#চাঁদ_সুন্দরী

সুরমা
পর্ব : ৫

পরাগের মা আয়েশা বেগম খুবই যত্ন করে জুঁইকে খাইয়ে দেয়।জুঁই বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নেয়।পরাগের ফ্যামিলির প্রত্যেকেই খুব ভালো।আনিকা মেয়েটাও খুব ভালো।কতো সহজে সে তাকে আপন করে নিয়েছে।রাত অনেক হয়েছে।আর রাত জাগার দরকার নেই।আয়েশা বেগম জুঁইকে ওষুধ খাইয়ে দিলেন।তিনি বললেন,,,,
-এখন ঘুমিয়ে পড়ো।শরীরে অনেক জ্বর ছিল।রাত জাগলে আবার জ্বরটা আসতে পারে।আজ তোমার ফুল বেড রেস্ট।ঘুমাও।কাল অনেক কথা হবে তোমার সাথে।
-ঠিক আছে।জুঁইও আয়েশা বেগমের কথায় শোয়ে পড়ে।আয়েশা বেগম নিজের রুমে চলে আসে।বিছানায় শোয়ে পড়লেও জুঁইয়ের চোখে ঘুম নেই।সারা দিনেই তো ঘুমালো।আর কতো ঘুমাবে?বিছানায় শোয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলো।বিছানায় শোয়ে থাকতেও জুঁইয়ের অস্বস্তি লাগছিল। আনিকা টেবিলে পড়ছিল।সে দেখলো জুঁই ঘুমাচ্ছে না।শুধু এপাশ ওপাশ করছিল।আনিকা বই বন্ধ করে জুঁইয়ের কাছে এসে বলে,,,
-তোমার কি খারাপ লাগছে?
-আসলে সারাদিনেই তো শোয়ে ছিলাম।তাই এখন শোয়ে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না।
-ব্যালকনিতে যাবে?
-যদি একটু হাঁটতাম তাহলে হয়তো ভালো লাগতো।
-তাহলে চলো ব্যালকনিতে গিয়ে একটু দাঁড়াবে।এখন তো আর নিচে যাওয়া যাবে না।আনিকা জুঁইকে নিয়ে তার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।ব্যালকনিটা বেশ সুন্দর।বসার মতো ব্যবস্থাও আছে।ব্যালকনি থেকে মুক্ত আকাশ উপভোগ করা যায়।আকাশ বেশ পরিষ্কার। চাঁদ তারার খেলা চলছে ঐ মুক্ত আকাশে।মৃদু বাতাসও আছে।এই রাতের পরিবেশটা বেশ রোমাঞ্চকর।জুঁইয়ের দুর্বল শরীরটা এক মুহূর্তেই সতেজ হয়ে উঠে।জুঁই ব্যালকনির রেলিং ঘেসে দাঁড়ায়।আনিকা জুঁইয়ের কাছে এসে বলে,,,
-ভালো লাগছে এখন?
-হু,অনেক ভালো লাগছে।তোমরা মনে হয় অনেক বড়লোক।আমি টিভিতে দেখেছি বড়লোকদের বাড়িতে এতো সুন্দর ব্যালকনি থাকে।সেইম এতো সুন্দর হয়।জুঁইয়ের কথা শোনে আনিকা শুধু একটু হাসলো।কিন্তু কিছু বললো না।জুঁই আবার বললো,,,
-তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
-ইন্টারে ভর্তি হয়েছি।তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
-আমি পড়ি না।
-কেন?
-পড়াশোনা করার মতো টাকা নাই আমাদের।
-কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছো?
-এসএসসি দিয়েছিলাম।এর পর আর পড়াশোনার সুযোগ পাই নি।জুঁইয়ের মনটা আবার রিক্ত হলো।পড়াশোনার প্রতি জুঁইয়ের প্রবল আগ্রহ।তার পড়তে খুবই ভালো লাগে।এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা সে ফ্রিতেই করেছে।বৃত্তি,স্যারদের সাহায্য আর নিজের মনোবল থেকেই এই টুকু এগিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার পর নিজের চাচা-চাচীর সাথে যুদ্ধ করেও কলেজে পা রাখতে পারে নি।তার চাচা-চাচী কিছুতেই তাকে আর ভর্তি করাবে না।কথাগুলো মনে হতেই জুঁইয়ের চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।আনিকা দেখলো জুঁইয়ের মুখটা মলিন হয়ে গেছে।মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।আনিকা কথা ঘুরানোর জন্য বললো,,,
-আচ্ছা এই জ্যোৎস্না মাখা রাত কেমন লাগছে তোমার কাছে?
-খুবই ভালো লাগছে।
-এই রাতটা দেখে আমারও খুব ভালো লাগছে।তুমি না আসলে তো আমি কখনই ব্যালকনিতে আসতাম না।এই রকম রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে গল্প করলে খুবই ভালো লাগবে তাই না??
