###জীবন যখন যেমন(২০তম ও শেষ পর্ব)
###লাকি রশীদ

মেঘলা কে দেখে মনে হচ্ছে, কতো বছর পর যেন দেখছি। সেও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,কালো
হয়ে গেছিস কেন ছোটভাই? আমি হেসে বলি,কই
কালো? ঠিক ই তো আছিরে। তোর তো অনেক সাহস হয়েছে। একা একা ঠিকই কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিস। সে এবার বলছে,বারে আমি কি ছোট না কি যে আসতে পারবো না? আমি হেসে বলি, না না তুই ছোট হবি কেন? অনেক বড় হয়ে গেছিস। পেছনে দোলার কথা শোনা যাচ্ছে, বাহ্ কয়েক দিন চোখের সামনে না থাকলে তো বেশ ভালো ই। কই আমাকে তো এই কয়মাসে একবারও এমন করে আদর করিসনি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি,আয়। ৩ ভাইবোন এভাবে দাঁড়িয়ে আছি দেখে মা বলল, অনেক আদর হয়ে গেছে। চা আর পিঠে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নাও তো তোমরা।

চা খেতে খেতে মেঘলা হঠাৎ করে বলে উঠলো,
ঠিক ৩ দিনের ছুটিতে এসেছি ছোটভাই। আইরিন আপুরা কি বাসায় থাকবে এখন? আমি সিলেট থেকে কমলা আর নিকোবিনা সাতকরার আচার এনেছিলাম। মা তখন বলে,পারলে এখন না হয় দিয়ে চলে এসো। কালকে তো আবার তোদের চাচার দাওয়াতে সবাই যেতে হবে। মেঘলা বলে,
আমি যাবো না মা প্লিজ। আমি তারিখ জানলে এখন আসতাম ই না। মা এবার বকছে, ছিঃ। এখন সামনে যখন এসেছিস,যেতে তো আর হবেই। ব্যাগ খুলে দোলাকে ডাঃ খালেদা হক এর
ভাগের গুলো দিল। খালার ভাগের কমলা আমি ছোট একটা টেবিলে মেলে দিলাম। তাহলে ভালো থাকবে। এই ৩ ভাগের জন্য সাতকরা আচার এলেও অভির জন্য আমের আচার এসেছে।আর আমাদের জন্য দুটো ই। আবার আফসোস করছে ইচ্ছে ছিল ভালো চাপাতা আনবো। পরে দেখি,
টাকাও শেষ আর ব্যাগ ভীষণ ভারী হয়ে গেছে। দোলা বলছে,বাহ্ সিলেট তো তোকে ছিদকাদুনে থেকে বেশ স্মার্ট বানিয়ে দিয়েছে রে।

আইরিন আপুকে ফোন দিলে বললেন, মেঘলা কে
নিয়ে চলে আসুন সাদি। আকাশ পরশু বৃষ্টিতে ভিজে ভীষণ কাশি হয়েছে। ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ কাশছেই।
তাই আমরা দুদিন ধরে বাসায় ই আছি। গেলাম দুজন। গিয়ে দেখি সত্যিই আকাশ ভাই কথা বলতে গেলেই অনেক কাশছেন। আমাদেরকে বললেন,এই এসির মধ্যে থেকে থেকেই শরীর এ
রকম বাজে হয়েছে। সারাজীবন বৃষ্টিতে ভিজেছি
কিচ্ছু হয়নি,এখন কি হচ্ছে দেখেন। তবে, মেঘলা কে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। সেদিনের ভয়ার্ত সে মেঘলার সাথে আজকের আত্মবিশ্বাসী মেঘলা
………… অনেক তফাৎ। মেঘলা এবার স্পষ্টস্বরে
বললো,এর শতভাগ কৃতিত্ব আপনাদের। আল্লাহ আপনাদের ভালো রাখুন সবসময়, দোয়া করি।

