#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি
পর্ব-১৩ বা পর্ব-শেষ
আজ লিখিত পরীক্ষা শেষ হলো অবশেষে। প্র্যাকটিকেল নিয়ে অতটা ভাবতে হবে না। তাই আজ থেকেই রিল্যাক্স বলা যায়। আজ সে তাদের রুমটাতে গিয়ে থাকবে ঠিক করে রেখেছে। বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার পর তার আম্মুকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলো যে সে উপরে যাচ্ছে, আজ ওখানেই থাকবে। উপরে উঠে তাদের রুমটাতে ঢুকলো। ঢুকে একটা লম্বা করে শ্বাস নিলো। এখনো কিভাবে সে নেহালের গন্ধ পায় রুমটাতে?কাবার্ড খুলে নেহালের কাপড়গুলোর উপর হাত বুলালো,মুখ ডুবিয়ে শ্বাস নিলো। একটা টিশার্ট বের করে কোলবালিশে পড়ালো। তারপর কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠলো। উঠেই নেহালকে ফোন দিলো,কিন্তু নেহাল কলটা কেটে দিয়ে ম্যাসেজ করলো,
– মিটিংয়ে আছি যে বিল্লি, পরে কথা বলি?আসছো আমাদের রুমে?
দিশান কোন উত্তর করলো না রাগে। কোথায় ভেবে রেখেছে অনেক কথা বলবে আজ,আর এখনো তার খবর নেই। বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নাকের হালকা একটু টনটনে ব্যাথাটার উপর হাত বুলালো। আজই সে কলেজ থেকে আসার পথে নাক ফুটো করে এসেছে আর এটাই তার নেহালকে দেয়া সারপ্রাইজ। ইতোমধ্যে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে যে নেহাল তার বউকে দেবার জন্য একটা নাকফুল তুলে রেখেছে। কিন্তু সেটা তো সে দিশানকে দিচ্ছে না। নেহালকে জিজ্ঞেসও করেছিলো একবার, নেহাল উত্তরে বলেছে,
– আগে বউ হয়ে নাও। যেদিন আমার জন্য মন থেকে বউ হয়ে নাকফুলটা তুমি পড়তে চাইবে,আমি সেদিন তোমাকে ঐ নাকফুলটা দিবো।
-আমি তো মন থেকেই চাই।
– সেটা তোমাকে মুখে বলতে হবে না,আমিই বুঝে নিবো।
পরে দিশান বুঝেছে যে তার নাক তো ফুটো করা নেই,তাহলে নেহাল তাকে দিয়ে কি করবে?নিজ থেকে যেদিন এই নাকফুল পড়ার বোধ আসলো ঐদিনই ঠিক করে রেখেছিলো শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথেই পার্লার হয়ে আসবে একবারে! নেহালকে সারপ্রাইজ দেয়া যাবে।
রুম থেকে বেরিয়ে নায়রাকে গুতিয়ে তুললো,দুইজন মিলে নিচে নেমে ফুচকা খেয়ে এলো। এবার নায়রা প্রস্তাব দিলো,
– চল,শাড়ি পড়ি। কবে থেকে ঢং করা হয়না।
দিশান সাথে সাথে লাফিয়ে উঠলো। দুইজন মিলে অনেক বাছবিচার করে দিশান একটা গোলাপী রঙের লক্ষ্মৌস্টিচ শাড়ি নিলো পড়ার জন্য আর নায়রা একটা কালো শিফন বের করলো। দুইজন হালকা সাজগোজ করে ছবি তুললো মন ভরে। নেহালের এখনো পাত্তা নেই। ফোন তুলছে না বলে দিশান ছবি পাঠিয়ে রাখলো। একটু পরে সিন হতে দেখলো। একটা লাভ রিএক্ট দিলো শুধু। এবার রাগ আসমানে উঠলো দিশানের। তার ভীষণ কান্না পেতে লাগলো। ইচ্ছে করছে সব সাজ খুলে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু আজ আবার খালা শাশুড়ীর বাসায় দাওয়াত আছে। ওদের পরীক্ষা শেষ শুনে যেতে বলল। একদমই যেতে মন চাইছে না। তার এখন নেহালকেই লাগবে। প্রায় তিনটা মাস ধরে সে আজ সারা রাত কথা বলার জন্য অপেক্ষা করেছে। নেহাল বলেছিলো আজ ছুটি নিবে। কিন্তু এখন অব্দি একবারও কথা বলেনি। তাকে একটু চোখে দেখার পিপাসায় পুড়ে মরছে সে কিন্তু সময় কোথায় ভিডিও কলের?