“চরিত্রহীনের পুত্র, এবং পরিজনেরা”
(স্বাগতা)

‘ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলেন সিমিনের দাদী, “সংসার? এটা সংসার? কয়টা আসবাবপত্র থাকলে আর কয়জন মানুষ এক ছাদের নিচে থাকলেই সংসার হয় রে মা? যেই সংসার সংসার করে তুমি মরছো, তোমার স্বামীর সেই সংসারের প্রতি কোনও দায়িত্ববোধ আছে? সে সংসার বোঝে? কবুল বললেই স্বামী হওয়া যায় না… আর বাচ্চা জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায় না…”‘

(তৃতীয় অংশঃ)
সিমিন ঢাকার এক নামকরা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। পেছনে ফিরে তাকালে ওর ভাবতেও অবাক লাগে যে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসে আজ এই পর্যায়ে ও পৌঁছালো কি করে! জামিল আর জামিলের মা না থাকলে এই পথটা পাড়ি দেয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। বাপের অপকর্মের ইতিহাস ঢাকতে ওর বাবা-মা তো তড়িঘড়ি ওর বিয়ে দিয়েই খালাস! ওর মামা-ফুফু সকলে না করেছিলো মেয়ের বিয়ের জন্য তাড়াহুড়া করতে, কিন্তু ওর বাবা, বিশেষ করে ওর মা কিছুতেই মানেন নি। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে মেয়ের বিয়ে এরপরে আর হবে না, যদি তাঁর স্বামীর যাবতীয় কীর্তি সামনে আসে। এটা ভাবতেও নারাজ ছিলেন তিনি যে, বিয়ের পরে জানলেই বা কি হবে তাঁর মেয়ের জীবনে! মেয়ের জীবন রক্ষা করছেন নাকি মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, সেই হিসাব করার মতো মানসিক স্থিতি তাঁর ছিলো না। এটা স্রেফ ওর ভাগ্য আর সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা যে জামিলের মতো ছেলের হাতে হাত পড়েছে ওর।
জামিলরা দুই ভাই বোন। সিমিন আর সোহেলের মতোই। জামিলের বড় বোন, শাহিনা আপা, উনিও স্কুল শিক্ষিকা। ওদের বাবা মারা যাবার পরে এক হাতে ওদের মা দুই ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন সামান্য যে জমিজমা ছিলো তারই উপর ভরসা করে। দুই ভাইবোনই ওরা মায়ের কষ্টের মান রেখেছে। পরিশ্রম করেছে, নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। শাহিনা আপার সাথে সিমিনের সম্পর্ক ভীষণ আন্তরিক যেমন বলা যাবে না, আবার শীতলও বলা যাবে না। উনি আসলে মানুষটাই ওইরকম। কারও সাথেই খুব বেশি ইনভল্ভড হবেন না, আবার কারও পেছনে লাগা বা ক্ষতি করার মতো কোনও কাজেও উনি নেই। সাতে পাঁচে না থাকার মতো মানুষ আর কি। দু’টো মেয়ে, দু’টোই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এখন। জামিলের সাথে উনার বয়সের পার্থক্য বছর ৫ এর। তবে ভাই-ভাইবউয়ের সঙ্গে যেমনই হোন না কেন, আলো একেবারে তার কলিজার টুকরো।
জামিল সিমিনের চাইতে প্রায় ৮/৯ বছরের বড়। ডাক্তারি পাশ করার পর আরও কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলো ও, কিন্তু মায়ের চাপাচাপিতে করে ফেলতে হয়েছে। সিমিনের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আনেন ওর মামাশ্বশুর, সিমিনের ছোটো মামা, উনিও ডাক্তার, জামিল ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যে হাসপাতালে কাজ করতো, সেখানকারই সিনিয়র কন্সাল্টেন্ট। বিয়ের এতো বছর পরে বোঝে জামিল যে ভাগ্নির বিয়ের কথাবার্তা চালাচ্ছে উনার বোন আর বোনের জামাই, এটা জানার পরেই উনি একরকম ভাগ্নিকে উদ্ধার করার জন্যই জামিলের সাথে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখেন। সিমিনের মা-বাবাও আর ডাক্তার জামাই পেয়ে এদিক ওদিক বিশেষ চিন্তা করেন নাই। সিমিনকে দেখতে গিয়ে ওর বিষন্ন, বেদিশা মুখটা আজও মনে পড়ে জামিলের। ওদের যখন একলা কথা বলতে দেয়া হলো, ও শুরুতে ভেবেছিলো সিমিনের কোনও সম্পর্ক আছে হয়তো, সেইজন্য অমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। অনেক পরে, ধীরে ধীরে বুঝেছে এর কারণ। বহুদিন লেগেছে সিমিনের ওর সাথে সহজ হতে। ওকে বিশ্বাস করতে।
জামিলের নিজের একটা সহজ ব্যক্তিত্ব আছে। একটু গম্ভীর প্রকৃতির, কিন্তু রূঢ় না সে। বরং ভীষণ বুঝদার একটা মানুষ। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পরে মায়ের যুদ্ধটা খুব কাছে থেকে দেখেছে বলে নারী জাতির প্রতি এক পরম শ্রদ্ধা আর মমত্ববোধ নিয়ে বড় হয়েছে ও। অবশ্য ওর মা বলতেন যে ওর বাবাও এমনই ছিলেন। যেমন ছিলেন নিজের মায়ের ব্যাপারে পাগল, তেমনই নিজের স্ত্রীর সমস্ত প্রয়োজনের প্রতি সুচারু খেয়াল ছিলো তাঁর। বাবা মারা যাবার পরেও বাবার প্রতি মায়ের যে গভীর ভালোবাসা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছে জামিল, সেখান থেকেই ওর নিজের ভেতরেও গেঁথে গিয়েছিলো যে ওর স্ত্রীও একদিন ওকে এইভাবেই ভালোবাসবে। আর সেই ভালোবাসাটা অর্জন করতে সে সক্ষমও হয়েছে সিমিনের কাছ থেকে।
বয়সের পার্থক্য নিয়ে শুরুতে একটু অস্বস্তিতে ছিলো জামিল, আজকের যুগে এতোটা গ্যাপে বিয়ে করতে রাজী ছিলো না ও। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যার সাথে যার জুড়ি লিখে রাখেন তাকে খন্ডায় কে? বিয়ের পরে তাই সিমিনের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ওকে যৌথ জীবনে খাপ খাইয়ে নিতে সবরকমের সাহায্য করেছিলো জামিল। বুদ্ধিমান জামিলের বুঝে নিতে খুব কষ্ট হয় নি যে সিমিন ভেতরে ভেতরে কোনও কারণে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ও আর দশটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক নেই। সেই কারণ জানার জন্য কোনও ধরণের চাপাচাপি না করে ও বরং নজর দিয়েছিলো জীবনে সামনের দিকের পজিটিভ দিকগুলো সিমিনের সামনে তুলে ধরার ব্যাপারে। সিমিন মেধাবী, অথচ ইন্টারের রেজাল্ট ভালো ছিলো না ওর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার মতো ন্যুনতম গ্রেডটুকু ছিলো শুধু ওর। তাও প্রথমবারের চেষ্টায় কোথাও ভর্তি হতে পারে নি সিমিন। জামিল পুরো সময়টা ওর সাথে থেকে, ওকে সময় দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, পড়ায় সবরকমের সহযোগিতা করে, কোচিং করিয়ে অবশেষে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ওকে সফল করতে পেরেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছে সিমিন। আর তারপর আর ফিরে তাকাতে হয় নি অবশ্য ওকে। পড়ালেখার মধ্যে আবার নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলো সিমিন। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে একের পর এক ভালো রেজাল্ট করে গেছে। তারপর সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা, আর এখন আজকের এই অবস্থানে ওরা দু’জন।
জামিলের মা চলে গেছেন আজ দু’বছর হলো। যতোদিন ছিলেন ছেলের কাছেই ছিলেন। সিমিনের সাথে সহজ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো উনার। বরাবর উৎসাহ দিয়ে গেছেন ওকে পড়ালেখার জন্য। বলতেন, “আমার ছেলে ডাক্তার, তুমি কি ইন্টার পাশ করে বসে থাকবা নাকি, মা? পড়ো পড়ো… নিজের জন্য পড়ালেখা খুব দরকার… অন্য কারও জন্য না… আমি আমার এক মেয়েরে দাঁড় করায় দিসি, আরেক মেয়েরে পারবো না নাকি?… তুমি পড়ো… যদ্দুর পর্যন্ত পড়তে চাও পড়বা…”। সিমিনও উনাকে আঁকড়ে ধরেছিলো সন্তানের মতোই। শাহিনা আপার বাসায় গিয়ে যখন থাকতেন, জামিলের চাইতে সিমিন বেশি অস্থির হয়ে যেতো উনাকে না দেখলে।
