#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি
শোভা বেশ যত্ন করে সিদ্ধিকে তুলে খাওয়াচ্ছেন। একেকটা লোকমায় মিশে আছে গভীর স্নেহ-মমতা। সিদ্ধির মনে হলো বোধহয় তার মা ফিরে এসেছে। শোভা খাবার খাইয়ে সিদ্ধিকে পায়েস দেন। মুখে মলিনতা বজায় রেখে বলেন,”আমি না তেমন ভালো পায়েস বানাতে পারি না। একটু খেয়ে বলো তো মা কেমন হয়েছে।” মা ডাক শুনে সিদ্ধির মনটা তপ্ত মোমের ন্যায় গলতে শুরু করে। এতক্ষণ হলো সে এসেছে না তার বাবা খোঁজ নিল আর আয়াশ? সে তো রেখেই দায়িত্ব চুকে নিয়ে চলে গেল। অথচ যাকে সে সবচেয়ে পর ভেবেছিল, সেই মানুষটাই তাকে যত্ন-আত্তি করে ভরিয়ে দিচ্ছেন। সিদ্ধি পায়েস মুখে দেয়। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,”বেশ ভালো হয়েছে। আমি খেয়ে নিব বাকিটুকু। অনেক রাত হয়েছে, আপনি ঘুমান।”
সিদ্ধির কথা শুনে শোভা চলে যাচ্ছিল কিন্তু দরজা অবধি যেয়েই আবার ফিরে আসে সে। সিদ্ধির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়।
-“আচ্ছা মা, আয়াশের সাথে কিছু হয়েছে তোমার? যদিও স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো ঠিক হবে না তবুও তোমার ইচ্ছে হলে বলতে পারো আমায়।”
-“ও বাড়িতে এক মেয়ে এসে দাবি করেছে যে সে আয়াশের প্রথম স্ত্রী। যদিও কথাটা ভিত্তিহীন। এই কথা নিয়ে ওর সাথে একটু মজা করেছিলাম। অতঃপর তিনি রাগ করে চলে গেলেন, ঠিকমতো কথাও বলছেন না।”
-“মা রে! পুরুষ মানুষের তেজ! খাঁটি প্রেমিক স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো নামটুকুও সহ্য করতে পারে না।”
-“আচ্ছা মা। আমি ওর সাথে কথা বলে নিব।”
-“ঐ কালনাগিনীকে ও বাড়িতে রেখে তুই এখানে শান্তিতে থাকতে পারবি? তুই বরং কাল সকালবেলাই ও বাড়িতে যা। জামাইকে নিয়েই এখানে আয়।”
সিদ্ধি মাথা নাড়ে। শোভা আর কিছু না বলে ঘর ছেড়ে বেরোয়। আচমকা থাপ্পড়ের শব্দে ঘোর কাটে সিদ্ধির। দরজার বাইরে থেকে ফিসফিসানির আওয়াজ পায় সে। তার বাবা ক্ষীণ গলায় শোভার উপর রাগ দেখাচ্ছেন। একটা সময় বেশ অশ্রাব্য গালি দিয়ে বললেন,”আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলার তুই কে? তোকে বের করে দেব আমি যদি আর একদিন আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে যেতে বলছিস।” শোভা মাথা নিচু করে চলে যায়।
সায়ন সাহেবের কথাটুকু সিদ্ধির ভালো লাগে তবে সে কিছুতেই খুশি হতে পারে না। তার বাবা নিজের বর্তমান স্ত্রীর গায়ে হাত তুললেন বিষয়টা বেশ ন্যক্কারজনক। সিদ্ধি ঘুমঘুম চোখে আয়াশের নম্বরটা ডায়াল করে। অপর পাশ থেকে ফোন ধরতে ত্রিশ সেকেন্ড ব্যয় হয়।
-“এখনো ঘুমোওনি যে? ঘুম আসছে না বুঝি?”
