#ধারাবাহিকগল্প
#চোরাবালি
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
পরদিন খুব ভােরে ফোনের শব্দে জুলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসছে।
—–হ্যালো, আমি জয়িতা বলছি। আপনি কি জুলি বলছেন?
—-জ্বি
—-রায়হান আপনার কি হন?
—-আমার পরিচিত না মানে আমার হাসবেন্ড।
—–আমি একজন সাংবাদিক। গতকাল রাতে উনি অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিলেন। আমি ওনাকে সিটি হাসপাতালে ভর্তি করেছি। হাসপাতালে আনার পর ওনার জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
—–আমার নাম্বারটা কোথায় পেলেন?
—–ওনার মোবাইল থেকে আপনার নাম্বারটা পেয়েছি।
—–ডাক্তার বলছে উনি মনে হয় ড্রাগ এডিক্টেট। আপনি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন।
জুলি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে গেলো। জয়িতা জুলিকে দেখে বললো,
—–আপনার হাসব্যান্ড যে ড্রাগ এডিক্টেট আপনি জানতেন না?
—–জানতাম। অনেক বাঁধা দিয়েছি। কিন্তু ফেরাতে পারিনি।
—–আপনার উনার চিকিৎসা করা উচিত ছিলো। যাই হোক এখন উনার ভাল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করুন। আপনি কি জব করেন?
—–হ্যা চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্টিতে আছি।
—–আমি “নারীর কথা”পত্রিকার সাংবাদিক। আমার কার্ডটা রাখেন। আজ তাহলে আসি। বাড়িতে মা চিন্তা করবে। যদিও ফোন দিয়ে সিচুয়েশন জানিয়ে দিয়েছি।
জয়িতা স্কুটি চালিয়ে চলে গেলো। জুলি ওর পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটাকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী মনে হলো। জুলির জীবনটা তো ওর মতো হতে পারতো।
রায়হানকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। জুলির রায়হানের দিকে তাকিয়ে কেন যেন খুব মায়া হলো। তাড়াতাড়ি হাসপাতালের ফর্মালিটিজগুলো সেরে ফেললো। জুলিকে আবার অফিসে ফিরতে হবে তাই একজন ওয়ার্ড বয়কে রায়হানের দেখাশোনার জন্য ঠিক করে রাখলো। হঠাৎ জুলির মাথাটা ঘুরে উঠলো। এ মাসের পিরিয়ড এখনো হয়নি। জুলির খুব টেনশন হচ্ছে। তাই হাসপাতালে চেকআপ করালো। ডাক্তার বললো,
—–আপনি মা হতে চলেছেন।
—–জুলির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ও সায়ানকে ফোন দিলো। জুলির ফোন দেখে ও রুবির সামনে থেকে বাগানে চলে গেলো।
—–হ্যালো জুলি ফোন দিয়েছো ভালই হলো। নয়ত আমি তোমাকে ফোন দিতাম। তোমাকে নিয়ে বাসায় খুব অশান্তি হচ্ছে। আমি ব্রেক আপ চাইছি। আমি আসলে তোমার সাথে আমার সম্পর্কটার সমাপ্তি চাইছি।
—-কিন্তু সায়ান আমাদের এই সম্পর্ক তো সমাপ্তি হওয়ার কথা ছিলো না। আমাদের তো বিয়ে করার কথা।
সায়ান একটু গম্ভীর হয়ে জুলিকে বললো,
—-জুলি তুমি এখন থেকে আমাকে স্যার বলবে। তুমি আমার অফিসের একজন সামান্য এমপ্লয়ি। এর বাইরে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নাই। আর তুমি বিয়ে করে যা পাও নাই আমার কাছে তার থেকে অনেক বেশী পেয়েছো। এটা ভুলে যেও না।
—–আমি প্রেগনেন্ট
—–এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। তোমার তো প্রটেকশন নেওয়ার কথা ছিলো।
—–তা ছিলো। কিন্তু আমাদের বিয়ে হওয়ারও কথা ছিলো। এভাবে দশ বছরের সম্পর্কটা শেষ করে দিবে আমি কখনও ভাবতে পারিনি। আমাকে যখন বিয়ে করবে না তাহলে এভাবে আমার অপেক্ষার সময়গুলো নষ্ট করার অধিকারও তোমার ছিলো না। তার মানে আমার অস্তিত্ব কখনও তোমার জীবনে ছিলো না। আমি ছিলাম ভোগের বস্তু এবং তোমার জীবনের একটা কাঁটা। এখন তুমি তোমার কাঁটা টাকে উপরে ফেলতে চাইছো।
—–শোন জুলি বাচ্চাটাকে এবরশন করে ফেলো।
—–সায়ান তুমি আমার উপর এতোটা নিষ্ঠুর হওয়ো না। আমাকে বিয়ে করে বিদেশে পাঠিয়ে দাও। এই বাচ্চার দায় তোমায় নিতে হবে না। আমি ওকে একা বড় করে তুলতে পারবো।