বিবাহিত জীবনের প্রায় ৮-৯ বছর পর আলোর জন্ম। ওদের কারোই কোনও সমস্যা ছিলো না, কিন্তু জামিল নিজেই চায় নি সিমিন পরিপূর্ণভাবে নিজের উপর আস্থাশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং সাবলম্বী একজন নারী হয়ে ওঠার আগে সন্তান আসুক। সবাই বলছিলো যে জামিলের বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তারপরেও সে চায় নি যে তার স্ত্রী মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত না হয়ে মা হোক। ট্রমা থেকে বের হয়ে আসতে সিমিনের যে সময়টুকু প্রয়োজন ছিলো, তার পুরোটাই জামিল ওকে দিয়েছে। এমন কি ওর মা কিছু জিজ্ঞেস করলেও জামিল উত্তর দিতো, যে সন্তান আসবে তার জন্য সুস্থ, মনের দিক থেকে শক্তিশালী, ধৈর্য্য এবং ধীশক্তি সম্পন্ন একজন মায়ের প্রয়োজন। মা ঠিক না থাকলে সন্তানের বিকাশ এবং বেড়ে ওঠা ঠিকঠাক হবে না। সুতরাং সিমিনকে সেই সময়টা দেয়া উচিৎ। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জামিল বলতো, “তুমি যেমন বুদ্ধিমতী এবং বিবেচক একজন মা! তোমার কারণেই আমি আর আপা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। আর তুমি আমাদের তৈরি করতে পেরেছো কারণ আব্বু তোমাকে সেই সাপোর্টটা দিয়ে গেছেন যতোদিন বেঁচে ছিলেন, এমনকি এখন যখন আব্বু নেই, তখনও তিনি তোমার সাপোর্ট হয়েই আছেন। আমি আমার স্ত্রীকেও প্রস্তুত হওয়ার সেই সুযোগটা দিতে চাই আম্মু!… যাতে আমার সন্তান, ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, সে একটা সুস্থ জীবন পায়… বড় হওয়ার পথটা, মানুষ হওয়ার রাস্তাটা যেন তার জন্য সহজ হয়ে যায়…”। ছেলের কথায় মনের মেঘ কেটে যেতো তার মায়ের। হেসে ছেলের মাথায় আশীর্বাদের পরশ বুলিয়ে দিতেন তিনি। সিমিন যখন বিয়ে হয়ে তাঁর কাছে আসে, তখন তিনি নিজেও তো খুব কাছে থেকেই দেখেছেন মেয়েটার বেদিশা কষ্টটা! বিন্দুমাত্র আত্মবিশ্বাসহীন, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, সমস্ত কিছুতে ভয় পাওয়া, ভঙ্গুর একটা মেয়ে ছিলো সে! সন্তানের জন্য সিমিন নিজেও যে দুই একবার যে মন খারাপ করে নি তা না, আশেপাশের লোকের কথায় বহুবারই ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেছে ওর, তবে আলো যখন এলো, তখন ওদের সব মন খারাপগুলো যেন উড়ে গেলো, সমস্ত না পাওয়াগুলো যেন এক নিমেষে পাওয়া হয়ে গেলো। আলোকে দেখে, ওর ৩ বছর বয়সে সিমিনকে শোকে ভাসিয়ে বিদায় নেন ওর শ্বাশুড়ি মা।
আজকে খাতা দেখতে বসেও বার বার মন ছুটে যাচ্ছিলো সিমিনের। অতীত-বর্তমান মিলিয়ে নানান চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে মন। মায়ের সাথে তখন ওরকম করে কথা না বলে রেখে দিয়ে মনটা খারাপও লাগছে একটু। হাজার হলেও নিজের মা। মা হয়ে উনি না বুঝলেও সন্তান হিসেবে সিমিন তো জানে মায়ের কাছে যাওয়ার বা মায়ের একটু শারীরিক বা মানসিক নৈকট্য পাওয়ার জন্য ওর কেমন লাগে। আলো যতোবার ওর কোলের মধ্যে এসে মুখ গুঁজে দেয়, ততোবার ওর নিজের মায়ের কোলের মধ্যে গিয়ে গুঁজে শুতে ইচ্ছে করে। যতোবার ওর মেয়ে এসে গায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়ায়, আধো আধো বুলিতে আবদার শোনায়, ততোবার ওর মায়ের গায়ের ঘ্রাণ নেয়ার জন্য প্রাণ আনচান করে। কিন্তু মায়ের সাথে মিষ্টিমধুর স্মৃতিগুলো ওর আটকে আছে সেই কোন সুদূর অতীতে! যতো দিন গেছে ততোই ওদের ভাই-বোনের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন ওদের মা। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা জুড়ে আছে শুধু সাজ্জাদ সাহেব। সোহেলও যে একই কষ্টে ভোগে সিমিন সেটা জানে। কিন্তু শায়লা কি কিছু বোঝেন? তাঁর জগৎ আবর্তিত হয় এক সাজ্জাদ সাহেবকে নিয়ে। তিনি সন্তান অন্তপ্রাণ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু, সাজ্জাদ সাহেব এমন একটা চরিত্র এদের প্রত্যেকের জীবনে, যে একে অপরের সংস্পর্শে এরা সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকে উনার চিন্তায়। সুস্থ, স্বাভাবিক সম্পর্ক তাদের ৪ জনের ভেতর কখনও গড়েই ওঠে নি। সিমিন জানে সিমিন কেন ফোন কেটে দিয়েছে, কথা বাড়ালেই শুরু হবে শায়লার নাকে কান্না আর আহাজারি, হয় বলবেন ‘তোরা কেউ আমাকে বুঝিস না… ছেলেটাও কথা শোনে না…’, আর নাহয় শুরু করবেন, ‘জানিসই তো তোর বাবার একটু সমস্যা আছে… তার জন্য কি তাকে ছেড়ে চলে যাবো?… লোকটার তো আমাকে ছাড়া চলে না!…’, অথবা, ‘আমি আর পারবো না… এবার তোরা কিছু কর!… এই বয়সে এসেও এই রকম অপমান আর সহ্য হয় না… সারাটা জীবন যন্ত্রণা সহ্য করে গেলাম আমি… আবার আরেক বেটির পাল্লায় পড়সে তোর বাপ…’।
দিনে দিনে সিমিন বুঝেছে সারা জীবন সাজ্জাদ সাহেবের এই চারিত্রিক দোষের সাথে বসবাস করতে করতে ওর মায়ের এক ধরণের মানসিক সমস্যা হয়ে গেছে। তিনি নিজেই নিজেকে মিথ্যা স্বান্তনা দেন, নিজের কল্পনাতেই নিজেকে অপরিহার্য করে তোলেন স্বামীর জন্য, আবার নিজেই বাস্তবে ফিরে মাথা কোটেন। নিজেই সারাক্ষণ স্বামীকে সন্দেহ করছেন আবার নিজেই তাঁকে ভেবে নিচ্ছেন পৃথিবীর সব চাইতে বিশ্বস্ত পুরুষ হিসেবে। আচরণ উন্মাদের মতো নয় বলে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে দেয়ার কথা কেউ ভাবে না, কিন্তু কোনভাবেই তাঁকে স্থির বুদ্ধির মানুষ বলা যাবে না। সাজ্জাদ সাহেবের ব্যাপারে তাঁর এক ধরণের অবসেশন কাজ করে, এটা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ওরা দুই ভাই বোন দেখে আসছে। শুধু ওরা না, আত্মীয়-স্বজন সবাই এ কথা জানে। যে মানুষটা কোনদিন পুরোপুরি তাঁর হয়ই নাই, সেই মানুষটাকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তিনি। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চান যে তাঁর জীবনে তিনিই অদ্বিতীয়। যেখানেই যাক, যতো মেয়ের কাছেই যাক, দিনের শেষে সেই তাঁর কাছেই তো ফেরেন! স্বামীর নামটা তো তাঁর নামের সাথেই জোড়া! অন্য কোনও নারী সেটা তো কেড়ে নিতে পারছে না! সেটাই শায়লার কাছে বিরাট পাওয়া, বিশাল অহঙ্কার! তাঁকে বোঝাতে পারে নি তাঁর মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই, ছেলেমেয়ের কথা তো বাদই। যে মানসিক শক্তিটা একজন মানুষের দরকার সত্যটার সামনাসামনি হয়ে একটা এ্যাবিউজিভ আর টক্সিক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার জন্য, সেই মানসিক শক্তিটা কখনোই তাঁর ছিলো না।
সিমিনের ঘোর ভাঙলো জামিলের কথায়, “রাতের জন্য কিছু রান্না করবা? সোহেল আসলো এতো দিন পর…”
স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে উত্তর দিলো সিমিন, “মুরগি ভিজিয়েছি। পেঁপে আছে, পেঁপে দিয়ে পাতলা ঝোল করবো… জ্বরের মধ্যে গুরুপাক কিছু দেয়া ঠিক হবে না… আর ওই বেলার রান্না করা সবজি, মাছ, সবই তো আছে… যদি ওর মুখে ভালো লাগে, খাবে…”।
সিমিনের কথার যৌক্তিকতা বুঝে আর কথা বাড়ালো না জামিল। সোহেল আসলেই ভালোমন্দ রান্না করে সিমিন, অথবা জামিল বাহির থেকে কিছু কিনে আনে, কিন্তু আজকে সোহেলের শরীরটা খারাপ যেহেতু, একটু হালকা খাবারই ভালো হবে ওর জন্য। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সিমিন হাতের কলমের খাপটা আটকে খাতাগুলো গুছিয়ে রেখে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। জামিল পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলো, “আমার কোনও হেল্প লাগলে বলো, সিমিন…”।
