চাদর
Subhra Roy
পর্ব ৩+৪
সারা রাত একটা ভুত ও চোখের পাতা এক করেনি । সাথে মানি ও জুটেছে । কত রকম রান্না করল।সে ঠিক আছে ।এত গুলো বক রাক্ষস আছে অসুবিধা হবে না । আর ঐ গাধা টার তো আহ্লাদের শেষ নেই । এসে থেকে মানি কে অ্যাসিস্ট করছে । বাকি গুলো ও ও মুখো হয়েছে । এক দিক থেকে ভালো ই হয়েছে । আমি একটু শান্তিতে আছি ।কিন্তু ঐ যে কতক্ষণ পারব জানি না । খাওয়া দাওয়া র পর সব কটার সাথে মানি ও সারারাত আড্ডা মেরে, গান গেয়ে, কবিতা বলে কাটিয়ে দিল। আমাকে ও ডাকছিল গলা, মাথা ব্যাথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি । আমি মানি কে বললাম শুয়ে পড়তে। তা আমাকেই বলে কিনা, আমি তোর মত বোরিং নই যে আড্ডা ছেড়ে বই মুখে বসে থাকব। কাল অফিস ছুটি । তোদের আসতে দিয়ে আরাম করে ঘুমবো। বই তো রইলই একটা কিছু শোনা না আজ। কতদিন তোর আর দীপের ডুয়েট কিছু শুনিনি । আমার মুড নেই, তোমার আদরের ছেলে কে শোনাতে বল- বলে বইয়ে মন দিয়ে ছিলাম আমি । মানি দীপ কে খুব ভালো বাসে। আমি মাঝেমাঝে মানি কে বলতাম, আমি তোমার কেউ নই, দীপ ই তোমার ছেলে ।
একটু পরেই গান ধরেছিল দীপ। আবেগ মাখা গলা। একদিন এভাবেই গান করতাম আমরা । এক এক করে সবাই গলা মেলাতো। গলার সুর কাটলেও মনের সুর গুলো কাটত না । আজ তো বন্ধুত্বের সুরটাই কাটতে বসেছে । চোখ গুলো জ্বালা করছিল । হয়তোবা ঘুম হয়নি বলেই।
বাসে সারাটা রাস্তা হুল্লোড় করে গেছে সবকটা । তার ওপর সয়তানটা ঠিক আমার পাশে বসেছে আর টানা সবার পেছনে লেগে যাচ্ছে ।দু এক এক জনের সাথে তো দাদা, দিদা, কাকিমা পাতিয়েও নিয়েছে ।বাসের লোক গুলোও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আর হাসছিল। একে কাল সারা রাত জাগা তার ওপর এসি বাস । কখন যে দু চোখ বুজে গেছে আমার বুঝতেই পারিনি । হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটা ব্রেক কষায় ঘুমটা একটু ভেঙে গেছল। ঘুমের ঘোরে ও বুঝতে পারছিলাম কেউ খুব যত্ন করে আমার মাথাটা বুকে আগলে রেখেছে। গন্ধ টা আমার চেনা । মানুষ টা আরও বেশি ।জানি নিজের কিছু হলেও আমার কিছু হতে দেবে না । আর দেখ সবচেয়ে কষ্ট আমাকেই ওকে দিতে হচ্ছে । ভাবনা গুলো শেষ হবার আগেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । হঠাৎ একটা ঠেলায় ঘুম টা ভেঙে গেছল। দেখি দীপ ডাকছে আমায় । রেস্টের জন্য বাসটা দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ । খাবার এনেছে আমার জন্য । আমি খাব না বলতেই এক টুকরো পরোটা সোজা আমার মুখে । জানি এ সিংহের হাত থেকে রেহাই নেই আমার । তুই খাবি না, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি । এই তো একসাথেই খাব সবাই । বাকি গুলো ও উঠে এসেছিল বাসে। সবাই একসাথে আবার আগের মতো খুনসুটি করতে করতে খাওয়া হল। সেই আগের মতো। একটা মানুষ এর থাকা না থাকা কতটা সহজ করে দিয়েছে সবাই কে । আমাকে সেই আগের মতোই খাইয়ে দিয়েছিল দীপ। মনে হচ্ছিল কিছু ই হয়নি যেন। বিদিশা নামের একটা মানুষ যে আছে সেটা র অস্তিত্ব ই নেই কারো কাছে । সব আগের মত ।