গেট দিয়ে ঢুকে দেখি বড়চাচা ও অভি বাবুর্চির সাথে কথা বলছেন। মেঘলা কে দেখে চাচা বলেন,
আমি খুব খুশি হয়েছি, তুই এসেছিস। মেঘলা কে বলি,বাসায় চলে যা। আমি এখানে বসি কিছুক্ষণ।এই একটা দিনে যেন বাচ্চাদের ঈদ হয়ে যায়।দোড়াদৌড়ি করছে,খেলছে দেখে খুব ভালো লাগে
বড়ফুপু,ছোট ফুপু এসেছেন। ছোট ফুপু গিয়ে আবার মাকে ধরে নিয়ে এসেছেন। চাচা বলছেন,
আগের সব অন্যায়, বেয়াদবি মাফ করে দিন। আপনি বড়, আপনি না থাকলে অনুষ্ঠান ই ফিকে
হয়ে যাবে। মা হেসে বলল,থাকবো ইনশাআল্লাহ।
এতো করে আর বলতে হবে না। রাতে খেয়ে আমরা ও অভি বাসায় গেলাম। অভি তার জন্য আনা আচার নিল, কিছুক্ষণ দোলাকে রাগাল। মেঘলা হঠাৎ করে বললো,অভি ভাই শোনো। তোমার কাছে আমরা আসলেই অনেক ঋণী। এতো সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার এনেছো। অভি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো,বাহ্ তুই তো অনেক ভদ্র হয়ে গেছিস রে। কি সব কঠিন শব্দ বলছিস ঋণী। দেখ দোলা ওর কাছে থেকে কিছু শিখতে পারিস কিনা। তোর মতো ইডিয়ট তো এই পৃথিবীতে ২য় পিস নেই।

আমাদের এলাকার রায়না ফুপু যিনি অনেক বেশি আঞ্চলিক গান জানেন, তাকে প্রতি অনুষ্ঠানে বড় চাচা আনেন। এবারো বলে রেখেছেন, গাড়ি গিয়ে নিয়ে আসবে উনাকে। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান,তাই মেয়ে দের পার্লারে যাবার ধুম পড়েছে। আমি যদিও খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি কিন্তু ভীষণ ভয় লাগছে কারণ দাওয়াতের পরদিন আবার আমার রেজাল্ট দিবে। মাঝে মাঝে বুকের ভেতর কেমন যেন শীত শীত করছে। খালি জায়গায় ষ্টেজ করা।
সামনে চেয়ার বসানো। গান শেষ হলে সবাই তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যার যার ইচ্ছে মতো বসে। একে একে আসছে নিমন্ত্রিত অতিথিরা। হঠাৎ শাওনকে দেখি সম্পুর্ন সাদা ড্রেস, সাদা জুতা পরে এসেছে। আমার দিকে তীব্র একটা দৃষ্টি হেনে বসে পড়লো।
আমি জানি,এই সাদাও আমার প্রতি রাগ দেখিয়ে পরা। কিন্তু সাথে সাথে ই আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি।

রায়না ফুপু গান ধরেছেন:

হলুদ বাটি, মরিচ বাটি
ইচ্ছা,বৈছা,তিতনা পুঁটি
তার সাথে মিশাইয়া দিলাম
অল্প একটু জল
খাইতো আইয়া কমলা তোর বাফরে গিয়া বল্।

আন্নি কচুর লতা,
হিদল হুটকি,কাঁঠাল বিচি,কচি কুমড়ার পাতা।
তার সাথে ছেচিয়া দিলাম কাঁচা লঙ্কা ফল
খাইতো আইয়া কমলা তোর বাফরে গিয়া বল্।

গান শেষ হলে বলছেন, এই গান গাইলেই আমার বড় ভাইজান মানে হাদির বাবার কথা মনে পড়ে।
বড়ভাবী মানে হাদির মা রান্না শেষ করেই হাদিকে
বলতেন,হাদি তোর বাবাকে খেতে আসতে বল্।
সবাই মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর মা কান্নায় ভাসছে। হঠাৎ দেখি শামীম ভাই উঠে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, কেঁদো না বড়চাচী। শোনো আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। দেখো তো আমাকে। খুব আশ্চর্য হচ্ছে সবাই এই দৃশ্য দেখে কারণ শামীম ভাইয়ের মতো শক্ত মানুষও এই মুহূর্তে অশ্রুসিক্ত তাই।

আমি মনে মনে ভাবছি,আজ তোমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা সাদি। আজ যদি সফল হতে চাও, শাওনের সাথে মোটেও কথা বলো না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, শাওন নিজেই দূরে দূরে থাকছে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। যাক্,
এটাই সবার জন্য ভালো হবে। রাতে ঘরে এসে মেঘলা বলছে, শাওন আপু বলল খুব তাড়াতাড়ি বাইরে চলে যাচ্ছে। ওখানে তার বোনের বাসায় থাকবে, পড়বে। মা বলছে, ভালো তো। যাক্ না।
শুধু দোলা ই অনেক কষ্ট নিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি চুপচাপ রুমে ঢুকে পড়ি। আমি আর এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।

