ভালো লাগবে।
বলতে বলতে জান্নাত চা নিয়ে রুমে আসে।জায়ানের পরিবারের সদস্যরা সবাই চা খুব পছন্দ করে,তাদের দুই তিন বেলা চা না খেলে চলেই না। পদ্ম’র পরিবারে আবার এরকম নয়,তারা মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলে খায় বা প্রয়োজন হলে।
পদ্ম চুপচাপ বসে থাকতে পারলো না, কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে ড্রয়িং রুমে গেল। জান্নাত আর এরশাদ মিলে টিভিতে সংবাদ দেখছে। পদ্ম ওখানে গিয়েও স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। আবার চলে এলো রুমে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আকাশের পানে তাকিয়ে রইল।
জায়ান পরিক্ষার খাতা দেখতে দেখতে, খাতার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। বারান্দা থেকে আসা ইয়া আল্লাহ আর্তনাদ শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে বাহির থেকে আসা কিছু আলোয় পদ্ম কে নিচে বসে থাকতে দেখে জায়ান। তাড়াতাড়ি বারান্দায় লাইট অন করে দেখলো বারান্দা জুড়ে রক্তের ছড়াছড়ি! পদ্ম জায়ান কে দেখতে পেয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
–“আমি আর সহ্য করতে পারছি না নির্ঘুম!
জায়ান পদ্ম কে আসস্ত করে বলে,
–“আপনার কিছু হবে না জুনিয়র পদ্ম, আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর আব্বু আম্মু বলে চিৎকার করে ডাকে জায়ান, পাশের রুমে তারা থাকায় দৌড়ে আসে। হসপিটালে নিতে নিতে জায়ান পদ্ম কে বলে,
–“গতকাল থেকে আপনার পেইন শুরু হয়েছে! এতো সময় কিভাবে পারলেন কাউকে না বলে থাকতে? আপনি তো এতোটা শক্ত মনের ছিলেন না জুনিয়র পদ্ম?
পদ্ম চিৎকার করতে করতে অস্পষ্ট স্বরে এটুকুই বললো,
–“সিজার ভয় পাই!
_________
চার বছর পর,
এ্যা এ্যা এ্যা,,,, বাবা?
চার বছরের ছোট্ট আহাদ কাঁদতে কাঁদতে তার বাবা কাছে যায় নালিশ দিতে।জায়ান বই পড়ছিল ছেলের কান্না শুনে বই রেখে এসে চোঁখের পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–“কি হয়েছে আমার বাবাটার?
ছোট্ট আহাদ কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী নিয়ে বললো,
–“বাবা,,,, আম্মুই মাচচে এ্যা এ্যা এ্যা,,,
আবার কাঁদতে শুরু করে দেয়।জায়ান বললো –“কেন মারলো আম্মু ধারাও আম্মুকে বকে দিব চলো, কোথায় আছে আম্মু?
জায়ান আহাদ কে নিয়ে উঠে দাঁড়ালে, রেগে মেগে আগুন হয়ে পদ্ম আসে রুমে। এসে বললো,
–“একদম ছেলেটাকে পস্রয় দিবেন না। আপনার আস্কারা পেয়ে পেয়ে ছেলে টা দিনকে দিন বাঁদর হতে চলেছে। ইচ্ছে করছে আরো কয়েকটা থাপ্পর লাগাই।
–“কি এমন ক্ষতি করেছে আমার ছেলে? না বলেই কখন থেকে বকবক করেই যাচ্ছেন।
–“কয়েলের ছাই গুলো দিয়ে পুরো রুমটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভরে ফেলছে! এখন এগুলো পরিষ্কার করবে কে? সারাদিন রুম গুলো উল্টোপাল্টা করে, আমি গুছাতে অস্থির হয়ে গেছি। এরকম দুষ্টুমি কেন করবে? আমি ও তো ওর মতো ছোট ছিলাম, শান্ত হয়ে বসে থাকতাম। নিশ্চয়ই ছোট বেলা আপনি ওর মতো ছিলেন! সেই জন্যই ছেলেটা এরকম বাঁদর হয়েছে।
জায়ান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,
–“মোটেও না, আমি কত্ত শান্ত শিষ্ট একটা ছেলে ছিলাম আপনি ভাবতেও পারবেন না।
–“হুম শান্ত-শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট! সেরকম ই হয়েছে ছেলেটা।
–“যাই হোক আপনি ওর গায়ে একদম হাত তুলবেন না বলে দিচ্ছি,ও যাই করতে মন চায় করুক। দরকার হলে আপনি পরিষ্কার করবেন না, আগামীকাল কাজের মহিলা এসে সব পরিষ্কার করবে।
