#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
শেষ_পর্ব
~মিহি
বাড়িতে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আয়াশ-সিদ্ধি। সবকিছু স্বাভাবিক আছে। নাফছী এসে সিদ্ধিকে নিয়ে গিয়ে ঘরে বসায়। আয়াশ জোহরা বেগমের সাথে কথা বলতে যায়। সিদ্ধি নাফছীর সাথে বসে গল্প করছে। একদিনেই যেন এক যুগের গল্প জমে গেছে তাদের। সিদ্ধির মাথা যন্ত্রণাটা ক্রমশ বাড়ছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে সে। নাফছীকে বলে একটু পানি দিতে। সিদ্ধির মনে তখন অন্য খেয়াল চলছে। শোভা আর তার বাবা কেন আলাদা রুমে ঘুমায়? তখন বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিলেও এখন সেটা মাথায় প্যাঁচ খাচ্ছে। তাছাড়া তার বাবা যে কারো গায়ে হাত তুলতে পারেন এটা কল্পনা অবধি করেনি সিদ্ধি অথচ তিনি কিনা নিজের বর্তমান স্ত্রীকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করলেন আবার তার গায়ে হাতও তুললেন।
-“ভাবী? মাথা ব্যথা কি বাড়লো? ভাইয়াকে ডাকি?”
-“না রে। ও মায়ের সাথে কথা বলে আসুক। তুই বরং দেখ ঐ রুফুটা কই! আমার বরের দিকে নজর দিচ্ছে না তো?”
-“হা হা! তোমরা পারোও বটে। নিজের শরীর খারাপ তাও যেন বরের দিকে কেউ নজর না দেয়, তাই না?”
সিদ্ধি মাথা নাড়ায়। নাফছী হাসতে হাসতে জোহরা বেগমের ঘরের দিকে এগোয়। এমন সময় খেয়াল করে রুফু জোহরা বেগমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আয়াশ আর জোহরা বেগমের কথা শুনছে, একরকম আড়ি পাতা যাকে বলে। এই রুফু মেয়েটাকে নাফছী বেশ আগে থেকেই সন্দেহ করে। মেয়েটার চালচলন সন্দেহজনক। রুফু হাতে কিছু একটা ধরে আছে, অনেকটা লুকিয়ে। একটু এগোতেই নাফছী বুঝতে পারে রুফুর হাতে লুকিয়ে থাকা জিনিসটা একটা মোবাইল ফোন। এই মেয়ের ফোনও আছে? তাও স্মার্টফোন? অজপাঁড়া গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়ে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফোন থাকতেই পারে কিন্তু লুকোনোর কি আছে? ফোনে কি লুকিয়ে রেখেছে মেয়েটা? সন্দিহান নাফছী দূর থেকেই রুফুর গতিবিধি খেয়াল করে। এখনি প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না, তাহলে মেয়েটা সতর্ক হয়ে যাবে। আয়াশ জোহরা বেগমের সাথে কথা শেষ করে দরজার দিকে এগোতেই রুফু ইচ্ছে করে আয়াশের সাথে ধাক্কা খেল কিন্তু ভাবটা এমন যেন ইচ্ছে করে কিছু করেনি। নাফছী দূরে দাঁড়িয়ে রুফুর কান্ড সবটুকুই দেখেছে। চাইলেই এখন আয়াশকে বলতে পারবে কিন্তু রুফুর আসল মতলবটা জানা দরকার আগে।
____________________
সিদ্ধি মাথা ব্যথায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। কোনরকমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকার চেষ্টা করছে। আয়াশ ঘরে ঢুকেই দেখে সিদ্ধি বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আয়াশ এসে সিদ্ধির পাশে বসে।
-“চলো তোমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো।”
-“আয়াশ, আমার কিছু হয়নি। স্বাভাবিক মাথা ব্যথা, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।”
-“চুপ করো তুমি! শরীর নিয়ে এত কেয়ারলেস হলে চলবে না। এখনি তোমায় নিয়ে হসপিটালে যাবো, ডাক্তার যা যা টেস্ট দিবে, সব করাবো।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
আয়াশ এই ফাঁকে সিদ্ধির গাইনী ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেয়। ডাক্তার হসপিটালে নিয়ে আসতে বলে। সিদ্ধি উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। আয়াশ সযত্নে সিদ্ধিকে কোলে নিয়ে নিচে নামে। দৃশ্যটা একজন দূর থেকে দেখে বেশ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
রুফুর মনে তখন রাগ বাসা বেঁধেছে। যদিও ষে এখানে এসেছিল অন্য কাজে কিন্তু আয়াশকে তার মনে ধরেছে। এখন আয়াশকে না পেলে তার জীবন বৃথা, বাকিটা যা হয় হোক।
_______________________________________________________________________
-“দেখুন আয়াশ, আপনার স্ত্রীর খেয়াল রাখে কে? তাকে খাওয়ানো বা তার কাছে থাকা?”
