#চাঁদ_সুন্দরী

সুরমা
পর্ব : ২

অফিসে সারাদিন এতো কাটাকাটি করে পরাগ অনেক ক্লান্ত।তার উপর বাসায় ডুকতেই মায়ের কড়া শাসন।পরাগের মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্য এটা যথেষ্ট ছিল।পরাগ জুঁইকে জোর করে নিজের বুক থেকে সরিয়ে হাল্কা ধাক্কা দিলে জুঁই অনেকটা পিছিয়ে যা।পরাগ কাঁধ থেকে লেপটপের ব্যাগটা নিয়ে ডিল মেরে বিছানায় ফেলে দিয়ে অনেকটা রেগে বলে,,,,

-dmn it,,,সব কিছু আম্মুকে বলতে হয়?তোমার কোনো কমন সেন্স নেই?কোথায় কি বলতে হবে এটা এখনো শিখতে পারলে না?সব সময় এই বায়না ঐ বায়না করেই যাও।কোন সময় কোন বায়না পূরণ করিনি বলোতো???

আজ বিকালে আসতে পারিনি বলে এতো ঠং শুরু করেছো??আমার কোনো কাজ থাকতে পারে না??সব সময় আমাকে তোমার কথায় উঠতে বসতে হবে??তোমার এতো প্যারা আর নেওয়া যাচ্ছে না।বলতে পারো কি করলে আমি একটু শান্তি পাবো??

তোমাকে জাস্ট এখন আমি নিতে পারছি না।দয়া করে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।ঘরে বাইরে সব জায়গায় প্যারা।তুমি জাস্ট একটা পেইন।আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছো।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও।কথা গুলো পরাগ একদমে বলে ওয়াশ রুমে চলে যায়।পরাগ রাগে শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা লাগায়।জুঁই এতক্ষণ পরাগের কথা গুলো হা করে শোনছিল।

পরাগের এক একটা কথা যেন জুঁইকে মারাত্মক ভাবে আঘাত করে।কথা গুলো কলিজায় সুচের মতো ডুকেছিল।জুঁই কল্পনাও করতে পারে নি পরাগ তার সাথে এভাবে কোনোদিন কথা বলবে।জুঁইয়ের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়তে থাকে।জুঁই খেয়াল করেছে পরাগ কিছুদিন যাবৎ তাকে ইগনোর করছে। আগের মতো সময়ও দিচ্ছে না।বাসায় সময় মতো আসেও না।সারাদিনেও দুজনের কথা হয় না।পরাগ যখন বাসায় আসে তখন জুঁই প্রায় সময় ঘুমিয়ে যায়।

সকালেও তেমন কথা হয় না।পরাগ তাড়াহুড়া করে অফিসের জন্য বের হয়ে যায়।জুঁই কল করলে পরাগ কল রিসিভ করে হয় বলবে সে এখন বিজি আছে নয়তো হাজারটা কল দেওয়ার পরও রিসিভ করবে না।এভাবেই জুঁই আর পরাগের কিছুদিন ধরে চলছে।

জুঁইয়ের পাগল মন অস্থির হয়ে উঠেছিল পরাগের সঙ্গ পাওয়ার জন্য।কিন্তু পরাগ আজ যা বললো,এগুলো শোনার পর জুঁইয়ের মনটা কাঁচের মতো টুকরোটুকরো হয়ে গেছে।জুঁই কল্পনাও করে নি সে কখনও পরাগের কাছে পেইন হবে।জুঁইয়ের এতকষ্ট লাগছি যে, নিঃশ্বাসটাও সে নিতে পারছিল না।

দরজায় হেলান দিয়ে নিঃশ্বাসের উপর নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।এতকষ্ট কেন লাগছে তার।এক মুহূর্তে সারা দুনিয়া কেমন উল্টেপাল্টে গেলো।দুটো পা যেন ফ্লোরের সাথে আটকে গেছে জুঁইয়ের।জুঁইয়ের বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তার দম বন্ধ হয়ে গেলো।এই মুহূর্তটা হয়তো তার জীবনের শেষ মুহূর্ত।

মানুষ জীবনের সেরা সুখটা যার কাছ থেকে পায় কষ্টটাও হয়তো তার কাছ থেকেই পায়।জুঁইয়ের চোখ দুটি অন্ধকার হয়ে আসছিল।সব কিছু কেমন ঝাপসা লাগছিল।জুঁই কোনো রকম নিজের রুমের বাহিরে চলে আসে।পরাগ অনেক্ষণ ধরে ওয়াশরুমে শাওয়ার নেয়।এমনি মাথা প্রচুর গরম।নিজেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো পরাগ।

শাওয়ার শেষ করে রুমে এসে দেখে রুম ফাঁকা।পরাগ ব্যালকনিতে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।চোখ দুটি বন্ধ করতেই জুঁইকে বলা প্রত্যেকটা কথা কানে এসে বাজতে থাকে।পরাগের ভীষণ খারাপ লাগলো।এর আগে কখনও পরাগ জুঁইকে আঘাত দিয়ে কথা বলে নি।সব সময় নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।আজ কি করে এতগুলো কঠিন কথা বলে দিলো?