আমরা ছজন বেস্ট ফ্রেন্ড । বন্ধুদের সম্পর্ক বোধ হয় এমনই হয় । যতই ধুলো মাখাও আবছা সে হবে না ।
এতটা জার্নি করে সবাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল । দুটো বড় রুম নেওয়া হয়েছিল একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের । কাল বিদিশা এলে ওর একটা রুম নেওয়া হবে । বুক করাই আছে । ও আবার ওর এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কে নিয়ে আসবে । সেই মেয়েটি ওর সাথে থাকবে ।
খাওয়া দাওয়া করে একটু রেস্ট নিয়ে আবার সবাই টো টো কোম্পানি । দল ছাড়া গোরু সব।এখানে এসে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও বাঁদরামি করছে সব কটা । হঠাৎ রাজা বলল, কত দিন পর মনে হচ্ছে সব আগের মত ই আছে । কত দিন পর এভাবে ভেক মারছি ভাব তো । বিদিশা এলে সব কেমন যেন দম চাপা হয়ে যায় । বলেই চুপ করে গেছল । যে কথাটা সবাই বুঝেও কেউ মুখে আনেনি সেটাই বলে ফেলেছিল রাজা। দীপ চুপ করে গেছল । রাজা বুঝতে পারছিল ভুল যায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। এসে জড়িয়ে ধরে বলে ছিল দীপকে– এভাবে বলতে চাই নি রে ভাই ।তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। হালকা হেসে ঠিক আছে বলে আবার সবার পেছনে লাগতে শুরু করে দিয়েছিল দীপ।
কাল ভোর ভোর উঠে রেডি হয়ে দোল উৎসব এর জন্য যেতে হবে ওদের । তাই সন্ধ্যা র পর আর কেউ বেরোয় নি তার ওপর রাতের দিকে বিদিশা আসবে । তাই রাতের খাবার এর অর্ডার দিয়ে রুমে বসেই আড্ডা দেওয়া হচ্ছিল । একগাদা বালিশ নিয়ে বসে খুনসুটি গানে গল্পে আমাদের আড্ডা জমতে বেশিক্ষণ লাগেনা । হঠাৎ সোম গিটার নিয়ে রাজা আর দীপ কে নিয়ে সেনোরিটা গানটা হইহই করে গাইতে শুরু করে দিতেই রিমি আর তনু টাও নেমে পড়ে ছিল নাচতে । আমাদের গ্রুপের একটা অদ্ভুত ডান্স ফর্ম আছে ।আমরা বলি ছন্নছাড়া নাচ । আমাকেও ডাকছিল। নামতে চাইনি আমি । হঠাৎ আমাকে কোলে করে খাট থেকে নামিয়ে এনেছিল দীপ। ওর পাগলামি জানে সবাই । ডুয়েট ডুয়েট করে চিৎকার করে উঠেছিল সবকটা । চশমাটা খুলে টেনে এনেছিল আমাকে । নাচতে নাচতে ই ল্যপটপে গান লাগিয়ে দিয়েছিল রাজা।