#ধারাবাহিকগল্প
#সামাজিক থ্রিলার
#চোরাবালি
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

জুলি আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। বয়স যদিও চল্লিশের কাছে দেহের আঁট সাঁট বাঁধুনিটা ঠিক রয়ে গেছে। এখনও মনে হয় পঁচিশ বছরের ভরা যুবতী। বেড রুমের আয়নাটার সামনে
দাঁড়িয়ে নিজেকে নিঁখুত ভাবে সাজিয়ে যৌবনবতী হিসাবে ফুটিয়ে তুলছে।
যার বদৌলতো পূর্বাচলে ডুপ্লেক্স বাড়ি প্রিমিও গাড়ি পেয়েছে তার মনোরঞ্জনের জন্য এটুকু তাকে করতেই হবে। সায়ান ওকে বাড়ি গাড়ি সব দিয়েছে শুধু স্ত্রীর মর্যাদাটা দিতে রাজি হচ্ছে না। জুলি ভাবছে যেভাবেই হোক সায়ানকে রাজি করাতে হবে। এই পাপের পথের সুখটা মাঝে মাঝে ওকে বেশ পোড়ায়।
বিবেকের দংশনে দংশিত হতে হয়। অনেকে ভাবে রক্ষিতাদের পাপের ভয় নেই। কথাটা ঠিক না। এটা জুলি হাড়ে হাড়ে টের পায়।
মাঝে মাঝে মনে হয় এ পথে আসাটা কি ওর খুব দরকার ছিলো। যদিও সায়ান ছাড়া ও আর কারো কাছে যায়নি তবুও রায়হান ওর স্বামী থাকা অবস্থায় সায়ানের সাথে থাকাটা ওর মেনে নিতে কষ্ট হয়।

রায়হান নামেই ওর স্বামী। গত দশ বছর ধরে ওর সাথে কোন দাম্পত্যের সম্পর্ক নেই। সায়ান ওকে বিয়ে না করলে রায়হানকে জুলি ডিভোর্স দিতে পারছে না। সমাজে যদিও ওকে নিয়ে কানাঘুষা আছে তারপরও রায়হান ওর সাথে থাকাতে জুলির সুবিধাই হয়।

আসলে দুনিয়াটা তো সুবিধাবাদীদের দখলে। যে যেভাবে পারে নিজের সুবিধাটা লুটে নেয়। জুলি ভাবছে এই সায়ান সমাজের চোখে ধোপধুরস্ত একজন মানুষ। প্রৌঢ়ত্বের পথে ধাবিত হওয়া পঞ্চাশোর্ধ সায়ানকে এখনও বেশ যুবা মনে হয়।বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর মালিক। কয়েকটা সোনার দোকান আছে। দুটো কারখানা রয়েছে।এক্সপোর্ট ইমপোার্টের বিজনেজ আছে। ঘরে তার সুন্দরী বউ আছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে নিয়ে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ছিমছাম সুখের সংসার। যদিও বছরের বেশীরভাগ সময়ই বউ দুবাই থাকে। ওখানে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সায়ান প্রচণ্ড অসুখী একজন মানুষ। জুলি জানে না সায়ান সত্যি বলে না মিথ্যা বলে। আর কারো সাথে সায়ানের এরকম সম্পর্ক আছে কিনা?কিন্তু জুলিকে সায়ান প্রায়ই বলে একমুঠো সুখের জন্য ও নাকি জুলির কাছে আসে। সায়ানের সাথে জুলির দশ বছরের সম্পর্ক। জুলি সায়ানের সাথে দুএকটা পার্টিতে গিয়েছে। সেখানে জুলি দেখেছে সায়ানের মতো অনেকেই আছে। বউ থাকতে জুলির মতো একজনকে জুটিয়ে নেয়। ওরা জুটিয়ে নেয় বলে হয়ত জুলির মতো মেয়েরা সুখ প্রাচুর্য আর ভোগবাদী জীবনের আকর্ষনে ছুটে আসে।