যেতে যেতে ঘুরে তাকালো সিমিন, মিষ্টি, শান্ত একটা হাসি দিলো, এই হাসিটা সম্ভবত একটা মেয়ে সেই সময়েই হাসে যখন তার জীবনসঙ্গী সত্যিকার অর্থেই তার ভালোমন্দ সব কিছুর সাথী হয়ে উঠতে পারে। ওর স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বললো, “লাগবে না… তুমি মেয়েকে দেখো… লাগলে ডাক দেবো…”।
মুরগি কেটে-ধুয়েই তোলা ছিলো ফ্রিজে। ঝামেলা নেই বিশেষ। মুরগির সাথে আদা-রসুন বাটার বক্স বের করে রেখেছিলো, সেগুলো ফ্রিজের জমাট ভাবটা কেটে নরম হয়েছে কিনা একবার দেখে নিয়ে পেঁয়াজ আর পেঁপে কেটে রান্নার জোগাড় করতে লাগলো সিমিন। সেই সাথে মনে চলছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব কিছুর মিলানো এলোমেলো চিন্তা।
***
মা-বাবার ঝগড়া আর পারষ্পরিক দোষারোপের মধ্য দিয়েই সিমিন আর সোহেলের জানা হয়ে গেছে তাঁদের বিয়ের ইতিহাস। শায়লারা দুই ভাই, দুই বোন। ভাইবোন সবার মধ্যে শায়লা মেজো। শায়লার পরে একজন ভাই, আর সবার ছোট আরেক বোন। বাবার ব্যবসা ছিলো। ১৭ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন বড় ভাই, আতিফের বন্ধু সাজ্জাদকে। সাজ্জাদ ছিলেন আতিফের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু বলা যাবে না অবশ্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন দু’জন। সাবজেক্ট এক না, তবে হলে রুমমেট ছিলেন তাঁরা। ইয়ারমেট এবং রুমমেট হওয়াতে ঘনিষ্ঠতা ছিলো, কিন্তু হরিহর আত্মা বলা যাবে না তাঁদের। সাজ্জাদ শায়লাকে বুঝিয়েছিলেন যে বড় ভাই জানলে কখনোই তাঁদের সম্পর্ক মেনে নেবেন না, বরং তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট হবে। সারাজীবন মিথ্যা বলে আসলেও, জীবনের শুরুতে এই একটা সত্য কথা সাজ্জাদ বলেছিলেন শায়লাকে। তাও আংশিক। বুঝিয়েছিলেন যে বিয়ে একবার হয়ে গেলে তো শুধু বন্ধু না, তখন সাজ্জাদের সম্বন্ধী হয়ে যাবেন শায়লার বড় ভাই, তখন আর মনোমালিন্যের অবকাশ থাকবে না।
আর এটাও সত্য ছিলো যে জানতে পারলে আতিফ কখনোই এই সম্পর্ক মেনে নিতেন না। কারণ বন্ধুর মতিগতি সম্পর্কে ভালোই ধারণা ছিলো তাঁর। সাজ্জাদ ভালো ঘরের ছেলে, তিন বোনের এক ভাই, বড় দুই বোন আর ছোট একজন। বাবা সরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। সাজ্জাদের বাবার ঠিক চরিত্রের দোষ না থাকলেও একটু উড়নচন্ডী স্বভাব ছিলো। একটু যে এদিক ওদিকে যাওয়ার অভ্যাস ছিলো না সেটাও বলা চলে না। আতিফ যে দুই একবার সাজ্জাদের বাসায় গিয়েছেন সাজ্জাদের সঙ্গে, তখনই দেখেছেন। ঢাকাতেই পোস্টিং ছিলো সাজ্জাদের মুখেও দুই একবার শুনেছেন ওর বাবার জুয়ার নেশার এবং অন্যান্য দোষের কথা। ফলাফলস্বরূপ, ভালো চাকরি হওয়া সত্ত্বেও, সাজ্জাদদের পরিবারে টানাটানি একটু হলেও লেগেই থাকতো। কোনও সেভিংস যে ছিলো না তাদের, সেটাও বোঝা গেলো যখন সাজ্জাদের মায়ের গলব্লাডার অপারেশন হলো। সাজ্জাদ তখন থার্ড ইয়ারে। অবশ্য আতিফদের বাসার জামাই হয়ে বসেছে সে ততোদিনে। বেয়াইবাড়ির সম্মান রাখতে শায়লার বাবাই সব খরচ পরিশোধ করেছিলেন সাজ্জাদের মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও।
তবে সাজ্জাদের মা’কে খুব পছন্দ করতেন আতিফ। সাজ্জাদের বাসায় গিয়েও দেখেছেন, আবার হলে ছেলের জন্য খাবার-টাবার এনে দেখা করতে এসেছেন যখন, তখনও দেখা হয়েছে শায়লার বিয়ের আগেই। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। সাজ্জাদের বাবার মতো পুরুষ মানুষকে সামলে মেয়েদের মানুষ করেছেন কোঠর হাতে। কিন্তু পেরে ওঠেন নি সাজ্জাদের সাথে। উনার পক্ষপাতিত্ব বা প্রশ্রয় কিছু ছিলো কিনা একমাত্র ছেলের প্রতি নাকি পুরোটাই রক্তের দোষ সে বিচার করতে যাওয়া এখন অবান্তর। সাজ্জাদ শিক্ষিত হয়েছেন, কিন্তু মানুষ হন নি।
সাজ্জাদের শায়লাকে বিয়ে করার মূল কারণ শায়লার বাবার টাকা। সেটা শায়লা না বুঝলেও তাঁর মা-বাবা বা বড় ভাইয়ের সেটা বুঝতে মোটেও দেরি হয় নি। শায়লা যখন বিয়ে করেন তখন তাঁর ছোট ভাইয়ের বয়স ১৩ আর একদম ছোট বোনটার বয়স মাত্র ১১, সুতরাং সংসারের কূটকাচালি বোঝার মতো বয়স তখন তাঁদের ছিলো না। সরকারি চাকরিজীবীর ছেলে সাজ্জাদ, ছোটবেলা থেকে অভাব না দেখলেও প্রাচুর্য্যও উপভোগ করতে পারেন নি। সেই কারণেই বড়লোক বন্ধু আতিফের বোন শায়লা ছিলেন তাঁর টার্গেট। মধ্যবিত্তের যে স্বাভাবিক আত্মসম্মানবোধ থাকে গাঢ়, সেটা যে কোনও কারণেই হোক, অনুপস্থিত ছিলো সাজ্জাদের মধ্যে। আতিফরা হলো সেই আমলের শিক্ষিত, ধনী পরিবার। ব্যবসা তাঁদের কয়েক পুরুষের। দেশের প্রধান শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম না হলেও শায়লার বাবা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাকেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে আরও বাড়িয়ে তুলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেদের অবস্থান। ওদের ধানমন্ডির মতো জায়গায় বিশাল জায়গা নিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, গাড়ি, হাল ফ্যাশানের কাপড়-চোপড়, এই সমস্ত কিছু দেখেই সাজ্জাদের মনে গেঁথে গিয়েছিলো যে যে কোনও উপায়ে এই পরিবারে ঢুকতে হবে, এই সুখ আর স্বচ্ছলতার ভাগ নিতে হবে।
এমন না যে সাজ্জাদ খুব দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। তবে হিসেবের জীবন তাঁর কখনোই ভালো লাগে নি। বাবার মতোই উশৃঙ্খল স্বভাবের জন্য, আর সহজ পথে সব কিছু হাসিল করার তাড়নায় তাই তিনি বন্ধুর বোনকে প্রেমের ফাঁদে ফেললেন। আতিফ আগে থেকেই সাজ্জাদকে খুব একটা বাসায় আনতে চাইতেন না। ঘরে সোমত্ত বোন আছে, সেটাই ছিলো তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ। তিনি জানতেন সাজ্জাদের স্বভাব। রাজশাহীতে হাত খরচ চালানোর জন্য টিউশন পড়াতেন সাজ্জাদ। আর ছাত্র না হয়ে যদি ছাত্রী হতো, আর কোনক্রমে তার বয়স যদি ১৫-১৬ এর কাছাকাছি হতো, তাহলেই সাজ্জাদের খেল শুরু হয়ে যেতো। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আতিফ দেখতেন টিউশন পড়ানোর প্রাপ্তি সেই আমলের সেই সামান্য টাকা আবার সেই সমস্ত প্রেমিকাদের উপরেই খরচ করে ফেলতেন সব সাজ্জাদ, তারপর আবার সেই বাচ্চা মেয়েদের কাছেই টাকা চাইতেন মাসের শেষে, আর ঘরে মা-বাবার উপর চোটপাট তো আছেই, আরও কিছু হাতখরচ বাড়িয়ে দেবার জন্য।