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলো খালার বাসায়। ওখানে গিয়ে গল্প আড্ডায় ভালোই কাটলো সময়টা। রুমে ঢুকতেই আবার মন খারাপটা চেপে বসলো। তার উপর নাক ফোঁড়ানোর ব্যাথাটাও ভোগাচ্ছে। সে পোশাক বের করতে আলমারির কাছে যেতেই হঠাৎ রুমের লাইট চলে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই একটা ছায়া রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। চিৎকার করে উঠতে নিতেই খুব কাছে এসে মুখটা আলতো করে চেপে ধরলো। কোমর হাতড়ে নিজের কাছে টেনে নিলো। বাইরে থেকে আসা হালকা আলোতে নেহালের আবছায়া চিনতে কয়েকটা মূহুর্ত লাগলো দিশানের। তারপর নেহালের শার্ট খামচে ধরে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। চোখে খুশির জলে বান ভাসলো। এতটা সুখ হাতের কাছে সে ভাবতেও পারে নি। তার নেহাল তার এতটা কাছে এটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। বারবার নেহালের মুখটা ছুঁয়ে দেখছে,হাতের আঙুলগুলো হাতে নিয়ে অনুভব করছে কাছে পাবার সুখ। নেহাল যেন আজ সুখের সমুদ্র নিয়ে ধরা দিয়েছে দিশানের কাছে।
আর নেহালও উপভোগ করছে প্রেয়সীর কাছে আসা। গোলাপি শাড়ি পড়া দিশানকে সে ডায়নিং রুম থেকে দেখেছে ঢোকার সময়। আরো মন ভরে দেখার জন্য বাইরে গিয়ে মেইনসুইচ বোর্ড থেকে তার রুমের পয়েন্ট অন করে দিলো। দিশানকে চমকে দিতেই তখন ঘর অন্ধকার করার জন্য সুইচ ডিসকানেক্ট করে দিয়েছিলো। আসলে নেহাল আজ সাতদিন হয় বাংলাদেশে এসেছে। দিশান ছাড়া সবাই জানে এই খবর। এই সাতদিন দিশানকে আসতে দেয়া হয়নি এই বাসায়৷ নায়রাই তার কাছে চলে গেছে দরকারে। তাদের গণিত পরীক্ষা তখনো বাকি ছিলো বলে সামনে এসে কোন রিস্ক নেয় নি নেহাল।সবদিন বাসায় ফিরেও নি,অফিস হাউসে থেকে গিয়েছে। আজ দিশানকে রাগিয়ে দিতেই ফোন ধরে নি সারাদিন আর ব্যস্ততাও ছিলো। খালার বাসায় যাবার সু্যোগে বাড়ি ফিরে ঘাপটি দিয়েছে সে। দিশান এসে রুমে ঢুকতেই লাইট অফ করে দিয়ে রুমে এসে কাছে টেনে নিয়েছে তার বউটাকে,তার বিল্লিটাকে।
লাইট অন করে মুগ্ধতার দৃষ্টি সরছে না নেহালের। একটা পরী যেন তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। গোলাপী শাড়ির সাথে লজ্জ্বায় রাঙা গোলাপী গাল,ভেজা ঘন পল্লবে কাজল লেপ্টানো চোখজোড়া, নাকে একবিন্দু শিশিরের মতো নাকফুল,গোলাপী গ্লসে পাতলা তিরতির করা ঠোঁট, ঠিক ঠোঁটের নিচে বামে থাকা একটা ছোট্ট তিল, কি অপূর্ব লাগছে দিশানকে। এলোমেলো চুলে এক পরতের ছড়ানো আঁচলের শাড়িতে নারীরূপ যেন উদ্ভাসিত হচ্ছে তার। দিশানকে শাড়িতে এই প্রথম দেখছে না নেহাল। বিয়ের পরপর দাওয়াতে কয়েকবার দেখেছে শাড়িতে। কিন্তু এমন মোহনীয় তো লাগে নি চোখে,নাকি বউয়ের দৃষ্টিতে তাকানো হয়নি বুঝি তখন। আর আজ এই নারী যেন তাকে পাগল করে দিতেই এইরূপে নিজেকে সাজিয়েছে। এত অসহ্য সুন্দর সহ্য করা যাচ্ছে না আর। নেহাল রুমের আলো নিভিয়ে দিয়ে হালকা নীল বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো। দিশান তার দুত্যি