#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৭

মিমি তার মায়ের সাথে এয়ারপোর্টে এসেছে। আজ তার চাচা শাকিব চৌধুরী দেশে ফিরছেন। তিনি একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফির উপরে এবছর তিনি দুটো ক্যাটাগরিতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সেরা হয়েছেন। তিনি আসছেন, সেই খবর পেয়ে সাংবাদিকদের দল এয়ারপোর্টের সামনে ভিড় করে আছে। মিমির কাছে ব্যাপারটা বেশ লাগছে। তার চাচা এত নামী লোক ভাবতেই কেমন গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছে।

লায়লা আবারও মিমিকে ধমকালো।
-“বলছি তো বারবার চুইংগাম ফুলাবে না৷ এখানে সাংবাদিকরা আছেন, ছবি তুলছেন। এত বড় হয়ে গেছ অথচ তোমার বাচ্চামো গেল না।”
মিমি মন খারাপ করে থু করে চুইংগামটা ফেলে দিলো।
লায়লা এদিক ওদিক বারবার দেখতে লাগলো। তার চোখ আরেকটা মানুষকে খুঁজছে। মানুষটা নিশাত। সে তো জানিয়েছিল নিশাতকে, আজ ফিরবে শাকিব। তবু এলো না কেন?
অনেকক্ষণ পর পিয়াসাকে দেখা গেল। সে তার কন্যাকে কোলে করে এদিকেই এগিয়ে আসছে। লায়লাও এগিয়ে গেল।
-“নিশাত আসেনি?”
-“এসেছে৷ মহারাণীর এসে লজ্জা করছে। গাড়িতে বসে আছে। অনেক সাংবাদিক দেখছি। এরা আবার ছবি ফবি তুলে কোনো নিউজ না করে দেয়!”
লায়লা পিয়াসার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করলো।
-“কন্যার মন খারাপ কেন?”
-“ওর বাবা ছয়দিনের অফিস ট্যুরে ঢাকার বাইরে। এরপর থেকেই মেয়ের মুখ ভোঁতা। আমি তো ভেবেই কুল পাই না, এই মেয়ের ঠুল্লা বাবার প্রতি এত দরদ কিসের?”
লায়লা চুমু খেলো ঝিলুর কপালে।
-“তুমি থাকো মিমির সাথে আমি দেখে আসি নিশাতকে।”
লায়লা নিশাতের সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেল।
গ্লাসে টোকা দিতেই নিশাত দরজা খুলে নেমে এলো গাড়ি থেকে। তার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। লজ্জায় মুখটাও লাল দেখাচ্ছে। এত মিষ্টি লাগছে দেখতে। শাকিব দেখলে নিশ্চয়ই আনন্দে কেঁদে ফেলবে।
লায়লা চেহারায় মিথ্যামিথ্যি রাগের ছবি ফুটিয়ে তুললো।
-“কী ব্যাপার, হাত খালি যে! দু-হাত ভর্তি ফুল কোথায়? ফুল ছাড়াই তুমি চলে এলে!”
নিশাত অপরাধীর মতো হাসলো। ফুল অবশ্য সে সঙ্গেই এনেছে। লায়লাকে দেখাতে লজ্জা করছে তার।
সে প্রসঙ্গে পাল্টে কথা বললো,
-“মিমি কোথায়?”
-“একদম কথা ঘুরাবে না। ফুল না দেখে আমি ছাড়ছি না। দেখি সরো, পেছনে কী দেখি?”
নিশাত লজ্জা লজ্জা মুখে সরে দাঁড়ালো।
গাড়িতে এক গুচ্ছ গোলাপ রাখা।
-“বাহ্! গোয়েন্দা পুলিশের কমিশনার ম্যাডাম তো দেখি ভেতর ভেতর খুব রোমান্টিক।”
নিশাত ফুলটা লায়লার হাতে ধরিয়ে দিলো।
-“এটা আপনি দেবেন, প্লিজ।”
-“আমি নিশ্চয়ই এত ন্যাকা ন্যাকা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার বয়সে নেই। তাছাড়া আমি দিলে তো এমন একগাদা গোলাপ দেবো না। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ফুল থেকে প্রেমের ঝর্ণা ঝরছে।”
নিশাত মাথা নিচু করে ফেললো। ইশ্ এত বোকামি সে কেন করতে গেল? এতগুলো লাল গোলাপ নিয়ে আসার কি কোনো দরকার ছিল?
গোলাপের দিকে তাকিয়ে লায়লার নিজের জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা মনে পড়লো খুব। মনে আছে, হাসিব চলে যাবার দিনে সে এমন টুকটুকে একটা লাল শাড়ি পরে এসেছিল। তার হাতেও ছিল এমন একগুচ্ছ গোলাপ। হাসিব যাবার সময়ে ফুলগুলো আঁকড়ে ধরেছিল শক্ত করে। বলেছিল, তোমায় নিয়ে যাচ্ছি লায়লা বুকে করে। লায়লা এত কেঁদেছিলো সেদিন। মানুষটা বেঁচে থাকলে আজও হয়তো সে এমন এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়েই আসতো।