এসমস্ত কিছু দেখেই আতিফ চেষ্টা করতেন কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে চলতে সাজ্জাদের সাথে। কিন্তু সাজ্জাদ নাছোড়বান্দা। সুযোগ পেলেই আতিফের সঙ্গে চলে আসতেন আতিফদের বাসায়। অতি ভদ্র আতিফ সাথে আসতে চাইলে আর সাজ্জাদকে মানা করতে পারতেন না স্বাভাবিকভাবেই। এর মধ্যেই কোন ফাঁক দিয়ে শায়লার সাথে তাঁর মন দেয়া নেয়া হয়ে গেলো। আতিফের সাবধানতা কাজে আসলো না। তিনি বলেছিলেন বোনকে একবার কথাচ্ছলে, যে সাজ্জাদ এক সাথে অনেকগুলো প্রেম করে। নিজের প্রাইভেট পড়ানো ছাত্রীদের সাথেই করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শায়লা নিজের ভাইকে বিশ্বাস না করে বিশ্বাস করেছিলেন সাজ্জাদের কথা। সাজ্জাদ তাঁকে আরও আগেই বুঝিয়ে রেখেছিলেন যে আতিফ কোনও কারণে টিউশন করানোটাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। আতিফ নাকি কনজারভেটিভ, তাই সাজ্জাদ যে মেয়েদের পড়াতে যায়, সেটা সে পছন্দ করে না। আর তাছাড়া আতিফের তো কখনও সেভাবে অর্থনৈতিকভাবে যুদ্ধ করতে হয় নি, তিনি কি করে বুঝবেন! মাসের শেষে দু’টো পয়সাও যদি মায়ের হাতে দেয়া যায়, কতোটা শান্তি তাতে! নিজে যা করতেন, সাজ্জাদ ঠিক তার উল্টোটাই বুঝিয়েছিলেন ষোড়শী, জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ আর সদাসর্বদা বিলাসিতার মধ্যে থাকা, রঙিন কল্পনায় বুঁদ শায়লাকে। আতিফ যখনই সন্দেহ করলেন যে তাঁর বোন সাজ্জাদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে, তখনই বোনকে নরমে-গরমে খুব ভালো করেই সাজ্জাদের স্বভাব সম্পর্কে সাবধান করলেন। কিন্তু শায়লা ঠিক তার কয়েক দিন পরেই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বাড়ি ফিরলেন। হলিক্রস কলেজে সবে তখন ভর্তি হয়েছেন। কলেজ পালিয়ে চলে গেলেন কাজী অফিসে, বয়স বাড়িয়ে দেখিয়ে, বিয়ে করে একেবারে গলায় মালা পরে সাজ্জাদের সাথে এসে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালেন। তাঁর বয়স তখন ১৬ থেকে ১৭ তে পড়েছে কেবল। আর সাজ্জাদের ২০-২১। শায়লার তো নয়ই, সাজ্জাদ নিজেও তখন কেবল অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, পড়া শেষ হতে তখনও অনেক দেরী।
শায়লার বাবা বিচক্ষণ মানুষ। পাকা ব্যবসায়ীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি তাঁর। মানুষ পড়তে ভুল হয় না সহজে। আতিফ উনাকে আগে থেকে কিছু না বললেও মাত্র দুই একবারের দেখাতেই সাজ্জাদকে চিনে নিতে উনার কষ্ট হয় নি। তাঁর এই মেয়ে যে আজীবন ভোগার মতো কাজ করে এসেছে, এবং নিজের অপকর্ম সম্পর্কে যে মেয়ের কোনও ধারণাই নেই, বাস্তবতা থেকে যে শায়লা লক্ষ-কোটি যোজন দূরে, সেটা বুঝেই তিনি চুপচাপ মেনে নিলেন বিয়েটা। সমাজের সামনে কোনও কথা ওঠার সুযোগ দিলেন না। সাজ্জাদের কাছ থেকে আলাদা করতে গেলে শায়লা যে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটাবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। মেয়ের চোখেমুখে তখন বিদ্রোহ আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সুস্পষ্ট ছাপ। অতএব তিনি সাজ্জাদের দিকে মনোযোগ দিয়ে কিছু হিসাব কষলেন। যতো যাই হোক, ছেলের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ না, সমাজে পরিচয় দেয়ার মতো, ছেলে নিজেও শিক্ষিত। সুতরাং মেয়ের স্বার্থে জামাইকে একটা সুযোগ দেয়ার চিন্তা করলেন। সাজ্জাদের উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় নি। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর সম্পত্তির উপর শকুনের নজর পড়েছে। তবে সেটা নিয়ে তিনি মোটেও উদ্বিগ্ন হন নি। তাঁকে কি করতে হবে তা তিনি খুব দ্রুত ছকে ফেলেছিলেন।
আতিফ মায়ের সাথে কিছু কিছু আলাপ করেছিলেন সাজ্জাদের ব্যাপারে আরও আগেই। সুতরাং শায়লার মা ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখালেন মেয়ে সাজ্জাদকে বিয়ে করে ঘরে আসার পর। তিনি নিজে উচ্চশিক্ষিত মহিলা, সেই আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করা, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, সম্ভ্রান্ত ঘরের বউ, তাঁর মেয়ে হয়ে কিনা এইরকম কুশিক্ষিতের মতো কাজ করলো! এটা মেনে নিতে তাঁর অসম্ভব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রতিক্রিয়া দেখালেই বা কি? কপাল যা পোড়ানোর তা তো শায়লা পুড়িয়ে ফেলেছেনই! পরে শায়লার বাবা স্ত্রী’র সাথে একান্তে দীর্ঘ আলাপ করার পরে শায়লার মা অসন্তুষ্ট মুখে এবং ক্ষুব্ধ মনে মেনে নেন মেয়ে-জামাইকে।
শায়লার মা-বাবা অথবা ভাইরা কেউ খারাপ বা অপমানজনক কোনও ব্যবহার করেন নি সাজ্জাদের সাথে। তবে শায়লার ছোট বোন নায়লা বড় হয়ে ওঠার পরে ওর যখন বিয়ের আলাপ হচ্ছে, তখন একবার সাজ্জাদের দুলাভাইসুলভ রসিকতার জবাবে কড়াভাবে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো। ছোট শালী বড় হওয়ার পরে তার রূপের দিকে নজর পড়লেও সাজ্জাদ অবশ্য সেভাবে ওর দিকে নজর তুলে তাকানোর সাহস পান নি। এই একটা জায়গায় তাঁকে সংযত হতেই হয়েছে, জানে মারা পড়ার ভয়ে। ওই একবার নায়লার কাছে ঝাড়ি খাওয়া ছাড়া, শায়লার পরিবারের কাছে উষ্ণ অভ্যর্থনাও যেমন পান নি সাজ্জাদ, তেমনই তাঁর কোনও অযত্ন হয়েছে, তেমন অভিযোগও তিনি জানাতে পারবেন না। তবে তাঁদের কঠোর মনোভাব সম্পর্কে খুব দ্রুতই সাজ্জাদ ধারণা পেয়ে গিয়েছিলেন। আর যেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেন নি, সেটা হলো, এই কঠোর মনোভাব আজীবনের জন্য কখনোই আর বদলাবে না।
শায়লার বাবা বুঝেছিলেন, এই মেয়েকে এই সময় ছেড়ে দিলে চরমভাবে ভুগবে। সংসার তো টিকবেই না, বরং মেয়ের বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব নষ্ট হবে। সুতরাং, তিনি সাজ্জাদকে বলে তাঁর মা-বাবাকে ডাকালেন। শর্ত রাখলেন, শায়লার পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত শায়লা বাবার বাসাতেই থাকবে, আলাদা সংসারের কোনও দরকার নেই এখন। তাঁর পরিবারের ছেলে-মেয়ে সকলেই উচ্চশিক্ষিত হয়, সেটা শায়লার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না। সাজ্জাদ আসবে, এই বাড়িতে থাকবে, অনুষ্ঠান-পার্বণে শায়লাও শ্বশুরবাড়ি যাবে, কিন্তু মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তো বটেই, অনার্স-মাস্টার্স পাশ করার আগ পর্যন্ত সংসারে উনি পাঠাবেন না।
সাজ্জাদের মা-বাবা এসেছিলেন মুখ কালো করে শায়লাদের বাসায়। তাঁর বাবার মুখ কালো কারণ একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে তাঁর সাধ-আহ্লাদ ছিলো প্রচুর, যৌতুকের ইচ্ছাও ছিলো। তাঁর মুখের অন্ধকার কেটে যায় অবশ্য শায়লাদের বাসাবাড়ি দেখে। ছেলে বড়শিতে ভালো মাছই তুলেছে বুঝে মনে মনে বেশ আহ্লাদিত হন তিনি। তবে শায়লার বাবার সামনে বসে, তাঁর কথাবার্তা শুনেই তিনি বুঝে যান যে যে কঠিন লোকের পাল্লায় পড়েছেন। ছেলে ধনী পরিবার খুঁজে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ছেলের বাপ বলে এখানে তাঁর আধিপত্য দেখানোর কোনও জায়গা তিনি পাবেন না। শায়লার বাবার বসার ভঙ্গীই বলে দিচ্ছিলো যে কর্তৃত্ব তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, তিনি মানুষ চড়িয়ে খেতে, আদেশ দিয়ে কাজ আদায় করে নিতে অভ্যস্ত, এবং এখানেও তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই সব হবে। তবে সাজ্জাদের মায়ের মুখ অন্ধকার ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। ছেলের এই কাজে প্রচন্ড অপমানিতবোধ করেছেন তিনি। এটাও বুঝেছেন যে ছেলে তাঁর স্বামীর কার্বনকপি তৈরি হয়েছে। বরং বাপের চাইতে দুই ডিগ্রী বেশি ছাড়া কম হয় নি। ছেলে প্রেম করে না জানিয়ে বিয়ে করেছে সেজন্য যতোটা না আঘাত পেয়েছেন তিনি, তার চাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছেন কারণ ছেলে শায়লাদের বাড়িতে তাঁদের নিয়ে এসে যেভাবে সব কিছু দেখাচ্ছিলো, যেভাবে তার চোখ চকচক করছিলো, তাতে তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে ছেলের মনে শায়লার জন্য প্রেম থাকুক আর না থাকুক, শায়লাদের সম্পত্তির জন্য লোভ আছে শতকরা ১০০ ভাগ! সেদিনই প্রথম উনার প্রচন্ড আফসোস হয়েছিলো ছেলেকে মানুষ করতে না পারার জন্য। নিজেকে ব্যর্থ মা হিসেবে চিনেছিলেন সেদিনই, আর বাকি জীবন ছেলের জন্য সেই গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছেন নিজের মনে।
