#ধারাবাহিকগল্প
#সামাজিক থ্রিলার
#চোরাবালি
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

গাড়িতে বসে জিনাতুন্নেছা ভাবছে, ভালবাসা হচ্ছে অমুল্য বস্তু। ভালবাসাকে পাওয়া যত সহজ তাকে ধরে রাখা বেশী কঠিন। এই ধ্রুব সত্যটা রুবি বা সায়ান কেউ বোঝেনি বলে ওদের দাম্পত্য জীবনের এই হাল। যার সমাধান খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে জিনাতুন্নেছাকে।
আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভালবাসাকে ডোমেস্টিক অ্যাপ্লায়েন্সের মতো ব্যবহার করে। ভাল না লাগলে বিনে ফেলে দিতে দ্বিধা করে না। অথচ ভালবাসাকে যে পরিচর্যা করতে হয় সেটাই তারা বোঝে না। সত্যিকারের ভালবাসা মানুষকে অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে ফেরাতে পারে। সেই আশা নিয়ে উনি রুবিকে সায়ানের বউ করে এনেছিলেন। না,রুবির দোষ উনি দেন না। নিজের ছেলেকে ভালভাবে মানুষ না করার দায় উনার। কারণ উনি তো ঐ সন্তানের মা। রুবি আজ একটা দামী কথা বলেছে। পরের মেয়ের ঘাড়ে দোষ না দিয়ে নিজের ঘরকে আগে সামলানো উচিত। সত্যি কথা শুনতে যতই তিতা লাগুক, যা সত্যি তা কখনও অস্বীকার করা উচিত নয়। ড্রাইভারের ডাকে জিনাতুন্নেসা সম্বিত ফিরে পেলো।
—–ম্যাডাম আমরা অফিসে আইসা পড়ছি।
প্রটোকল অফিসার মিজান সাহেব আগেই দাঁড়ানো ছিলো। পৌঁছানো মাত্র গাড়ির দরজা খুলে ম্যাডামকে ওয়েলকাম জানিয়ে অফিসের ভিতরে নিয়ে আসলেন। জিনাতুন্নেসা মিজান সাহেবকে বললেন,
—–সায়ান কি অফিসে আছে?
—–না,স্যার কারখানা ভিজিটে গাজীপুরে গিয়েছে। ম্যাডাম চা দিবো না কফি দিবো?
—-কফি দাও।
মিজান সাহেব রুমে কফি পৌঁছে দেওয়ার সময় জিনাতুন্নেছা বললো,
—–জুলিকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও।
—-May I come in sir.
—–yes.
সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে জিনাতুন্নেছা জুলিকে বললো,
—-বসো, তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমি তোমার সাথে কি নিয়ে কথা বলতে চাইছি?
—-না,ম্যাডাম আমি বুঝতে পারছি না।
—-তোমাদের মতো মেয়েরা ছলনা ভালই জানে। কত টাকা পেলে তুমি আমার ছেলের জীবন থেকে সরে যাবে?
—–ম্যাডাম আমি সায়ানকে ভালবাসি।
—–মাই ফুট। সায়ানকে নাম ধরে ডাকছো কোন সাহসে? রক্ষিতাদের কাছে আবার ভালবাসার মুল্য কি?। তোমার মতো মেয়েদের কাছে ভালবাসা হচ্ছে ছলনা। ভালবেসেই তো বিয়ে করেছিলে। তাকে ছেড়ে আসতে তোমার এতটুকু বাঁধেনি। কারণ সে তো গরীব। তার কোনো চাল চুলো নেই। সায়ান তো রাজপুত্র। সায়ানকে যখন বাগে পেয়েছো তাহলে তথাকথিত ঐ স্বামীকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে সমস্যা নাই। তবে এটা মনে রেখো সায়ানের মা যতদিন বেঁচে আছে পঁচা শামুকে সায়ানের পা আমি কাটতে দিবো না। আর আমি ভেবে পাই না সায়ান চৌধুরীকে ভালবাসার স্পর্ধা কেমন করে পাও। তুমি কি নিজের অবস্থানটা ভুলে গেছো। কোথায় তুমি আর কোথায় সায়ান চৌধুরী। আসলে কি জানো পায়ের তলার জিনিস পায়ের তলাতেই রাখতে হয়। তাকে মাথায় তুললে দন্ড দিতে হয়। তোমাকে পায়ের তলায় রাখলে আজ তোমার এতো বাড় বাড়তো না। আমার ছেলের ভদ্রমানসিকতার সুযোগটাও নিতে পারতে না। আমি তোমাকে শেষ বারের মতো বলছি আমার সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ো না। তাহলে সেই আগুনে তুমি জ্বলে পুড়ে মরবে। কথাটা মনে রেখো।
কথাগুলো বলে গটগট করে জিনাতুন্নেছা অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।
জিনাতুন্নেছার কথাগুলো শোনার পর জুলির মনে হলো কে যেন ওর কানে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। ও টেবিলে এসে খুব বিমর্ষ হয়ে বসে রইলো। মিজান সাহেব কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে বললো,
—-ম্যাডাম আমাদের মতো পোকামাকড়দের প্রদীপের আলোর আকর্ষণে কাছে যেতে নেই। পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হয়।
