#জলছবি
#পার্ট_২৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
দখিনা বাতাস এসে লাগে লুবনার চোখে, মুখে খোলা চুলে। তার রুমের এই দক্ষিণ পাশের খোলা বারান্দাটা তার খুব পছন্দের। ঠোঁটের কোণের হাসি নিয়ে দূরে কোথাও তাকায়, কি যেন ভাবে আনমনে।
“কি ভাবছো একা একা?”
লুবনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পাশে তাকায়। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলে,
“কিছু না বাবা। তুমি কখন এলে?”
পঞ্চাশ পেরোনো ভদ্রলোক কিছুটা গম্ভীর ধরনের। বদরাগী হিসেবে বেশ নাম আছে। তবে মেয়ের কাছে এলেই তার সকল রাগ গলে জল হয়ে যায়। আমিনুল হক নিজের গাম্ভীর্য ভেঙে নরম কন্ঠে বলে,
“মাত্রই এলাম। তোমার সঙ্গে গল্প করতে।
তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে মা?”
“পড়াশোনা ভালো চলছে বাবা। কিন্তু তোমার সাথে তো আমি মোটেও গল্প করবো না। আমি খুব রেগে আছি তোমার উপর।”
লুবনার শেষের কথাটাতে রাগের চেয়ে অভিমানের মাত্রা বেশি স্পষ্ট। আমিনুল হকের কাছে মেয়ে তার পৃথীবি। মেয়ের মলিন মুখ মোটেও কাম্য নয় তার কাছে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“কেন মা? আমি আবার কি করলাম? রাগ কেন?”
লুবনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“গত এক সপ্তাহ তুমি আমার সঙ্গে ঠিক ভাবে কথা বলোনি। যখনই দেখা হয়েছে, তখনই দেখেছি কানে একটা ফোন নিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছো! এটা খুবই জঘন্য একটা দৃশ্য বাবা। তুমি আমায় ইগনোর করেছো।”
আমিনুর হক হো হো করে হেসে উঠে। মেয়েকে কাছে টেনে আহ্লাদ করে বলে,
“স্যরি আম্মাজান। একটুও ইগনোর করিনি, সত্যি বলছি। তুমি ভুল ভাবছো। ব্যাপারটা হলো, নতুন একটা প্রজেক্ট নিলাম না? ওইটা নিয়েই একটু ব্যস্ত ছিলাম। এই প্রজেক্টটা আমাদের কোম্পানিরর জন্য মোস্ট ইম্পরট্যান্ট। কোটি টাকার কারবাররে মা। এইতো আর দুদিন পর ফ্রি হয়ে যাবো। তখন বাপ-বেটি মিলে জম্পেশ আড্ডা দিবো, ঠিক আছে?”
লুবনার খুব রাগ লাগে। সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
“না, একদমই ঠিক নেই বাবা। তুমি সবসময়ই সেইম কথা বলো। আম্মুর সাথেও তো দশ মিনিট গল্প করতে দেখিনি কখনো। দিজ ইজ নট ফেয়ার, বাবা। এত টাকাপয়সা দিয়ে কি হবে? টাকা পয়সা কি মানুষকে সুখি করতে পারে?”
আমিনুল হক বুদ্ধিদীপ্ত হেসে বলে
“এককভাবে টাকাপয়সাও যেমন সুখ দিতে পারে না, তেমনি টাকাপয়সা অভাব দেখা দিলেও কেউ সুখি হতে পারে না। আমি তা নিজ চোখে দেখেই বড় হয়েছি মা। তাই টাকাপয়সার মুল্য একটু বেশি-ই আমার কাছে। পেটে ভাত না থাকলে সুখ কোন দিক দিয়ে পালাবে নির্ণয়ও করতে পারবা না। শুধু টাকা পয়সা যেমন সুখ দিতে পারে না, তেমনি পর্যাপ্ত টাকা পয়সা না থাকলে সুখি হয় না কেউ।”
“কে বলেছে তোমায়, টাকা-পয়সা ধনদৌলত ছাড়া কেউ সুখি হতে পারে না? চাইলেই পারে। এই টাকা-পয়সা, ধনী-গরিব বিভেদ গড়ে তুলে আমারাই জীবনটাকে জটিল করে তুলি। আমার মাঝে-মধ্যে খুব ইচ্ছে করে, গরিব হয়ে গিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে, একমুঠো ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম যদি! তুমি যদি ধনী না হয়ে মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র কেউ হতে?”
আমিনুল হক হাসেন। মেয়ের কথাগুলো বাচ্চাদের কথা হিসেবে ধরে নেয়ার হাসি। তিনি বললেন,
“এসব তোমার ফ্যান্টাসি। রিয়ালিটি ভিন্ন।একটু ম্যাচিউর হও, নিজেই সব বুঝতে পারবা। যাহোক, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, কেমন?”
লুবনা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। মনে মনে বলে,
‘এই ফ্যান্টাসিকেই রিয়েলিটি হিসেবে দেখার খুব ইচ্ছে বাবা!’