পরদিন দুপুরে খেতে বসেছি সবাই। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, খাজুর বেগম বেশ ভালো ভালো ৩টা আইটেম পাঠিয়েছেন। চিতল মাছের পেটি ও কোপ্তা,বাইম মাছ ভুনা ও কাতলা মাছ ভাজা। মা বললো, কালকে আমাকে বলেছে কিছু তরকারি পাঠাবো ভাবি। মেঘলা কে নিয়ে খাবেন,প্লিজ ভাবি ফেরৎ দিবেন না। মেঘলা এবার হেসে বলল, হঠাৎ করে আমাদের দাম বেড়ে গেল নাকি মা? কালকে দেখি, তোমাকে যে ই দেখছে খুব সম্মান দিয়ে নিজের চেয়ারে বসাচ্ছে। হাসতে হাসতে দেখি গল্প করছে। আমার সাথে এসে গল্প করার চেষ্টা করেছে কয়েকজন,পাত্তা না পেয়ে চলেও গেছে। একমাত্র শাওন আপুর সাথে আমি খুশি মনে কথা বলেছি। এই একটা মানুষ,আগেও কক্ষণো কথা
বন্ধ করেনি আমাদের সাথে।

মা এবার মৃদু হেসে বলল,জানিস মানুষ ই মনে হয় একমাত্র প্রানী যে নিজের স্ব জাতিকে কষ্ট দিতে ভীষণ ভালবাসে। অপমান করতে ভালবাসে। কিন্তু
ভেঙ্গে পড়তে দেখলে আবার কোলেও টেনে নেয়‍।
সুতরাং ঘৃণা, অপমান সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে নাই। মানুষ বদলে রে মা, অনুতপ্ত হয় বলেই তো সম্পর্ক ঝালাই করতে এসব করে। তোরা তো সবাই তোদের বাবার মতো বড় মাছের
তরকারি ভলবাসিস। আজ খা, আমি দেখি। ঠিক সেই সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দেখি ভাইয়া
এসেছে, হাতে দুনিয়ার খাবার দাবার। যথারীতি মেঘলার হাসিতে মুখ ভরা আর দোলার বিরস মুখ। কারণ মেঘলা ফোন দিয়ে ভাইয়াকে আসতে
বলেছে।

মা বললো, এতো খাবার দিয়ে কি হবে? ৩/৪ টা প্যাকেট রেখে,যাবার সময় বাকিগুলো নিয়ে যেও।
ভাইয়া কিছু না বলে বেসিনে হাত ধুতে গেল। এই সময়ে মেঘলা চাপাস্বরে বললো, এইমাত্র না তুমি
এতো উপদেশ দিলে মা। তাহলে তুমি ভাইয়াকে ক্ষমা করতে পারছো না কেন? ভাইয়াও অনুতপ্ত না হলে কি, বারবার আসতো বলো? মা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। ভাইয়া এবার মায়ের কাছে এসে বলে, আমার মা খাওয়া বন্ধ করে বসে আছে কেন? এর পেছনে কারণটা কি তুমি শুধু আমাকে বলো মা। তাকে একদম কচুকাটা করে ফেলবো। অনেক দিন পর, ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, তোর কিচ্ছু করতে হবে না। আয় একসাথে সবাই বসে খাই।

পরদিন রেজাল্ট দেখি,যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। রাকিবেরটাও ভালো, খালা
দুজনকে নিয়ে গাড়িতে উঠেছেন। আমি বলেছি,
আমি বাসে বাসায় যাচ্ছি খালা। মা অনেক চিন্তায় থাকবে। খালা এবার অবাক হয়ে বলছেন, আমরা সবাই তো তোর বাসায় ই যাচ্ছি। কেন নিবি না তুই আমাদের? রাকিব এবার বলছে, আমরা আজ কেন যাবো? আজকে তো খালা আমাদের দেখে ভালো করে খুশির কান্নাটাও কাঁদতে পারবে না। আজকে বাদ দাও,অন্যদিন যাবো না হয়। মাঝে মাঝে রাকিব এমন সব কথা বলে, মনে হয় ওর ম্যাচুরিটি লেভেল আমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। খালা এবার বলেন,হ্যা তাও তো ঠিক। ঠিক আছে ওকে বাসায় নামিয়ে অন্তত দিয়ে যাই।

