৩.
#জলছবি
#৩য়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
আদ্র আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে, ভারী অদ্ভুত প্রশ্ন! এবং এই অদ্ভুত প্রশ্ন করা মানবীটা কে তা বোধহয় খানিক অনুমান করতে পারলো সে। তবে বিন্দুমাত্র কৌতূহলও তৈরি হয়নি তাকে দেখার জন্য। পেছনে না ফিরে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। তার ধারনা এই মেয়ের মাথায় কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। এই ধরনের মানুষের সব কথা গায়ে মাখতে নেই! বরং যথাসম্ভব এদের এড়িয়ে চলা উচিৎ।
আদ্র এরূপ ভাবনার মাঝেই পুনরায় সেই বিক্ষিপ্ত কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
“দোস্ত? আই ক্যান্ট কনট্রল মাই-সেল্ফ!
মন চাচ্ছে…মন চাচ্ছে..!”
পুরো কথাটাও শেষ করতে পারছে না, চাপা ক্ষোভে।
অনবরত এমন উদ্ভট কথা বলা মানবীটাকে দেখার জন্য আদ্র এবার ঘার ঘুরিয়ে তাকালো। আবছা আলোয় আদ্র দেখতে পেলো ট্রেনের অপর-প্রান্তের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা, তেজে জ্বলজ্বল করা মেয়েটাকে। তাকে মেরে ফেলার মতো তীব্র বাসনায় উজ্জ্বলিত হয়ে থাকা সুশ্রী মুখশ্রী! সুশ্রী? নাকি তেজস্বী? আদ্র তাকানোর পরও, আদ্র’র দিকে তাক করে থাকা নোলকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটির সামান্য নড়চড় হলো না। পারলে যেন এই তেজী চাহনিতেই জ্বালিয়ে-পুরিয়ে অঙ্গার করে দিতো ছেলেটাকে!
আদ্র প্যান্টের পকেটে হাত দুটো গুঁজে থাকা অবস্থাতেই একটু একটু করে এগিয়ে গেলো নোলকের কাছে থেকে কাছে। নোলকের কানে ফোন নেই এখন আর, সাথে কথা নেই মুখে। আদ্র কাছে এসে দাঁড়াতেই মনে ছোট্ট একটা অযথা ভয়ের সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবলো সে, “এই বেয়াদপ লোকটা আবার আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিবে না তো? যদি ফেলে দেয়, তবে কি আমি মারা যাবো? আপুকে কি ফোন দিবো একটা?”
বিপদে পড়লে কেন যেন সবার আগে বড় বোন নবনীর কথাই মনে পড়ে নোলকের! হালকা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কেমন ব্যাথা-ট্যাথা পাবে।
আদ্র এক হাতে চশমা ঠিক করে মেয়েটার উদ্ভট কার্যকলাপ দেখছে। ‘দেখতে যেমন বাচ্চা বাচ্চা, কর্মকান্ডগুলোও বাচ্চাদের মতোই! ভাবনা চিন্তাও নিশ্চই অমনই হবে’, ভাবে আদ্র। মেয়েটা মনে মনে কি ভাবতে পারে সেটাও বোধহয় অনুমান করতে পারছে সে। মৃদু কন্ঠে বলে,
“এখান থেকে যদি কেউ আপনায় ফেলে দেয় তবে আল্লাহ্ চাইলে বেঁচে যাবেন। অন্যথায়…!”
পুরো কথা শেষ করার আগেই নোলক চমকে উঠে। ভয়ে তটস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এ..এই? আপনি কি আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে চাচ্ছেন? দে..দেখুন? তবে কিন্তু আমিও পেত্নী হয়ে আপনার ঘার মটকে দিবো!”
মেয়েটা কোনো কর্মকান্ডে এই প্রথম আদ্র’র হাসি পেলো। সে হাসলোও। সুন্দর সেই হাসি। ছোট্ট করে বলল,
“আচ্ছা? তাই?”
নোলক নিশ্চয়তা দেয়ার মতো করে বলল,
“হ্যাঁ, তাই। একদম সত্যি কথা। এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি। সুতরাং আমায় ধাক্কা-টাক্কা দেয়ার পরিকল্পনা মাথায় থেকে থাকলে এক্ষুনি ঝেড়ে ফেলুন ঝটপট।”
এই পর্যায়ে এসে আদ্র মৃদু আওয়াজ করে হাসলো। একটু গাঢ় করে হাসলে ছেলেটা চোখ দুটো অনেকখানি বুজে যায়। লক্ষ্য করে তাকালে চশমার আড়ালেও এই চমৎকার দৃশ্যটি দেখা যায়। এসব অবশ্য নোলকের চোখে লাগে না। ওর কাছে তখন আদ্র মানে আতঙ্ক!
আদ্র হাসি মুখে নিজের গালে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কিছুক্ষণ আগে তো, অন্যকাউকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছিলেন! তখন সে যদি ভূত হয়ে এসে আপনাকে কামড়ে দিতো?”
