#জলছবি
#পার্ট_৩৩
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
রুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। আদ্রর অসুবিধার কথা চিন্তা করেই লাইট অফ রেখে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়। লাইটের তীব্র আলোতে মাথায়, চোখে তীক্ষ্ণ যন্ত্রনা অনুভব করে ছেলেটা।
খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আদ্র। পরনে মেরুন টিশার্ট আর কালো টাউজার। চুলগুলো খুব পরিপাটি। মাথার উপর চঞ্চল পাখা ঘুরছে। তাতেও গোছানো চুলগুলোর বিশেষ হেলদুল হচ্ছে না। দৃষ্টিতে সুনিপুণ মায়া! ভ্রু যুগল সামান্য কুঁচকানো। আধ-ভাজ করা বা’পায়ের উপর বা’হাত রেখে নখ খুঁটছে। অনেক্ষণ যাবত কিছু বলতে চাওয়ার প্রস্তুতি বলা চলে। কী ভাবছে সে?
রুমে অন্যপ্রান্তে বসে আছে ইশান। তার পরনেও টিশার্ট এবং টাউজার। দৃষ্টি ল্যাপ্টপে নিবদ্ধ। পুরোনো ছবিগুলো দেখছে। পুরোনো ছবি বলতে শ্রীতমার বিয়েতে তোলা নোলকের ছবিগুলো! একেকটা ছবি কী ভীষণ চঞ্চল, দূরন্ত, জীবন্ত! মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন, আদ্র’র সাথে কত রাগ, কত তেজ! আর এখন…!
ইশান নিজের আবেগিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছবিগুলো সব ডিলেট করে দিচ্ছে। আজ নোলকে দেখতে যেতে চেয়েও যায়নি। কোথায় যেন বাধা অনুভব করেছে। সবগুলো ডিলেট করা শেষে পেছনে দু’হাত রেখে, সেই হাতের ভরে শরীর খানিক এলিয়ে সিলিং-এ দৃষ্টি রেখে তপ্ত নিশ্বাঃস বিসর্জন দিল। কিছুক্ষণ সেভাবে থেকে ডাকলো,
“দোস্ত?”
আদ্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল,
“হু?”
“সময় কত দ্রুত যায়, না?”
“হুম।”
“শুরুর দিকে অগ্নিশর্মা কত বেশি ছটফটে ছিল! এখন অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, না?”
আদ্র একটু চুপ থেকে বলল,
“আগে শুধু ছটফটে ছিল। আর এখন সেই ছটফটানির সাথে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ আর অভিযোগ যোগ হয়েছে। কত বেশি ভয়ংকরতম ভেবেছিস?”
ইশান সুন্দর করে হাসে। বলে,
“এগুলোই ওর স্পেশালিটি। মন ভালো হয়ে যায়।” ইশান আনমনে কথাটা বলে থতমত খেয়ে যায়। ঠিক হয়নি বোধহয় বলা! নোলকের মুখটা মনে পড়তেই কেমন যেন লাগে!
আদ্রর মুখে অদ্ভুত হাসি। শান্তস্বরে ডাকে,
“ইশু?”
ইশান খানিক চমকায় বোধহয়। চমক ভাব এড়াতেই ঝটপট করে জবাব দেয়,
“হু?”
“নোলককে তোর কেমন লাগে?”
ইশান শুকনো ঠোঁট জিহ্ব দিয়ে ভিজিয়ে। সময় না নিয়ে দ্রুত উত্তর দেয়,
“কেমন লাগবে? ভালোই লাগে। খারাপ লাগার কিছু তো দেখি না।”
“এক্সাক্টলি!”
“কী?”
আদ্র খানিকক্ষণ চুপ থেকে বিবৃতি দেয়ার, মতন করে বলে,
“নোলকের কিছু জিনিসে সেই শুরু থেকে আমি বিরক্ত অনুভব করলেও তুই কখনোই করিসনি। ইভেন ওর সব কিছুই তোর পছন্দ।”
ইশান বুঝতে পারে না আদ্র হঠাৎ এসব কেন বলছে!
আদ্র বলে,
“মানুষ বেশিরভাগ সময়-ই নিজের জন্য ভুল জিনিসটাকে পছন্দ করে বসে। হয়তো সেই জিনিসটা তার জন্য কখনোই পারফেক্ট নয়, তবুও! নোলকের বেলাতেও তাই হলো, বুঝলি?”
ইশান বিছানা থেকে নেমে আদ্র’র কাছে গিয়ে বসে। হলদেটে আলোয় আবছা বোঝা যাচ্ছে আদ্র’র মুখ! আদ্র’র হাতের উপর হাত রেখে বলে,
“কী হয়েছে বলতো? আবোল-তাবোল বকছিস কেন হঠাৎ? নোলককে মিস করছিস? চল যাই, ওদের বাসায়?”