নেমে আমি ঘোর লাগা অবস্থায় গেটের ভেতরে ঢুকি। মনে মনে প্রার্থনা করি, এই মুহূর্তে কেউ যেন আমার সামনে না পড়ে। আমি সোজা আমার মা এর কাছে যেতে চাই। ঘরে ঢুকে দেখি মা পেঁয়াজ কয়েকটি নিয়ে রান্নাঘরে মালাবু কে দিচ্ছে। দোলা জগ ভরে টেবিলে এনে রাখছে। মেঘলা টেবিল লাগাচ্ছে। মা বের হতেই মাকে জাপটে ধরে বলি,
আমার রেজাল্টের কথা। আমার দুঃখিনী মা তখন হাউমাউ করে অঝোরে কাঁদছে। বারবার বলছে,
আল্লাহ আমার এতিম বাচ্চাকে তুমি এতো মায়া করেছ………. তোমার শুকরিয়া আমি কি দিয়ে বলো আদায় করি মাবুদ। আমি যদি রাতদিন সেজদায় পড়ে থাকি তবুও তোমার শুকরিয়া এক কণাও আদায় হবে না। আমার বাচ্চাদেরকে তুমি দয়া করো মাওলা।

এবারে এই প্রথম মেঘলা কে কাঁদতে দেখলাম।
মালা বু মাটিতে বসে চোখ মুছছে আর বলছে, কাইন্দেন না গো আম্মা। দোলা এবার চেঁচাচ্ছে, কি এক অবস্থা আমাদের বাসার। খুশির খবর পেয়ে কেউ এতো কাঁদতে পারে !!! আমার জানা ছিল না। দয়া করে তোমরা ৪ জনের কান্না থামাও
তো। কেউ শুনলে মনে করবে কি যে হয়েছে !!!
মা এবার বললো, আগে আমার অভিকে জানা।
নয়তো ছেলেটা রাগ করবে দেখিস। আমি তখন দোলাকে ফোন করতে বলে গোসলে ঢুকলাম।

অভি রাতে এসে আগের মতো সবাইকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে যেতে চাইলো। আমি স্পষ্ট ভাষায় না করে দিলাম। আমি জানি হয়তো, সেই এক ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। সবার সাথে শাওনও যেতে পারে। আবার কথা হতে পারে, আবার সাদি
দুর্বল হতে পারে। সবই হতে পারে…….. কিন্তু রিস্ক
নিয়ে আদৌ লাভ আছে কি? সাদির হৃদয় কেটে
কুটে বারবার রক্তাক্ত করার দরকার কি? আর কষ্ট নেয়ার মতো জায়গা বা শক্তি কোনোটাই এই হৃদয়ের নেই। তারচেয়ে,ঘুম আসার চেষ্টা করাও ভালো।

এর পরের তিন মাসে অনেক গুলো ঘটনা ঘটলো।মাস দুয়েক এর মাথায় শাওন ইংল্যান্ড চলে গেল।
মর্জিনা নাকি মালাবুকে বলেছে,যাবার আগে তার মাকে অনেক ভালোমন্দ বলেছে সে। চিৎকার করেছে, তোমার জন্য শুধু তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা। তুমি যদি বড়চাচীর সাথে ভালো ব্যবহার করতে তবে তিনি না করতেন না। সারা জীবন তুমি আর তোমার মর্জিনা এতো
জ্বালিয়েছো চাচীকে, ভদ্রমহিলার ভীষণ রকম ঘেন্না এসে গেছে আমাদের প্রতি। এতো কঠিন তিনি তো না। মর্জিনা নাকি আজ মালাবুকে সাক্ষী মানছে, বলোতো আমার কি দোষ? আমাকে ওর মা যা বলেছে আমি তাই করেছি। আমাকে এজন্য দেখতেই পারে না এখন শাওন আফা।

এমনকি শাওন বাসায় এসে মা ও দোলার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে গেছে এমন এক সময়, যখন আমি ছিলাম না। ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছে। ওর যাবার আরো মাসখানেক পর আমার চাকরি হয়েছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি
তে বেতনও মাশাআল্লাহ ভালো। আকাশ ভাইকে প্রতিমাসে কিছু কিছু করে মেঘলার জন্য আনা টাকা দিবো ভেবে রেখেছিলাম। প্রথম মাসে যেতেই ভদ্রলোক খামটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, শুনেন সাদি আমার জীবনে আমি অনেক টাকা উপার্জন করেছি এবং খরচও করেছি। কিন্তু এতো বছরে একটা ভালো কাজে খরচ করলাম বলতে পারেন।