শায়লার বাবা বড় করে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করে সমাজে মুখ রক্ষা করেছিলেন বটে, কিন্তু মেয়ে তুলে দেন নি। মজার ব্যাপার হলো শায়লা নিজে থেকে আর মোটেই চান নি পড়ালেখা শেষ করতে। কিন্তু তাঁর অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেয় নি তাঁর পরিবারের কেউ। ঘাড়ে ধরে তাঁকে দিয়ে মাস্টার্স পাশ করিয়ে নিয়েছিলো। একই রকম কড়া সুরে তাঁকে পড়া শেষ করে সংসারে মনোযোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়িও। বাবার বাড়িতেই ছিলেন তিনি সে পর্যন্ত। বাবার বাসায় থাকতেই অসতর্কতার কারণে সিমিন আসে তাঁর পেটে বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। মেয়ের জন্মের আগে, বা জন্মের পরেও কিছুই করতে হয় নি তাঁকে। মেয়ে হাতে ধরে বড় করে দিয়েছেন তাঁর মা। সোহেলের জন্মও তাঁর বাপের বাড়িতেই। তবে সোহেল পেটে এসেছিলো তাঁর নিজের ইচ্ছায়, সাজ্জাদকে সংসারে বাঁধার চেষ্টায়।
বিয়ের বছর ২ যেতে না যেতেই শায়লার চোখের সামনে সাজ্জাদের আসল রূপ খুলতে শুরু করে। হ্যাঁ, শায়লাকে রাজকণ্যার মতোই ট্রিট করতেন সাজ্জাদ। কিন্তু আতিফের চোখ ফাঁকি দিতে পারেন নি। আতিফও অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর ছেলে। বাবার বুদ্ধিমত্তা পুরোটুকুই পেয়েছিলেন তিনি। যতো গোপনীয়তার সাথেই যাই করুক, রাজশাহীতে তখনও আতিফ উপস্থিত। প্রায় সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন আতিফ বোনের জামাইকে। তাই নতুন ফুলের খোঁজে যাওয়া মাত্রই ধরা পড়েছেন সাজ্জাদ। এক দিকে ইন্টার পড়ুয়া এক ছাত্রী, অন্যদিকে ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়র। শায়লার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো বড়জোর বছরখানেক। তারপরেই তাঁর ছোঁক ছোঁক করার স্বভাব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি যে বিবাহিত, সে তথ্যটা চমৎকারভাবে লুকিয়ে তিনি তাঁর মিশন চালু করে দেন। আতিফ জানার পরে বোনের কাছ থেকে সব কিছু আড়াল করে মহান সাজার কোনও চেষ্টা করেন নি। পালিয়ে বিয়ে করার পর থেকে সিমিনের জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত আতিফ বোনের সাথে একটা কথাও বলেন নি। কিন্তু তাই বলে বোনের ভালোমন্দ চিন্তা থেকে হাত গুটিয়েও নেন নি। সিমিনের জন্মের পরে অসম্ভব মিষ্টি, লাল মুখের ছোট্ট মানুষটাকে কোলে নিয়েই নিজের সমস্ত রাগ-অভিমান ত্যাগ করেছিলেন আতিফ। আর তাই, নিজের বোন আর ভাগ্নীর জীবনের স্বার্থে সাজ্জাদের ব্যাপারে সব সত্য সবার সামনে খোলসা করে রাখাটাই কর্তব্য বলে মনে করেছেন।
প্রথমবার যখন আতিফ সাজ্জাদকে হাতেনাতে ধরে প্রমাণসহ বোনের সামনে দিলেন, শায়লা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। সিমিনের তখন ৮ মাস বয়স। এতো ভালো পরিবারের মেয়ে, কোনকিছুর কোনও অভাব যে কখনও চোখে দেখে নি, কোনও কষ্ট যাকে ছুঁতে পারে নি, সেই তিনি কিনা পালিয়ে বিয়ে করার মতো লজ্জার একটা কাজ করে এসেছেন। বড় ভাইয়ের সাবধান বাণী শোনেন নি। মা-বাবার কোনও মানাই মানেন নি। তার উপর সাজ্জাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কোনও তাগিদও তাঁর চোখে পড়ে নি তখনও। নিজেকে বুঝ দিয়েছেন যে পড়াটা শেষ হোক সাজ্জাদের, সময় তো চলে যাচ্ছে না! শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকাটাই তাঁর জন্য বেশি আগ্রহের ছিলো, বাকিরা তো সেটা বুঝতোই, শায়লা নিজেও ততোদিনে সেটা খেয়াল করতে শুরু করেছেন। এমনকি রাজশাহী থেকে এসেও সাজ্জাদ শায়লাদের বাসাতেই বেশিরভাগ সময় কাটাতেন, নিজের বাসায় প্রায় যেতেনই না বলা যায়। আপাতদৃষ্টে সেটা অভিযোগ জানানোর মতো কিছু না, কারণ তাঁর বউ-বাচ্চা এখানে, টান তো থাকবেই, কিন্তু সাজ্জাদকে যারা চেনে, তাদের জন্য এর অন্য অর্থ দাঁড়াতো। একটা মেয়ে যে হলো, মেয়েটার খরচও সব শায়লার বাবাই দিচ্ছেন, সাজ্জাদের কোনও গরজই নেই যেন, বাবা হিসেবে তাঁরও যে দায়িত্ব বলে কিছু আছে, সেই চিন্তাই নেই তাঁর। এসব নিয়ে মানসিক চাপে আগে থেকেই ছিলেন, কিন্তু বিয়ের মাত্র ২ বছরের মাথায় সাজ্জাদের আবার আরেক জায়গায় প্রেম করতে যাওয়ার লজ্জাটা আর নিতে পারলেন না।
সেই যাত্রায় তাঁকে বহুকষ্টে বাঁচিয়ে তোলা হলো। সাজ্জাদ চোখের পানি নাকের পানি এক করে হাসপাতালেই শায়লার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন সকলের সামনে। নিজের মায়ের মাথায় হাত দিয়ে কসম কাটলেন যে আর কোনদিন এমন কোনও কাজ করবেন না। কিন্তু শায়লার ভেতর সেই সময় থেকেই নিরাপত্তাহীনতা আর অবসেশন তৈরি হয়ে গেলো সাজ্জাদকে নিয়ে। প্রতি মুহূর্তে সাজ্জাদকে চোখে চোখে রাখা, তাঁর মতিগতির ঠিকানা রাখা, সন্দেহ করাটাই হয়ে গেলো তাঁর একমাত্র কাজ। নিজেকে সুন্দর, তন্বী রাখার প্রচেষ্টায় কোনও খামতি রাখলেন না। সাজ্জাদকে ঘরমুখী করতে বাবার বাড়িতে থাকতেই আবার বাচ্চা নিলেন, সোহেল এলো তাঁর কোলে সিমিনের জন্মের ৪ বছর পর। সিমিন-সোহেলের প্রতি মাতৃসুলভ স্নেহ থাকলেও, সাজ্জাদকে আঁকড়ে ধরে নিজের প্রতি নিষ্ঠাবান একজন স্বামীতে পরিণত করাটাই ছিলো শায়লার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। আর যতো তাতে ব্যর্থ হলেন, ততোই বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। সবকিছু চোখের সামনে দেখে-শুনে-বুঝেও তিনি অস্বীকার করতেন। আসলে তাঁর নিজের লজ্জাটাকেই তিনি অস্বীকার করার চেষ্টা করতেন। তাঁর স্বামী তাঁর প্রতি সৎ না, কমিটেড না, এই জ্ঞানটা যতো তাঁকে কষ্টো দিতো, ততোই তিনি নিজের কল্পনাকে আশ্রয় করতেন। কাজেই কেউ তাঁর কাছে তাঁর স্বামীকে নিয়ে বলতে আসলেই কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে নেমে যেতেন তিনি। আবার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে সাজ্জাদের সাথেও অশান্তি করতেন। সাজ্জাদকে নিয়ে তাঁর বাবার পরিবারের সকলের সাথেই তাঁর বহু ঝামেলা হয়েছে। তাঁদের সাথে চিৎকার করে করে বলেছেন যে সাজ্জাদকে তাঁরা নাকি কেউ দেখতে পারেন না, তাই এসব কথা বলেন। আবার ঘরে ফিরে সাজ্জাদকে বলেছেন যে তাঁকে বিয়ে করে বাপের বাড়িতে অসম্মানিত হতে হয় তাঁকে।
শায়লা আর সাজ্জাদের বিয়ের শুরুর দিকে সকলে দাঁতে দাঁত চেপে শায়লার এই সমস্ত চিৎকার-চেঁচামেচি, রাগ-ক্ষোভের উদ্গীরণ ইত্যাদির পর্ব সহ্য করলেও পরের দিকে ঝামেলা হতো। তাঁর পরিবার সহ্য করতো কারণ মেয়ে তো সর্বনাশের পথে এক পা বাড়িয়েই রেখেছে! একে যদি স্বনির্ভর হওয়ার মতো ন্যূনতম যোগ্যতা তৈরি করে না দেয়া যায়, এ তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ডুববে! কিন্তু তাঁদের সহনশীলতার মূল্য শায়লা তখন বোঝেন নি। পরবর্তীতেও বুঝেছেন কিনা যথেষ্ট সন্দেহের বিষয় সেটা। আতিফ এখন পর্যন্ত শায়লাকে এড়িয়েই চলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিরক্তিকর এবং কুরুচিকর ঝগড়াঝাঁটি, কথাকাটাকাটির মধ্যে ঢুকতে বাধা দেয়। শায়লার ছোট ভাই, ডাক্তার যিনি, তাঁর সাথে এখনও শায়লার ঝগড়া বাধে যখন তখন। এখনও ওই সাজ্জাদকে নিয়েই। কোনও না কোনভাবে সব কথার শেষ কথা ওই সাজ্জাদে গিয়েই শেষ হয়। শায়লার ছোট বোনের সাথেও শায়লার ঝামেলা হয়েছে, এবং গত প্রায় ৩-৪ বছর দুই বোনের কথাবার্তা নেই।