নিশ্চয় মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে।মেয়েটাযে বড্ড অভিমানিনী।পরাগ নিজেই এখন অনুশোচনায় ভুগছে।খুব খারাপ লাগছে পরাগের।পরাগ রুমে এসে দেখে জুঁই এখনো রুমে আসে নি।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১২টা।পরাগ জানে,জুঁইকে না নিয়ে আসলে এখন আর রুমেও আসবে না ।পরাগ নিজের রুম থেকে বের হয়ে দেখে তার মা ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে আছে।পরাগ একটু এগিয়ে গিয়ে বলে,,,

-তুমি এখনো ঘুমাও নি??
-তুই খাবি না?কখন থেকে খাবার নিয়ে বসে আছি।আয়,তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাকে ছুটি দে।আর কতো সময় এভাবে বসে থাকবো?পরাগ গিয়ে ডাইনিং এ বসে।

তার মা খাবার দিলে পরাগ খাবার খাওয়া শুরু করে।বারবার এদিক ওদিক দেখছিল।কিন্তু জুঁইকে কোথাও দেখতে পেলো না।পরাগ বুঝতে পারছে না জুই কার রুমে আছে।তার মায়ের রুমে নাকি বোনের রুমে।তার মায়ের কাছে জুঁইয়ের কথা জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না।কি মনে করবে,বা কি ভাববে।

লজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে।পরাগের খাওয়া প্রায় শেষ।তখন তার মা বলে,,
-জুঁই কি ঘুমিয়ে গেছে??মায়ের কথা শোনে পরাগ চমকে উঠে।তার মা জুঁইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছে।তার মানে জুঁই মায়ের রুমে নেই।পরাগ কি বলবে বুঝতে পারছে না।

এখন যদি মাকে বলে সে জুঁইকে হার্ড করে কথা বলেছে তাহলে তার মা আবার এটা নিয়ে তাকে বকাবকি করবে।তাই সে আমতা আমতা করতে থাকে।পরাগকে আমতা আমতা করতে দেখে তার মা বলে,,,,,

-এভাবে কথা বলছিস কেন??তোর জন্য মেয়েটা আজ কতো কাঁদলো জানিস?আর তুই এলি ১২টা বাজিয়ে।মেয়েটা সেই সকালে খেয়েছিল।এখনো না খেয়ে ঘুমিয়েছে।আর তুই তার কথা না জিজ্ঞাসা করেই খেতে শুরু করলি।জুঁই মিথ্যা কিছু বলে নি,,,,

তুই এখন বদলে গেছিস।একটা মেয়ে সারাদিন অপেক্ষা করলো তোর জন্য।আর তুই রাতে বাসায় এসে আবার একা একা খেয়ে ফেললি।মেয়েটার কথা একবারো জিজ্ঞাসা করলি না।পরাগ তার মায়ের কথা শোনে থমথম খেয়ে যায়।সত্যি তো,এটা তার ভুলেই হয়েছে।তার উচিত ছিল জিজ্ঞাসা করার জুঁই খেয়েছে কিনা।

এবার পরাগ নিজের উপর রাগ লাগলো।ইদানীং সত্যি সে এতো বিজি হয়ে গেছে যে সারাদিনেও জুঁইয়ের খোঁজ খবর নিতে পারছে না।জুঁই তাহলে অকারনে তার উপর রাগ করে নি।এমনি বয়স অনেক কম।এই সময় আরো মন আবেগে ভরপুর থাকে।জুঁইতো সেরকমেই একজন।কথা গুলো মাথায় আসতেই পরাগের খুব খারাপ লাগলো।

বাকি খাবারটা আর পরাগের পেটে গেলো না।পরাগ হাত ধুয়ে উঠে পড়লো।তার মা সব কিছু গুছিয়ে নিজের রুমে চলে গেলে পরাগ এসে একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে নিজের রুমে রেখে আসে।তারপর পরাগ তার বোন আনিকার রুমে চলে যায়।পরাগ আনিকার রুমে গিয়ে দরজায় নক করতেই আনিকা এসে দরজা খুলে দেয়।এই সময় পরাগকে নিজের রুমে আসতে দেখে আনিকা বলে,,,

-ভাইয়া,তুই এতো রাতে আমার রুমে???কিছু বলবি??
-জুঁইকে ডেকে বল রুমে আসতে।আমি ডাকছি।পরাগের কথা শেষ হলে আনিকা অবাক হয়ে বলে,,,,
-ভাবীকে কোথায় বলতো?ভাবীতো আমার রুমে নেই।

