#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১৪

রাত সাড়ে আটটা। দরাম দরাম দরজায় কিল পড়ছে। সোহেল দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। তারা খোঁজ করছে রাবেয়াকে!
নিশাত অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপনারা কী চান?”
-“ম্যাডাম পুলিশের কিছু চাওয়ার নাই। পুলিশ শুধু জনগণের ভালো চায়। আমরা জনগণের দরকারে দুইটা কথা বলতে আসছি। রাবেয়া বেগমরে ডাইকা দেন, কথা বইলা শেষ করি।”
-“মায়ের শরীর ভালো না। প্রেশার অত্যন্ত লো। প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। দু-বার বমি করেছেন৷ আপনাদের যা দরকারি কথা আমার সাথে বলুন।”
পুলিশের মাঝে একজন অত্যন্ত অভদ্র ইঙ্গিতে বললেন,
-“ম্যাডাম, আপনার সাথে দরকারি কথা বলতে পারলে আমাদেরও আরাম হইতো। কিন্তু কপাল খারাপ, কপালে আরাম নাই। কপালে আছে ঝামেলা। ছত্রিশ ঝামেলা। ডাকেন, আপনার মায়েরে ডাকেন।”
নিশাত একরাশ বিস্ময় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে ডাকলো,
-“মা, একটু এসো তো।”
রাবেয়া ও’ঘর থেকে জবাব দিলেন না। পুলিশের দল নিশাতকে উপেক্ষা করেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো।

রাত ন’টার মধ্যে চারজনের পুলিশের সেই দল রাবেয়া বেগমকে ধরে থানায় নিয়ে গেল। সবুরা অবিরত বিলাপ চালিয়ে যেতে থাকলেন। সোহেল নির্বিকার হয়ে দাদীর পাশে বসে রইলো। নিশাত, হালিম চাচার খোঁজে বেরোলো। মোহাম্মদপুরে সেই ঠিকানায় গিয়ে হালিম সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। নিশাত বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একা একাই থানায় উপস্থিত হলো।
থানার অফিসার মহিউদ্দিন সাহেব স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন,
-“থানায় ঘুরাঘুরি করে লাভ নেই। জটিল কেইস। প্রতিমন্ত্রীর বাসায় চুরি। মামলা কোর্টে উঠবে। উকিল ছাড়া আসামীর জামিন হবে না।”
-“মা কোথায়?”
-“আপাতত, আমাদের হেফাজতে। কালকের মাঝে কোর্টে চালান হবে।”
-“আমি মায়ের সাথে একবার দেখা করবো।”
-“দেখা করে লাভ হবে না। উকিল নিয়া আসেন। কথা বলতে হবে আইনের ভাষায়। আমরা আইনের ভাষা ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না।”
-“আমি শুধু মা’কে একটু বলে যাবো, উনি যাতে চিন্তা না করেন। প্লিজ!”
ওসি সাহেব দেখা করার সুযোগ দিলেন।
-“দশমিনিটে কথা শেষ করবেন। চুরির মালপত্রের হদিস ভালো কইরা নিয়া নেন। এমন হইতে পারে মালপত্র ফেরত পাইলে পার্টি কেইস উঠাই নিয়া মিমাংসায় যাইতে পারে। প্রতিমন্ত্রীর বড় মেয়ের তেরো লাখ টাকা দামের হীরার নেকলেস। একটু ভালো কইরা জিজ্ঞাস করেন। আমরা জিজ্ঞাস করলে কিন্তু খবর হইয়া যাবে।”