আমিনুল হক কিছুদূর গিয়ে আবার ফেরত এসে বলে,
“ওহ একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম। যে কারণে আসা।”
লুবনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিটি চায়। আমিনুল হক বলেন,
“তোমার একটা বন্ধু আছে না? কি যেন নাম?”
লুবনা বুঝতে না পেরে বলে,
“কার কথা বলছো?”
আমিনুল হক খানিক চিন্তাভাবনা করে বলে,
“আরেহ, ঐযে….কালো মতো দেখতে, লম্বাচওড়া!”
লুবনা বুঝতে পারে। মৃদু হেসে বলে,
“ফয়সাল?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ! ঐ ফয়সাল না টয়সাল!”
লুবনা আহত হওয়ার মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
“টয়সাল না বাবা! ওর নাম ফয়সাল। সুন্দর করে বলো।”
“ঐ হলো একই। ছেলেটাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়। কেমন যেন উগ্র চলাফেরা। একজন ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের চলাফেরা এমন হবে কেন? কোনো নম্রতা-ভদ্রতা নেই। প্রায় সময় দেখি, পাড়ার মোড়ের টং দোকানটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকে আর চা-টা খায়। আবার দেখি বাইক নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে। বেপরোয়া ছেলেপেলে। ওর থেকে দূরে দূরে থাকবা, কম মিশবা। ঠিক আছে?”
লুবনা মুখ নিমিষেই চুপসে যায়? শেষ পর্যন্ত ওকেই অপছন্দ করতে হলো? লুবনা ফয়সালের পক্ষ নিয়ে বলে,
“বাবা তুমি ওকে যেমন ভাবছো ও কিন্তু আসলে তেমন নয়। তুমি ভুল ভাবছো।”
“হয়েছে, তোমার আর ওকে নিয়ে সাফাই গাইতে হবে না মা। তোমাকে আমি যা বলেছি তা করো। আমার ধারনা মতে ওর ব্যাকগ্রাউন্ড খুব একটা ভালো হবে না।….”
আমিনুল হক আরো কিছু বলতে যাবেন তার আগে উনার ফোন বেজে উঠলো। তিনি ফোন কানে নিয়ে, মেয়েকে ইশারায় বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।
লুবনা কাঁদোকাঁদো মুখ করে ঠোঁট উল্টে আকাশের দিকে চাইল। যার অর্থ, আল্লাহ্ আমায় রক্ষা করো, প্লিজ!
.
চিকমিক করছে রোদ। নোলক রোদের আড়াল হতে একটু দূরে সরে বসলো। প্রশাসনিক অনুষদের এই দিকটা নোলকের ভালো লাগে। ফাঁকা কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাতেই একটা শুকনো পাতা এসে পড়লো নোলকের কোলের কাছে। কোল থেকে পাতাটা হাতে নিবে তার আগেই ঝড়ের গতিতে কোত্থেকে ছুটে এসে ফয়সাল বসলো ওর পাশে। নোলকের মাথায় ঠুয়া মেরে বলল,
“কিরে ফকিন্নি? ক্লাস না করে এইখানে কি করস? ছ্যাঁকাখোর, না, ছ্যাঁকাখোর তো পোলাগোরে কয়। মাইয়া মানুষ ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হইলে কি কয় রে? ছ্যাঁকাখোরনী? হু, তো এইরাম ছ্যাঁকাখোরনীগো মতো মুখ কইরা বইসা আসিছ ক্যা? কে ছ্যাঁকা দিছে ক? খালি নামডা ক, পিডাইয়া হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়ার কাম আমার।”
নোলক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে হুংকার দেয়,
“ফয়সাইল্লা…!”
ফয়সাল দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে খানিক হেলে পড়ে নোলকের দিকে। হাতে থাকা জবা ফুলটা নিজের কানেই গুঁজে দিয়ে বলে,
“তোরে নাচানাচি, আই মিন, লাফালাফি ছাড়া দেখতে ভাল্লাগে না। কী হইছে বল তো? কয়দিন যাবত দেখতেছি, কেমন থম মাইরা থাকিস সারাদিন! কে কি করছে বল?”
“কেউ কিছু করে নাই। সর তো, জ্বালাচ্ছিস কেন?”
“তাইলে এমন গুইলের মতো মুখ করে আছস ক্যান?”
নোলক ওর মন খারাপকে মাটি চাপা দেয় খানিকক্ষণের জন্য। কারণ এই ফাজিলের সামনে মন খারাপ করে থাকা সম্ভব না। মূল কারণ ফয়সালের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা। এসব আজগুবি কথা এই ছেলে কই পায়, কে জানে! নোলক ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘গুইলের মতো মুখ’ মানে কী? গুইল কী?”
ফয়সাল কিছু বলবে তার আগেই লুবনা এসে উপস্থিত হয়। ফয়সালকে ঠেলেঠুলে ওর কাছ ঘেঁষে বসতে বসতে বলে,
“তোরা দুইটায় ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে কী করিস, হু? ফাঁকিবাজ!”