আজকাল জুলির খুব ক্লান্ত লাগে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বাজে। জুলিরও প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। হয়ত একটু পরেই সায়ান চলে আসবে। জুলির সাথে সম্পর্কের শুরুতে সায়ানের কখন দেরী হতো না। বরং দশটা বাজার বেশ আগেই চলে আসতো। ইদানিং জুলি খেয়াল করেছে সায়ান আগে তো আসেই না বরং বেশ দেরীতেই আসে। জুলির মাঝে মাঝে মনে হয় ইদানিং ওর প্রতি সায়ানের আকর্ষণটা মনে হয় কমে যাচ্ছে। যদি সায়ানের সাথে ওর বিয়ে না হয় তাহলে ওকে আজীবন রক্ষিতা হিসাবে থাকতে হবে। এটা জুলির পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এমন সময় দরজায় ঠোকা পড়লো। জুলি বললো,
—–কে?
মিনমিনে গলায় রায়হান বললো,
—–আমি।
—–কি চাই?
—–তুমি তো জানো আমি তোমার কাছে কি চাইতে পারি?
—–লজ্জা করে না তোমার নেশার টাকার জন্য বউয়ের কাছে হাত পাততে?কেন এ বাড়ি পড়ে আছো? মরতে পারো না।
—-মরতেও যে টাকা লাগে জুলি।
—-কিভাবে মরতে চাও জানিও। যদি গলায় দড়ি দিয়ে মরতে চাও মোটা শক্ত পোক্ত দড়ি কিনে দিবো। আর যদি ওষুূধ খেয়ে মরতে চাও ঘুমের ওষুধ কিনে দিবো।
—–জুলি মরনও মনে হয় আমার মতো পাপীর শরীরটা নিতে চায় না। নইলে হিরোইনের নেশায় পুড়ে কলিজাটার এখনও বেঁচে থাকার কথা নয়। মরতে পারলে রক্ষিতা বউয়ের কাছে হাত পাততে হতো না।
—-দিব্যি তো আমায় রক্ষিতা বললে। লেখাপড়া তো জানো তাহলে কাজ খুঁজে নেওনা কেন? আমার মতো রক্ষিতার টাকায় খেতে পড়তে তোমার তো ঘেন্না হওয়ার কথা।
—–তোমার জন্য সব জলাঞ্জলী দিয়েছি। তুমি ছিলে সায়ান চৌধুরীর পার্সোনাল সেক্রেটারী। আর আমি ছিলাম তোমার বসের চিনির কারখানার এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ভালই তো আমাদের জীবনের দিনগুলো পার হচ্ছিলো।
—-ওটাকে জীবন বলে? যে টাকা রোজগার করতে সেই টাকা থেকে তোমার বাবা মার জন্য বাড়িতে পনেরো হাজার টাকা পাঠাতে হতো। বাসা ভাড়া বিশ হাজার টাকা তারপর যাতায়াতের খরচ সব মিলিয়ে সামলানো কঠিন হয়ে যেতো। সারা বছর একটা ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারতে না। কতদিন এমন হয়েছে মাসের পর মাস ঘরে মাংস রান্না হয়নি।
—–যতই অভাব অনটন থাক সমাজে তোমার দিকে আঙ্গুল তুলে কেউ বলতো না তুমি একজন রক্ষিতা। তোমার একটা সম্মান ছিলো। আমরা তো খারাপ ছিলাম না। দুজনে মিলে ষাট হাজার টাকা আয় করতাম। ভোগ বিলাসটা হয়ত হতো না।কিন্তু কোনরকমে সুখে দুঃখে জীবনটা পার হতো। তোমাকে এসব কথা বলে লাভ নেই। তোমার মতো মেয়েরা নিজের আরাম আয়েশ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিলিয়ে দিতে দ্বিধা বোধ করে না। তাদের ভিতরে পাপ পুন্যের বোধ জাগ্রত হয় না। যেদিন থেকে তুমি সায়ান চৌধুরী রক্ষিতা হলে সেদিন থেকে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেই। আর সেই সাথে আমার লাজ লজ্জা ঘেন্নাপিত্তি সব তােমার কাছে বন্ধক দেই।
—–থাক এতো বড় বড় কথা তোমার মুখে মানায় না। ওই যে টেবিলের কোনায় পাঁচশ টাকা রাখা আছে নিয়ে যাও।
রায়হান টাকাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি ওর নেশার আসরে চলে যায়। ঠিক সময়ে নেশাটা না নিলে শরীরের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। কাগজের পুড়িয়াতে একটু তামাক পাতা দিয়ে টান দিতে পারলে বুকের জ্বালা যন্ত্রনা নিমেষেই দূর হয়ে যায়। এক সুখের মহাসমূদ্রে ঐ সময় রায়হান হাবুডুবু খায়। রায়হান খোলা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবে আসলেই ও নির্লজ্জ। তা না হলে ও জুলির বাড়িতে পড়ে থাকে। ওর সামনে দিয়ে ওর বউ পরপুরুষের সাথে রাত কাটায়। নিজ হাতে নিজের প্রেমিক খতম করার জন্য ও অপেক্ষা করছে।
রায়হান আর জুলি ব্যাচমেট। কিন্তু রায়হান বুড়িয়ে গিয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি ময়লা ট্রাউজার আধপুরোনো হাফ হাতা শার্ট। রায়হানের চেহারাটা খুব বিধ্বস্ত। অথচ এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে জুলির সাথে ঘর বেঁধে ছিলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে দুজনে অনার্স পড়তো। ওদের দুজনের ছিলো চার বছরের প্রেম। সবাই বলতো পারফেক্ট কাপল। মোটামুটি রেজাল্ট করে দুজনে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। জুলি আগেই সায়ান চৌধুরীর কোম্পানীতে পি এস এর চাকরি পায়। তারপর ওর বসকে বলে রায়হানের চাকরিটা যোগাড় করে দেয়।
জুলি দেখতে বেশ সুশ্রী এবং স্মার্ট। এই কারনে সায়ানের পার্সোনাল সেক্রেটারী হিসাবে চটজলদি জুলির চাকরি হয়ে যায়। সৎমার ঘরে বেড়ে উঠা কষ্ট ছিলো জুলির নিত্যসঙ্গী। অনেক কষ্ট সয়ে জুলি লেখাপড়া করেছে। উদয়াস্ত খেটে জুলিকে লেখাপড়া করতে হতো। কাজে একটু ভুল হলে সৎমার একটা মারও মাটিতে পড়তো না। জুলির বাবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকতো। ইন্টার পাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন চান্স পায় জুলির মনে হয়ে জেলখানা থেকে ও মুক্তি পেয়েছে। বাড়ি থেকে বছরখানিক ওর বাবা পড়ালেখার খরচ চালিয়েছে। এরপর জুলি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতো।
তাই সুখ নামক মরিচিকাটা জুলিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো। আর সেই আকর্ষণে সায়ান নামক চোরাবালিতে জুলি আস্তে আস্তে ডুবে যেতে থাকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here