শায়লাকে বহুবার তাঁর পরিবার বলেছে সাজ্জাদকে ছেড়ে নতুন করে ভাবতে। তাঁর দুই ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলো তাঁর পরিবার। শায়লা বা সাজ্জাদের সাথে যাই হোক, সিমিন আর সোহেল কিন্তু নানাবাড়িতে অসম্ভব আদর পেয়েছে। যতোদিন ওই বাড়িতে ছিলো ততোদিন তো বটেই, পরবর্তীতেও ভাগ্নে-ভাগ্নীর যাবতীয় প্রয়োজন বা বিপদে পাশে পেয়েছে ওরা নানাবাড়ির সকলকে। আর আর্থিক সহায়তার কথা তো বলাই বাহুল্য। এমন না যে সাজ্জাদ ইনকাম কম করেন, কিন্তু সাশ্রয়ী তো তিনি কোনদিনই ছিলেন না, প্রেমিকাদের পেছনে খরচ করে অনেক সময়েই সংসার চালাবার মতো খরচ আর তাঁর হাতে থাকতো না। সোহেলদের পরিবার এখনও পর্যন্ত অনেকাংশে চলে মামাদের সহায়তাতেই। শায়লা আলাদা করে সংসার শুরু করার পরে সেই যে আসবাবপত্র বানিয়ে তাঁর বাবা তাঁর ঘর সাজিয়ে দিয়েছিলেন, এখনও পর্যন্ত সেগুলোই চলছে। ঘরের টেলিভিশনটাও তাঁর ছোট ভাইয়ের কিনে দেয়া। সোহেলের পড়ার সময়ের প্রয়োজনে কম্পিউটার ওর খালার উপহার।
সোহেলের নানা-নানী বেঁচে থাকতে তাঁরাও এবং পরবর্তীতে মামারাও শায়লাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন নিজে কিছু করার জন্য। যে কারণে তাঁকে পড়ালেখা করানো। এমন কি শেষে গিয়ে বলেছেন অনলাইন বিজনেস করতে, কাপড়ের বা মেকআপ আইটেমের, বা আর কিছু না হোক, ঘরে তৈরি খাবারের। দরকার পড়লে তাঁর ভাইয়েরাই পুঁজির টাকা দিতেন। কিন্তু কিসের কি! শায়লা কথা যে সাজ্জাদকে ধরে রাখতে তাঁর ঘর-সংসার এবং রান্নাটা ঠিক রাখতে হবে। হাজার হলেও পুরুষ মানুষের মনের রাস্তার খোঁজ নাকি পাওয়া যায় পেট দিয়ে! সেই উদ্দেশ্যে তিনি রান্নার কোর্সও করেছেন।। তিনি চাকরি বা বিজনেস করতে গিয়ে সংসারে অবহেলা করতে পারবেন না। সাজ্জাদ তাঁর হাত থেকে ছুটে যাবে তিনি খেয়াল না রাখলে। সুতরাং তিনি সারাটা জীবনই সাজ্জাদের বেতনের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে করতে, টাকা কই গেলো তাই নিয়ে অশান্তি করতে করতে, এবং ভাইদের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিতে নিতে পার করেছেন।
সাজ্জাদও খুব অল্পদিনের মধ্যেই বুঝে গেছেন যে এই মেয়ে তাঁকে ছেড়ে যাবে না সে যাই করুক। শায়লার অবসেশনের পুরো সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে প্রেম প্রেম খেলা চালিয়ে গেছেন। শুরুর দিকে যাও বা রাখঢাক ছিলো, পরের দিকে আর কিছুই রইলো না। তবে, শায়লার বাবার সম্পত্তি নিয়ে তাঁর যে পরিকল্পনা, তাতে পুরোপুরি পানি ঢেলে দিয়েছিলেন শায়লার বাবা।
শায়লাকে যখন শেষ পর্যন্ত আলাদা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, শায়লার মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরে, তখন তিনি উকিল ডেকে নিজের উইল সম্পর্কে সকলকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে দিলেন। তাঁর অবর্তমানে ব্যবসা, স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পত্তি কিভাবে ভাগ হবে সব নির্দেশনা ছিলো তাতে। সেই বৈঠকে সাজ্জাদের মা-বাবাকেও ডেকেছিলেন তিনি। অতি উৎসাহী হয়ে এসেছিলেন সাজ্জাদের বাবা। ধরেই নিয়েছিলেন যে এতোদিনে সাজ্জাদের নিশ্চয়ই এই পরিবারে অবস্থান অনেকটা শক্ত হয়ে এসেছে। কিন্তু এসে দেখলেন যে শরীয়ত মোতাবেক পুঙ্খানূপুঙ্খভাবে সম্পত্তি ভাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন শায়লার বাবা। তবুও দুই মেয়ের যতোটা প্রাপ্য, তার চাইতে কিছুটা বেশিই দিয়েছেন। এবং তাঁর সিদ্ধান্তের উপর তাঁর পরিবারের কেউই কোনও আপত্তি জানায় নি। শায়লার যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, দু’টো বাচ্চা হয়েছে তাঁর, এবং নতুন করে সংসার শুরু করতে যাচ্ছেন, সুতরাং তাঁর ভাগের সম্পত্তি তাঁকে তখনই বুঝিয়ে দেবার প্রস্তাব দিলেন শায়লার বাবা। তবে সরাসরিই জানালেন, সম্পত্তি পুরোটাই তাঁর মেয়ের নামেই যাবে, জামাইয়ের নামে না। আর দুই নাতি-নাতনিকে তিনি আলাদা করে দু’টো জমি উপহার হিসেবে দেবেন।
সাজ্জাদের বাবা গাঁইগুঁই করে বলার চেষ্টা করেছিলেন একবার যে মেয়েমানুষের নামে সম্পত্তি থাকার চাইতে তার স্বামীর নামে থাকাই তো ভালো! আর স্বামীর যা কিছু তার উপর তো স্ত্রীর অধিকার এমনিতেই থাকবে! সাজ্জাদের মা সেই প্রথম, মানুষের সামনে কোঠর গলায় স্বামীর কথার বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলেন, “সোহানার আব্বু! সম্পত্তি বেয়াইয়ের… উনি উনার ছেলেমেয়েদের কিছুই না দিয়ে যদি সবকিছু দান করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সেখানেও কারও কথা বলা মানায় না… উনি উনার ছেলেরে কতোটুকু দেবেন আর মেয়েরে কতোটুকু দিবেন, কি দিবেন, সেই সিদ্ধান্তের মধ্যে বেয়াই হয়ে আপনার-আমার কথা বলাটা একদমই ঠিক না…”। সাজ্জাদের বাবা তাঁর সল্পভাষী স্ত্রীকে একটু সমঝেই চলতেন। কাজেই স্ত্রী’র স্পষ্ট উচ্চারণে পরিষ্কার বক্তব্যের উত্তরে তিনি আর কথা না বাড়িয়ে মুখ কালো করে চুপ করে গিয়েছিলেন।
তবে, সেখানে বসে ফুঁসেছিলো সাজ্জাদ। কিন্তু কিছুই বলতে পারে নি। ইতিপূর্বে অনেক বারই সে শ্বশুরের ব্যবসায় ঢোকার চেষ্টা করেছে। শ্বশুর তাঁকে হাসিমুখে প্রশ্রয় দিলেও কখনোই ব্যবসার পরিচালনার কোনও ভার বা গুরুদায়িত্ব তাঁর হাতে ছাড়েন নি। টাকা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরতে যাওয়া এক কথা আর পাই পাই পয়সা ইনভেস্ট করে সেখান থেকে মুনাফা তুলে আনা সম্পূর্ণ আরেক ব্যাপার। সাজ্জাদের যে সেই জ্ঞান এবং নিজের উপর সেই নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটা তিনি বুঝেছিলেন। কয়েকবারের পরে হাসিমুখেই বরং সাজ্জাদকে বলে দিয়েছিলেন, “বাবাজী!… ব্যবসা সম্ভবত তোমার জন্য না… ব্যবসায় পরিশ্রম করতে হয় বাবা! সব কিছু তো সহজে হাসিল করা যায় না! আর করতে যাওয়াও ঠিক না… তুমি আসো আমার সাথে কাজে, আমার ছেলেদের সাথে… আমার ভালোই লাগে!… কিন্তু এক দিনে তো তুমি সব শিখে ফেলতে পারবা না!… থাকো!… কাজ দেখতে দেখতেই এক সময় দেখবা বুঝতে শিখে গেছো… আর যদি চাকরিবাকরি করবা বলে চিন্তা করো, আমাকে জানিয়ো… আমার অনেক পরিচিত মানুষজন আছে… তোমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে কোনও সমস্যাই হবে না আমার!…”। সাজ্জাদ অলস, উশৃঙ্খল, সবই, কিন্তু বুদ্ধি তো তাঁর কম ছিলো না! তিনি সেদিনই বুঝেছিলেন শ্বশুরের ইঙ্গিত।
