২.

#জলছবি
#২য়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
আদ্র পাশে ফিরে তাকাতেই প্রথমে নজর গেলো নিচে পরে থাকা নোলকের ফোনটার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফোনটা বেশ ভালোই আহত হয়েছে।
নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা তড়িঘড়ি করে ফোনটা তুলে ব্যাটারি লাগাতে লাগাতে বলল,
“স্যরি আপু। আই এম এক্সট্রেমলি স্যরি। আসলে খেয়াল করিনি।”
নোলক মোটেও শান্ত হলো না এতে। বরং আরো খানিক চিল্লামিল্লি করে বলল,
“কিসের স্যরি হ্যাঁ? লাগবে না আপনার ঘোড়ার ডিমের স্যরি! আর খেয়াল করেন নি মানে কী? চোখ কই রেখে হাঁটেন? আকাশে? চোখে দেখেন না নাকি? মাত্র এক মাস হলো ফোনটা কিনলাম। দিলেন তো ভেঙে?”
নোলকের চেঁচামেচিতে মোটামুটি একটা জটলার তৈরি হয়েছে। উৎসুক জনতাদের কৌতূহলময়ী ভীর। কেউ কেউ লোকটাকে সাবধান হয়ে না হাঁটায় দোষ দিচ্ছে। কেউ-বা আবার নোলককে শান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু সে কি আর শান্তনার ধার ধারার পাত্রী? মোটেও না। যে-ই শান্তনা দিতে আসছে সে-ও তার চোটপাটের শিকার হচ্ছে।
লোকটা কাঁচুমাচু করে ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“তেমন কিছু হয়নি আপু। এই যে দেখুন! জাস্ট একটু স্ক্রিন ফেটে গিয়েছে। আমি নাহয় ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবো?”
নোলক খ্যাঁক করে উঠে বলল,
“লাগবে না আপনার ক্ষতিপূরণ। আপনার ঘোরার ডিমের ক্ষতিপূরণ আপনার কাছেই রাখুন। দিন, ফোন দিন। ফোনটা ভেঙে-টেঙে আসছে উনি ক্ষতিপূরণ দিতে।”
ফোন নিতে নিতে শেষের কথাটুকু নিচু স্বরেই বলল। লোকটা ঝাড়ি-টারি খেয়ে চলে যেতেই ইশান প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনার বুঝি ঘোরার ডিম খুব প্রিয়?”
নোলক ‘কথাটা ঠিক বুঝে নাই’ টাইপ মুখ করে কপাল কুঁচকে তাকায়। ইশান বিষয়টা ধরতে পেরে রসিক হেসে বলে,
“না মানে, লোকটা ‘স্যরি বলল’ তখনও বললেন, ‘ঘোরার ডিমের স্যরি’ লাগবে না। আবার লোকটা ‘ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলো’ তখনও বললেন, ‘ঘোরার ডিমের ক্ষতিপূরণ’ লাগবে না। তাই আর কি কিউরিসিটি মাইন্ড থেকে জানতে ইচ্ছে হলো। ঘোরার ডিম কি বেশি পছন্দের?”
এতক্ষণে যেই ছোটখাট জটলার তৈরি হয়েছিলো তারা সবাই মিটিমিটি হাসতে হাসতে যার যার জায়গায় চলে যেতে লাগলো।
নোলক খুবই বিরক্ত হওয়ার মতন করে তাকালো। মেজাজটা যে তরতর করে খারাপ হয়ে যাচ্ছে সেটা ও বেশ বুঝতে পারছে।
ইশান নিজেও আন্দাজ করতে পারলো যে সে ভুল সময়ে রসিকতা করে ফেলেছে। তাই পরিস্থিত সামাল দিতেই হালকা কেশে অন্যদিকে ফিরে বসলো। যেভাবে অগ্নিশর্মা রূপ ধারন করেছে মেয়েটা, তাতে এই মূহুর্তে তাকে নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে যে, আগ্নেয়গিরির লাভাটা তার উপর এসেই যে পড়বে তা বেশ ভালো মতোই টের পাচ্ছে।
ইশান তার পাশে বসে থাকা স্বাস্থ্যবান লোকটাকে নিচু স্বরে বলে,
“বুঝছেন ভাই? মেয়ে মানুষকে রাগানো আর জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দেয়া একই ব্যাপার। এরা খুবই ডেঞ্জারাস! ঠিক বললাম না?”
স্বাস্থ্যবান লোকটা সম্মতি দেয়ার মতো করে মাথা নাড়লেন। যেন এই ব্যাপারে তার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এমনকি সুযোগ পেয়ে আক্রোশ ঝাড়ার মতো করে বলল,
“আর বইলেন না! মাইয়া মানুষ যে কি জিনিস তার হিসাব আমি এই পঁয়ত্রিশ বছরেও মিলাইতে পারি নাই। এই এক মাইয়া মানুষ জিন্দেগীডা পুরা তেনাতেনা কইরা ছাইড়া দিলো।”
ইশান বুঝতে পারলো ভদ্রলোক সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। কিন্তু নোলক যদি শুনতে পায় তবে যে সর্বনাশ হবে, সেই আন্দাজ করে বলে,
“ভাই আস্তে। মিস.অগ্নিশর্মা শুনতে পেলে জিন্দেগীর যেটুক বাকি আছে ঐটুকুরও দফারফা করে ছেড়ে দিবে।”
কথাটুকু বলে বোকা বোকা হাসলো। লোকটাও সাবধান হয়ে গেলো।