জুলি মিজান সাহেবের সাথে কথা না বলে অফিস থেকে বের হয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধা ছয়টা বাজে। একটা উবার নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা হলো। জুলি ভাবে গরীব হয়ে জন্মানো বর্তমান যুগে চলা খুব বেদনাদায়ক ও ব্যায়বহুল। টাকার জন্য ব্যাংকের কাছে লোন চাইতে গেলে ওরা যে ডকুমেন্ট চায় সেগুলো গরীবের কাছে থাকে না। তাই নিজের অবস্থান পরিবর্তনের কোন অপশন তাদের হাতে থাকে না। বিপরীত পক্ষে বড়লোকেরা ঋণ খেলাফি হলেও তাদের ঘরে লোন পৌঁছে যায়। এই পৃথিবীর সবাই গরীবকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বড়লোকের চরিত্রে কোনো কলঙ্কের দাগ লাগে না। আর গরীবের চরিত্রের পোস্টমর্টেম করতে কারো এতটুকু বাঁধে না। এমনকি আপন আত্মীয় স্বজন থু থু ছিটাতে এক মুহুর্ত দেরী করে না। যেদিন জুলি সায়ানের জালে আটকা পড়ে এই বাড়িতে এসেছিলো রায়হানের কাছে সবটা শুনে সেদিন ওর বাবা এসে ওকে অপমান করে বললো,
—–জুলি তুই কোথাও আমার পরিচয় দিবি না।। তোর মতো চরিত্রহীন সন্তান আমার দরকার নেই। আমার জুলি মরে গেছে। তুই জুলির অশরীরি ছায়া। জীবনে যতদিন বেঁচে থাকবো তোকে আমি আমার সন্তান হিসাবে পরিচয় দিবো না। কথাটা মনে রাখিস।

সেদিন ওর বাবা চলে যাওয়ার পর জুলির মনে হলো ওর এই অবস্থার জন্য ওর বাবা কি দায়ী নয়? কিভাবে নিজের দায় অস্বীকার করে সব দোষ জুলির উপর চাপিয়ে দিয়ে গেলো। সৎ মার সংসারে পান থেকে চুন খসলেই কপালে লাথি ঝাঁটা জুটতো। বাবা দেখেও না দেখার ভান করতো। ওর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ওর মা মারা যায়। ছয় মাস পরেই ওর বাবা বিয়ে করে। একবছরের মধ্যে তুলির জন্ম হয়। ঐ টুকুন বয়সে ওকে তুলিকে দেখভাল করতে হয়েছো। অথচ জুলি নিজেকেই তখন দেখভাল করতে পারতো না। গায়ের জামা ছিঁড়ে যেতো বাবা খেয়াল করতো না। তখন ওর বয়স দশ বছর। বাসায় ওর বাবার কলিগ বেড়াতে এসেছিলো। ওকে দেখে বাবাকে বললো,
—–আপনার বাসার কাজের মেয়েটা বেশ ফুটফুটে।
বাবা ওকে ধমক দিয়ে বললো,
—–তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন। রান্না ঘরে গিয়ে দেখ কোনো কাজ আছে কিনা।
জুলি খুব কষ্ট পেয়েছিলো। সেদিন ওর গায়ের জামাটা ছেঁড়া ছিলো। পরদিন ওর বাবা অফিসে যাওয়ার সময় জুলি বললো,
—-বাবা তুমি আমাকে তুলির মতো একটা ফ্রক কিনে দিবে?
ওর সৎমা শুনে ওর বাবাকে বললো,
—–নিজের চোখে দেখো আর কানেও শুনো। আমি বললে তো বিশ্বাস করো না। তোমার মেয়ের পেটে কত হিংসা। তুলির মতই ওর একটা ফ্রক লাগবে। বাবারে বাবা এই টুকুন মেয়ের পেটে এতো হিংসা। এই জন্য তোমাকে বলি ওর লেখাপড়ার পিছনে আর পয়সা খরচ করো না। কোনো লাভ নেই। মনের কালিমা তো দূর হবে না।
বাবা মায়ের রাগ আমার উপর ঝেড়ে বললো,
—-দূর হ আমার সামনে থেকে। আমার যাত্রাটাই নষ্ট হয়ে গেলো।
অথচ জুলির মনে হলো তুলিকে তো কেউ কাজের মেয়ে বলে না। ওকে বলে। হয়ত তুলির মতো জামা পড়লে ওকে আর কেউ কাজের মেয়ে বলবে না। ভাত খাওয়ার সময় তুলির পাতে মুরগির রান উঠতো। আর ওর পাতে থাকতো দু,তিনটে গলার হাড্ডি। তাও আল্লাহ পাক ওর ভাগ্যটা ভালো রেখেছে যে কারনে ওর লেখাপড়াটা বন্ধ হয়নি। এই ভাবে সেই ছোটোবেলা থেকে পাহাড় সমান অপ্রাপ্তি জমতে জমতে একটু ভালো থাকার লোভটা জুলিকে পেয়ে বসে। আর এর পরিপূর্ণ সদ্বব্যবহারের জন্য সায়ানের মতো পুরুষলোকেরা ফাঁদ পাতে। আর সেই ফাঁদে জুলির মতো মেয়েরা অনায়াসে পা দেয়। ড্রাই ভারের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। এইটুকু পথ আসতে দু,ঘন্টা লাগলো। কেয়ারটেকার আক্কাস মিয়াকে জুলি জিজ্ঞাসা করে,
—-রায়হান বাসায় ফিরেছে?
—–হ, ম্যাডাম।
জুলি ঘরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় রায়হান বললো,
—–কি ব্যাপার মক্ষীরানির অফিস থেকে ফিরতে এতো দেরী হলো কেন?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here