#ধারাবাহিক_গল্প_পর্ব_৬
#চারুলতা_ভালোবেসেছিল

সকালে নাস্তার পর আবার সবাই বসবে ঠিক হয়েছে।
ভাইয়া আজই একটা ফয়সালা করে ফেলতে চান, আর আমরাও। কিন্তু গতরাতে লতার মুখে হৃদয় ভাই আসবে শুনে আমার আর কোন কিছুতে মন নেই।
রাতে লতার সাথে আর কথা বাড়াইনি, দুইবোন চুপচাপ শুয়ে পড়েছি। সকালে দু’জনই স্বাভাবিক চলার চেষ্টা করছি। সবার খাওয়া যখন মোটামুটি শেষ, তখন ঘড়িতে প্রায় নয়টা বাজে। এমন সময় বাইরে বাইক থামার শব্দ পেলাম। কিন্তু আমার নিজের হৃৎস্পন্দনও যেন বন্ধ হয়ে গেলো, যখন সেই পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনলাম এত বছর পর।

ভাইয়া, হৃদয় ভাইকে এখানে আশা করেনি। আমার আর হৃদয় ভাইয়ের ঘটনাটা ওর কানেও গিয়েছিল।
যদিও ঐ ঘটনার আগে যে হৃদয় ভাইয়ের সাথে ভাইয়ার খুব মাখামাখি ছিল, তা কিন্তু না। ভাইয়া ফুপু বা হৃদয় ভাই কারো সাথেই খুব একটা মিশতেন না। ফুপু, আম্মাকে পছন্দ করে আব্বার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, এ জিনিস টা সম্ভবত ভাইয়ার মনে দাগ কেটেছিল।

“হৃদয় তুমি এখানে হঠাৎ? নোয়াখালী কবে আসলা?
সাথে কে? ”

হৃদয় ভাই সাথে জানি কাকে নিয়ে এসেছেন। আমি সরাসরি তাকাতে পারছি না, কেমন এক লজ্জা, আর ভয় মনকে গ্রাস করে রেখেছে। লতাকেও দেখতে পাচ্ছি না অনেকক্ষণ হলো।

“ভাইয়া ফুপার কবর জিয়ারত করতে আসলাম।
আমার সাথে আসলাম ভাইকে নিয়ে এসেছি। আসলাম ভাই মাইজদী কোর্টে আছেন। আপনারা শুনলাম সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যায় আছেন। আসলাম ভাই এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে। ”

হৃদয় ভাই পরিমিত হেসে উত্তর দিলেন। আগের চেয়েও যেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন তিনি।পুলিশের পোশাকটা কী মানিয়েছে ভাই কে। পুলিশ আর উকিলের উপস্থিতিতে ভাইয়ার মামা আর খালাকে একটু উসখুস করে উঠতে দেখলাম। খালার তো তখুনি জরুরি কাজ মনে পড়ে গেল। অথচ আজ সকাল সাতটা না বাজতে হাজির হয়েছিলেন আমাকে আর লতাকে শায়েস্তা করার জন্য। একটু হাসি পেল। হৃদয় ভাই যেন এখন নায়ক রূপে আছেন। লতা নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে, এত সকালে গোসল করেছে, মিষ্টি গোলাপী সালোয়ার কামিজে কী স্নিগ্ধ লাগছে লতাকে।

লতা আম্মার মতো হয়েছে, খুব মায়াবী চেহারা। আর আমি হয়েছি আব্বার মতো। বাবার মতো চেহারা পেলে নাকি মেয়ে ভাগ্যবতী হয়!! তাহলে আমার এমন মন্দভাগ্য কেন? এতবছর পর যখন মনের মানুষের দেখা পেলাম, তখন সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নিজেরই ছোট বোন দাঁড়িয়ে আছে।

“হৃদয়, ফুপা ফুপির মৃত্যুর পর তো আমরা তোমাদের জায়গা জমি ভাগ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে যাইনি। তাহলে তোমার এত দরদের কী কারণ? পুরানো পিরিতি জেগে উঠেছে নাকি? ”

ভাইয়া রিতীমত রাগ। কিন্তু হৃদয় ভাই দেখলাম স্বাভাবিক। বললেন, “কারণ আমার চার বোনের সাথে কোন অন্যায় হয়নি। তাই অন্য কারো সাহায্যের তাদের প্রয়োজন হয়নি। চারু আর লতা তোমার সৎ বোন হতে পারে, কিন্তু তোমরা তিন জনই আমার আপন মামাতো ভাই বোন। ”

বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা চললেও, শেষ পর্যন্ত উপস্থিত সবার পরামর্শে ভাইয়া উকিলের সাহায্য নিতে বাধ্য হোন। পুলিশের লোক বলে হৃদয় ভাইয়ের অবস্থানই আলাদা, আর হৃদয় ভাই আমাদের দু’বোনের ঢাল হয়েছেন এটাও সবাই বুঝতে পারছেন। শেষ পর্যন্ত সব কিছু এত সহজে সমাধান করতে পারব তা আমি আর লতা কোনদিন ভাবিনি। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল যেন। বাড়ির পিছনে পুকুর ভরাট অংশের জায়গার পরিমান পুরনো বিল্ডিং এর তিনগুন। আগে সেখানে বড় পুকুর ছিল, আব্বা সেটাতে নতুন বিল্ডিং করবেন ভেবে ভরাট করেছিলেন।