-“কেউ যখন জেনেবুঝে অবহেলা করতে থাকে, তখন ঘুমানো কি খুব সহজ?”
-“ও মা! তুমিই না বললে এ বাড়িতে আরেক বউ আছে? তার একটু সেবাযত্ন নিব না?”
-“একটাবার ভাবলে না আমি কোন মানসিক পরিস্থিতিতে কথাটা বলেছি? আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করে এনেছে, আমার সাথে কথা বলছেনা, আমি মা হতে চলেছি। আমার মানসিক অবস্থা ভাবলে না তুমি, শুধু দেখলে আমি একটা কথা বলেছি। তার জের ধরে এমন রাগারাগি। আর যখন নিজে থেকে কল দিলাম তখন ঐ রুফুর ডাকে খেতে গেলা, একটাবার শুনলাও না যে আমি খেয়েছি কিনা।”
-“আর কিছু?”
-“সবাই বলত বিয়ের পর নাকি ছেলেদের ভালোবাসা কাঁটা ঘুড়ির মতো দিশাহীন হয়ে উড়তে থাকে। ভাবতাম কই না তো, আমার বাবা-মার সম্পর্ক তো এমন না। আমার আর তোমার সম্পর্কও তো একবছর এমন ছিল না কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। আসলেই ভালোবাসা রঙ বদলায়।”
-“মহারানির বুঝি খুব রাগ? চিলেকোঠার ঘরে এসে জানালাটা খুলে আমায় একটু উদ্ধার করবেন, মহারানি? প্লিজ?”
-“কেন?”
-“আরে আসেন তো আগে।”
কল কাটলো সিদ্ধি। এখন রাত এগারোটা। বাবা আর ঐ মহিলা ঘুম। এত রাতে ছাদে কেন যেতে বললো আয়াশ? গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে ভাবছে সিদ্ধি। চিলেকোঠার ঘরটাতে প্রবেশ করতেই অনুভব করলো ঘরের প্রতিটি কোণ ঘিরে এখনো আয়াশের ঘ্রাণ ভাসে। চিলেকোঠার জানালাটা খুললো সিদ্ধি। নিচে রোডলাইটের আলোয় মেরুন রঙের টি-শার্ট পড়া আয়াশকে দেখা যাচ্ছে। সিদ্ধিকে দেখেই দুহাত দিয়ে কান ধরলো আয়াশ। উঠবস করতে লাগলো। আয়াশের এমন কাণ্ডে সিদ্ধি হেসে কুটিকুটি। হাতে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হতেই রিসিভ করলো কলটা।
-“কি অর্ধাঙ্গিনী? এখনো রাগকন্যার রাগ বাকি আছে?”
-“আলবাত আছে। এই মাঝরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী ফাজলামি শুরু করছেন আপনি?”
-“আমি কিন্তু জানি তুমি মনে মনে খুব খুশি কিন্তু মুখে স্বীকার করবে না। এই তোমাদের মেয়েদের মনে এত হিংসে কেন হ্যাঁ? এই মাঝরাতে আসছি তোমার জন্য, ভেতরে ডাকবা না একটু? তা না করে কেন আসছো, কেন আসছো করতেছো।”
-“ফেরত যান। আপনারে কেউ আসতে বলে নাই।”
-“এই সিদ্ধি দেখো, আমি কুকুর খুব ভয় পাই আর তোমাদের পাশের বাসার কুকুরটা আমার দিকে কেমন যেন করে তাকাচ্ছে। আমার মতো একটা নিরীহ, অবলা মানুষকে ঐ নরপশু কুকুরটার থেকে বাঁচাবে না তুমি?”