ফয়সাল বাঁকা হেসে বলে,
“এহ! আইছে আমার পড়ুয়া রে! চোরের মায়ের বড় গলা। আয়, এদিক আয়, গলাটা কেটে ছোট করে দেই। নয়তো দূরে সর। ঘেঁষাঘেঁষি করস ক্যা এত? সর।”
“না, সরুম না। এখানেই বসে থাকমু। তুই পাড়লে সরা।” লুবনার তেজ।
ফয়সাল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
“হে হে! চ্যালেঞ্জ করছিস? শোন, বুচি? তোরে আমি এক হাতেই একটা আছাড় মারতে পারবো। সো ভাব কম, ওকে? নয়তো আছার তো দিবোই সাথে বোনাস হিসেবে ঐ বোঁচা নাকটাতে ঘুষি মেরে আরো বোঁচা বানিয়ে দিমু।”
লুবনা ফয়সালের কথায় দুঃখ পেলো কম, এতক্ষণে এসে ফয়সালের কানে জবা ফুল দেখে হাসি পেলো বেশি। ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
“এক্কেবারে মিস জরিনা খাতুনের মতোই লাগছে। হি হি!”
ফয়সাল চোখ দুটো ছোটছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায়। তারপর বলে,
“এই মাইয়া তুই হাসিস ক্যান? তুই কি ‘কানে ফুল পড়া’ একমাত্র মাইয়া মানুষের জন্মগত অধিকার ধইরা নিছিস?”
লুবনা জোর দিয়ে বলে,
“অবশ্যই।” বলেই ফয়সালের কান থেকে ফুল নিয়ে নিজের কানে পড়ে। ফয়সাল ‘এই?’ বলে হুংকার দিয়ে থাবা মারবে তার আগেই লুবনা নাগালের বাইরে চলে যায়। চোখ, মুখ, শরীর বেয়ে মেয়েটার হাসি উতলে পড়ে। কি সুন্দর, কি সুন্দর!
নোলক অনেক আগেই স্থান ত্যাগ করেছে। মন ভালো না থাকলে আশেপাশের কিছুই ভালো লাগে না। ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো। এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিছু দেখলো-কি-দেখলো না ঠিক বুঝা গেলো না। শরীরটাও হালকা দূর্বল লাগছে। অনেক্ষণ রোদে থাকায় বোধহয়।
ক্যাম্পাস পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর আকস্মিক নোলকের ব্যাগ হ্যাঁচকা টানে নিয়ে নিলো কেউ! নোলক কিছু বোঝার আগেই ছিনতাইকারী নাগালের বাহিরে চলে গেলো। যখন বুঝতে পারলো তখন হঠাৎ-ই নোলক আর্তনাদ করে উঠলো, ‘এই আমার ব্যাগ, আমার চিঠি, নূপুর। এই বেয়াদপ! প্লিজ নিও না।’
কে শুনবে নোলকের এই অনুরক্তি?
নিষাদ সেই পথ ধরেই আসছিলো। নোলক এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে অড়িঘড়ি কাছে এসে ধরলো। বাহুতে নিয়ে বলল,
“এই? কি হয়েছে?”
নোলক ফুঁপিয়ে উঠে। চোখেমুখে হাত রেখে বলে, আমার চিঠিটা দোস্ত! নিয়ে গেলো”
নিষাদ আগামাথা কিছুই ঠাহর করতে পারলো না। নোলককে ধরে রেখেই সে ফয়সাল, সৃজন সকলকে কল করে জানিয়ে দিলো। দু’মিনিটের মাথায় সকলেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো। এত করে জানতে চাইলো, কি হয়েছে? নোলক কিছুই বলতে পারছিলো না। শুধু বলতে লাগল, আমার নূপুর, চিঠি।
পাশ থেকে যারা দেখেছে ঘটনাটা তাদের কেউ কেউ বলল,
“ছিনতাই হইছে।”
ফয়সাল সৃজন আর নিষাদকে বলল,
“তোরা একটু সামনে এগিয়ে দেখ তো।”
তারপর ফয়সাল নোলকে আগলে নিয়ে বলল,
“আরেহ! বোকা নাকি? নূপুর আমি বানিয়ে দিবোনে। এই জন্য এভাবে কাঁদতে হয়? বোকা।”
শ্রেয়ার আর লুবনা বোধহয় নোলকের কান্না দেখেই হতভম্ব। কি বলে শান্তনা দেওয়া উচিত তাই ভুলে গিয়েছে।
নোলক বলল,
“আমার অন্য নূপুর চাই না। আমার চিঠিটা দোস্ত!”
ফয়সাল শান্তনা দিতে দিতে বলল,
“কিসের চিঠি? কার চিঠি?”
নোলক ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আর কিছুই বলে না। এমন কেন হলো! হাতের উল্টোপাশ দিয়ে ভেজা গাল মুছে বলে,
“দোস্ত বাসায় দিয়ে আয়, আমাকে। প্লিজ!”
(চলবে)…..