আদ্র বলে,
“তুই যা। ওকে আমি মিস করি না। আবোল-তাবোল ভাবিস আর যা-ই ভাবিস! সত্যি এটাই, ওর জন্য আমার কোনো ফিলিংস নাই। ওরে আমার পছন্দ নয়। সত্যি দোস্ত! এই কয়দিনে এটাই রিয়ালাইজ করলাম। ঐ যে বললাম, আমরা বেশিরভাগ সময় নিজের জন্য ভুল জিনিসটাই চুজ করি। নোলক আমার জন্য কিংবা আমি নোলকের জন্য কখনোই পারফেক্ট ছিলাম না, না এখন আছি।”
ইশানের এত বেশি রাগ হয়! কী নির্দ্বিধায় বলে দিল, নোলকের প্রতি কোনো ফিলিংস নাই!
ইশান ব্যাথিত হওয়ার মতন করে বলে,
“অগ্নিশর্মারর প্রতি তোর একটুও অনুভূতি নাই? এতো নির্দ্বিধায় বলে দিলি কথাটা তুই?”
আদ্র দৃঢ়তার সহিত বলল,
“যা সত্য তাই বললাম। বাচ্চা মানুষ মিথ্যে ইমোশন ওর! আমি তো বাচ্চা নই, তাই না? ওসব আজইরা ফ্যাসিনেইশন পাত্তা দিয়ে লাভ আছে?”
রাগে শরীর কাঁপে ইশানের। দাঁড়িয়ে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে শক্ত হয়ে বলল,
“আসলেই তুই ওকে ডিজার্ভ-ই করিস না আদ্র! এতো জঘন্য মানসিকতা হয়ে গিয়েছে তোর! ভাবতে পাড়ছি না!”
আদ্র মৃদু হাসে!
“সত্যি বললাম বলে রেগে গেলি? ওর জন্য তোর এতো টান কেন?”
“কারণ তোর মতো আমার মানসিকতা এতো ফালতু হয়ে যায়নি!”
“এক্সাক্টলি! হা হা হা!”
কী আশ্চর্য হাসি! ছেলেটা মূহুর্তে এমন বদলে গেল? মন থেকে বলল, এমন জঘন্য টাইপ কথাগুলো!
ইশান আদ্র’র কাছ থেকে সরে আসে। টিশার্ট টা চেঞ্জ করে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। আদ্র চোখ বুজে শরীর এলিয়ে দেয়। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
.
রাত তখন দশটার এপাশ-ওপাশ। নোলককে খাইয়ে এসে, নবনী আরমানকে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে। আরমান নানান তালবাহানা করে আরো কিছুক্ষণ করে থেকে যাচ্ছে। নবনীর হাত টেনে খুব রোমান্টিক রোমান্টিক ভাব করছিল ঠিক তখনই দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। আরমান বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলো, নবনী হেসে দিয়ে উঠে গেলো দরজা খুলতে। কুটকুট করে বলল, একদম ঠিক হয়েছে।
দরজা খুলে ইশানকে দেখে নবনী খানিক চমকালো বৈকি! চমকালেও স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। ভাবলো নোলককে দেখতে এসেছে হয়তো। মিষ্টি হেসে বলল,
“আরেহ! আপনি!”
আরমান কাছে এসে বলল,
“তুই এতো লেইট করে এলি কেন? আদ্র আসে নাই?”
আদ্র’র কথা বলতেই ইশানের চোয়াল ঝুলে এলো। একটু রাগও অনুভব করলো বোধহয়! বলল,
“না, ওর কোনো কাজ নাই এখানে। ভিতরে আসবো?”
নবনী লজ্জিত হওয়ার মতো করে বলে,
“এই স্যরি স্যরি! আসুন প্লিজ!”
ইশান ভেতরে এসে প্রথমেই বলে,
“একটু পানি দিন তো ভাবি!”
ইশানের অস্থিরতা আরমানের চোখ এড়ায় না। আর ইশান ঠিক কখন এমন অস্থির, অশান্ত আচরণ করে তাও বেশ ভালো জানে। নবনী পানি আনতে যায় সেই ফাঁকেই আরমান খানিক কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“তুই কী কোনো কারণে রেগে আছিস ইশু? কিছু হইছে নাকি? এমন অস্থির হয়ে আছিস যে!”
কপালে সৃষ্টি হওয়া বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো কম্পিত হাতে মুছে আরমানের দিকে তাকালো তবে জবাব দিল না। প্রচন্ড রাগে তার হাত-পা কাঁপছে। নবনী পানি নিয়ে আসে। ইশান পানি পান করে জিজ্ঞেস করে,
“অগ্নিশর্মা কেমন আছে? জ্বর পুরোপুরি কমেছে ভাবি?”