-“ভাই থাম! এত ওভারএক্টিং ভালো না।”
-“ভাই? ছিঃ ছিঃ! বরকে ভাই ডাকতে লজ্জা করে না? তাড়াতাড়ি নিচে নামেন আর দরজা খুলেন।”
-“আসছি।”
সিদ্ধি হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় খেয়াল করে সায়ন সাহেবের ঘরের পাশের ঘরটার লাইট জ্বলছে। এ ঘরে তো কেউ থাকে না, তাহলে বাতি জ্বলছে কেন? বিষয়টা নিয়ে আর ভাবার সুযোগ পায় না সিদ্ধি। আয়াশের কথা খেয়াল হতেই দরজার দিকে এগোয় আবার।
________________________
-“এই মাঝরাতে আসার কোন দরকার ছিল?”
-“এই চিলেকোঠার ঘরটাতে তোমায় নিয়ে তারা দেখার বড্ড ইচ্ছে ছিল। আজ পূরণ করে নিলাম।”
-“বাবা বড্ড অচেনা হয়ে গেছে আমার কাছে আয়াশ।”
-“ওনাকে একটু সময় দাও। এখানে বসে তুমি ওনার মনের পরিস্থিতি বুঝছো না। যখন বুঝবে তখন জাজ করতে পারবে।”
-“রুফাইদার সম্পর্কে খোঁজ পেয়েছে তূর্য ভাইয়া?”
-“ওর চাচা মারা গেছে সকালে, বলার সুযোগই পাইনি।”
-“আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা টাকার জন্য আমাদের বাড়িতে আসেনি, বড়সড় কোন প্ল্যান আছে।”
-“কেন এমন মনে হচ্ছে? তোমার বর কিন্তু যথেষ্ট সুদর্শন, তাকে পাওয়ার জন্য যেকেউ যে কোন রকম ষড়যন্ত্র করতেই পারে।”
-“তা তো পারেই। তবে তোমার বউ যে কম সুন্দরী না সে অভিজ্ঞতা তো তোমার শুরুতেই হয়ে গেছে, তাই না? আচ্ছা, তাহমিদ কোনভাবে এসব করাচ্ছে না তো?”
-“ও জেলেই আছে, আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। বাইরের জগতের সাথে ওর কোনরকম কন্ট্রাক্ট নেই।”
সিদ্ধি আর কথা বাড়ালো না, নিশ্চুপ হয়ে গেল। সবকিছু অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। এই যে আয়াশ পাশেই অথচ মনে হচ্ছে দুজনের মাঝে বিস্তর দূরত্ব। সবচেয়ে অসহায় মুহূর্ত বোধহয় এটাই যখন কাছের মানুষ কাছে থাকলেও মনে হয় মাঝখানে এক আকাশ সমপরিমাণ দূরত্ব।
-“মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট করছেন কেন আপনি?”
-“তোর অত দরদ কিসের পরের মেয়ের জন্য? তোকে যা বলছি, যেভাবে বলছি, করবি। বেশি দরদ দেখাইতে গেলে তোর অবস্থা কী হবে তা নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি।”
আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায় শোভার। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারেন তিনি লাইন অন করেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। লাইটটা অফ করতেই চোখে পড়ে দরজার দিকে।দরজা খোলা, চটজলদি এসে দরজাটা লাগান তিনি। দরজার একপাশে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে একজোড়া জুতো। সকালে আয়াশ এসেছিল জুতোজোড়া পড়ে। আহা! ছেলেটা সিদ্ধির মায়াজালে চিরআবদ্ধ। এমন একটা জীবনসঙ্গীর স্বপ্নই তো সব মেয়ে দেখে কিন্তু পায় আর কয়জনা। দিনশেষে বেশ কিছু মেয়েই সঙ্গীর প্রতি বিরক্ত, রাগান্বিত। অবশ্য শোভার বিষয়টা আলাদা। সে তো মাত্র কদিনের মেহমান এই পৃথিবীতে। এই ক’দিনের চুক্তিতেই তো তাকে এ বাড়িতে এনেছেন সায়ন সাহেব। চুক্তি শেষ, মুক্তি পাবে দুটো জীবন।
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং অনুগ্রহপূর্বক গল্প সম্পর্কে নিজের মতামত জানাবেন।]