—–জুলি পাগলামী করো না। যা বলছি তাই করো। যত টাকা লাগে আমি দিয়ে দিবো। কেবল তো একমাস। এখনও ওটা মাংসের দলা। তোমার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু যদি ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করো তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো না। আর হ্যা তাড়াতাড়ি অফিসে যাও। প্রজেক্টের ফাইল টা রেডী করো। তোমার প্রেজেনটেশন আছে। সেটার জন্য প্রস্তুতি নাও। আমার এই কন্ট্রাকটা চাই।
ফোনটা রেখে জুলি ভাবলো পাপ কখনও কাউকে ছেড়ে দেয় না। রায়হানের কথাটা ওর জীবনে ফলে গেলো। সুখের লোভে শরীর দিয়েও সায়ান চৌধুরীর মতো মায়ার জালে নিজেকে আটকাতে পারলো না। দিনশেষে মায়ার বাঁধন কেটে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলো। আর রায়হানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ফল ওকে হাতে নাতে পেতে হলো।
সায়ান ফোনে কথা শেষ করে চিন্তায় পড়ে গেলো। জুলির এই ঘটনা যদি ওর মায়ের কান অবধি পৌছে যায় ওকে কি ফেস করতে হবে কে জানে? এমনিতেই সেদিন ওর মা ওকে থ্রেট দিলো যে পাওয়ার অব এটর্নী অন্য কাউকে দিয়ে দিবে? যদি ওকে বাদ দিয়ে রুবিকে দিয়ে দেয় তাহলে ওর মান সম্মান ধুলায় মিশে যাবে। আর এই সামান্য একটা মেয়ের জন্য ও এই সম্পত্তি হাতছাড়া করতে পারবে না। রায়ান তো কোনদিন দেশে আসবে না। সুতরাং মায়ের মতে চলতে পারলে এই বিশাল চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্টি একদিন ওর হবে। মাকে খেপিয়ে লাভ নাই। লোকশানের বোঝাটাই বেশী হবে। তাই ও ওর মাকে চটাতে চায় না। সায়ান ভেবে পায় না জুলির জালে ও কিভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেললো। ইতিমধ্যে রুবিও বাগানে চলে এসেছে। রুবি দূর থেকেই সায়ানের ফোনে কথা বলার ভঙ্গি দেখে বুঝেছে something wrong. কিন্তু এটাও জানে বোম মারলেও সায়ানের পেট থেকে কোনো কথা বের হবে না। যদিও শাশুড়ি মাকে বিষয়টা জানানোর ফলে সায়ান ওর সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চাইছে। ও শাশুড়ি মাকে যা বলার বলবে। সায়ানকে খুব অন্যমনস্ক লাগছে। রুবির ডাকে সায়ান সম্বিত ফিরে পেলো। রুবি সায়ানকে বললো,
—–মা ব্রেক ফাস্ট করতে তোমায় ডাকছে।
—–আমি ফ্রেস হয়ে টেবিলে আসছি।
সায়ান রুবির সামনে থেকে দ্রুত সরে পড়লো। একদম রেডী হয়ে এসে টেবিলে বসলো। জিনাতুন্নেসা সায়ানকে বললো,
—-তোমার ঐ প্রজেক্টের ডিল কবে হবে?
—–আগামীকাল।
—–ডিলটা হয়ে গেলে তুমি তোমার পার্সোনাল সেক্রেটারীকে চেইঞ্জ করে ফেলো। এই পোস্টে কাউকে এতো বছর ধরে রাখতে হয় না। তাহলে অফিসের গোপনীয়তা বলে কিছু থাকে না।
—–ঠিক আছে। পত্রিকায় সার্কুলার দিবো। আমি উঠলাম।
সায়ান রুবির সামনে ওর মায়ের সাথে কঘা সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত চলে গেলো।
সায়ান অফিসে যাওয়ার পর জিনাতুন্নেসা রুবিকে বললো,
—–সায়ান কি তোমার সাথে গতকাল স্বাভাবিক ছিলো।
—-তা ছিলো। কিন্তু আমার ধারণা সকালে ঐ মেয়েটা মনে হয় ফোন দিয়েছিলো।
—–তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারছো কি?
—–মা ওর কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমার মনে হয়েছে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে।
—–আচ্ছা আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি। আমি যেহেতু হ্যান্ডেল করছি তুমি এই বিষয়টাতে ঢুকো না। আমি ঠিক কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে ফেলবো।
—-মা ঐ মেয়েটাকে যে বাড়িতে সায়ান থাকতে দিয়েছে ওটা কি ওর নামে লিখে দিয়েছে?
—–সায়ানকে জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। তবে আমার মনে হয় না সায়ান এতো তাড়াতাড়ি ওকে লিখে দিবে। তুমি এসব নিয়ে প্যারা নিও না। দাদু ভাইরা এখন বড় হয়ে গেছে। তুমিও অফিসে জয়েন করে ফেলো। সায়ানের একা এতো বড় ব্যবসা সামলাতে সমস্যা হয়। তুমি পাশে থাকলে ওর হেল্প হবে।
রুবি ভাবছে ওর আসলেই অফিসে জয়েন করা উচিত। সায়ানকে চোখে চোখে রাখতে পারবে।
—–ঠিক আছে আপনি যেহেতু চাইছেন আমিও জয়েন করবো।
চলবে