-“আমি নিজেই করি ডক্টর।”
-“রিসেন্টলি ওনাকে স্ট্রেস বাড়ানোর কিছু মেডিসিন দেওয়া হয়েছে, অনেকগুলো। এটা তার ব্রেনের সাথে সাথে প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।”
-“স্ট্রেস বাড়ানোর ওষুধ?”
-“হ্যাঁ! ওনার আগের রিপোর্ট আমি দেখেছি। ওনার নাকি মেমোরি লস হয়েছিল কিন্তু ওনাকে যে মেডিসিনগুলো দেওয়া হয়েছে সবগুলোই ভুল।”
-“কী!”
-“হ্যাঁ। কেউ আপনার ওয়াইফের ক্ষতি করতে চাচ্ছে, ওনার দিকে বেশি বেশি নজর দিন। যদি অল্প মেডিসিন পেতাম রিপোর্টে, তাহলে তাও ধরেই নিতাম আপনার স্ত্রীই নিজের কোন কষ্ট ভুলানোর জন্য খেয়েছে কিন্তু এত মাত্রার মেডিসিন যেটা ওনার শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর-এটা কেউ স্বেচ্ছায় খাবে না। আচ্ছা, আমি ওনার সব মেডিসিন ভালো করে চেক করে প্রেসক্রাইব করেছি। আপনি ওনার খেয়াল রাখবেন।”
-“ওকে ডক্টর, আমি আসছি।”
সিদ্ধি বেডে শুয়ে আছে। আয়াশ ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে সিদ্ধিকে নিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামে। এখন সিদ্ধির মাথা ব্যথা আগের চেয়ে কিছুটা কম। আয়াশ কিছু বলছে না। সিদ্ধি কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেয়েও সাহস পাচ্ছে না। কেন যেন তার মনে হচ্ছে অপ্রস্তুত কিছু বলতে চলেছে আয়াশ যা সে সহ্য করতে পারবে না।
-“তোমার দ্বিতীয় মা তোমার ক্ষতি করতে চাচ্ছে সিদ্ধি।”
-“কী যা তা বলছো! তোমার মাথা ঠিক আছে, আয়াশ?”
-“আমি ঠিকই বলছি।”
সিদ্ধি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনটা বেজে ওঠে। সিদ্ধির বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। কল রিসিভ করে সিদ্ধি।
“সিদ্ধি শোনো, তোমার বাবা….” আর বলতে পারলো না শোভা। ফোনের অপর পাশ থেকে বিকট একটা চিৎকার শুনতে পেল সিদ্ধি। আয়াশকে বললো যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধির বাড়িতে নিয়ে যেতে। আয়াশ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। হঠাৎ এমন করছে কেন মেয়েটা? কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলো না এখনি।
__________________________________
সায়ন সাহেব শোভাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন ছাদে। এই মেয়েটাকে যতটা সহজ-সরল তিনি ভেবেছিলেন, ততটা সে না। তলে তলে প্রচুর বুদ্ধি! আজ একে মেরে তবেই দম নেবেন তিনি। রাগে তার গায়ে আগুন জ্বলছে। রাগের মাথায়ই মানুষ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলগুলো করে ফেলে। সায়ন সাহেবও ব্যতিক্রম হলেন না। রাগ আর উত্তেজনায় তিনি শোভাকে অতিরিক্ত দুর্বল ভেবে বসেছিলেন, হাতের কাছে পাওয়া ফুলদানিটা দিয়ে সজোরে সায়ন সাহেবের মাথায় আঘাত করে শোভা। সায়ন সাহেব দমে যান নি কিন্তু অনেকটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। এই