নবনী বলে,
“জ্বর কমেছে, কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। তাছাড়া খুব মনমরা হয়ে আছে।”
“আমি ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।”
নবনী বলে, “বসুন, আমি আসছি।” বলেই সে নোলকের রুমের দিকে আসে।
নোলক হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে তখন। খোলা জানালা দিয়ে ফিনফিনে বাতাস এসে দুর্বল-ক্লান্ত শরীর আর বিষন্ন মনে লাগছে। কেমন দম বন্ধ লাগছে! নিজেকে, নিজের অনুভূতিকে খুবই ঠুনকো লাগছে!
যখন থেকে আদ্র’র পাঠানো ভয়েসটা শুনেছে ঠিক তখন থেকে আদ্র’র প্রতি অভিমানের পাশাপাশি ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। কে দিয়েছে তাকে অন্যকারো অনুভূতিকে খাঁটো করার অধিকার! কী ভাবে সে নিজেকে? এত দাম্ভিকতা তার?
মস্তিষ্কজুড়ে কতশত অভিযোগে মানুষটাকে ঘিরে!
নোলক বিরবির করে বলল,’আই হেইট ইউ, হেইট ইউ!’
বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো!
নবনী এসে নোলকের রুমের লাইট অন করে নোলকে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
“নোলক ঘুমাসনি তুই?”
নবনীর কন্ঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজেকে সামলে নেয় নোলক। অন্যদিকে ফিরেই বলে,
“না।”
নবনী কিছুই শুনতে কিংবা দেখতে পায়নি, তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলে
“ভালোই হয়েছে। ইশান এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। পাঠাবো তোর রুমে?”
নোলক আড়ালে চোখ মুছে, ভগ্নমন নিয়ে নবনীর দিকে চাইল। তারপর একটু চুপ থেকে বলল,
“পাঠাও।”
নবনী “আচ্ছা” বলে চলে যাওয়ার দু’মিনিটের মাথায় ইশান এসে উপস্থিত হলো। দরজায় দাঁড়িয়েই বলল,
“আসবো অগ্নিশর্মা?”
নোলক ইশানের দিকে না ফিরেই বলল,
“আসুন।”
রুমের ভেতর এসে চেয়ার টেনে বসলো। নোলকের মুখ সামনের দিকে ফিরানো। ইশান জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো অগ্নিশর্মা?”
“ভালো।”
“এদিক তাকাচ্ছ না কেন? আমার উপর রাগ তোমার?”
নোলক ইশানের দিকে তাকালো। বাঁকা হেসে বলল,
“আপনার উপর আমার কিসের রাগ? ওহ! আপনাদের তো আবার বদ্ধমূল ধারনা আমি ইমম্যাচিউর, ইউজলেস একটা মেয়ে! অযথা অকারণেই রেগে যাই!”
ইশান মৃদু হেসে বলল,
“আদ্র’র উপর রাগ থেকে বলছ?”
নোলক হোঠাৎ-ই রেগে গিয়ে বলল,
“তাকে ছাড়া কি আমি কিছু ভাবতে পারি না?”
“পার?”
“হ্যা পারি, খুব পারি। আপনি কেন সবসময় আমার সব কিছুতে তাকে টেনে আনেন?”
ইশান মুখে অন্যরকম হাসি। কিছু বলে না সে।
নোলক ইশানের দিকে তাকায়। তারপর আচমকাই বলে বসে,
“আপনি সবসময় আমার সব কিছুতে ছুটে আসে কেন? বলুন? ভালোবাসেন আমায়? বিয়ে করবেন? প্লিজ বিয়ে করে ফেলুন আমায়! আপনি আমায় বিয়ে করে নিলে আপনার বন্ধুর জীবনটা বেঁচে যাবে। তিনি না আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড? বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য এটুকু করতে পারবেন না?”
ইশান হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো নোলকের মুখে। বলল,
“পাগল হয়ে গেছো অগ্নিশর্মা?”
নোলক টলমলে দৃষ্টি, ভাঙা কন্ঠে বলে,
“প্লিজ, প্লিজ! আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ। রাখুন না প্লিজ! আর কখনো কিছুই চাইবো না, প্রমিস।”
ইশান অপলক চোখে নোলকের দিকে চেয়ে রইলো। এই পাঁচদিনেই মেয়েটা মুখ শুখিয়ে গিয়েছে। সাথে মনটাও কী? আদ্রর প্রতি শুধু অভিমান থেকেই এসব বলছে?
নোলক পুনরায় বলে,
“আপনিও আমার কথা শুনবেন না, তাই না?
ঠিক আছে। যান আপনি। আমি ঘুমাবো।”
ইশান বলে,
“বিয়ে করতে চাও তুমি নোলক?”
“হ্যাঁ চাই।”
“হবে তোমার বিয়ে, এবং কালই। এখন ঘুমাও নোলক।”
“সত্যি বলছেন?”
“মিথ্যে বলি না আমি, অগ্নিশর্মা। ঘুমাও! ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তোমায়।”
বলেই বেড়িয়ে যায় ইশান। আদ্র আর নোলকের মাঝে ইশানের নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সেই সাথে অনুভব হয় রাগ, ভয়ানক রাগ!…..(চলবে)