শাকিব চলে এসেছে। মিমি চিৎকার করে ডাকলো,
-“চাচা…”
লায়লা নিশাতের হাত ধরে বললো,
-“চলো। একসাথে যাই।”
শাকিব কাছে আসতেই নিশাত এক পলক তাকিয়েই লায়লার পেছনে চলে গেল। উফ্, শরীরটা এমন থরথর করে কাঁপছে কেন তার? সে কি এখন মাথা ঘুরে পরে যাবে?
শাকিবের সাথে আরেকটি দশ বারো বছর বয়েসী ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। লায়লার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো৷ ছেলেটার চেহারা একদম হাসিবের মতো। যেন মুখটা কেটে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু গায়ের রংটা অতিরিক্ত ফর্সা।
মিমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“হাই! হোয়াটস ইওর নেইম?”
ছেলেটি মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো মিমির দিকে।
-“আমি রেয়।”
-“আমি মিমি।”
-“আমি জানি।”
-“বাহ্, তুমি বাংলা জানো!”
–“হ্যাঁ।”
-“ও মাই গড! দেখি বাংলায় কিছু বলো তো?”
-“আমি তোমার ছবি দেখেছি। তুমি ছবির থেকেও সুন্দর দেখতে। একদম উজ্জ্বল রোদের মতো।”
মিমি মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখ ছলছল করছে।
লায়লা চোখে জল নিয়ে হেসে ডাকলো।
-“রেয়, একটু আমার কাছে এসো তো বাবা। তোমায় একটু আদর করে দিই।”
রেয় এগিয়ে গেলো লায়লার কাছে। লায়লা পরম মমতায় রেয়’র গালে হাত ছুঁইয়ে চুমু খেলো দু-হাতে।
রেয় বিস্মিত চোখে লায়লাকে দেখতে লাগলো।
সম্পূর্ণ অপরিচিত এই মহিলাটি তার মাথায় হাত রেখে কেমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। কেন এত কাঁদছেন তিনি? তার কিসের এত কষ্ট?
রেয়’র ইচ্ছে করলো, সে লায়লার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, আপনি কাঁদবেন না প্লিজ! আপনি কাঁদছেন বলে আমারও কান্না পেয়ে যাচ্ছে।