সেদিনের ভীতু মেয়েটার রাতারাতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাওয়া দেখে মনে হলো, এটা তো ভাই আকাশের পক্ষ থেকে বোন মেঘলার গিফটও হতে পারে। জানেন তো মাঝে মাঝে একটু ঋণী থাকলেও কোনো সমস্যা নেই। আমি যে কি খূশি হবো কারণ, আমি মনে করি একমাত্র এই টাকা গুলো অনেক ভালো কাজে লেগেছে। আমি হেসে বলি,Stick to your words আকাশ ভাই। আবার
কখনো সমস্যা হলে তখন আমি আপনাকে অবশ্যই বলবো। তবে কি জানেন, টাকা ফেরত দেই আর যা ই করি না কেন,আপনার ঋণ আমি বা আমার পরিবার এমনিতেই কখনো শোধ করতে পারবে না। কারণ, কিছু কিছু ঋণ কখনো শোধ হয় না,হবেও না।

ওখান থেকে আসার সময় দোলা কে ফোন দিলাম। এই সময় সে কোচিং সেন্টারের পড়ানো শেষ করে। বললাম, এই উইকএন্ডে কক্সবাজার যেতে চাচ্ছিলাম আমরা সবাই। মেঘলা না করে দিয়েছে। তাহলে আমাদের তিনজনের তিনটা টিকেট কাটছি। সে সম্মতি দেয়ায় কেটে বাসায় গিয়েছি। রাতে মাকে বললাম,পরশুদিন রাতের বাসে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। মা এবার বলছে,
কেন? বেতন পেয়েই উড়াতে হবে না কি?

আমি জানি,মা সমুদ্র ভীষণ পছন্দ করে। বাবা বলতো তোর মা সমুদ্র এতো ভালবাসে কেন বুঝি না তো বাপ। ঘন্টার পর ঘন্টা ভদ্রমহিলা সমুদ্রের পাশে বসে থাকতে পারে। মাকে বাবা ক্ষেপাতো, তোমার মধ্যে মহিলা কবি কবি ভাব আছে। মা বলতো,কবি তো কবি ই। মহিলা কবি আবার কি? বাবা হেসে বলতো,হ্যা তাইতো। তোমার কাছে বসলে দেখো কতো কি শেখা যায় !!! মা তখন চাপা স্বরে বলতো, ছেলে মেয়েদের সামনে কি সব
বলছো, নিজেই মনে হয় জানো না। কি যে সুন্দর দিন ছিল সেগুলো !!! এখন মনে হয় সবকিছু খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন ছিল।

মা বাস দেখে গজগজ করছে। বলছে,এসি বাস নাকি? কেন এই রুটে কি নন এসি বাস চলে না?
নাকি চাকরি পেয়ে তা ভুলে গেছো? কথাবার্তা তুমি তে চলে এসেছে মানে খুব রেগে আছে। কিছু
না বলে আমি মিটিমিটি হাসছি। দোলার আগে থেকেই মাইগ্ৰেন এর ব্যথা ধরেছিল। এখন এতোক্ষণ ধরে মায়ের এসব কথা শুনে বলছে,
আশ্চর্য মা তখন টাকা ছিল না বলে হিসেব করে চলেছো। এতো বছর পর ছোটভাই নিয়ে এসেছে। কোথায় তুমি সময়টা উপভোগ করবে…… তা না করে শুধু টাকার চিন্তা। মা এবার বলছে, না চিন্তা করবে না। শুধু টাকা উড়ানোর ধান্দা। আমি মনে মনে ভাবছি, হোটেলে গিয়ে মা যখন দেখবে যে এতো দামী সুন্দর হোটেল থেকে সমুদ্র দেখা যায়……….. তখন যে কোন উদ্দাম ঝড় আবার আসবে, কে জানে !!!

২ দিন ১ রাত থাকলাম ওখানে। মাকে মাঝখানে রেখে,২ ভাইবোন ফটো তুলে মেঘলা,ভাইয়া ও অভিকে পাঠালাম। মা এই ২ দিন খুব চুপচাপ কাটালো। মনে হয় বাবার সাথে থাকা স্মৃতিগুলো কাঁদাচ্ছে। লাষ্ট যে দিন রাতে বাসে উঠবো, সেই সন্ধ্যায় মা হঠাৎ আমার হাত ধরে বলছে, আমি
অনেক খুশি হলাম বাবা। আমাকে খুশি করার জন্য, পৃথিবীর সবসুখ আল্লাহ তোকে যেন দেন।

