চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি
______________

-“খারাপ না বাড়িটা।”

-“আমিও কিন্তু খারাপ না মিস.চাশমিশ।”

-“নাফছী এবার এস.এস.সি দিবে?”

-“হ্যাঁ।”

-“খুব মিশুক মেয়েটা। আর আন্টিও অনেক কিউট। তোমার চেহারা কি আন্টির মতন?”

-“এই শোনো! হয় আপনি বলবা, নয়তো তুমি। দুটো মিশায়ে জগাখিচুড়ি ভালো দেখায় না। এখন তুমি বলতেছো, পরে আবার আপনি বলবা। কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে না ব্যপারটা?”

-“কথা তো ঠিক তবে চেষ্টা করবো পরেরবার থেকে..”

-“পরেরবার থেকে?”

-“আপনি করে বলার।”

-“ধূর!”

-“আন্টি ডাকছে। থাকেন আপনি।”

সিদ্ধি আয়াশের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে ছাদ থেকে নেমে যায়। আয়াশ বিষণ্ণ হওয়ার ভান করে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সিদ্ধি তার সাথে তার বাড়িতে এসেছে। সিদ্ধি যে এত সহজে রাজি হবে ভাবতেই আয়াশের মনে একটু খটকা লাগছে। তাছাড়া তারেক সাহেবের ব্যপারটা এখনো ধোঁয়াশা। ঐ বিষয়ে যে সায়ন সাহেব কিছু একটা লুকোচ্ছেন তা স্পষ্ট বুঝেছে আয়াশ কিন্তু সায়ন সাহেব এমন কেন করছেন বুঝতে পারছে না সে। আয়াশ আর দাঁড়ালো না ছাদে। সিদ্ধির পিছু পিছু সিড়ির দিকে এগোলো সে।

-“প্রথমবার এলে তুমি আর না খেয়ে যাবে? আমি থাকতে এমনটা হবে না।”

-“আরে না আন্টি, এত চাপ নেওয়ার দরকার নেই। আমি খেয়েই এসেছি।”

-“তাতে কী? না খেয়ে যাবে না। যাও আয়াশের সাথে গিয়ে বসো আমি খাবার আনছি।”

নাফছী এসে বসলো সিদ্ধির পাশে। সিদ্ধিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সিদ্ধি হা হয়ে তাকিয়ে আছে নাফছীর দিকে। মেয়েটাকে দেখে শান্ত লাগলেও চোখজোড়ায় দুষ্টুমি আর চাঞ্চল্য মিশে আছে। সিদ্ধির মাঝে মাঝে আফসোস হয় তার যদি এমন একটা বোন থাকত, তাহলে বোনটাকে কত যত্ন-আদর-খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখত সে।

-“কী ভাবছো আপু?”

-“কিছু না তো। তুমি খুব চঞ্চল, তাই না?”

-“হুহ! ভাইয়াও বলে।”

-“পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার?”

-“অনেক ভালো। আমিও বড় হয়ে ভাইয়ার মতো ডাক্তার হবো তারপর আমার ভাবীকে একসাথে খুঁজে বের করবো।”

-“খুঁজবে মানে? তোমার ভাবী বুঝি হারিয়ে গেছে?”

-“হ্যাঁ গেছেই তো, সেই ছোট্টবেলায়। ভাইয়া বলেছিল তো…”

আচমকা আয়াশ এসে নাফছীকে জড়িয়ে ধরে। মূলত আয়াশের উদ্দেশ্য নাফসীকে চুপ করানো কেননা মুখ ফসকে সিদ্ধির সামনে সব বলেই ফেললেই বিপদ। “এই নাফছীটাও নাহ! ওর থেকে কিছু লুকোলেই আমি বিপদে পড়ি। নাফছীকে এখন কেমনে বলি যে সিদ্ধিই ওর ভাবী। মা না-হয় বুঝেছে কিন্তু নাফছী তো জানেনা।” মনে মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সিদ্ধির দিকে তাকালো আয়াশ। সিদ্ধি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট বুঝে গেল আয়াশ যে বাড়ি থেকে বের হলেই সিদ্ধির জেরার কবলে পড়বে সে। জোহরা বেগম বেশ যত্ন করে আয়াশ আর সিদ্ধির খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সিদ্ধি অবশ্য চাচ্ছিল জোহরা বেগম আর নাফছীর সাথে আরো কিছুটা সময় কাটাতে কিন্তু আয়াশ আর ঝুঁকি নিলো না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই মা আর বোনের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