রাবেয়া নিশাতকে দেখে বেশ আনন্দিত হলেন। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা বা ভয়ের কোনো ছাপ নেই। যেন থানায় আসার ব্যাপারটা তিনি জানতেন।
-“শোন্ মা, একদম চিন্তা করবি না। তুই শুধু তোর হালিম চাচাকে খবরটা দে। দেখবি উনি আসলে সব এক মিনিটে সমাধান।”
-“উনি কিভাবে সমাধান করবেন? অপরাধে ফেঁসে গেছ তুমি।”
রাবেয়া রহস্যময় ভাবে হাসলেন।
-“উকিল, জজ-ব্যরিষ্টার সব উনার পকেটে থাকে। তুই মন খারাপ করিস না, মা। একবার জেল থেকে ছাড়া পাই এর পেছনের সব ঘটনা তোকে খুলে বলবো!”
-“মা, হালিম চাচা যদি আমাদের সাহায্য করতে না আসেন?”
-“অবশ্যই আসবেন। আমার জন্য না আসলেও উনার সন্তানের জন্য আসবেন।”
রাবেয়ার চোখ আনন্দে চকচক করছে। কিশোরীর মতো খুশি খুশি চেহারায় তিনি নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছেন।
নিশাত কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
-“উনার সন্তান কি তোমার গর্ভে, মা?”
রাবেয়া মাথা নাড়লেন।
-“তুই আমাকে অবিশ্বাস করিস না, মা। আমরা কিন্তু শরীয়ত মেনে বিয়ে করেছি। সাক্ষীও আছে। তোর দাদীমা সব জানে।”
-“তুমি কি এই কাজটা উনার পরামর্শেই করেছো?”
-“যা করেছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করেছি।
তোর ভালো, সোহেলের ভালো সব কথা চিন্তা করেই তো করেছি।”
রাবেয়া আরো কিছুক্ষণ কথা বললেন।
নিশাত মিনিটকয়েক চুপচাপ বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো। হালিম চাচা যে নিঁখোজ এই কথাটা তার মাকে বলতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে তখনো তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। নিশাত বৃষ্টির মাঝেই বেরোলো। ভিজে গায়েই তো সে। আর গা বাঁচিয়ে লাভ কী?

বাড়ি ফিরে নিশাত বেশ অবাক হলো। সোহেল আর দাদীমা বারান্দায় বসে আছে। দরজায় তালা। নিশাতকে দেখেই সোহেল ছুটে এলো।
-“বাড়িওয়ালা আমাদের বের করে দিয়েছে আপা। বলছে, একটা জিনিসপত্রও দেবে না।”
নিশাত বাড়িওয়ালা রুস্তম আলীর সাথে দেখা করতে গেল। বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর দরজা খুললো। বাড়িওয়ালা রুস্তম আলী অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। হাতে সবসময় তজবি। নিশাতকে দেখে তজবিতে চুমু খেলেন। যেন কিছুই হয়নি এমন হাসিমুখে বললেন,
-“আসো মা, ভেতরে আসো।”
নিশাত দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
-“ভেজা গায়ে ঘরে যাবো না চাচা।”
-“ভেজা গায়ে ঘরে আসবা না কেন? মানুষের থাইকা তো আর ঘর বড় না। আগে মানুষের জীবন তারপর অন্য হিসাব।”
নিশাত ক্লান্ত স্বরে বললো,
-“চাচা, আজকের রাতটা আমাদের অন্তত থাকতে দিন। আমি কালকের মধ্যেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো।”
-“থাকতে তো আমি মানা করি নাই মা। বিছানা বালিশ দিয়া দিসি। বারান্দায় থাকো। যতদিন খুশি থাকো। কিন্তু ঘর তো মা খোলা যাবে না। চুরির আসামী বইলা কথা। আমার উপরে অভিযোগ আসবে আমিও এই চুরির সাথে জড়িত। তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই মা। অভিযোগ চুরির প্রতি। যে প্রতিমন্ত্রীর বাসায় চুরি করে, সে যে আমার বাড়িতে করবে না, এর গ্যারান্টি কী?”
নিশাত একবার ভাবলো সে নিচু হয়ে বাড়িওয়ালা চাচার পা ধরে ফেলবে।
-“শোনো মা, তোমাদের জন্য এই বাড়ি ভাড়া করছে হালিম মিয়া। এখন শুনতেছি সে নারিন্দার হালিম ডাকাত। ডাকাতি কইরা তিন চাইরবার জেল খাটছে।তার উপরে খুনের মামলাও আছে ঘাড়ে। মোহাম্মদপুরে তার বরফকলে কিছুদিন আগে দুইটা ডেডবডিও পাওয়া গেছে। আমরা মা সাধাসিধা মানুষ। এইসব ডাকাতির হিসাব নিকাশ তো মা আমরা বুঝি না। তুমিই বলো, আমি হজ্জ্ব কইরা আসছি নয় বছর। এরপর থাইকা এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা নাই। আমি কি ডাকাতির হারাম পয়সা খাইতে পারি? তোমার বিবেচনা ভালো, তোমার নিজ বিবেচনায় বলো।”
নিশাত হাতজোড় করে বললো,
-“চাচা, এই মুহূর্তে আমরা ভয়ংকর বিপদে পড়েছি। এই মুহূর্তে আপনার সাহায্য দরকার!”
-“সাহায্য তো মা আমি তোমাদের অবশ্যই করবো৷ নাহলে বলো, অন্য বাড়িওয়ালা হইলে পুলিশ ডাইকা এতক্ষণে অভিযোগ দিতো। অথচ আমারে দেখো, পুলিশ দুইবার ফোন কইরা খবর জিগাইলো, আমি কাটছাঁট কইরা এক কথা বলে দিসি। বলছি, তোমরা এইসব কিছু করো নাই। আমার আবার এক স্বভাব। মানুষের উপকার না কইরা থাকতে পারি না।”
নিশাত মাথা নিচু করে বললো,
-“যাই চাচা।”
-“যাইবা মানে, এক কাপ চা খাইয়া যাও। এত রাতে ভিজা শরীরে আসছো, চা না খাইয়া গেলে তো চলবে না।”
নিশাত ওখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।
রুস্তম আলী পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন,
-“মা শোনো, তোমার বই খাতা আমি প্লাস্টিকের বস্তায় ভইরা যত্ন কইরা দিয়া দিসি। বিদ্যাশিক্ষার সম্মান আমি জানি মা। বিদ্যা শিক্ষা মাথার তুল্য জিনিস। এর অমর্যাদা আমি কোনোদিন করি নাই।”