-হু।আমরা গ্রামে এই রাতের বেলায় খেলা করতাম।সবাই মিলে কানামাছি খেলতাম।কত্তো মজা হতো।
-তাই???
-হু,লুকোচুরিও খেলতাম।সবাই একসাথে বসে গানের কলি খেলতাম।গ্রামে অনেক মজা করা যায়।
-আমাকে একদিন তোমাদের গ্রামে নিয়ে যাবে??এবার আবার জুঁইয়ের মন খারাপ হলো।সে বললো,,,
-আমাদের গ্রামে?
-হু,
-আমি আর ঐ গ্রামে ফিরে যাবো না।আর গেলে তোমাকে নিয়ে যাবো।
-ঠিক আছে যেতে হবে না।তোমাদের গ্রামে যা খেলা খেলতে তা আমাদের বাসায় খেলতে পারবো।আমাদের বাড়ির পেছনে অনেক খোলা জায়গা আছে।এখানেই খেলতে পারবো।
-দুজনে খেলা খেললে মজা হয় না।বেশি লোক হলে ভালো লাগে।
-দুজন খেলবো কেন?ভাইয়াও খেলবে আমাদের সাথে।
-তোমার ভাইয়া খেলবে?তোমার ভাইয়া কতটুকু বড়?
-অনেক বড়।আমার থেকে ৯বছরের বড়।আমার ভাইয়াই তো তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসলো।ভাইয়া বললো,তুমি আর ভাইয়া পাশাপাশি সিটে বসেছিলে।
-ওহ হু।আন্টি কাল বলেছিল।কিন্তু তোমার ভাইতো অনেক বড়।এতো বড় ছেলে আমাদের সাথে খেলবে?এগুলো তো ছোটদের খেলা।
-আমার ভাইয়াও ছোট।আমার আম্মু মনে করে।তাছাড়া আমি কিছু বললে ভাইয়া না করতে পারে না।
-অহ!ঠিক আছে খেলবো।জুঁই আর আনিকা গল্প করতে করতে রাত ২টা বেজে যায়।দুজন এতো ক্লোজলি কথা বলছে যে,মনেই হচ্ছে না দুজন দুজনকে আগে চিনতো না।যে কেউ দেখলে মনে করবে তারা দুজন দুজনার পূর্ব পরিচিত।আনিকা বলে,,,
-এই,এখন চলো রুমে যাই।তোমার শরীর তো এখনও দুর্বল।এর বেশি রাত জাগলে পরে আরো শরীর খারাপ হবে।তখন আম্মু কিন্তু খুব বকা দিবে।এখন চলো আমরা রুমে গিয়ে কথা বলি।
-হু,চলো।জুঁই আর আনিকা রুমে এসে বিছানায় শোয়েও অনেক গল্প করে।গল্প করে করতে এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালে মিষ্টি রোদের আলো এসে জুঁইয়ের চোখে পড়তেই তার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।জুঁই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে বাইরে বেশ আলো।গ্রামে থাকতে প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙ্গতো দূরে আযানের মিষ্টি সুর আর পাখির কলরবে।এখানে ইট পাথরের চার দেয়ালের ভেতরে কিছুর সন্ধানও পেলো না জুঁই।তবে ব্যালকনির দিকের জানালা খোলা থাকার কারনে একটু রোদের স্পর্শ পেলো সে।জুঁই বিছানা থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসে।জুঁইয়ের শরীর মেজমেজ করছিল।দুদিন ধরে গোসল নেই।আজ গোসল করতে পারলে শরীর একদম ফ্রেশ লাগতো।আরাম পাওয়া যেতো।কিন্তু তার তো সাথে কোনো জামা কাপড় নেই।গোসল করে পরবে কি?জুঁই বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
-তুমি এতো সকালে উঠে পড়লে নাকি?জুঁই মুখ ঘুরিয়ে দেখে আনিকা।জুঁই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,,,
-হ্যাঁ,
-এতো সকালে উঠলে কেন?আরেকটু রেস্ট নিতে পারতে।
-সকালে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আবার অভ্যাস।বাড়িতে আমি সকাল সকাল ঘুম থেকেই উঠি।এখনতো অনেক বেলা হয়েছে।
-অহ আচ্ছা।খিদে লেগেছে?
-নাহ,,
-তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
-আসলে দুদিন ধরে গোসল করি না।তাই শরীর কেমন করছে।
-তাহলে এখন গোসল করে নাও।
-আমিতো সাথে কোনো জামা কাপড় আনি নি।গোসল করে পরবো কি তাই,,,,,,জুঁইয়ের কথা শোনে আনিকা বিছানা থেকে উঠে আলমারি খুলে একটা থ্রি-পিছ বের করে জুঁইয়ের সামনে এসে বলে,,
-আই থিংক আমার ড্রেস তোমার গায়ে খুবই ফিট হবে।এটা পরতে পারো।
-তোমার ড্রেস আমি পরবো?
