#ধারাবাহিকগল্প
#চোরাবালি
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী

জুলি ভাবছে ওর জীবনটা কেন এমন হল? সারাজীবন কলুর বলদের মতো অন্যের জন্যে খেটে গেছে। অপরের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। কোন ছোটোবেলায় মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর নিজেরও কবর হয়েছে। আর এতোদিন বোধহীন ভাবে জীবমৃত লাশ হয়ে অপরের তরে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। অথচ নির্মম ক্লেদে ওর নিজের জীবনের দিনগুলো পার করেছে।
এতোদিনের চেনা জগত ছেড়ে জুলির আজ চলে যেতে মন চায়।
জুলির ফোনটা বেজে উঠলো। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে।
—–হ্যালো, আপনার পেশেন্টের অবস্থা আগের থেকে ভাল হয়েছে। পেশেন্ট আপনাকে খুঁজছে। আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসুন।
জুলি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। জুলি ভাবছে কি হবে নিজেকে মিথ্যা মায়ার মোহে আটকে রেখে?জুলির এখন আর ভালবাসায় বিশ্বাস নেই। ওর মনে হয় যারা বোকা আর নির্বোধ তারাই শুধু ভালবাসে। শরীর ছাড়া ছেলেরা মেয়েদের মনের খেয়াল কখনও রাখে না। মেয়েরা বোকা তাই ছেলেদের কথার জালে ডুবে গিয়ে নিজের সবটুকু উজার করে দিয়ে দিন শেষে সর্বস্ব খোয়াতে হয়। তারপর কুকুর বিড়ালের মতো তাদের জীবন কাটাতে হয়। হাসপাতালে পৌছে উবারের বিলটা মিটিয়ে দিয়ে কেবিনে চলে আসে। ডাক্তারের সাথে দেখা করে। ডাক্তার ওকে বলে,
—–আপনার পেশেন্টকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে।
কেবিনে গিয়ে জুলি রায়হানকে বললো,
—–কেমন আছো।
—–আমাকে বাঁচাতে গেলে কেন?
—–আমি আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র। তুমি এবার মাদকের নেশাটা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলে আমিও সায়ানের জাল থেকে বেরিয়ে আসবো। তারপর দুজনে মিলে আবার নতুন করে আমাদের জীবনটা শুরু করবো।
রায়হানের কেন জানি জুলির কথাগুলো বিশ্বাস করতে মন চাইছে। ও জুলির মুখের দিকে তাকিয়ে বিশ্বাসের গভীরতা খুঁজছে। জুলি রায়হানের মনের কথা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,
—-এবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখো ঠকবে না।
আমরা দুজন এ শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো। যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না।
রায়হানের কাছে বিদায় নিয়ে জুলি অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। ও ভাবছে সায়ান যদি বাচ্চাটাকে মেনে না নেয় এবং ওকে জোর করে এবরশন করাতে বলে তাহলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রায়হানকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে।
অফিসে এসে প্রজেক্টের প্রেজেনটেশন জুলি খুব সুন্দর করে তৈরী করে ফেললো। সায়ান জুলির উপর অনেক খুশী হলো। সায়ান এটুকু বুঝতে পেরেছে জুলি স্বেচ্ছায় এই বাচ্চাটা এবরশন করাবে না। তাই ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে বললো,
—–জুলি আমি সরি। আমি আসলে চিন্তা করে দেখলাম তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। আমাকে কয়েকদিন সময় দাও সব ঠিক করে ফেলবো।
জুলির চোখ মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠলো
সায়ান ভাবছে মিষ্টি কথায় জুলিকে ভুলিয়ে কাজটা করতে হবে। আগে কন্ট্রাক্টা সই হয়ে যাক তারপর জুলির এই বিষয়টা নিয়ে ও ভাববে।
জুলিকে ডেকে সায়ান বললো,
—–দোয়া করো কাল যেন আমাদের ডিলটা ভালই ভালই হয়ে যায়। তারপর তোমার জন্য সারপ্রাইজ গিফট আছে।
জুলি মনে মনে খুশী হলো। ও ভাবছে সায়ান মনে হয় ওর বাচ্চাটাকে মেনে নিবে। এবং ওদের বিয়েটা মনে হয় হয়ে যাবে।
দুদিন পর______