জোড়ায় জোড়ায় নাচছে সবকটা । আজ অবধি কারনে অকারণে এমন অনেক নাচানাচি করেছি আমরা । কখনও কিছু মনে হয়নি । কিন্তু আজ হচ্ছে । দীপের এত কাছে থেকে মনে হচ্ছে ভেতরটা কেমন করছে । যেন চুরি করছি। অন্য কারো জিনিস ছুঁয়ে দিচ্ছি । কোথাও একটা বাঁধ ভাঙছে। ভয় করছে আমার । কারো কথা ভাঙছি না তো । চোখ তুলে তাকাতে পারছি না । এমন হওয়ার তো কথা নয় । একবার ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি নি এমন নয় । কিন্তু বড্ড শক্ত করে ধরে আছে কেউ । এত শক্ত বাঁধন ছিঁড়তে পারব তো আমি । বন্ধুত্ব, ভালবাসা, আবদার, দুষ্টুমি অনেক গুলো সুতোর বাঁধন। গিঁট টা খোলার ক্ষমতা আমাকে দিও ঠাকুর ।
বেশ রাত ই হয়েছিল বিদিশা র আসতে । আমরা খাওয়া দাওয়া করে বসে ছিলাম ওর অপেক্ষায় । ও পৌঁছনোর পর সবাই শুয়ে পড়েছিলাম । সকাল ছ’টা র মধ্যেই পৌঁছে যেতে হবে ক্যাম্পাসে ।
একটা গোলাপি সিফন শাড়ি আর ব্যাকলেস ব্লাউজ পরেছিল বিদিশা ।দারুণ মানিয়েছিল ওকে । অমন ফিগার, অমন গায়ের রঙ । যে কোন ছেলে ফিদা হতে বাধ্য। রেডি হয়ে দীপের রুমে গেছল বিদিশা ওকে ডাকতে। ওকে দেখে বলেছিল, খুব ভালো লাগছে । রাজা ও ঢুকতে বাইরের চেয়ারে বসে জুতো পরছিল। সোম গাড়ি এসেছে কি না দেখতে নীচে গেছল।
তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকালেও না দীপ। এই শাড়ি টা স্পেশাল কিনেছি আজকে র জন্য ।তোমার ভালো লাগবে বলে, বলেছিল বিদিশা ।
আমার যে যেমন তাকে সেভাবেই ভালো লাগে বিদিশা ।আমি মানুষ কে বদলে ভালোবাসি না । কথাটার মধ্যে কোথাও একটা রাগ ছিল । অনন্যা র বদলে যাওয়া টা সবার মতো দীপের ও চোখে পড়ে ছিল । হয়তোবা একটু বেশি ই লেগেছিল । আর কারন টা যে বিদিশা, সেটা বুঝলেও কারন টা বুঝতে পারেনি দীপ।
আমার মতো এই সব ড্রেসে ভালো লাগবে ভেবেছ তোমার বান্ধবীকে । জঘন্য লাগবে ।ঐ তো গেঁয়ো ভুত।
সে তো ঠিকই ।কিন্তু ভুলে যেও না সবাই কে সব সময় তোমার ভালো টা ঐ মেয়েটা ই দেখিয়েছে । ও না থাকলে আজ আমরা ও একসাথে থাকতাম না। আর ও যেমন আমরা সবাই তেমনি ভালবাসি ওকে। একটা তাঁতের শাড়ি তেও ওকে এতটা মিষ্টি লাগে ওর এত উগ্রতার প্রয়োজন হয় না । ওর সরলতা টাই ওর শক্তি । আর তোমার এত সমস্যা কেন ওকে নিয়ে ।
তুমি কি করে জানলে ও তাঁতের শাড়ি পরবে? তুমি ওর সব বোঝ? শুধু আমাকে বোঝ না । এত দূর থেকে শুধু তোমার জন্য এসেছি ।আর তুমি অন্যের জন্য আমার সাথে ঝগড়া করে যাচছ।
আমি ঝগড়া করতে চাইনা ।শুরু টা তুমি ই করেছ। অনেক হয়েছে এবার প্লিজ নিচে চল।সবাই অপেক্ষা করছে । বলেই বিদিশা কে নিয়ে নিচে নেমে এসেছিল দীপ।
বাইরে বসে সবটাই শুনেছিল রাজা। ভাবছিল এবার বুঝি সত্যি ই ভেঙে যাবে ওদের বন্ধুত্ব গুলো । কেমন হবে জীবন বন্ধু দের ছাড়া ।