সুযোগে শোভা উল্টো দিকে দৌড়ানো শুরু করল। বেশি দূর এগোতে পারল না। লম্বা চুল সহজেই সায়ন সাহেবের হাতে ধরা দিলে। চুল ধরে টেনে শোভাকে একটা থাপ্পড় দিলেন তিনি। এই থাপ্পড়টা গিয়ে লাগলো শোভার আত্মসম্মানে। পাল্টা থাপ্পড় দিতে দু সেকেন্ড ভাবতে হলো না শোভার। সায়ন সাহেব কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। কিছু করার আগেই আয়াশ-সিদ্ধি এসে উপস্থিত হলো। শোভা দৌড়ে সেদিকে গেল।
আয়াশ সায়ন সাহেবকে ধরে এনে বসালো। তিনি কিছুতেই শান্ত হচ্ছেন না। শোভা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে শুরু করলো,”তোমার বাবাই তোমার বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে চাচ্ছিল। সেজন্য তোমার পায়েসে এই ওষুধগুলো মিশিয়েছিল। আর এই ওষুধের কারণেই এতদিন তোমার স্মৃতিশক্তি ফেরেনি। তিনি কখনোই চাননি তোমার স্মৃতিশক্তি ফিরুক আর তুমি আয়াশের কাছে ফিরে যাও। আয়াশের বাবাকেও এই লোকটাই মেরেছে শুধুমাত্র স্কুলের প্রপার্টি পেপারের জন্য যেটা এখন আয়াশের কাছে এসে। সেজন্যই রুফাইদাকে পাঠিয়েছে ও বাড়িতে। বিদেশী কোম্পানির লোকগুলো ধরা পড়ার পর ওনি ভেবেছিল স্কুলের মাটির নিচে যে সোনার খনি লুকোনো আছে, সেটা ওনা একাই নিবেন। ঐ খনিটার জন্যই এত ষড়যন্ত্র। তোমার মাকেও এই লোকটাই মেরেছে।”
-“এত সব কথা আপনি কী করে জানলেন?”
-“আয়াশ, মানুষের একটা ভালো অভ্যেস হলো ডায়েরি লেখা। আবার সেটাই বদ অভ্যেস হতে পারে। ওনি প্রায়ই ডায়েরি লেখেন। আজ সে ডায়েরি পড়েই আমি সব জানতে পেরেছি।”
সিদ্ধি কাঁদছে। চোখের সামনে রক্তের সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেওয়ার মতো যন্ত্রণা কোন কিছুতেই নেই।
-“বাবা, কেন করলে তুমি এসব?”
-“তোর বাবা না আমি! তুই একটা অবৈধ সন্তান! ঐ তূর্যর চাচার মেয়ে তুই! ঐ লোক আর তোর মায়ের নষ্টামির ফল তুই। তুই কেউ না আমার।”
সায়ন সাহেব পাগলের মতো আচরণ করছেন। আয়াশ পুলিশে কল করলো। সায়ন সাহেব আর রুফাইদাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। এখন অবশ্য সে বুঝতে পেরেছে তূর্য কেন তার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল আর কী বলতে চাচ্ছিল।
সিদ্ধি ভেঙে পড়েছে অনেকটাই। জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা আজ জানতে পেরেছে সে, চাইলেও এখন নিজেকে সামলাতে পারবে না। আয়াশ শক্ত করে সিদ্ধির হাত নিজের মুঠোয় নিল। মানেটা এটাই যে আয়াশ সিদ্ধিকে কখনোই ছেড়ে যাবে না। সিদ্ধির মনটা বোধহয় হালকা হলো, অশ্রু বিসর্জন বন্ধ হলো। এবার সময়টা সবকিছু নতুন করে শুরু করার। অন্তত নবাগত সন্তানটার জন্য।
সমাপ্ত||
[ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার জন্য গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হলো। হয়তো দীর্ঘ সময়ের জন্য একটা বিরতি নিব। সবাই ভালো থাকবেন।]