#জলছবি
#পার্ট_১৭
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
শেষ রাতে ঘুমানোর ফলে নবনীর ঘুম ভাঙলো অনেক দেরিতে। বালিশের পাশে হাতরে ফোন নিয়ে দেখলো নয়টা চল্লিশ বাজে। নবনী হুড়মুড় করে উঠে বসলো। এতো বেলা করে সে কখনই ঘুম থেকে উঠে না। পাশে তাকিয়ে দেখলো নোলক নেই। প্রথমে আফসোস করলো না খেয়ে কলেজ চলে গিয়েছে ভেবে। পরে মনে পড়লো আজ শুক্রবার।
তারপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নোলকে ডাক দিবে তখন শুনতে পেলো ড্রয়িংরুম থেকে একটু আড্ডাসুলভ আওয়াজ ভেসে আসছে। নবনী সাতপাঁচ না ভেবে চশমাটা পড়ে নিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো। পর্দা সরিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই আৎকে উঠলো যেন। এক হাতে চশমা ঠিক করে রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো,
“আশ্চর্য! আপনি এখানে কেন এসেছেন? দিনকে-দিন আপনার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি!”
নোলক আর আরমান দুজনই এক সঙ্গে তাকালো নবনীর ধারালো কন্ঠস্বর শুনে। নোলক কাছে এসে বলল,
“আপু উঠে গিয়েছো? কখন উঠলা?”
নবনীর চোখেমুখে রাজ্যের বিতৃষ্ণা। নোলকের প্রশ্ন কানে না তুলে তেজী কন্ঠে উল্টো প্রশ্ন করলো,
“উনি এখানে কি করছে? কে আসতে দিয়েছে?”
নোলক এবং আরমান দুজনই বুঝতে পারছে নবনী প্রচন্ড রেগে গিয়েছে। নোলক বলে,
“আমি আসতে বলেছি।”
নবনী কিছু বলবে তার আগেই আরমান বলে,
“ওকে বকো না। আমিই ইচ্ছে করে এসেছি। আচ্ছা স্যরি! চলে যাচ্ছি।”
নবনী নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করে বলল,
“তা আবার গর্ব করে বলছেন? আমি জাস্ট ভেবে পাই না, একটা মানুষের কমনসেন্স এত কম কি করে হতে পারে! আপনি জানেন, আমরা বাসায় দুইটা মেয়ে তবুও আপনি কোন সেন্সে ভেতরে এসেছেন? এলাকায় কি থেকে কি রটে যায়, আপনার কোনো ধারনা আছে?”
আরমান পুনরায় অপরাধ মেনে নিয়ে বলে,
“আচ্ছা তেমন কছুই হবে না। অযথা এতো রাগ করো না। আমি চলে যাচ্ছি।”
নবনী খুবই দৃঢ় ভাবে বলে,
“হ্যাঁ, আমার রাগটাকে তো আপনার কাছে অযথা মনেই হবে। শহরের অন্যতম সেরা ব্যবসায়ী, কত পাওয়ার! একটু-আকটু কথা রটে গেলে কি এমন হবে? তার উপর আবার ছেলে মানুষ, মেয়ে তো নন। অত চিন্তা কিসের? এসব কথা-টথায় কি এমন হবে? তাই মনের আনন্দের বাসার সামনে ঘুরঘুর করবেন, রাস্তাঘাটে ফলো করবেন, উদ্ভট উদ্ভট কাজকারবার করবেন, ইচ্ছে হলে বাসায় চলে আসবে, যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন। আপনার তো আত্মসম্মান নেই যে আত্মসম্মানে লাগবে! যা হওয়া আমাদের হবে, আত্মসম্মানে আঘাত আমাদেরই আসবে। টুনির মা ঘুরেঘুরে বদনাম ছড়াবে আমাদের। আপনার তো কিছু যাবে-আসবে না। অত চিন্তার কি আছে, তাই না?”
এক দমে কথা গুলো বলে হাঁপিয়ে উঠলো নবনী। চশমার ফাঁকে টলটলে চোখ দুটো খুব টানলো আরমানকে। বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। আসলে সে এতসব ভেবে তো কিছু করেনি। এতোটা নেগেটিভ এফেক্ট পড়বে তাও ভাবেনি সে!
আরমান নবনীর সামনে এসে খুব দরদমাখা কন্ঠে সুধালো,
“শুধু একবার বলো, বিয়ে করবে আমায়? বিশ্বাস করো, তোমার আত্মসম্মানে বিন্দুমাত্র টোকাও লাগতে দিবো না। করবে বিয়ে?”
নবনী চমকে তাকালো। এতো কঠিন কঠিন কথার শেষে এমন করে কেউ বলতে পারে, তা যেন ধারনাতেই ছিলো না। এই দুই বছরে কম কথা তো শোনায়নি! তবুও যেন কোনো কথাই লোকটার গায়ে লাগে না!