পদ্ম রেগে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।
জায়ান বুঝলো আজকে তার রেহাই নেই।
রাতে খাবার খাওয়ার পর জায়ান আহাদ কে ঘুম পাড়িয়ে অপেক্ষা করছে পদ্ম’র জন্য, জায়ান ভাবছে পদ্ম হয়তো কিচেনে কাজ করছে কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর ও যখন পদ্ম এলো না তখন, কিচেনে গিয়ে দেখে পদ্ম নেই লাইট অফ। তখনি জায়ান বুজে গেল পদ্ম জান্নাত আর এরশাদ এর রুমে গিয়ে শুয়ে আছে। এরকম ঘটনা নতুন নয়,যখনি পদ্ম রেগে থাকে তখনি তার শ্বশুর শাশুড়ির রুমে গিয়ে শুয়ে থাকে, অনেক বলেও জায়ান নিজেদের রুমে আনতে পারে না।তাই শেষ মেষ জায়ান ও পদ্ম কে জোর করে জরিয়ে ধরে শুয়ে থাকে নিজেও। কিন্তু এগুলো আহাদ জন্মের আগের ঘটনা, এখন যেহেতু আহাদ আছে তাই জায়ান আহাদ কে নিয়ে এসে পদ্মর পাশে শুয়ে পরে।
রমজান মাসের ছুটি পরেছে কলেজে,তাই জায়ান পদ্ম আহাদ কুমিল্লা যাচ্ছে ছুটি কাটাতে।আহাদের খুশি দেখে কে, দাদা দাদুর কাছে যাচ্ছে বলে তার লাফালাফির অন্ত নেই। গাড়িতে বসে সে যেন ধৈর্য হারা হয়ে যাচ্ছে একটু পর পর জিজ্ঞাসা করছে আম্মু কখন আছবে দাদু বাড়ি?জায়ান পদ্ম বলে একটু ধৈর্য ধর চলে আসবে।
অতঃপর আহাদ তার দাদু বাড়ি এসে পৌঁছায়,এসেই সারা বাড়ি দৌড়াচ্ছে।অনিতার দু বছরের ছেলে আয়ান সেও খুব খুশি আহাদ কে পেয়ে। বিকালের দিকে অর্পিতা আসে তার দুই মেয়ে এক ছেলে তাঁরাও যোগ দেয় আহাদ আর আয়ানের সাথে।আয়ান সবার ছোট বলে সবাই খুব আদর করে। অর্পিতার বড় মেয়ে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখে আয়ান কে।সব নাতি নাতনি কে একসাথে পেয়ে এরশাদ আর জান্নাত আনন্দে আত্মহারা।
শ্বশুর বাড়ি দুদিন থেকে বাপের বাড়ি চলে আসে পদ্ম।জায়ানের কাজ থাকায় পদ্ম আর অনিতা আসে, অর্পিতার শরীর ভালো লাগছে না বলে সে আসে না। পদ্ম নিজের বাড়ি বহুদিন পর এসে প্রান ভরে শ্বাস নেয়।যতই হোক বাপের বাড়ির মতো এতো প্রশান্তি কোথাও নেই। তবে ভাই বোন কেউ নেই বলে একটু মন খারাপ হয় পদ্ম’র। জামিয়া কে কল করে আসতে বলে কিন্তু জামিয়া জানায় তার ছেলে মেয়ের স্কুলে কোচিং আছে তাই আসতে পারবে না। একমাত্র ভাই সেও বিদেশে। এদিকে আহাদ কে নিয়ে পরেছে মুশকিলে বাড়ির কাছে নদী হওয়ায় একা একা চলে যায় নদীর কাছে,তাই অনিতা কে নিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসে পদ্ম।
রাতের বেলা,
সবাই ঘুমিয়ে পরেছে,জায়ানের চোখে ঘুম নেই।তাই পদ্ম কে ডেকে বললো,
–“চলুন না ছাদে গিয়ে রাতের অমায়িক শান্ত মুহূর্তটা উপভোগ করি?
পদ্ম ঘুমে বিভোর হয়ে আছে,তাই জায়ানের কথা যেন কানেই পৌঁছাচ্ছে না।জায়ান বাধ্য হয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় পদ্ম কে পাঁজা কোলে করে এগিয়ে যায় ছাদে।জায়ানের এহেন কান্ডে ঘুম ছুটে দৌড়ে পালায় পদ্ম’র।
বিয়ের কয়েক মাস পর জায়ান পদ্ম’র সাথে ঘুমানোর চেষ্টা করে, প্রথম প্রথম ঘুম না আসলেও পরে ধীরে ধীরে পদ্ম’র উষ্ণতায় ঘুম চলে আসে জায়ানের। ধীরে ধীরে জায়ান ও স্বাভাবিক হয়ে উঠে।অন্য সবার মত দশটা/এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পরে।
ছাদে এসে রেলিং গেসে একটা মাদুর পেতে, রেলিং এ হেলান দিয়ে পদ্ম কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বসে জায়ান। তারপর আকাশের পানে তাকিয়ে মুহূর্তটা উপভোগ করে,আর পদ্ম বাচ্চাদের মত করে গুটিসুটি মেরে জায়ানের উষ্ণতায় আরো আরামে ঘুমিয়ে থাকে।জায়ান হেসে পদ্ম’র কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
🍀 সমাপ্ত 🍀