ভালভাবে ওদের ডিলটা হয়ে গেলো। সায়ান এবার ওর ফন্দি আঁটতে লাগলো। অফিস ফেরত জুলি হাসপাতালে রায়হানকে দেখতে গিয়েছিল। আগামীকাল রায়হানের রিলিজ হবে। রায়হান খুব খুশী। ও আসলেই জুলিকে খুব ভালবাসে। এবার মনে হয় জুলির সাথে ওর সুখের সংসার হবে। জুলির ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সায়ান ফোন দিয়েছে। ও রায়হানের কাছে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের বাইরে চলে এসে ফোনটা ধরলো।
—–হ্যালো জুলি, তুমি কোথায়? আমি ঘন্টা খানিকের মধ্যে বাংলোতে আসছি।
জুলি বললো,
—-ঠিক আছে আসো, আমি তার আগেই পৌছে যাবো।
জুলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধা সাতটা বাজে। ও উবার ডেকে বাংলোর দিকে রওয়ানা হলো। তাড়তাড়ি বাড়িতে পৌছে সায়ানের জন্য রেডী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। জুলি সায়ানের গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনতে পেলো। তারপর সিঁড়িতে সায়ানের
জুতোর শব্দ শুনতে পেলো। মিনারা খালা খুব খুশী। বাড়ির পরিবেশ আগের মতো হয়ে আসছে। সায়ান জুলির রুমে আসা মাত্র ও দরজা খুলে সায়ানকে উষ্ণ ওয়েলকাম জানালো। সায়ান ওকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে ভাবছে আজকেই জুলির সাথে সম্পর্কের ইতি টানবে। এখান থেকে সোজা জুলিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাবে। ওখানে ডাক্তারের সাথে আলাপ করা আছে।
রুমে যাওয়ার পর মিনারা খালা দুগ্লাস আপেলের জুস দিয়ে গেল। সায়ান জুলিকে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
————-
রায়হান ফ্লোরে বসে জুলির মাথাটা কোলে নিয়ে আদর করছে। জুলির সারা শরীর রক্তে ভেসে গিয়েছে। আর ওর হাত দিয়ে জুলির হাতটা নিয়ে নিজের শরীর বুলিয়ে নিয়ে বলছে,
——পাগলীটা কতদিন আমায় আদর করে না। আমারও তোকে আদর করা হয় না। তুইও তো আমাকে আগের মতো ভালবাসিস না। আমি তোকে আবারও বিশ্বাস করে ঠকে গেলাম। কেন তুই বারবার আমার ভালবাসা নিয়ে খেলিস। তুই যখন আমায় বললি আমায় নিয়ে তুই নতুন করে আবার সব শুরু করতে চাস আমি সত্যি তোকে অনেক বিশ্বাস করেছিলাম। আমি লোভটা সামলাতে পারিনি। তাই তোর কাছে ছুটে আসলাম। আমার তো কাল রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলে ডাক্তারকে বলে আজ রাতে রিলিজ নিয়ে চলে আসলাম। তারপর লনে সায়ান চৌধুরীর বিএমডব্লিউ গাড়ি দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেলো। তারপর যা হবার তাই হলো। আমি অনেক আগে তোকে আর সায়ান চৌধুরীকে খুন করার জন্য ছুরিটা কিনে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আজ বাড়িতে এসে ছুরিটা ফেলে দিবো। তোকে সারপ্রাইজ দিবো। আমার তো কাল রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তোদের মৃত্যুই আমাকে টেনে এনেছে। তুই আমার সাথে আবারও বিশ্বাসঘাতকতা করলি আর ছুরিটাকেও ব্যবহার করতে হলো। তোরা নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলি আমার উপস্থিতিটা টের পেলি না। আমারও তোদেরকে মেরে ফেলতে সুবিধা হলো। আমার শান্তি এটাই আমি নিজ হাতে আমার ভালবাসাকে খুন করেছি।

মেঝেতে রক্তাক্ত ছুরিটা পড়ে আছে। বিছানায় চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্টির কর্ণধার সায়ান চৌধুরীর ডেড বডিটা পড়ে আছে। মৃত্যুই মনে হয় সায়ানকে এখানে টেনে এনেছে। রায়হান মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পাগলের মতো জুলিকে আদর করছে। পুরো বাংলো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এতোক্ষণে রুবি আর জিনাতুন্নেছা ঘটনাস্থলে চলে এসেছে।জিনাতুন্নেছা অনেক চেষ্টা করেও পাপের প্রায়শ্চিত্ত থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারলেন না। আহারে জীবন লোভ লালসায় পড়ে মানুষ এভাবেই মৃত্যুর চোরাবালিতে ডুবে যায়। পাপ কখনও বাপকেও ছাড়ে না। প্রতিটি মানুষকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। বার বার পৃথিবীতে এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হয়। তারপর মানুষ ভুলে যায়। আবার পাপের অতলান্তিক গহ্বরে হারিয়ে যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here