নোলক বোনের এমন কঠিন কঠিন কথায় খুব আহত হলেও তার জবাবে আরমানের এমন মায়াময় আবদারে খুব বেশি সন্তুষ্ট হয়। বোনের জন্য এর থেকে পারফেক্ট কাউকে ভাবতেই পারছে না এই মূহুর্তে। কিন্তু তার খুশি ভাবটা উড়ে গেলো যখন নবনী উত্তরে বলল,
“না। আমার প্রতি, আমার বোনের প্রতি কেউ করুনা দেখাক তা আমি চাই না। আপনি আপনার পথ দেখুন। দয়া করে আমায় জ্বালানো বন্ধ করুন। আমি আমার জন্য খুব সাধারন কাউকেই চাই। তার অনেক টাকাপয়সা থাকবে না। যার অনেক ক্ষমতাও থাকবে না। আমি খুব ভালো করেই জানি, দুদিন পর আপনার এসব প্রেম ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে।”
আরমান করুন স্বরে বলে,
“হায়রে! এ আমি কার প্রেমে পড়লাম! সারা জীবন শুনলাম টাকাপয়সা না থাকলে নাকি প্রেম ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, এখন শুনি টাকা পয়সা বেশি হলে নাকি…..!”
এতো সিরিয়াস মূহুর্তেও আরমানের বলার ভঙ্গিতে নোলক ফিক করে হেসে দিলো।
কপট রাগ নিয়ে নবনী একবার বোনের দিকে চাইলো, একবার আরমানের দিকে। নোলক কিছুটা দূরে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া, আপু মিথ্যে বলছে। আপুও আপনাকে পছন্দ করে। এমনকি চিঠি-ফিঠিও লিখে! কিন্তু মুখে স্বীকার করে না। প্লিজ জলদি জলদি বিয়ে-টিয়ে করে ফেলুন তো।”
নবনী বোনের এহেন কান্ডে হতভম্ব। আড়াল করার জন্য বলল,
“এই না। মিথ্যে কথা। প্লিজ আপনি যান। টুনির মা নিশ্চিত একটা তুরকালাম বাঁধাবে। এমনিতেই তিনি আমাদের উপর ক্ষ্যাপে আছে।”
“আচ্ছা টুনির মার চিন্তা বাদ, তুমি শুধু বলো, নোলক যা বলল, তা কি সত্যি?”
“না।”
নোলক বেগরা দিয়ে আরমানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরেহ আজব! মেয়েদের ‘না’ মানে ‘হ্যা’ বোঝেন না ক্যান? ঐ যে, ঐ গানটা শোনেননি? ‘সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়!'”
আরমান একগাল হেসে বলে,
“ওকে দ্যান, টুনির মা তুরকালাম বাধানোর আগে নাহয় আমি-ই বাধিয়ে ফেলি?”
নবনী বিস্ময় নিয়ে তাকায়। এই ছেলের বিশ্বাস নেই। যা কিছু করতে পারে। নোলক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কি করবে তা দেখার। দুজনকেই অবাক করে দিয়ে কাউকে ফোন লাগায় আরমান। ওপাশ থেকে কল ধরতেই বলে,
“এই ইশু তোকে আমি একটা এড্রেস দিচ্ছি। বিশ মিনিটের মাঝে সেখানে কাজি নিয়ে আসবি। আর হ্যা, আমাদের লেখক সাহেবকেও সাথে আনিস।”
বলেই ফোন কেটে দেয়। নবনী জিজ্ঞেস করে,
“কি হচ্ছে কি? আপনি যাচ্ছেন না কেন?”
নবনীর কথা কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে আরমান আবার কাউকে কল দিলো। ওপাশ থেকে ফোন তুলতেই বড় আহ্লাদ মেশানো কন্ঠে বলল,
“আম্মা? তোমাকে আর আব্বাকে ছাড়া বিয়ে করে তোমাদের বউমাকে নিয়ে যদি বাড়ি ফিরি, তুমি কি খুব রাগ হবা?”
ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
“কি কস আব্বা? কারে বিয়া করসছ? নবনী মার কি হইবো?”
আরমান হো হো করে হেসে বলে,
“তোমার ছেলের তারে ছাড়া আর কাউরে বিয়ে-ফিয়ে করা সম্ভব নয়। তবে বিয়ে এখনও করিনি, করবো। তোমাকে পরে সব বিস্তারিত বলবো আম্মা। এখন খালি অনুমতিটা দিয়ে দেও তো।”
“তোর সব কাজে আমার অনুমতি আছে বাপজান। কিন্তু তোর আব্বা? তারে কি কমু?”
“তুমি ম্যানেজ করো আম্মা। এখন রাখছি।
দোয়া করো।”
আরমানের মা এক গাল হেসে বলল,
“অনেক দোয়া বাপ। বউমারে নিয়া শিঘ্রই গ্রামে ফির।”
“ইনশাআল্লাহ। আসবো আম্মা। রাখছি।”
বলে ফোন রেখে রহস্যময় হাসে।
নবনীর চোখেমুখে দারুন বিস্ময়। কি থেকে কি হতে যাচ্ছে কিছু ঠাওর করতে পারছে না। ছেলেটা কি পুরোপুরি পাগল-টাগল হয়ে গেলো নাকি?