বাইরে বেরিয়ে অনন্যা কে দেখে ভেতরে ভেতরে চমকে গেছল বিদিশা । ঠিক দীপের বলা কথা গুলোর মতই লাগছে ওকে । ফুল তোলা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি ।এলো খোঁপা । একটু কাঠের গয়না । আর কিছু নেই । তবু মনে হচ্ছে চারদিকে আলো জ্বলে আছে । তবে কি দীপের কথাটা ই ঠিক । ওর ই মন টা কালো হয়ে যাচ্ছে।না আজ আর মন খারাপ করবে না।আজ সবার সাথে মন খুলে মিশবে। পারলে অনার সাথেও,মনে মনে ভাবছিল বিদিশা।
পর্ব ৪
শান্তিনিকেতন কেন এমন নাম হয়েছিল যায়গাটার জানিনা ।সত্যি ই কি শান্তি পাওয়া যায় এখানে এসে । সেটাও জানা নেই । শুধু দেখলাম এখানে পা দেওয়ার সাথে সাথে অন্য আনন্দে ভরে উঠেছে মনটা ।
সবে শুরু হয়েছে প্রভাতফেরি ।ছোট ছোট বাচ্চা থেকে বড় সবাই পা মিলিয়েছে রবি ঠাকুরের গানের সুরে সুরে । গায়ে সবার গাঁদার মালা, পলাশ ফুল। দীপ কোথা থেকে সবার জন্য পলাশ ফুলের মালা নিয়ে এসেছিল।
সব কটা আবার বাঁদরামি শুরু করেছে ।বড় রাগ হয় ।এত সুন্দর পরিবেশ । আর এগুলোর কোন হেলদোল নেই । সোম টা তো হাতে মালা জড়িয়ে সমান তালে তনু র পেছনে লেগে গেল । সবাই হাসছে । পলাশের মালাগুলোর এমন সদ্ব্যবহার বোধহয় আগে কেউ দেখনি। আমার মালা দুটো হাতে নিয়েই দাড়িয়ে ছিলাম আমি ।সবাই গলায় পরছিল। মাথায় লাগাচ্ছিল। আমি ও ভাবলাম এসেইছি যখন সবার মতই বরং সাজি। খোঁপায় মালাটা লাগাতে যেতেই হাত টা ধরে নিয়েছিল দীপ।
একা মালা আটকেছিস কখনও । নাচের অনুষ্ঠানেও তো হয় আমি নয় মানি লাগিয়ে দিয়েছি।।এত পাকামি কিসের জন্য তোর। খুব বেড়ে গেছিস না । অনেক দিন ঝাড় খাসনি, মালা টা খোঁপায় লাগাতে লাগাতে বলেছিল দীপ।
।
তাকা একবার শুনে পেছনে তাকাতেই দুটো হাত দিয়ে আবির মাখিয়ে দিয়েছিল দীপ।আজকের প্রথম রং।সারা জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রথম রং আমার ।আমাকে নয় বিদিশা কে মাখাবি যা বলে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম ছেলেটাকে ।
কেন এমন করে ছেলেটা আমার সাথে । কি দরকার ছিল এসব করার ।পারলে লাগাতাম না পারলে লাগাতাম না ।অন্যরা মাখালে আবির মাখতাম নইলে না ।ওর কি হচ্ছে ।বিদিশা আছে ।ওর সাথে ঘুরুক , যা ইচ্ছা করুক। আমাকে নিয়ে কেন পড়ে আছে । অসহ্য লাগছিল সবকিছু । মেয়েটা আবার আমায় দেখছে।ভাল লাগছে না । পুরো মুড টাই ঘেঁটে দিয়েছে । এত সুন্দর পরিবেশ একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না তাউ। তাও ভালো বিদিশা ছেলেটাকে টেনে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ঘুরতে । এখন কেমন অসহ্য লাগছে এই ভিড়, লোকজন। গান গুলো ও চিৎকারের মত লাগছে । মনে হচ্ছে কোন ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকি ।