নোলক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে বসে থেকে ঘন ঘন নিশ্বাস নেয় বার’কয়েক। রাগ কমার বদল বেড়ে যাচ্ছে আরো। কি মনে হতে ব্যাগ থেকে একটা পুরাতন নিউজ পেপার বের করে অনবরত ছিঁড়তে আরম্ভ করে। ট্রেনের হুইসাল দেয়। কি বিদঘুটে আওয়াজ! চোখমুখ কুঁচকে আসে নোলকের। কুটকুট করে সে পেপারটা ছিঁড়ছে আর পাশে বসা গুরুগম্ভীর ছেলেটা ভ্রু’কুটি করে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে। এতক্ষণ যাবত ঘটে যাওয়া সবটাই সে দেখেছে।
মেয়েটার কাজকর্ম তার পছন্দ হচ্ছে না মোটেও। হুটহাট চিল্লানো, আর রেগে যাওয়াটা সবচাইতে বেশি অপছন্দের। তার কাছে মেয়ে মানে চুপচাপ নমনীয়। এমন ছটফটে স্বভাবের হবে কেন?
কিন্তু এই কাগজ ছেড়ার রহস্যটা ঠিক ধরতে পারছে না আদ্র। সব শেষে, বিবেচনা করে মেয়েটা মানসিক রুগী ব্যাতিত কিছুই মনে হয় নি তার! মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, অদ্ভুতুড়ে! এর তো কোনো কাজকর্মেই ডিসিপ্লিন নেই। উইয়ার্ড!
পেপারটা ছিঁড়া শেষে যখন অনুভব করলো ওর রাগ কমে গিয়েছে, তখন টুকরো করা কাগজগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। নিচে ফেললে নোংরা হয়ে যাবে, তাই ফেলে নি। এইটুকু ডিসিপ্লিন তার মাঝে আছে অবশ্যই।
কিন্তু তার ছটফটে স্বভাবের কারনেই আরেকটা তুরকালামের সূত্রপাত ঘটিয়ে ফেললো মূহুর্তের মাঝে। পানির বোতলের ক্যাপ খুলতে গিয়ে ঝপঝপ করে পানি সব পড়লো আদ্রর ডান হাতে। আকাশি রঙের শার্টটা ভিজে গিয়ে গাঢ় নীল আকার ধারন করলো।
নোলকের উপর তৈরি হয়ে থাকা চাপা বিরক্তিটা এবার আর দমিয়ে রাখতে পারলো না আদ্র। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে অমিষ্ট শান্ত স্বরে বলল,
“খুবই যন্ত্রনার তো আপনি! সমস্যাটা কী? একটার পর একটা গন্ডগোল পাকিয়েই যাচ্ছেন! ছোট্ট একটা বাচ্চাও তো আপনার চাইতে বেশি স্থির থাকে! আপনার তো মানসিক ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন।”
শেষের কথাটা শুনে যেন নোলক আকাশ থেকে পড়লো! পরিস্থিতি অনুকূলে যাওয়ার আগে সামাল দেয়ার মতো করে ইশান বলে,
“এই আদ্র, কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ। সিম্পল একটা ব্যাপার। টেইক ইট ইজি।”
নোলক তখনও বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
একটু পানি পরাতে এত্তোগুলো কথা শুনালো ছেলেটা? হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ আদ্রর দিকে চেয়ে থেকে দাঁড়িয়ে পরে। আচমকা ফুঁসে উঠে বলে,
“এই যে, মিস্টার আদ্র, না অনাদ্র, হোয়াটএভার! আপনার সমস্যাটা কী, সেটা আমায় বলুন? আমার ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন মানে? ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন তো আপনার।
আমি তো জাস্ট ভেবেই পাচ্ছি না আপনি নিজেকে কী ভাবছেন!”
আদ্র টিস্যু দিয়ে শার্টের উপর থেকে পানি মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
“আমি নিজেকে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ব্যাতিত আর কিছুই ভাবছি না। অন্ততপক্ষে আপনার মতো আগাগোড়া দুরন্তপনা আর অস্থিরতায় ভরপুর আমি নই। প্লিজ একটু ম্যাচিউর হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার এই ইমম্যাচিউরিটি বাকিদের বিরক্তির কারন তৈরি করছে।”
এই এতসব কথার কোনোটাই কিন্তু আদ্র উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেনি। বরং জ্ঞান দেয়ার মতো করে যথেষ্ট শান্ত স্বরে বলেছে।
অন্যদিকে রাগে নোলকের হাত-পা তরতর করে কাঁপছে। মাথা ভনভন করছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এত বেশি রাগ হচ্ছে যে, তার বাকশক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছে! এত এত কঠিন কথা এর আগে কেউ তাকে বলেনি!
দাঁতে দাঁত চেপে হাতে থাকা বতলটা ছুড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। ইশান খুব অনুনয়ের সুরে বলে,
“আমি স্যরি, কিছু মনে করবেন না প্লিজ। ও একটু এমনই।”
আদ্র বসে পরে নিজের আসনে। বন্ধুর অযৌক্তিক কার্যকালাপে রাগ হলেও কিছু বলে না। ইশানের কর্মকান্ডে নোলকও সন্তুষ্ট নয়। একজন অন্যায় করে আরেকজন স্যরি বললে, কি লাভ হবে? না বসে দাঁড়িয়ে থাকে সে। টিটিকে ডেকে বলে,
“প্লিজ, আমাকে একটু সিটটা চেঞ্জ করে দিতে পারবেন? যদি না পারেন তবে আমাকে এই ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। এই অসহ্যকর লোকটার সাথে আর এক সেকেন্ড ও বসে যাওয়া সম্ভব নয়। প্লিজ…!”
টিটি যেন মহা যন্ত্রনায় পরে গেলো। সে সবটা দেখে দেখেছে। নরম স্বরে বলল,
“দেখুন আপু, এটা তো বাস নয় যে, যখন-তখন থামানো যাবে। আর কেউ কমপ্রমাইজ করতে না চাইলে তো সিট ও চেঞ্জ করে দেয়া সম্ভব নয়। একটু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন, প্লিজ।”