______________________

-“আজ সিদ্ধি ক্যাম্পাসে আসলো না কেন রে তানভী?”

-“দেখ শ্রাবণ, আমি সিদ্ধির মা নই যে ও কখন কোথায় থাকবে জানবো। তাছাড়া নতুন বয়ফ্রেন্ড পাইছে মামণি, ঘুরতেছে হয়তো।”

-“এভাবে কথা বলছিস কেন তুই? সিদ্ধি কেমন আমরা জানি। ওর জীবনে কেউ আসলে, ও সবার আগে আমাদের জানাবে।”

-“তাহলে ও আয়াশ ছেলেটার কথা কেন জানালো না আমাদের?”

শ্রাবণ চুপ হয়ে যায়। তানভীর সাথে কথা বলাটা সম্পূর্ণ বৃথা। তানভী মেয়েটা একটু অন্যরকমই বটে। ওদের গ্রুপের চারজনই মোটামুটি শান্ত কিন্তু তানভী মেয়েটা উশৃঙ্খল বলেই সবার থেকে আলাদা। শ্রুতি আর অয়ন কী যেন গল্প করছে। শ্রাবণ বারবার সেদিকে তাকাচ্ছে অথচ শ্রুতি একবারও শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করছে না যে,” শ্রাবণ কিছু বলবি?” সে ব্যস্ত অয়নের মাঝে। দুই বইপোকা এক জায়গায় হলে যা হয় আর কী! শ্রাবণের অবশ্য বেশ বিরক্ত লাগছে, অনেকটা রাগও হচ্ছে অয়ন আর শ্রুতির মধ্যকার সখ্যতা দেখে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। আর বলবেই বা কীভাবে? বন্ধু তো, কথা বলতেই পারে।

-“কীরে শ্রাবণ কিছু বলবি?”

-“না রে অয়ন। তোরা বস, আমি একটু আসছি।”

শ্রাবণ উঠে মাঠের বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগলো। অয়নও লক্ষ করলো যে শ্রাবণ তাকিয়ে আছে অথচ শ্রুতির খেয়ালই নেই। অয়নকে কেন যেন আজকাল বড্ড অসহ্য লাগে শ্রাবণের। বন্ধু হিসেবে ওর জন্য প্রাণও দিয়ে দিতে পারে কিন্তু অয়ন আর শ্রুতির অতিরিক্ত সখ্যতা বড্ড পীড়া দিচ্ছে শ্রাবণকে। শ্রাবণ জানে শ্রুতির প্রতি নিজের অনুভূতিগুলোর কথা সে কখনো শ্রুতিকে জানাতে পারবে না। কারণ একটাই, বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলার ভয়।

_____________________

মৃদু গতিতে ট্যাক্সি চলছে। পেছনের সীটে দুদিকে মুখ করে বসে আছে দুজন মানুষ। ট্যাক্সিচালক ধরেই নিয়েছে, মিয়া-বিবি ঝগড়া করে দুদিকে মুখ করে বসে আছে। রেডিওতে গান ছাড়লেন তিনি,
“সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময় ।
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?”