-কেন?প্রবলেম আছে আমার ড্রেস পরতে???
-না না।তা বলি নি।কিন্তু তোমার এই ড্রেসটাতো অনেক দামী মনে হয়।তাই বললাম।আমি এটা পরলে কি তুমি পরে আর পরতে পারবে??
-শোন,এই ড্রেসটা দামী। কিন্তু কোনো মানুষের থেকে দামী না।আর তুমি পরলে যে এই ড্রেসটা আমি আর পরতে পারবো না এটাও ঠিক না।আমি দিচ্ছি তুমি পরবে।আর কথা বলো নাতো।যাও গোসল করে আসো।জুঁই ড্রেসটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো।তারপর মনে মনে বললো,,,,,
-এই মানুষগুলো কতো ভালো।এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে?আপনজনরা দূরে সরিয়ে দেয়।অবহেলা করে।আর দূরের অচেনা অজানা মানুষগুলো সাদরে কাছে টেনে নেয়।দুনিয়ার মানুষগুলো কতো অদ্ভুত। জুঁই ওয়াশরুমে ডুকে গোসল করে আনিকার দেওয়া ড্রেসটা পরে বাইরে বের হয়ে আসে।আনিকা জুঁইকে দেখে হা হয়ে যায়।অসম্ভব সুন্দর লাগছে জুঁইকে।আনিকা বুঝতে পারছে না আজ তার কেন জানি জুঁইকে দেখে হিংসা লাগছে।আনিকা জুঁইয়ের কাছে এসে বলে,,,,,
-ওয়াও,তুমি এতো সুন্দর কেন গো?মনে হচ্ছে ডানা কাটা পরী।আনিকার কথা শোনে জুঁই একটা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে বলে,,,,,
-তুমি কি কম সুন্দর?তোমাকে একদম হলিউডের নায়কাদের মতো লাগে।আমিতো তেমার কাছে কিছুই না।
-আমি নায়কাদের মতো।বাট তুমি অবিকল একটা পরী।হয়তো পরীর থেকেও সুন্দর।আমি তোমার মতো এতো সুন্দর মেয়ে কখনও দেখি নি।বিশ্বাস করো,তুমি যদি কোনো ধনী পরিবারে জন্ম নিতে তাহলে রাজকন্যা হয়ে থাকতে।
-তুমি বেশি বেশি বলছো।
-ঠিক আছে,তুমি অপেক্ষা করো আমি আসছি।আনিকা দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ডুকে যায়।দুমিনিটে ফ্রেশ হয়ে আসে।
-চলো,নিচে যাই।আম্মু তোমাকে দেখে কি বলে তাই জানতে হবে।
সকাল ৮টা বাজে।পরাগ অফিসের জন্য রেডি হয়ে সকালের ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং এ বসে আছে।সকালে না খেলে আয়েশা বেগম কিছুতেই ছেলেকে বাইরে বের হতে দিবেন না।তাই ব্রেকফাস্ট না করে কিছুতেই পরাগ বাইরে যেতে পারবে না।আয়েশা বেগম ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন।পরাগ বললো,,,
-আম্মু,আমার জরুরি কাজ আছে।একদিন না খেয়ে গেলে কি সমস্যা?বাইরে ব্রেকফাস্ট করে নিতে পারতাম।
-বাইরে তুই ব্রেকফাস্ট করবি না এটা আমি জানি।তাই তো তোকে না খাইয়ে ছাড়ি না।যতই কাজ থাকুক।খেয়ে তারপর বের হবি।
-তা তো জানি,যতক্ষণ আমি খাবো না ততক্ষণ তুমি আমাকে ছাড়বে না।দাও,খেয়ে আমি চলে যাই।বেশি সময় নাই।আয়েশা বেগম প্লেটে পরাগকে খাবার দিয়ে পরাগের সামনে চেয়ারটায় বসলো।পরাগ মুখে খাবার দিতে গিয়ে সামনে চোখ যেতেই চমকে উঠে।আনিকা আর জুঁই আসছে।পরাগ জুঁইকে দেখে মুখে আর খাবারটা দিতে পারলো না।খাবারটা হাতে নিয়ে জুঁইয়ের দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকে।কালো থ্রি-পিছে জুঁইয়ের ফর্সা চেহারাটা যেন অপ্সরীর মতো লাগছে।পরাগের মনে হচ্ছে অন্য কোনো গ্রহ থেকে নিশ্চয় ভুল করে এই মেয়ে তাদের বাসায় চলে এসেছে।অসম্ভব সন্দরী এই মেয়ে।সত্যি তাকে চাঁদ সুন্দরী বলা যায়।একটুকুও সাজে নি।তবুও তার সুন্দর্য তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছিল।এমন মেয়ের থেকে চোখ সরানো দায়।পরাগ কিছুতেই চোখের পলক ফেলতে পারছিল না।আয়েশা বেগমও জুঁইকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

চলবে———

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here