বাকি গুলো দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভেক করছিল আর ঝারি মারছিল। লাজ লজ্জা বলে তো কোন বস্তু নেই শরীরে। নিজেদের জোড় গুলো কে নিয়েই বজ্জাতি করে যাচ্ছে । সে যা পারে করুক ।আমার আর ভালো লাগছে না এখানে থাকতে । মাথা ব্যাথা করছে বলে কেটে পড়াই ভালো । আমাকে দেখতে না পেলে মেয়েটাও একটু শান্তি তে এনজয় করতে পারবে ।
হোটেলে ফিরে চুপ করে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ । বোঝার চেষ্টা করছিলাম । অন্যদের নয় । আজ নিজেকে বুঝতে চাইছি । কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে । কোনটা ঠিক কোনটা ভুল । কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । অন্যকে ঠকানো যায় । নিজেকে ঠকাব কি করে । মুখে রাগ করছিলাম । মন কি খুশি হয়নি কেউ মালাটা অত যত্ন করে লাগিয়ে দিয়েছিল বলে।প্রথম আবির আমায় মাখিয়েছিল বলে।মন কি খোঁজে না রাগ করলে সেই যেন অভিমান ভাঙায়। একটু যেন সেই আগের মতোই আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । মন বড় বেইমান বান্দা । যা পাবেনা তাই চাইবে । যেটা ভুলতে চাইবে সেটাই ভাবা করাবে । বড্ড জটিল যুদ্ধ ।
বড্ড ক্লান্ত লাগছে ।পালাতে ইচ্ছে করছে কোথাও । এখানে থাকলে……. ভাবার ক্ষমতা টুকু ও নেই আর বুকের ভেতর । মাথা থেকে আলতো করে খুলে এনেছিলাম মালাটা ।যাকে ছোঁয়ার ক্ষমতা অধিকার কোনটাই নেই আমার তার দেওয়া মালাটাতেই মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম ।ঠোঁট দুটো আলতো করে ছুঁইয়ে দিয়েছিলাম পাঁপড়িগুলোর গায়ে । কেঁপে উঠেছিল শরীর টা । কাকে খুঁজছি আমি? ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়েছিলাম। চোখ বন্ধ করে আর কি দেখব না আমি? আর কতদিন? ঘোরের মধ্যে মালা টা ব্যাগে ভরে রেখে পার্টস আর বইটা নিয়েই বেরিয়ে গেছলাম। ফোন টাও সুইচ অফ করে রেখে দিয়েছি। রিসেপশনে শুধু জানিয়ে দিয়েছিলাম ওদের যেন এলে বলে দেয় একটু বেরোচছি । তাড়াতাড়ি চলে আসব। চিন্তা করার দরকার নেই । একটু একা হতে চাইছিলাম ।শান্ত করতে হবে নিজেকে । নইলে এত প্রশ্নের উত্তর যে আমার নিজের কাছে ও নেই ।
খাবেনা শয়তান মেয়েটা জানি । কখন ফাঁক তালে হোটেলে চলে গেছে । একবার বলে ও যায়নি । এমন কেউ করে । কেন যে কিছুদিন ধরে এমন করছে কে জানে? বাচ্চাদের মত লুকোচুরি খেলছে যেন। ভাল লাগেনা আর।প্লিজ তুই আগের মত হয়ে যা খেপি। খুব মিস করছি আমার বাঁদরি টা কে ।কত দিন হয়ে গেল জেদ করিস না, অভিমান করিস না, ঝগড়া করিস না আগের মত । কেন এমন করছিস? কার জন্য? প্লিজ আমার পাগলি বেস্ট ফ্রেন্ড টা কে ফিরিয়ে দে অনা । তোকে ছাড়া যে সব ফাঁকা রে। ভাবতে ভাবতে হোটেলে ফিরে এসেছিল দীপ ।
একেই অনেক টা বেলা হয়ে গেছে । তার ওপর এসে মেয়েটা বেরিয়ে গেছে শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেছল দীপের । সবারই চিন্তা হচ্ছিল ।