নোলক যেন এমন আজগুবি কথা কোনদিনও শোনেনি! আদ্র’র সাথের শত্রুতা ভুলে গিয়ে কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“ভূতেরা বুঝি কামড়ে দেয়?”
আদ্র জোর দিয়ে বলার মতন করে বলে,
“হুম দেয় তো। ঘারে, হাতে, আঙুলে! মাঝে-মধ্যে গলায়ও!”
কথাটা সে নোলকের একটু কাছে ঝুকে বলে।
কথাটুকু বলে আর একটুও দাঁড়ায় না আদ্র। মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে স্থান ত্যাগ করে।
আদ্র চলে যেতেই নোলক আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একবার চারপাশে তাকায়। তারপর ঘারে, গলায়, হাতে, আঙুলে হাত বুলায়। মনে মনে ভাবে,
“কি ভয়ংকর ব্যাপার! সত্যিই কি কামড়ে দিতো? আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে ধাক্কা-টাক্কা দেই নি!”
ভূতে মেয়েটার বরাবর-ই খুব ভয়। এখন সেই ভয় আরো প্রকট আকার ধারন করলো। ভূত রিলেটেড যাবতীয় কথাও সেও খুব সহজে বিশ্বাস করে নেয়। এবারও তার ব্যাতিক্রম হলো না। চটপট সে দরজার কাছ থেকে সরে বগির ভেতর আসলো। নিজের আসনে আসে। বসার সময় আদ্র’র সাথে চোখাচোখি হয়। চোখ নামিয়ে নিজের আসনে আড়ষ্ট হয়ে বসে।
মেয়েটার ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে বেশ মজা পায় আদ্র। নোলককে জব্দ করতে পেরে মনে বোধহয় পৈচাশিক আনন্দও পায়। তার ধারনামতে নোলকের তুরতুর কমানোর জন্য এইটুকু ভয় দেখানো উচিৎ কাজ হয়েছে।
.
সন্ধ্যে সাতটা কি সাড়ে-সাতটা বাজে তখন। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে নোলকের চোখ লেগে এলো তা সে টের-ই পেলো না। ঘুমের রেশ কাটলো নিষাদের ডাকে। নোলক হালকা চমকে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো তার সব বন্ধুরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একেকজন একেক কথা বলছে। কিন্তু কোনো কথাই তার কর্নপাত হচ্ছে না। ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি তার। আর ঘুমুঘুমু চোখে সে ঘুম ব্যতিরেকে কিছুই ভাবতে পারে না। শ্রীতমা বলে,
“দোস্ত? জলদি চল, প্লিজ। অলরেডি অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে। বাবু আমায় বোকবে। দা’ভাইও। বারবার কল করছে! তোদের জন্য দু’দিন লেইট করে আসতে হয়েছে, এখনও যদি লেইট করি তো খুব বোকবে! কাল আমার গায়ে হলুদ দোস্ত!”
নোলক বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে তাকায়। ট্রেন প্রায় অনেক খানি। অল্প কিছু লোক যারা আছে, তারাও নেমে যাবে। কারন ট্রেনের চলার পথ এখানেই সমাপ্ত। ফয়সাল বলে,
“এই ঘুমের জন্য তুই সব জায়গায় লেইট লতিফা হোস। শেষে এসে আমাদের দোষ দিস! কানে-গালে দিমু একটা। নাম তারাতারি।
নোলক বিরক্তি নিয়ে উঠে আসে। ট্রেন থেকে নামতে নামতে বলে,
“বিরক্তিকর! আরেকটু পর ট্রেন’টা থামতে পারেনি? চল, তারাতারি। আমি ঘুমাবো।”
.
দ্বীপ বসেছে ড্রাইভার এর পাশের সিটে। আর পেছনের সিটে বসেছে আদ্র, ইশান। গন্তব্য দ্বীপের বাসা। তিনজনই বাল্যকালের বন্ধু। এত বছর পরে এসেও তাদের বন্ধুত্বে এইটুকু ফাটলও ধরেনি। তিনজন তিন স্বভাবের হওয়ার পরও বেমালুম টিকে আছে। মাস্টার্স শেষে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে আসার পর দ্বীপ একটু ব্যাস্ত হয়ে গেলেও পরিবর্তন আসেনি, আদ্র আর ইশানের জীবনে। দুজন এখনও একসাথে একই রুমে থাকে। দুজনের জীবন গল্প একটু মিলে যাওয়াতে তাদের মাঝে সখ্যতাও বেশি। দ্বীপ বাবার ব্যাবসায় মননিবেশ করলেও আদ্র আর ইশানের ঝোক সৃজনশীল লাইনে। ইশানের ভালো লাগে ফটোগ্রাফি। তার ইচ্ছে, সে একদিন সফল ফটোগ্রাফার হবে। আর আদ্র’র ধ্যানজ্ঞান লেখালেখিতে। সে চুপ থেকে তার মনের কথাগুলো কলমে ফুটায়। মানুষ পড়ার প্রতি তার তমুল আকর্ষন! তার কম কথা বলা স্বভাবটা লিখে পুষিয়ে দেয় ঠিক।
দ্বীপের একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষেই জোর করে আনা হয়েছে আদ্র আর ইশানকে। বন্ধুত্ব বাল্যকালের হলেও দ্বীপে বাড়ি এই প্রথমই যাচ্ছে তারা।
ইশান জিজ্ঞেস করে,
“তোর বোন কিসে পড়ে যেন, দ্বীপ?”
“অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। জগন্নাথে ইংরেজি নিয়ে পড়ছে।”
এবার দ্বীপ জিজ্ঞেস করলো,
“তোদের ট্রেন জার্নি কেমন হয়েছে?”
ইশান সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো,
“দারুন।”
দ্বীপ আদ্র কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
“আর আদ্র তোর?”
আদ্র গাড়ি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকানো অবস্থাতেই বলল,
“তোদের বাসা আর কতক্ষণ?”
ছেলেটা এমনই। কোনো প্রশ্ন কিংবা কথা তার কাছে অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে বোধ হলে তার উত্তর দেয় না সে। দ্বীপ, ইশান দুজনেই অভ্যস্ত আদ্রর এই স্বভাবে। তাই তাদের কাছেও এখন স্বাভাবিকই লাগে বিষয়গুলো।
দ্বীপ জবাব দেয়,
“এইতো আর একটু, সামনেই।”
ইশান নিজের ক্যামেরায় আজ সারাদিনে ধারন করা ছবিগুলো দেখছিলো এতক্ষণ। একটা ছবিতে এসে থমকে গেলো। ছবিটাতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে নোলকের ঘুমন্ত মুখ। ইশান মুগ্ধ হয়ে দেখে। এই ছবিটা সে তুলেছে ট্রেন থেকে নামার সময়। যদিও কারো পারমিশন ছাড়া ছবি তোলে না সে। কিন্তু এই মেয়েকে বলে-কয়ে ছবি তোলার সাহসও পায়নি। অন্যদিকে মেয়েটার ছবি তোলার লোভও সামলাতে পারেনি। ইশান দ্বীপকে ডেকে ছবিটা দেখাতে দেখাতে বলে,
“এই দেখ, মিস.অগ্নিশর্মা।”
আদ্র কপাল কুঁচকে তাকায়। দ্বীপ হেসে দিয়ে বলে,
“এই সেই মেয়ে?”
“হুম।” জবাব দেয় ইশান।
দ্বীপ হো হো করে হাসে। ইশানের কাছ থেকেই সবটা শুনেছে সে।
মিনিট পাঁচেক এর মাঝেই ওদের গাড়ি এসে থামে শঙ্কর মহলের (ছদ্মনাম) সামনে। দ্বীপের ঠাকুর দা’র বাবার বাবা ‘ভবানী শঙ্কর’ এর নাম অনুসারে এই অন্দরমহল। দিন শেষে যেন আদ্র ভীষণ করে মুগ্ধ হলো এবার। এই সুন্দর পুরান আমলের বাড়িগুলো বরাবর-ই ভালো লাগে তার। ইশান ছবি তোলায় ব্যস্ত।
দ্বীপের বাবা মা এসে দুজনকে সমাদর করে। ইশান আর আদ্রকে দোতলায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুম দেখিয়ে দিয়ে আসে। দ্বীপ নিচে নেমে আসতেই দ্বীপের বাবা দ্বীপকে নিচু স্বরে বলে,
“শ্রী তো এখনও এলো না রে! সাথে ওর বন্ধুরাও।”
দ্বীপ অবাক হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরো একটা গাড়ি এসে থামলো শঙ্কর মহলের সামনে। দ্বীপ হেসে দিয়ে বলল,
“ঐতো চলে এসেছে বোন আর বোনের বন্ধুরা।”
সবাই গাড়ি থেকে নেমে এক এক করে বাড়ি ভেতর প্রবেশ করলো। শ্রীতমাকে পেয়ে দীপঙ্কর বাবু আর অনুপমা দেবী আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলেন। দ্বীপ শ্রীতমার বন্ধুদের সমাদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাড়ি দেখে সবাই ওয়াও ওয়াও করলেও বিমোহিত হতে পারলো না কেবল নোলক। সে ভীত কন্ঠে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,
“এ..এই শ্রী? এটা তো ভূতের বাড়িরে! হরর মুভি গুলোতে এমন বাড়ি দেখা যায় না? এই? এখানে আবার ভূত-টূত নেই তো?”
দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা ইশান প্রথমে নোলককে দেখে অবাগ হলেও এই পর্যায়ে এসে হেসে ফেলে। ইশানের সাথে সাথে বাকিরাও। আদ্র এতক্ষণ অন্যদিকে ফিরে ছিলো। সবার হাসির কারন খুঁজতে গিয়ে নোলকে দেখে ভীষণ রকম চমকে উঠলো। এই মেয়ে এখানে কেন?…….(চলবে)