সকাল থেকেই কলির ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে। এতদিন পর ছোটচাচা বাড়ি আসছে। আয়োজনের তো কোনো কমতি রাখলে তো চলবে না। সব ধরনের আয়োজন থাকা চাই। ছোটচাচার সবথেকে প্রিয় রাজহাঁসের মাংস ভুনা। অথচ রাজহাঁসের মাংসেই গন্ডগোল লেগেছে। মাংস সিদ্ধ হচ্ছে না। কাঁচা পেঁপের টুকরো দিলে মাংসা তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। ঘরে কাঁচা পেঁপে নেই।
কলি বিমর্ষ মুখে রান্নাঘর থেকে বের হলো।
রফিক ব্যস্ত হয়ে কলির কাছেই ছুটে এলো।
-“কলি, রকেটের তো সামনের দাঁত নড়তাছে। ফালাই দিবো?”
-“আপনের ছেলের দাঁত আপনে ফালাইবেন আমারে জিগান ক্যান? আমি আমার টেনশনে বাঁচি না।”
-“এইডা কী বল্লা কলি, আমার ছেলে! ছেলে কি শুধু আমার? সে আগে তোমার ছেলে। সবার আগে মা। মায়ের অনুমতি ছাড়া তো আমি ছেলের দাঁত ফেলবো না। অনুমতি দেও।”
-“দিলাম, অনুমতি দিলাম। সাথে আপনার একটা দাঁতও ফেলবেন, এইডা আমার আদেশ। বুড়া বয়সে সারাক্ষণ ছেলে কোলে নিয়া হাটাহাটি। আহলাদ দেখলে অসহ্য লাগে।”
কলি মুখভেংচি দিয়ে সড়ে এলো।
রেহনুমা ডাকছেন কলিকে।
-“নানীজান কিছু বলবেন?”
-“রান্না শেষ?”
-“শেষের পথে। হাঁসের মাংসে আটকাই আছি। মাংস তো হিলতাছে না।”
-“প্রেসার কুকারে দিয়েছো?”
-“পেসার কুকারে দিলে তো টেস লাগবো না নানী।”
-“ঝাল মসলা ছাড়া একটু স্যুপ করে ফেলো। শাকিবের সাথে একজন গেস্ট আসছে। উনি এসব তেল ঝালের তরকারি খেতে পারবেন না।”
-“গেশট আসতেছে? কোন গেশট? চাচাজান আবার কারে নিয়া আসতেছে?”
রেহনুমা জবাব দিলেন না। তাঁর রেয়’র কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বুকটা ফাঁকা লাগছে খুব। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে থাকা সবকিছু কেউ খাবলে খুবলে ফেলে দিয়েছে বাইরে। আচ্ছা হাসিব বেঁচে থাকলে রেয়কে এভাবে এখানে নিয়ে আসতো?
কলি রেহনুমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রফিক হাতে দাঁত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-“কলি, দেখো আমার রকেটের দাঁত।”
-“আমারে দাঁত দেখান কেন? আমি দাঁত দিয়া কী করবো? আপনার ছেলের দাঁত আপনে মন ভইরা দেখেন।”
-“কথায় কথায় আপনের ছেলে বলো কেন কলি?”
-“আপনার ছেলেরে আপনার ছেলে বলবো না তো কি বলবো? গরুর ছেলে বলবো? যান সামনে থাইকা যান।এখন আবার স্যুপ রানতে হইবো।”
রফিকের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ছেলের প্রথম দুধদাঁত পড়লো। এত আনন্দের একটা ব্যাপার অথচ কলির মুখে হাসি নেই। সে আছে সারাক্ষণ কাজকর্ম নিয়ে।
রফিক মনে মনে ঠিক করলো, আজ রাতেই সে কলিকে বুঝাবে, জীবন খুব ছোট। সারাক্ষণ শুধু কাজ নিয়া পড়ে থাকলে এই ছোট জীবন বৃথা। এই জীবনে কাজকর্মের সাথে সাথে আনন্দ-ফূর্তিরও বিশেষ দরকার আছে। রফিক দাঁতটা যত্ন করে পকেটে রেখে দিলো। রাতে কলিকে সে দাঁতটা ভালো করে দেখিয়ে তবেই ফেলবে।

~শেষ~

*****

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here