নোলকের ‘না’ মানে ‘না’। সে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে যাবে তবুও ‘এই ছেলের পাশে বসে কিছুতেই যাবে না’ বলে স্থির করেছে।
টিটি যেন অথৈ সমুদ্রে পড়লো।
ঠিক তখনই সামনের থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলল, সে তার সিট এক্সচেঞ্জ করতে পারবে। সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো নিমিষেই। টিটি ঝামেলে থেকে রেহাই পেলো আর নোলকেরও মনোবাসনা পূর্ণ হলো। আদ্র প্রতিকারটা ঠিক বোঝা গেলো না। সে বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত, প্রতিক্রিয়াহীন। নোলক সিট ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্রুর দৃষ্টিতে একবার তাকালো আদ্রর দিকে। আদ্র নিজের চশমাটা ঠিক করতে করতে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো।

পুরো ব্যাপারটাতে ইশান তার বন্ধুর উপর বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলো। নোলক চলে যেতেই সে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“একটু বেশি বেশি করে ফেললি না আদ্র? বাচ্চা একটা মেয়ে। এমন করা কি খুব প্রয়োজন ছিলো?”
আদ্র যেন কোনো রকম পাত্তাই দিলো না। ইশানের কথাটা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে গিয়ে শার্ট ঠিক করতে করতে বলল,
“আর কতক্ষণ লাগবে? দ্বীপকে ফোন করেছিস?”
ইশান যেন পুনরায় আহত হলো। অসন্তুষ্টি নিয়ে ছোট করে জবাব দিলো,
“না। তোর ইচ্ছে হলে তুই কল কর।”
.
ঢাকা থেকে দুজনের গন্তব্যই অনেকখানি দূর। কয়েক ঘন্টার পথ। দুপুর গরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারপাশে। নিস্তব্ধ পরিবেশের কারনেই হয়তো ট্রেনের ঝকঝক শব্দ আরো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে।
ট্রেনের বেশ অর্ধেক মানুষ ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আদ্র অনুভব করলো তার পাশের লোকটা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্রথম কিছুক্ষণ সহ্য করে গেলেও বেশিক্ষণ তা সহ্য করতে পারলো না। আদ্র অস্বস্তিকর অবস্থা দেখে ইশান মিটিমিটি হাসলো। বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“কী মিস্টার ম্যাচিউর? ভাল্লাগছে এখন?”
আদ্র নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“হুম, খুবই ভাল্লাগছে। খারাপ লাগার মতো কিছু হয়েছে কি?”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই দাঁড়ায় সে। ইশানকে জিজ্ঞেস করে,
“একটু ঐদিকটায় যাচ্ছি, যাবি তুই?”
“না, তুই যা।” বলতে বলতে নিজের সিটে শরীর এলিয়ে দেয় ইশান।

আদ্র দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। এই নিস্তব্ধতা, আবছা আলো, ঝক-ঝক করে বয়ে চলা ট্রেন জার্নি ভালো লাগছে তার। প্যান্টের পকেটে দু-হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ বাতাস উপভোগ করে সে। এই নিশ্চুপতা ভেঙে দিয়ে পেছন থেকে ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“দোস্ত? এই চলন্ত ট্রেন থেকে কোনো অভদ্র-বেয়াদপ লোককে যদি ধাক্কা মেরে ফেলে দেই, তবে কি সে মারা যাবে?”………(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here