তখনতো বলছিল মাথা ব্যাথা করছিল।শরীর খারাপ হয় নি তো । ফোন টাও রেখে গেছে । বড্ড অবাধ্য মেয়ে ।এলে আজ ঝাড় খাবে সবার কাছে, রেগে গিয়ে বলেছিল রিমি ।
খাবার দিচ্ছে চল সবাই ।অলরেডি অনেক লেট আমরা – – – খাবার জন্য ডাকতে এসেছিল বিদিশা ।
তোমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে,মেয়ে টা কোথায় গেল তার ঠিক নেই, রেগেই বলেছিল তনু।
বাচ্চা নয় আর বলেই তো গেছে । চলে আসবে একটু পরেই । দেখো হয়তো খেয়ে ও নিয়েছে বাইরে কোথাও ।চিন্তা করার মত কিছু হয়নি – একটু বিরক্ত হয়ে ই বলেছিল বিদিশা । তোরা খাবি তো খেয়ে নে, আমি আসছি একটু বলেই উঠেপড়েছিল দীপ।
কোথায় যাবে এখন না খেয়ে । তুমি তো জানোও না কোথায় গেছে ও। কোথায় খুঁজতে যাবে ।দেখ চলে আসবে একটু পরেই – দীপের হাতটা ধরে বলেছিল বিদিশা ।
আমি জানি, শুকনো হেঁসে বলেছিল দীপ।যদি না জানতাম তো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতাম না । শুধু এতক্ষণ যে মনে পড়েনি সেটা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে ।আমি বোধহয় আর ততোটা ভালো বন্ধু নেই এখন।বলেই বেরিয়ে গেছল ছেলেটা ।
সাবধানে যাবি ।তোরা ফিরে আয় একসাথে খাব সবাই – দীপকে বলেছিল সোম।
অবাক চোখে দীপের যাওয়াটা দেখছিল বিদিশা । এমন বন্ধু ও হয় ।যারা একে অপরের এতটা কাছের হয় ।কই ও তো কাউকে এমন করে চেনে না, নিজের ভালবাসার মানুষটাকে ও না।
ওদের নিয়ে ভেব না ।একটু পরে দুটো পাগলা ই চলে আসবে । অনেক দিনের বন্ধু আমারা । এটুকু পাগলামি তো সহ্য করতে হবেই তোমাকে । রাগ করো না । যাও তুমি খাবে তো খেয়ে নাও- বিদিশা র হাতটা ধরে বলেছিল রিমি ।
একদিন না দোলের সময় শান্তিনিকেতন যাব আমরা । অনেক আবির খেলব ।তারপর কোপাই এর ধারে চুপটি করে বসে এই বইটা পড়ব। তুই একটা সুন্দর গান শোনাবি। তারপর হঠাৎ আমাকে বলবি, এই তাকা এদিকে ।আমি তাকাতেই ঝপ একটা ছবি তুলবি তুই ।আর আমি এমনি এমনি করে তোকে ভেংচি কাটব।
আর আমি তোকে তুউউলে কোপাই এর জলে ফেলে দেব।বলেই হিহিহিহিহিহিহি করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল দুই বন্ধু অনেক দিন আগে যখন কেউ জানতো ও না বন্ধুত্বের ও পরীক্ষা হয় । যন্ত্রণার পরীক্ষা । যেতে যেতে ভাবছিল দীপ।
দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল মেয়েটাকে । চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। গালে লেগে আছে সকাল বেলার আবির। কোলে রাখা একটা বই । এত দূর থেকে না দেখেও বলে দিতে পারে, সঞ্চয়িতা।
একবার তাকা । কথাটা শুনে তাকাতেই দেখি এখানে ও এসে হাজির বাঁদর টা ।আবার ছবিও তুলছে । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি এখানে জানল কি করে?