-নেই মানে?জুঁই তোর রুমে না আসলে কোথায় গেলো ??
-কোথায় গেলো মানে কি?ভাবীর তো তোর রুমে থাকার কথা।পরাগ আনিকার রুমে ডুকে দেখে সত্যি জুঁই আনিকার রুমে নেই।পরাগ আনিকার দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,

-জুঁই আমার রুমেও নেই।আম্মুর কথা শোনে মনে হলো আম্মুর রুমেও নেই।তাহলে গেলো কোথায়?
-কি হয়েছে বলতো?পরাগ আনিকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা তার মায়ে রুমে চলে আসে।পিছন পিছন আনিকাও আসে।পরাগ তার মায়ের রুমে গিয়ে নক করলে তার মা এসে দরজা খুলে দিয়ে দেখে পরাগ আর আনিকা দাঁড়িয়ে আছে।পরাগ তার মাকে বলে,,,,,

-আম্মু,জুঁইকি তোমার রুমে??
-জুঁই আমার রুমে থাকবে কেন?সেতো দিন থেকে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে কান্না করছিল।কতবার ডাকলাম।কিন্তু দরজা খুলে নি।তুই আসার পর দরজা খুলেছিল।তারপর তো আমি আর তোর রুমে যাই নি।কেন?জুঁই রুমে নেই???

-না,আমি যখন আসলাম তখন তো রুমেই ছিল।কিন্তু তারপর রুম থেকে বের হলো।এখনও আসে নি।আমি তো মনে করলাম আনিকার সাথে আছে।
-এতো রাতে যাবে কোথায়?দেখ হয়তো অন্য রুমে আছে।তোর উপর হয়তো রাগ করেছে।

-হু,আচ্ছা,দাঁড়াও আমি দেখছি। পরাগ একে একে সব রুম দেখলো। ছাদে গিয়েও দেখলো।কিন্তু কোথাও জুঁইকে দেখতে পেলো না।পরাগ যেই বাসা থেকে বের হবে অমনি তার মা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে,,,,

-সত্যি করে বলতো তুই জুঁইকে কি বলেছিস?এমনি এমনিতো সে বাসা থেকে বের হয়ে যায় নি?তুই বিকালে আসিস নি শুধু যদি এই কারনটা হতো তাহলে তো আমার রুমে নয়তো আনিকার রুমে যেতো।বাসা থেকে বের হতো না।এর মধ্যে নিশ্চয় অন্য কোনো কারন আছে,আমাকে বল কি হয়েছে?

মায়ের কথা শোনে পরাগ মাথা নিচু করে ফেলে।কিন্তু কিছু বলতে পারলো না।কি করে বলবে সে জুঁইকে এই সব কথা গুলো বলেছিল?পরাগকে এভাবে থাকতে দেখে পরাগের মায়ের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ব্যাপারটা কি হতে পারে।তিনি রাগে ঠাস করে পরাগের গালে একটা চড় বসিয়ে দেন।

চড়টা এত জোরেই লাগে যে পরাগের গালে আঙ্গুলের দাগ বসে যায়।পরাগ একটা ফ্রিজডের মতো হয়ে যায়।এতটুকু বয়সে কোনোদিন তার বাবা মা তার গায়ে হাত তুলে নি।এই প্রথম তাকে তার মা মেরেছে।যদিও মারার যথেষ্ট কারন ছিল।পরাগের মা বলে,,,,,

-এতরাতে মেয়েটা কোথায় গেলো?মেয়েদের কতো রকম বিপদ রাস্তায় বের হলেই।এখতো আরো রাত।আল্লাহ জানে মেয়েটা কোথায় কি করছে।ছোট মানুষ।না বুঝে হয়তো কোনো ভুল করতেই পারে।তাই বলে তুই ওকে বকবি?

বুঝিয়ে বলা যেতো না?আমি যখন বউ হয়ে এসেছিলাম তখন তো আমি কিছুই বুঝতাম না।ভাত গুলোও নিয়ে খেতে পারতাম না।কিন্তু তোর বাবা কোনোদিন আমার উপর রাগ দেখায় নি।সব কিছু বুঝিয়ে দিতো।অনেক কাজ তো নিজেও করে দিতো।আর তুই কি করলি?হুম?জুঁই আমার ঘরের লক্ষ্মী। যেখান থেকে পারিস জুঁইকে নিয়ে তবেই বাসায় আসবি।না আনতে পারলে তোরও আর বাসায় আসার দরকার নাই।কথাগুলো বলে পরাগের মা রুমের ভেতরে ঢুকে গেলে পরাগ বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

চলবে———

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here