জানালার বাইরে তাকিয়ে আনমনে কী যেন ভাবছিল সিদ্ধি। গানটা কানে আসামাত্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চোখদুটি বুঁজে গা ভাসালো সুরের স্রোতে। আয়াশ জানালা থেকে মুখ সরালো না, গানের সুর তার কানেও বাজছে কিন্তু সে আছে ভিন্ন চিন্তায়। তারেক নামক লোকটাকে তার মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না, তাই লোকটার নাড়ি-নক্ষত্র খুঁজে না বের করা অবধি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে না সে। আচমকা ট্যাক্সিচালক বলে উঠলেন,”কী সাহেব! বউয়ের উপর রাগ কমেনি? এখনো যে মুখ ফিরায়ে রইছেন।” লোকটার কথায় আয়াশ যতটা না ভ্যাবাচ্যাকা খেল, তার চেয়ে বেশি সিদ্ধি। সে যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লোকটা আবারো বলা শুরু করলো,”জানেন সাব, আমার বউটারে বড্ড ভালোবাসতাম। বড়ই লক্ষী ছিল বউডা, পাঁচগ্রামে তার হাতের রান্না আর তার গুণের কদর হইতো। আমি অভাগা তার মন বুঝি নাই কোনোদিন। তার হাত দুইটা ধইরা কইনাই, বউ তোমারে ভালোবাসি। আমার কাছে কিছুই চাইত না মাইয়াডা আর না আমি তারে কিছু দিতে পারছি। ভালোবাসতাম তারে খুব।” সিদ্ধির মনে প্রশ্ন জাগলো লোকটা বারবার বাসতাম, ছিল এসব কেন বলছে। অকপটে প্রশ্ন করে বসলো সে,”বাসতেন মানে? এখন আর বাসেন না?” ট্যাক্সিচালক হেসে উঠলো। তার হাসির মাঝে ক্রন্দনের সুর পেল সিদ্ধি। সত্যিই কি লোকটা কাঁদছে? আবারো লোকটা বলে উঠলো,”আর যে বাসার সুযোগ নাই মাগো। বউডা আমার গত বছর গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট কইরা মইরা গেছে, বাঁচাইতে পারিনি তারে। একখান বেটি আছে, মাইয়াডা এক্কেবারে মায়ের লাহান হইছে। তোমরা আইসো একদিন বাড়িতে, দেখাবোনি। ঐ যে সামনের গলি পেরিয়ে বস্তি, ঐটার চার নম্বর বাড়িটাতে থাকি।” সিদ্ধির মনটা খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপের কারণটা বোধহয় একজন মানুষের ভালোবাসা হারানোর গল্প শুনতে পারা। ট্যাক্সিচালক সিদ্ধির বাড়ির সামনে ওদের নামিয়ে দিল। সমস্ত রাস্তা আয়াশ আর সিদ্ধি চুপ ছিল। ট্যাক্সিচালকের ভুল ধারণাটা আর ভাঙানো হলো না। আয়াশ স্বেচ্ছায় ভাঙায়নি আর সিদ্ধি অন্য জগতে হারিয়েছিল। ট্যাক্সিচালক তাদের রেখে যাওয়ার সময় স্বামী-স্ত্রী ভেবেই দোয়া করে গেলেন।

সন্ধ্যে হতে এখনো ঢের বাকি। সিদ্ধি ভিতরে যাচ্ছে আনমনে, পেছনে যে আয়াশ নেই সেদিকেও ধ্যান নেই মেয়েটার। অন্য কারো ভালোবাসার মানুষের সাথে বিচ্ছেদের গল্প শুনে যার মন এত বিষণ্ণ, সেই মেয়েটা নিজেও জানে না যে সেও ন’বছর নিজের ভালোবাসা থেকে দূরে ছিল। আয়াশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। যদি স্বার্থক হয়, তাহলে আয়াশ আর সিদ্ধির জীবনটা সহজ হয়ে যাবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে হয়তো আর ফেরা হবে না সিদ্ধির জীবনে। রহস্য উদঘাটনের পথে আরো এক কদম এগোয় আয়াশ।

চলবে…

[জানিই ছোট হয়ে গেছে পর্বটা, পরবর্তী পর্ব বড় করে দিব ইনশাআল্লাহ। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন এবং গল্পের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন🧡]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here