দুচোখ ভরে দেখছি আমি । খোলা চুল, কান্না ভেজা কাজল মাখা চোখ, গালে আবির । মনে হচ্ছে কোপাই এর ধারেই এক ঝাঁক হলুদ ফুল ফুটে উঠেছে । কিন্তু কাঁদছিল কেন? এখন তো আমায় বলেও না কিছু । অবাক হয়ে চশমা টা পরতেও ভুলে গেছে । ভারি মিষ্টি লাগছে । কি রে ভুলে গেছিস সব? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বলেছিল দীপ।
ইইইইই, করে ভেংচে দেওয়ায় হেসে ফেলেছিল দীপ । ছবি তুলে ছিল কতগুলো ।বলছিল সবাই কে দেখাবে কাঁদুনির ছবি । আমি মারতে গেলে ধপ করে বসে পড়েছিল আমার পাশে ।কাঁদছিলি কেন? জিজ্ঞেস করেছিল। মাথাটা একটু ব্যথা করছিল।তাই চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। কাঁদিনি রে। শুনে আর কিছু বলেনি ।আলতো করে আমায় ধরে মাথায় ঠোঁট দুটো ছুঁইয়ে ছিল ।এ ছোঁয়া য় শরীর থাকে না, থাকে শুধু মমতা । আদি অকৃত্রিম স্নেহ । বন্ধুত্বের ছোঁয়া ।
তুই ভাবলি কি করে তুই লুকিয়ে থাকবি আর আমি খুঁজে পাব না তোকে ।এ টা কখনও হয়নি আর হবেও না।জানিস কত চিন্তা হচ্ছিল । আর একটু আঁকড়ে ধরে বসে ছিলাম খেপিটাকে।কেন এমন ভয় লাগে মাঝে মাঝে? কি হারাবার ভয় পাই? জানি না । চুপকরে ছিলাম দুজনেই ।
আমি এখন আর তোর তত ভাল বন্ধু নেই ।নইলে কেন তুই এত কষ্ট পাস ঠিক জেনে যেতাম।কিন্তু দেখবি একদিন আমিই সব ঠিক করে দেব দেখবি।
ভাবতে ভাবতে উঠে পড়েছিল দীপ।
চল সবাই না খেয়ে অপেক্ষা করছে তোর জন্য ।এমনি কেউ করে? আমাদের চিন্তা হয় না? এবার একটু বড় হ খেপি ।কেন এত জালাস আমাকে ।সব সময় কি তোকে খুঁজতে থাকব আমি? তখন কি হবে?
হারিয়ে যাব, বলে চুপ করে গেছলাম আমি ।
আবার ভুল। রাগে লাল হচ্ছে মুখ ছেলের।
ঠাস করে একটা চড় মারব ।তাহলেই যত পাকামি আছে বেরিয়ে যাবে । বাজে কথা একটাও বলবি না । সকাল থেকে খাওয়া নেই কিছু নেই এখন উনি ভাঁট বকবেন আর আমাকে সেগুলো সহ্য করতে হবে ।মার খাসনি অনেক দিন তাই তোর বাড় টা বেড়ে গেছে । তাড়াতাড়ি চল এবার । হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে অটোতে বসিয়ে দিয়েছিল পাগল টা ।
নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়েছিল পাগলটা। বোঝাতে পারিনি এখন ওর জীবনে আর ও কাছের মানুষ আছে । সে ওর দায়িত্ব । ভেবেছিলাম এখানে এসে অনন্ত বিদিশা খুশি হবে। বুঝবে আমি, আমরা বন্ধুরা কেউ ওদের খারাপ চাই না । ওরা ভালো থাক সেটাই চাই । না একটা ভালো প্লেন আমাকেই করতে হবে । কাল কোপাই এর ধারে পিকনিক করতে যাব আমরা । কিছু একটা করতে হবে যাতে মেয়েটা খুশি হয়ে যায় ।
সকালে উঠেই হইহই করে সব চলে এসেছি কোপাই এর ধারে । হোটেল থেকে একজন রাঁধুনি আর হেল্পার দিয়েছে । ওরাই সব রান্নার কাজ করবে । ওদের সাথে বেশ জমে গেছে আমাদের সবার ।জলখাবার তৈরী করছে এখন । লুচি আর আলুর দম। বিদিশা র অবশ্য অন্য খাবার ।ওসব ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট দেখছে। আজ অবশ্য মুড ওর ভালই আছে দেখছি ।বেশ হেসে হেসে কথা বলছে তনুর সাথে ।যাক কালকের ওষুধ ধরেছে মনে হচ্ছে । আমি বলিনি ।সোম কে দিয়ে ম্যানেজ করে কাল সন্ধ্যায় বাইরে পাঠিয়ে ছিলাম দুটোকে । বাকিরা সব নানা অজুহাতে রয়েগেছল।কে কি ভেবেছে জানিনা ।ওরা দুজন বেশ আনন্দেই আছে ।কথাটা মনে হতেই কেমন যেন করে উঠল বুকটা । কেন কেউ কি আমাকে ছাড়া আনন্দে থাকতে পারে না। আমি তো এটাই চেয়েছি। তবে কেন বুকটা জ্বলছে । না না ।কাল হয়ত অসময়ে খেয়েছি বলেই এমন লাগছে ।অম্বল হয়েছে বোধ হয় । অম্বল হলে সত্যিই কি এমন ব্যাথা লাগে?