ছড়িয়ে রুমের মাঝে ঠায় দাঁড়ানো তখনো। নীল আলোয় অপ্সরীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো নেহাল। চুলে মুখ ডুবিয়ে মাদকতায় হারিয়ে যেতে যেতে ভাবলো মুখের ভাষায় পরেই কথা হোক,শরীর আগে এত দিনের সংযম ভাঙুক,দূর থেকে তাকে প্রতিনিয়ত ভেবে ভেবে পাগল হবার প্রতিটা হিসাব আগে মেটাতে হবে দিশানকে। নিবিড়ভাবে মিশে যেতে যেতে নেহাল বুঝতে পারলো অনুভূতির অনুরণনে দিশানও সব হিসাব চুকাতে মুখিয়ে আছে। উত্তাল আকর্ষণের অবগাহনে আকন্ঠ ডুবে গেলো দুই কপোত-কপোতী।
সকালে ঘুম ভেঙে নিজের বাহুডোরে নেহাল সাদা খরগোশটাকে পেলো। কোন সকাল বুঝি এতটা মধুর হয়নি এর আগে। কতক্ষণ চুল নিয়ে খেলা করলো, আদুরে গাল দুটো একটু টিপে দিতেই গভীর ঘুমে কপাল কুঁচকালো দিশান। পাগলীটা নাক ফুঁড়িয়েছে তার জন্য। বিছানা থেকে আস্তে করো নেমে অনেক যত্নে রাখা নাকফুলটা নামিয়ে আনলো। কপালে চুমু দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলো,
– দিশান…
দিশান গলায় আহ্লাদী স্বর টেনে আরো নেহালের বুকের ভেতর ঢুকতে নিলো। নেহাল তার অগোছালো চুলগুলো সরিয়ে নাকের ফুলে চুমু দিয়ে বললো,
– অনেক ব্যাথা পেয়েছিস পাগলী,তাই না?আমি আসলে পরেই না হয় করতে,আমি হাত ধরে পাশে থাকতাম। সেটা যখন পারলাম না,আসো নিজের হাতে নাকফুলটা পড়িয়ে দেই৷
বলে পাঁচটা ডায়মন্ড বসানো ফুলের ডিজাইনার নাকফুলটা বের করে আনলো। কসরত করে দিশানের নাকে পড়িয়ে দিলো। মাত্র কালই ফোঁড়ানো হয়েছে বলে ব্যথায় চোখে জল এসে গেলো। কিন্তু নাকফুলটা যেন দিশানের জন্যই বানানো। দিশানের বাচ্চা বাচ্চা মুখটা যেন হঠাৎই বউরূপী হয়ে গেলো। নেহাল তাকে তুলে ধরে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। পিছন থেকে ওড়নাটা তুলে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলো। এবার পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে দিশানের কাঁধে মুখ রেখে নেহাল বললো,
– তোমাকে কি পরিপূর্ণ লাগছে দেখো। সত্যিকারের বউ লাগছে।
– আমি বুঝি মিথ্যা বউ ছিলাম।
– না,কাগজে কলমে তুমি বউ হয়ে এসেছো বিয়ের দিনই। কিন্তু আজ তোমাকে পরিপূর্ণ লাগছে দিশান। স্বামী সোহাগের আবেশ যেন লাজুক রঙ হয়ে ঠিকরে পড়ছে তোমার শরীর থেকে আর তাতে জ্বলজ্বল করছে এই নাকফুল যেন তোমাকে অনেক বেশি পরিণত করে দিয়েছে দিশান। তোমাকে অনেক ভালোবাসি বউ,অনেক বেশি। এই ভালোবাসাটা আমার জীবনের সেরা উপলব্ধি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। তেমার ভালোবাসাটাও মুখে বলার দরকার নেই। অনুভূতি বুঝে নেবার ক্ষমতা আমার আছে। আমাদের একে অপরের পরিপূরক করেই সৃষ্টি করেছেন তিনি। তুমি আমি মিলে তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা দুইজন। এই অর্ধেক অঙ্গ রেখে অসম্পূর্ণতা আর পোষাচ্ছিলো না আমার, তাই আপাতত তিন মাসের জন্য চলে এলাম। তোমার রেজাল্টের পর তোমাকে নিয়েই ফিরতে পারবো আশা করছি। আর কোন বিচ্ছেদ আমাদের ছোঁবে না দিশান।
আনন্দে নেহালের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো দিশান। আর কোন বিচ্ছেদ তাদের ছুঁবে না আর।
সমাপ্ত