নিশাত দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। এই মুহূর্তে তাকে থাকবার জন্য একটা জায়গা বের করতে হবে। রাসনা খালার কাছে যাওয়া যায়। বস্তিতে তিনি নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবেন না। এত রাতে ভ্যান যোগাড় করা অসম্ভব। জিনিসপত্র থাকুক। সকালে এসে নেওয়া যাবে।
নিশাতের মোবাইল ফোন বাজছে। অচেনা কেউ ফোন করেছে। নিশাত ফোনটা কেটে দিলো।
সাথে সাথেই মেসেজ এলো,
‘আমি তোমার নিপু ভাইয়া নিশাত। ফোনটা রিসিভ করো। জরুরি কথা আছে৷’
নিশাত ফোনকল ব্যাক করলো।
-“হ্যালো নিশাত! তোমার সাথে একটা জরুরি দরকার ছিল।”
-“জি বলুন।”
-“বিরাট বিপদে পড়েছি বুঝলে নিশাত? আমার মেজো ফুপির খুব শরীর খারাপ। ফুপি একা মানুষ। বিশাল বাড়িতে থাকেন। উনি বারবার করে বলছেন, আমি যাতে উনার সাথে গিয়ে থাকি। আমি কী করে থাকি বলো? আমি আছি চৌদ্দ রকম ঝামেলায়। এখন এইখানে ডাক পড়ে তো তখন ওইখানে ডাক পড়ে। তুমি যদি আমায় একটু সাহায্য করো!”
নিশাত ঢোঁক গিলে কান্না আটকালো।
-“বড় ভাই হিসেবে তোমায় একটা অনুরোধ নিশাত। তুমি যদি কটা দিন আমার ফুপির পাশে থাকতে! এখনি চলে আসলে ভালো হয়। তুমি কি এই অধম বড় ভাইয়ের অনুরোধটা রাখবে?”
নিশাত ফোনের এপাশে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“এক কাজ করো নিশাত, সোহেলকে আর দাদীমাকে সাথে নিয়ে নাও। একা বাড়িতে, কখন কী দরকার হয়?”

রাত দুটা নাগাদ নিপু ভাই সমস্ত মালপত্র সহ নিশাতকে নিয়ে যে বাড়িতে পৌঁছালেন সে বাড়িতে নিপু ভাইয়ের কোনো অসুস্থ খালা নেই। ফাঁকা বাড়ি।
নিশাতদের জন্য তিনি খাবার দাবার থেকে সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
-“তোমরা এত রাতে কখন কী রান্না করবা না করবা।তাই খাবার আনায়া রাখছি।”
নিপু ভাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
নিশাত মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কাতর স্বরে বললো,
-“আপনি শুধু আমাদের সাহায্য করবেন বলে এই মিথ্যে গল্পটা ফেঁদেছেন, তাই না?”
নিপু ভাই বেশ বিরক্ত হলেন।
-“তোমাকে পরিষ্কার করে একটা কথা বলি নিশাত, এইসব সাহায্য আমি তোমাকে করছি না।”
-“তাহলে কে করছে?”
-“কে করছে সেটাও আমি তোমাকে বলতে পারবো না। নাও যথেষ্ট ঝামেলা করছো। এখন বাকিটা সামলাও।”

নিশাত মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। এত ক্লান্তি সে আর নিতে পারছে না।

চলবে

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here