সবাই কত আনন্দ করছে । ঐ তো দীপ তনু আর বিদিশার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে । ঐ তো হাতটা ধরে আছে মেয়েটার ।হাসছে সবাই ।এখানে আজ ও বড় অনাকাঙ্খিত । এখানে কারো দরকার নেই ওকে। হে ঠাকুর কবে শেষ হবে কালকের দিনটা । ভাল লাগছে না আর এখানে ।
আস্তে আস্তে উঠে নদীর ধারে চলে গেছলাম আমি । জিন্সটা গুটিয়ে পা টা জলে ডুবিয়ে বসে বইটা পড়েছিলাম । সঞ্চয়িতা ।আমার মন খারাপের সাথী। আমার একলা পৃথিবীর সাথী ।চুলটা ভিজে ছিল ।স্নান করেই চলে এসেছি । এখনও শুকনো হয়নি ।চুলটা খুলে মন দিয়েছিলাম কবিতায় ।হঠাৎ গমগমে আওয়াজ শুনে চমকে তাকিয়েছিলাম পাশে । ছেলেটা আমাদের সেই কবিতাটা আবৃত্তি করছে,…..
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ
তাদের গাছে গায়যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে নাচে আমার বুক…………………..
গলা কখন বেইমানি করল জানি না । সোম হইহই করে রেকর্ড করা শুরু করেছিল ডুয়েট ডুয়েট করে চিৎকার করতে করতে ।
কেন এমন হয় । কেন এমন মূহুর্তরা আসে ।কেন বাতাস কানে কানে বলে যায়, যা তোমার ছিল সেটা তোমারই আছে । কেন এমন মিথ্যে সপ্ন দেখায় মন ।
আমিতো করতে চাইনি । তবু কেন মন, আমার মন আমার সাথেই বেইমানি করল?
রাজা তো বলেই দিল, আবার তোদের কবিতা একসাথে শুনতে পাব ভাবিনি ।মনে হত গত জন্মে শুনেছি ।
মাথার চুলগুলোর সাথে আমার বুকের ভেতর টাও ঘেঁটে দিয়ে চলে গেছল শয়তান ছেলেটা । কি দরকার ছিল এই কবিতাটা করার । এত কিসের শখ ওর ।কেন এত কষ্ট পেতে হয় আমাকে ওর জন্য ।
কেউ অনন্যা র হাতের বইটা উল্টে দেখলে দেখতে পেত মেয়ে টা একটা কবিতা পড়ছিল,রবিঠাকুরের “একগাঁয়ে”,
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি.,
সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ………………….
মজা করে ই কেটেছিল সারাটা দিন । পরের সারাটা দিন কেটে গেছল চারিদিক ঘুরতে ঘুরতে । বেলা শেষ । রাত পেরলেই ফেরার পালা । কেমন করে কেটে গেল কটা দিন ।
আবির শুধু বাইরে টা রাঙায় না । মনের ভেতর টুকু ও রাঙিয়ে দিয়ে যায় বন্ধুত্বের রং এ, ভালবাসার রং এ।
চলবে….