এর পরের মাস থেকেই শুরু হয়েছে, এবার তোর বউ দেখা শুরু করছি বাবা। আমি বলি, এখন আমি বিয়ে করবো না মা। একটু গুছিয়ে নেই। মা বলে, সমস্যা নেই তো। তোর পছন্দ থাকলে বল্,
আংটি পরিয়ে আসি। হেসে বলি, আমার কোনো পছন্দ নেই মা।সময় হলে এমনিই তোমাকে বলব।

কিছুদিন পর একটা ফটো এনে বলল,দেখ তো এই মেয়েটাকে কেমন লাগে? আমি তার হাতে দিয়ে বলি, এখন বিয়ে করবো না মা। চোখগুলো এবার ঘোরালো হয়ে গেছে, সেটাই তো বলছি কেন করবি না? খুব ভালো মেয়ে। আমি বলি, এই
দেশে যে এতো ভালো মেয়ে আছে জানতাম না।
পরের দিন অফিস থেকে এসে শুনি মা খায়নি।রাগ করে কথাও বলছে না।দোলাকে হলে থাকতে
হয় বলে আর কে বকা দিবে? কি করলে রাগ ভাঙ্গবে বলতেই বাচ্চাদের মতো বলছে,সবাই কি সুন্দর বৌ নিয়ে ঘুরছে, শপিং করছে,গল্প করছে।
শুধু আমারই ছেলে বৌ নেই। প্লিজ বাবা এ মেয়ে টাকে দেখ্ না। গেলাম, আমি,মা ও দোলা। নাম চৈতি। সব ঋতুগুলো ই মনে হয় আমার জীবনের
স্পেশাল মানুষ। বললেন মাষ্টার্স শেষে একটি কলেজে চাকরি নিয়েছেন। চুপচাপ, কথা খুব আস্তে বলেন। বাসা ও পরিবার দেখে আমাদের আগের অবস্থার কথা ই মনে পড়লো। হয়ে গেল বিয়ে। চোখ বুজে ভাবছি, মায়ের খুশির জন্য জীবনের মোড় ঘুরে গেল তাহলে বিয়ে ই বা
নয় কেন?

বিবাহিত জীবনের এই ৩ মাসে মনে হচ্ছে হয়তো বা ভুল করিনি। আমি ঠিক কি চাই না বলতেই যেন বুঝে যায় সে। আমার দিকে থেকেও অনেক
সম্মান ও ভালবাসা ছিল। আর মায়ের সাথে কথা বলতে দেখলে, কেউ ভাববে ২বান্ধবী। মা গোল্ড প্ল্যালেটেড চুড়ি কিনে আনছেন তো বৌ আবার মায়ের পছন্দের জিনিস সাপ্লাই দিচ্ছেন। দুজনে চা খেতে খেতে কোনো কথায় হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ের উপর পড়ছেন। আজ দুপুরে ফোন এসেছে, শোনো আবৃত্তিকার মুনমুন মুখার্জি ঢাকায় আসছেন। দুটো টিকেট আনতে পারবে? তুমি আমি যেতাম। গেলাম,প্রায় ৩ মিনিটের জয় গোস্বামীর প্রথম কবিতা তেই মুনমুন না জেনে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন:

মেঘ বলতে আপত্তি কি,বেশ বলতে পারি,
ছাদের উপর মেঘ দাঁড়াতো,ফুল পিসিমার বাড়ি।
গ্ৰীস্ম ছুটি চলছে তখন, তখন মানে কবে?
আমার যদি চৌদ্দ, মেঘের ষোল সতেরো হবে।
ছাদে থেকে হাতছানি দিত,ক্যারাম খেলবি আয়?
সারা দুপুর কাঁহাতক আর ক্যারাম খেলা যায়?

ঘুটিরও সেই প্রথম মরণ,প্রথম মরা মানে?
বুঝবে শুধু তারাই,যারা ক্যারাম খেলা জানে।

চলেও গেল দুদিন পরে,মেঘ যেমন যায়
কাঠফাঁটা রোদ রইলো পড়ে, মেঘের জায়গায়।
খেলা শেখাও, খেলা শেখাও হা পিত্যেস কাক
কলসিতে মুখ ডুবিয়ে ছিল,জল তো পুড়ে খাক।
সেই কলসি আবার ভরলো পরের বছর জলে,
বলবো কেন তোমায়? থামো ওসব কি কেউ বলে?

……………………….

আমিও পাশে বসে থাকা আমার চৈতির হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। ভাবছি,কতো তুলিতে আঁকা এই নশ্বর জীবনের ধাপগুলো।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here