নোলক খুব আগ্রহ নিয়ে সবটা দেখছে। আরমানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে সুধায়,
“এই ভাইয়া? সত্যি সত্যি আমার আপুকে বিয়ে করে ফেলবা নাকি আজ?”
আরমান নোলকের মতোই ফিসফিয়ে বলে,
“মনেহয়! তুমি তোমার বন্ধুদের ডেকে ফেলো তো। ঝটপট।”
নোলক সুবোধ বালিকার মতো তাই করে।
নবনী ফিকে রাগ দেখিয়ে বলে,
“আজব তো! উনাকে যেতে বলছিস না কেন?”
নোলক বলে,
“তুমি বউ মানুষ, এত কথা বল কেন? বউদের চুপচাপ থাকতে হয়। রাগ দেখিও না তো। বউদের রাগ দেখানোর নিয়ম নেই।”
নবনী বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
প্রায় আধা ঘন্টা পর ইশান আর আদ্র এড্রেস অনুযায়ী চলে আসে। দরজা খুলে ওদের দুজনকে দেখে নোলকের চোখ ছানাবড়া! চাপা উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
“আপনারা?”
আদ্র এক পলক নোলককে দেখে ইশানকে জিজ্ঞেস করে,
“কই নিয়ে এলি?”
ইশান নিজেও অবাক। বৃদ্ধ কাজি বলে,
“আমরা কি ভুল বাড়ি চইলা আসছি? এইডা তো বিয়া বাড়ি বিয়া বাড়ি মনে হইতাছে না।”
ইশান সবার দিকে ঘুরেফিরে তাকিয়ে বলতে লাগে,
“আমি তো…!”
পুরো কথা শেষ করার আগে আরমান এগিয়ে এসে বলে,
“চলে আসছিস? আয়, ভেতরে আয়। পাত্রী কিন্তু যখন তখন বেঁকে বসতে পারে। আতংকে আছি ভাই।”
ইশান এবং আদ্রর দুজনেরই প্রথমে বুঝতে বেগ পেতে হয়, বিয়েটা আসলে কার? পরে সংক্ষেপে সবটা শুনে আসল বিষয়টা বুঝলো।
ততক্ষণে ফয়সাল, লুবনা, নিষাদ সহ সকলে চলে এলো। বাসা তখন ভরপুর।
আদ্র তার স্বভাবসুলভ চুপ রইলেও ইশান মজার মজার কথা বলতে আরম্ভ করলো।
নবনীর ভাবনা চিন্তা সব তালগোল পাঁকিয়ে যেতে লাগল। নিজের রুমে এসে কিছুক্ষণ বসে ছিলো। কিন্তু যখন দেখলো ব্যাপরটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তখন আচমকাই আবার রেগে গেলো। রুমে যখন শ্রেয়া লুবনা নোলক এলো তখন সে একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! এখানে কি সার্কাস হচ্ছে? মানে হচ্ছেটা কি? একটা এলাকাতে থাকি তো নাকি? তারা কি আমাদের এলাকা ছাড়া করতে চাচ্ছে?”
নবনী যখন খুব রেগে গেলো তখন পরিবেশে কিছুটা থমথমে ভাব বিরাজ করলো। কিছুসময় পর নোকল এক প্রকার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করলো। এর পেছনে অবশ্য কারন আছে। কারণ ও জানে বোনটা ওর কথা ভেবেই নিজের অনুভূতি চেপে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু সে এমনটা আর হতেই দিবে না। বোনের অনুভূতি টের পাওয়ার পরপরই ফয়সাল, সৃজন, নিষাদকে দিয়ে খোঁজ লাগিয়েছিল। এবং খুব ভালো ফিডব্যাক পেয়েছে। তার নিজেরও আরমানকে বেশ ভালো লেগেছে। নিজ থেকে এই মেয়ে নিজের অনুভূতি স্বীকার করবে না বুঝতে পেরেই এই পন্থা অবলম্বন করলো। এবং সব শেষে সফলও হলো।
জুমার নামাজের আগে আগেই কাবিন হয়ে গেলো নোলক আর আরমানের। সেই ছোট্ট বয়স থেকে এত এত টানাপোড়ন শেষে বোনের জীবনের কিছুটা পূর্ণতা দেখতে পেয়ে নোলকের অদ্ভুত অনুভূতি হলো। ভালো লাগলো, শান্তি লাগলো।
সকল আনুষ্ঠানিকতা যখন শেষ দিকে ঠিক তখন নোলকদের দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। নোলক গিয়ে দরজা খুলতেই এলাকার কিছু মানুষ নিয়ে হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলো টুনির মা।…(চলবে)