সিদ্ধান্ত হয়, আমরা দুইবোন এই পুরানো বিল্ডিং টা পাব, যেহেতু নতুন বাড়ি তোলা আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব না। তার বিনিময়ে ভাইয়াকে বড় জায়গাটা ছেড়ে দেব। আমরা দুইবোনই তাতে রাজি হই। দোকানের টাকাটা তিন ভাগের এক ভাগ হিসেবেই ভাগ হয়।
আব্বার নিজের একাউন্টে সামান্য টাকাই ছিল, সব মিলেয়ে লাখ দেড়েক, সেটাও ভাগাভাগি হয়।
জমিজমা গ্রামে, তবে আমি আর লতা জমির দাবি ছেড়ে দিয়ে তার বিনিময়ে ভাইয়ার কাছ থেকে ক্যাশ টাকা পাব ঠিক হয়। গ্রামের জমি দেখাশোনা করা বা দখলদারি হতে রক্ষা করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য।

দুপুরে হৃদয় ভাই এখানেই খেয়েছেন, লতা নিজে ভাইয়াকে সার্ভ করে। আমি নিজেকে যেন একদম গুটিয়ে নিয়েছিলাম, লতাই যেন আজ এ বাড়ির কর্ত্রী স্থানীয়। আমি শুধুই দর্শক।ভাইয়া দেখলাম একটু ফোঁড়ন কাটলেন

“হৃদয়ের কি প্রেমের কাঁটা ঘুরে গিয়েছে?”

“ভাইয়া কী বোঝাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনের মানুষ সবসময় একজনই ছিলো। ”

পরিষ্কার স্বরে বললেন হৃদয় ভাই। একমুহূর্তের জন্য আমার পৃথিবী যেনো থমকে গেলো, সাথে মনে হলো লতারও। একটু আগের হাসি মাখা মুখটা মলিন হয়ে গেল যেন।

বিকেলে দোতলার বারান্দায় বসে আছি, হৃদয় ভাইয়া বেরিয়ে যাবেন একটু পর। ঝড়ের মতো আসলেন, আবার চলেও যাচ্ছেন। আমাদের দুইবোনের জন্য যেনো ত্রাতা হয়ে এসেছেন এই অল্প সময়ে। তবে চলে যাওয়ার পর হয়তো আমাদের দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে যাবেন।

“চারু যাচ্ছি আমি। ”

বিদায় নিতে এসেছেন হৃদয় ভাই, চার বছর পর প্রথম কথা,তাও বিদায়। কাঁদলে খুব খারাপ দেখাবে, প্রাণপণে চেষ্টা করছি না কাঁদার।একটা বিধবা মেয়ে স্বামী ছাড়া অন্য কারো জন্য কাঁদলে কেমন বাজে হবে সেটা।

“চারু আমার উপর খুব রাগ তাই না। তোমার জীবনটা আমার জন্য কত এলোমেলো হলো। আম্মা এমন করবেন আমি সত্যি ভাবিনি। মাফ চাওয়ার ভাষা নেই আমার। এত লজ্জিত ছিলাম যে আর সামনে আসার সাহস হয়নি।”

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি আমি। সময় আমাকে বয়সের আগেই পরিণত করে দিয়েছে, কিন্তু মনটা যে এখনো নেচে বেড়ায়।

“চারু আমি আরও তিনদিন আছি নোয়াখালী, কাল আবার আসব ইনশাআল্লাহ। সব সমাধান করে তবেই যাব। চার বছর আগে তোমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর মতো সাহস বা শক্তি ছিল না। কিন্তু আজ আছে।তোমার বা লতার কারো ক্ষতি হবে না, ভরসা রাখ। ”

কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে যায় হৃদয় ভাই।
ভাইয়া আর ভাবি আরো দুইদিন থাকবে। আব্বার জন্য মিলাদ পড়াবেন আর এতিম খাওয়ানো হবে। যেহেতু আমরা দুইবোন টাকা পেয়েছি, তাই মিলাদ আর এতিম খাওয়ানোর খরচে আমাদের ও শরিক হতে হবে।
কত খরচ হবে, কী আয়োজন হবে তাই নিয়ে নিচে আলোচনা চলছে। লতা আমার জন্য ছাদে চা নিয়ে এসেছে।

“আপা হৃদয় ভাইয়ের সাথে তোর কী নিয়ে কথা হয়েছে? ”

“কেন, সেটা তোর কী দরকার? ”

“আপা এত ঝামেলা হলো, অসম্মান হলো, তাও মন ভরেনি তোর? লজ্জা করে না, তুই তো বিধবা এখন।”

লতা কে আমার এখন বিষাক্ত লাগছে, মনে হচ্ছে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই।
ছিঃ! এ কী ভাবছি আমি, আমি কি পাগল হয়ে গেলাম!

“লতা তুই কী বলছিস তুই নিজে ভেবে দেখ। আর তোর এত গায়ে লাগছে কেন? হৃদয়ের ব্যবহারে তো আমি তোর জন্য আলাদা কোন ফিলিংস দেখিনি। ”

“তাহলে কী তোর জন্য ফিলিংস দেখেছিস, কী ফিলিংস দেখালো শুনি? লুকিয়ে চুমু খেয়েছে বুঝি।
তোর তো একবছরের বিয়ের অভিজ্ঞতাও আছে।
ছলাকলা ভালো জানার কথা।”

সর্বশক্তি দিয়ে চড় মারলাম লতার গালে, কাল পর্যন্ত ভালো বোন হতে চেয়েছি, আর এখন মনে হচ্ছে ওর গলা টিপে ধরি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here