আর সেদিনের সেই বৈঠকের আগেই তাঁর শ্বশুর তাঁকে আলাদাভাবে কয়েকটা কথা বলে দিয়েছিলেন আবারও। যার পরে তাঁর আর কিছুই বলার ছিলো না। জামাইয়ের সাথে একা মিটিং-এ তিনি বলেছিলেন, “বাবা সাজ্জাদ… আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে শায়লার যা প্রাপ্য, আমি তাকে তা বুঝিয়ে দিতে চাই… আমার শালুকে আমি যতোটুকু চিনি, সে সম্পত্তি টম্পত্তি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর মতো মেয়ে না… কিন্তু তোমার তো সেই চিন্তা আছে, তাই না? থাকাই উচিৎ!… তোমাকে সেই কারণেই ডাকলাম কয়েকটা কথা বলার জন্য… বয়স তো তোমার চাইতে আমার অনেক বেশি, তার উপর করি ব্যবসা… মানুষ না চিনলে ব্যবসা করে টিকে থাকা যায় না… যাই হোক, যেটা বলছিলাম… শায়লা ততোটুকুই পাবে যেটা তার প্রাপ্য… তোমাদের দুই ছেলেমেয়ে, তাদের জন্মের সময়ের হাসপাতালের খরচ থেকে শুরু করে দুধের টিন পর্যন্ত সব খরচই ওদের নানাই দিয়েছে… এটা তো অস্বীকার করতে পারবা না!… তা সেগুলো ওদের নানার কাছ থেকে ওদের উপহার, আর ওদেরও হক… সেখানে কোনও দাবী আমার বা ওদের মামাদের কারও থাকবে না সেটা নিশ্চিত হয়েই বলছি… কিন্তু তোমাকে তো এতোদিন দেখলাম!… তুমি বিশ্বাসের কতো মর্যাদা দাও, সেটাও দেখলাম… আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ যে কি, সেটা সত্যিই আমার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়… আর সেই জন্য… ওর নিরাপত্তার জন্য ওর সম্পত্তি আমি ওর নামেই করে দেবো… তুমি আশা করো না বাবা যে ওগুলো তোমার নামে হবে… তোমার নামে আমি সম্পত্তি দেবো আর তুমি অন্য বাপের মেয়েদের পেছনে সেগুলো উড়িয়ে আসবা, আমার এতো কষ্টের টাকা তো তোমার ফূর্তির জন্য রাখি নাই আমি বাবা!… তুমি তোমার বউকে কি বুঝায় তার কাছ থেকে কি আদায় করবা সেটা তোমার ব্যাপার… সেটা যে তুমি করবা তা আমি জানি… আমার মেয়ে তার ভুলের মাশুল আরও দেবে… সেই রাস্তা সে নিজের হাতে তৈরি করেছে… এই তো গেলো এক কথা… আর দ্বিতীয় কথাটা হলো, তুমি কিন্তু কখনোই এটা ভেবো না যে সম্পত্তি দিয়ে টিয়ে আলাদা করে দিলাম মানে আমার মেয়েকে আমি আল্লাহর নামে কুরবানী করে দিলাম!… তার কোনও ভালোমন্দের খোঁজ আমি আর কোনদিন রাখবো না বা তার কোনও আশ্রয় নেই… আমি তো বটেই, এখনও জীবিত আছি… আমার অবর্তমানেও ওর ভাইয়েরা যে আছে, কথাটা তুমি কখনও ভুলে যেয়ো না, কেমন? তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে… সমঝদারের জন্য ইশারাই যথেষ্ট, জানো তো?… তোমার স্বভাব চরিত্র তো আর আমি পাল্টাতে পারবো না! আর এতোদিনে যখন বদলাও নাই তখন আর সেই আশাও করি না… আমার মেয়েরেও বুঝায় কোনও লাভ এতো দিনেও হয় নাই… আর হবে বলেও মনে হয় না… মেয়ের সংসার ভাঙলেও যে আমার খুব আনন্দ হবে তাও না… তবে পারলে নিজেকে শোধরায় নিও… তা না হলে জীবনে কোনও একদিন এমন কোনও পরিস্থিতি বা প্রশ্নের সামনে না পড়তে হয় যেখানে তোমার সেই পরিস্থিতির চাইতে বা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চাইতে মৃত্যু শ্রেয় বলে মনে হবে!… সুন্দরী-শিক্ষিতা বউ আছে তোমার… দুইটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে!… টাকাপয়সার অভাব নেই… পরিবারের তেমন কোনও ঝুটঝামেলা নেই… তোমার জীবনটা কিন্তু অতোটাও খারাপ না, তাই না? যে তোমাকে বাইরে বাইরে সুখ খুঁজতে যেতে হবে!…”
শায়লাকে বিয়ে করার তাঁর যাবতীয় পরিকল্পনায় যে এভাবে পানি ঢেলে দেবেন তাঁর শ্বশুর, এটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিলো সাজ্জাদের। কোথায় চালু লাভজনক ব্যবসা! আর কোথায় স্রেফ কিছু টাকাপয়সা আর জমিজমা। শেষের দু’টোর পরিমাণও যে নেহায়েৎ কম, তা কিন্তু না! তারপরেও তাঁর মূল পরিকল্পনা তো এতো কম টার্গেটের ছিলো না! এখন আবার তাঁর বাবার কথার উত্তরে তাঁর শ্বশুর মুচকি হেসে বলে দিলেন, “বেয়াই সাহেব, স্বামীর যা কিছু তাতে স্ত্রী’র ভাগ থাকে একটা… কিন্তু স্ত্রী’র যা কিছু, তা কিন্তু এক অর্থে স্বামীরই! মেয়ে তো থাকবে আপনার ছেলের সংসারেই… সুতরাং আপনার ছেলের লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হচ্ছে না!…”। এই কথার পরে আর কিছু বলার থাকে না। সাজ্জাদ বা তাঁর বাবা, কেউই আর কিছু বলেনও নাই। শুধু ফোঁস ফোঁস করা ছাড়া।
কিন্তু শায়লার বাবা যা ধারণা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেটাই সঠিক হয়েছিলো। শায়লাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে, প্রেমের কথা বলে গলিয়ে, গিফট দিয়ে ঠিকই সাজ্জাদ তাঁর জমিজমা, টাকাপয়সা অধিকাংশই তাঁর হাত থেকে বের করে নিতে পেরেছিলেন ব্যবসা করবেন বলে। আফসোস থাকতো না যদি সে সেগুলো নিজের সংসার-সন্তানদের জন্যই ব্যবহার করতো। কিন্তু যথারীতি, সেগুলো গেছে তাঁর নিজের ভোগে। শায়লা যতোদিনে টের পেয়েছেন, ততোদিনে সম্পত্তি অধিকাংশই শেষ। শুধু তাঁর দুই ছেলে-মেয়ের দুই টুকরো জমি, ব্যাংকে সামান্য কিছু টাকা, আর তাঁর নিজের নামের দু’টো ছোট জমি বাকি আছে। এগুলো আর সাজ্জাদ বহু চেষ্টা করেও তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিতে পারেন নাই।
মজার ব্যাপার ছিলো এটা যে, ছেলের বিয়ের পাত্রী বাছাই দেখে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন যিনি, সাজ্জাদের বাবা, সাজ্জাদের হাতের টাকাপয়সা, বা শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে আদায় করা জমিজমা, এগুলোর কোনও কিছুই তিনি এক কণাও ভোগ করতে পারেন নি নিজে। সাজ্জাদ মা-বাপের জন্য হাত খুলে খরচ করা তো দূরের কথা, প্রয়োজনেও দু’টো পয়সা ঠেকায় নি তাঁদের হাতে। বরং তাঁদের কাছ থেকে কি কি আদায় করা যেতে পারে, সেই দিকেই সতর্ক দৃষ্টি রেখে গেছে বরাবর।
***
মুরগি রান্না করতে করতে এসব কথাই মনে ভাসছিলো সিমিনের। কোনও কথাই চাপা থাকে না। সময়ের ফেরে সবাই সব কিছুই জানতে পারে। ওর মামাবাড়ির কেউ কখনও নিজে থেকে ওদের আঘাত করার জন্য এসব কিছু শোনায় নি। মা-বাবার ঝগড়া থেকেই জেনেছে। আবার পরিবারের অন্যদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সময়েও বের হয়ে এসেছে অনেক অপ্রিয় সত্য।
সিমিন আর সোহেল ওদের দাদাকে খুব বেশি পায় নি। কিন্তু দাদীকে পেয়েছে বড় হওয়া পর্যন্ত। তবে দাদীকে বেশির ভাগ সময় ওদের ফুফুদের কাছেই থাকতে দেখেছে। ওদের বাসায় আসলেও খুব একটা থাকতে চাইতেন না তিনি। ফুফুরাও বেশি ছাড়তে চাইতেন না মা’কে। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে তাঁর বড় মেয়ের বাসায়, মেয়ের আর মেয়ে-জামাইয়ের হাতের সেবা পেয়ে। গম্ভীর এবং চুপচাপ মানুষটার সাথে খুব আহ্লাদের সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও তিনি যে সিমিন-সোহেলকে ভালবাসেন, সেটা বোঝা যেতো। ওরাও তাঁকে সম্মান-শ্রদ্ধা না করার মতো কোনও কারণ পায় নি কোনদিন।
মায়ের সাথে দাদীর সম্পর্কটা কোনদিনই ঠোকাঠুকির ছিলো না, সেটা সম্ভবত এক ছাদের নিচে সেভাবে কখনও একসাথে থাকা হয় নি বলেই। আবার খুব আন্তরিকতারও ছিলো না। শাশুড়ি আসলে যত্ন করতেন শায়লা, তবে নিজের কাছে রাখার জন্য জোরাজুরি ছিলো না কোনও তাঁর তরফ থেকে। বড় হওয়ার পরে সিমিনের মনে হয়েছে শাশুড়ির ব্যক্তিত্বের কাছে যেন কিছুটা কুঁকড়ে থাকতেন শায়লা। ও যখন ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা দেবে, তখন একবার দাদী আর ওর মায়ের কথাবার্তা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলো। দাদী মা’কে বলছিলেন, বেশ কড়াসুরেই বলছিলেন, “কিসের আশায় এই রকম একটা পুরুষের সংসার করো তুমি বৌমা? আমার নাহয় কোনও উপায় ছিলো না বলে সাজ্জাদের বাবার মতো মানুষের ঘর করে গেছি সারাজীবন… না ছিলো শিক্ষা, না ছিলো বাপের বাড়ির জোর… আর সমাজের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তো ছিলোই না!… তোমার তো আমার মতো অবস্থা না! তুমি শিক্ষিত, বাপের বাড়ির সবাই তোমার পাশে আছে… তারপরেও তুমি ওর অন্যায় সহ্য করো! কেন?”
সিমিন চমকে উঠেছিলো। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয়েছিলো দাদী কি তাহলে ওর বাবার আসল মা না? নাকি ওর মা’কে উনার অপছন্দ! নাহলে এমন কথা কীভাবে বলেন তিনি! শায়লার মৃদুস্বর ভেসে এসেছিলো সিমিনের কানে, “আপনি মা হয়ে নিজের ছেলের সংসার ভাঙার কথা কিভাবে বলেন, মা?”
ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলেন সিমিনের দাদী, “সংসার? এটা সংসার? কয়টা আসবাবপত্র থাকলে আর কয়জন মানুষ এক ছাদের নিচে থাকলেই সংসার হয় রে মা? যেই সংসার সংসার করে তুমি মরছো, তোমার স্বামীর সেই সংসারের প্রতি কোনও দায়িত্ববোধ আছে? সে সংসার বোঝে? কবুল বললেই স্বামী হওয়া যায় না… আর বাচ্চা জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায় না… এই যে সে সংসারের খরচটাও ঠিক মতো দেয় না… তুমি হাত পেতে তোমার ভাইদের কাছ থেকে খরচ আনো… তার নাইলে কোনও লজ্জা নাই… তোমারও কি নাই? টাকাপয়সা তো কম কামায় না সে! সব খরচ করে আসে দুনিয়ার মেয়েদের পিছে… আর তোমরা থাকো না খেয়ে!… এইগুলা সংসারের লক্ষণ? একবার… একটা কোনও ভুল হলে তারে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে… কিন্তু একই কাজ দিনের পর দিন করতে করতে ওর তো আর সমাজ-সংসারের ভয়ডরের কোনও বালাই নাই!…”
আবারও মিনমিনে স্বর শায়লার, “আমি তো বলি মা!… অন্য মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে বলি…”।
সপাটে কথা থামিয়ে দেন শাশুড়ি, “তোমার বলায় কাজ হইসে? আজকে এতো বছরে হইসে কোনও কাজ? দুইদিন বাদে বাদে ঘরে অশান্তি ছাড়া আর কি লাভ হইসে তোমার? তোমারে সে পাত্তা দেয়? দুই দুইটা বাচ্চার মা হয়ে গেসো, এখন কি না সে তোমার গায়ে হাত তোলে! আমি সারাজীবন জ্বলছি সাজ্জাদের বাপের কারণে… কিন্তু তারপরেও সে কোনদিন আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পায় নাই বৌমা!… তুমি তারে কতোটা সাহস দিসো খালি ভেবে দেখো ভালো করে… তোমারে সে দুই পয়সা দিয়ে গোণে না… আর তুমি আছো তারে মাথায় করে রাখতে… না আমি পারলাম আমার ছেলে মানুষ করতে, না তুমি পারলা তারে শিক্ষা দিতে… ”।
গজগজ করতে করতে থেমে গিয়েছিলেন দাদী, আর সিমিনের জ্ঞানচক্ষু খুলে গিয়েছিলো সেদিন। বাবা তো বাবাই! বাচ্চাদের সাথে খুব বেশি এ্যাটাচমেন্ট না থাকলেও সন্তান হয়ে এর আগে কোনদিন বাবা ছাড়া আর কিছুই তো তাঁকে ভাবে নি সিমিন! উঠতি বয়স তখন ওর। সেদিন প্রথম বাবাকে দেখেছিলো একজন পুরুষ হিসেবে। ভয়ে, বিতৃষ্ণায়, ক্ষোভে শিউরে উঠেছিলো সেদিন সিমিন। আর তারপর থেকেই ওর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার শুরু। দিনে দিনে শুধু নিজের ভেতরে নিজে মরেছে ও তিলে তিলে। যা কিছু এর আগে চোখে পড়তো না, সেগুলো পড়া শুরু করলো। যা কিছু আগে মেলাতে পারতো না সেই হিসেবগুলো মিলতে শুরু করলো। মামা-খালাদের ক্ষুব্ধ কিছু কথার মানে খুলতে শুরু করলো চোখের সামনে। আর ক্রমেই নিশ্চুপ হয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলো সিমিন নিজের ভেতর নিজে লজ্জায়, অপমানে। ভাই তখনও অনেক ছোট, এসব কিছু বোঝার মতো না। একজন কোনও মানুষ সে পায় নি যার সাথে একটু শেয়ার করে হালকা হবে। মামা-খালা-নানী-নানা যাই জানুক, নিজের দুশ্চরিত্র বাপের কীর্তি যেচে পড়ে তাঁদের গিয়ে জিজ্ঞেস করার মতো আগ্রহ বা সাহস কোনটাই সিমিনের হয় নি। দম নিতে পারতো না ও। বুকের পাঁজর মনে হতো ভেঙে আসছে ভেতর থেকে আসা চাপে।
***
ডাইনিং রুম থেকে সোহেলের গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। সিমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুরগির কড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিলো। গলার স্বর শুনে মনে হলো সোহেলের শরীর একটু ভালো লাগছে বোধহয়। জ্বর ছাড়লে ক্ষুধা লাগে, তাই দ্রুত হাতে এবার রাতের খাবার গোছাতে লাগলো সিমিন। ওকে ডাকতে হলো না। জামিল এসে হাত লাগালো এবার। ভাত, তরকারি, সালাদ সব একে একে নিয়ে টেবিল সাজাতে লাগলো। সোহেল একবার এসেছিলো সাহায্য করতে, মৃদু ধমকে ফেরত পাঠিয়েছে ওকে জামিল।
খাবারের টেবিলে তেমন কোনও আলাপ আজ আর হলো না ওদের। সোহেলের জ্বরটা নেমেছে। আগ্রহ নিয়ে আরাম করেই খাবারটা খেলো সে। মুরগি, ডাল আর সালাদ দিয়েই ভাত খেলো, মাছ নিলো না। আলোর চোখ ভর্তি ঘুম। রাত ১০টার কাছাকাছি বাজে প্রায়। তাকে আরও আগে খেয়ে নিতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু সে খাবে মামার সাথেই। এখন ঘুমে ঢুলে পড়ে যাচ্ছে আর মায়ের হাতের ছোট ছোট লোকমা টুক টুক করে মুখে নিয়ে গিলে নিচ্ছে। এই মেয়েটা খাওয়া নিয়ে বিশেষ যন্ত্রণা দেয় না সিমিন আর জামিলকে। বাকি বাচ্চাদের মতো তারও আগ্রহ ফাস্টফুড, চকোলেট, জাঙ্ক ফুডের দিকেই। কিন্তু সেগুলোর পাশাপাশি প্রতিদিনকার খাবার নিয়ে খুব বেশি সমস্যা সে করে না। তার মা’ও যখন পারে তাকে চিকেন ফ্রাই, বার্গার, পিৎজা, ইত্যাদি ঘরেই বানিয়ে দেয়। সুতরাং সে মোটামুটি খুশি থাকে ঘরের খাবারেই। এখন অবশ্য ঘুমের তালে সে কি খাচ্ছে খুব একটা টেরও পাচ্ছে না বোধহয়।
খাওয়া শেষ হলে জামিল আস্তে করে সিমিন আর সোহেলকে বললো, “আমি মেয়েকে ব্রাশ করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ঘুমে পড়ে যাচ্ছে, আজকে আর দুধ নিয়ে জোরাজুরি করার দরকার নেই। সিমিন, তুমি সোহেলকে আরেক ডোজ প্যারাসিটামল দিয়ে দাও। আর ওকে বরং এক কাপ গরম দুধ দাও। গা ম্যাজ ম্যাজ ভাবটা কমবে গরম একটা ড্রিঙ্ক নিলে। আলোকে ঘুম পাড়িয়ে আমরা একটু ড্রয়িং রুমে বসবো। একটু কথা বলা দরকার।”
কথাটা শুনে সিমিনের কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে সোহেল বুঝে গেলো ওদের স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে এই আলাপ করা নিয়ে আগেই সম্ভবত কথা হয়েছে কিছু। কিন্তু দুধের মগটা সিমিন ওর হাতে দিতে ওর একেবারে গা গুলিয়ে উঠলো। একে তো জ্বরের মুখ, তার উপর সারাদিনে নিজের উপর করা অত্যাচার। জ্বরটা ছাড়লেও শরীর মোটেই ভালো লাগছে না। ওর মুখ দেখে বুঝলো সেটা সিমিন। মগটা নিয়ে কিচেনে গিয়ে এবার ফেরত এলো হট চকোলেট নিয়ে। জামিলের জন্যেও এনেছে। এটাতে সোহেল অল্প অল্প করে চুমুক দিতে শুরু করলো।
ভাই-বোনের দুই একটা সাধারণ কথাবার্তার মধ্যেই জামিল ফেরত এলো মেয়ের ঘর থেকে। কিছুদিন হলো মেয়েকে আলাদা ঘরে দিয়েছে ওরা। ওদের বেডরুম আর মেয়ের বেডরুমের মাঝে দরজা আছে, খোলাই থাকে সেটা। রাতে ওরা যে ক’বার ওঠে, মেয়েকে দেখে আসে, ঠিক ঠাক করে শুইয়ে দিয়ে গায়ের কাঁথা ঠিক করে দিয়ে আসে। আর মেয়ের ঘুম ভাঙলে কখনও সে ঘুম চোখে এসে উঠে পড়ে ওদের বিছানায়, ওদের দু’জনের মাঝখানে। মেয়েকে ঘুমের পোশাক পড়িয়ে বিছানায় মশারি টানিয়ে দিয়ে এসেছে জামিল। আজকে আর গল্প বলতে হয় নি। তার আগেই আলো ঘুমে কাদা।
সেন্টার টেবিলে ট্রের উপর থেকে নিজের মগটা টেনে নিলো জামিল। সিমিনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো যে ওরটা কোথায়। সিমিনও চোখে চোখেই উত্তর দিলো যে ওর মগ থেকেই কিছুটা নেবে সিমিন পরে। সোহেল দেখলো, চোখে চোখে দু’জনের কথোপকথন পুরো বুঝতে না পারলেও দেখলো। দাম্পত্যের এই রসায়নগুলো সোহেল বুভুক্ষের মতো লক্ষ্য করে। ওর বাবা-মায়ের দাম্পত্য যদি প্রচন্ড ভালবাসা-বাসির নাও হতো, স্রেফ অতি সাধারণও যদি হতো, তাহলেও হয়তো এই ছোটখাটো বিষয়গুলো ওর কাছে নগণ্য হয়ে রয়ে যেতো প্রতিদিনের ব্যাপার হিসেবে। দৃশ্যগুলো রয়ে যেতো অধরা। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কের যে অস্বাভাবিক রসায়ন দেখে সোহেল অভ্যস্ত, তার মধ্যে থাকতে থাকতে এগুলো এখন ওর খুব চোখে পড়ে। শুধু সিমিন-জামিলের ক্ষেত্রে না, মামা-মামী, ফুফু-ফুফা, কাজিন-বন্ধু, সকলের ক্ষেত্রেই। স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটি, গোপন রসিকতা বিনিময়, চোখের ইশারায় নিষেধ অথবা শাসন, মুখে কিছু না বলেও একে অন্যের কথা বুঝে নেয়া, সবটাই সোহেল রীতিমতো চাতকের মতো এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে দেখে। ওর নিজের জন্য স্বপ্ন কতোটা থাকে কে জানে! কিন্তু যা কিছু দূরের, তার প্রতি আকর্ষণটা থাকে দুর্নিবার, এই কথা প্রমাণ করেই যেন নিজের অভিজ্ঞতার সাথে ও বাইরের সম্পর্কগুলোকে মেলাতে চেষ্টা করে যায় এক অদম্য নেশা নিয়ে। যা কিছু পায় নি, যা কিছু সে কখনও পাবে না, এ যেন তারই খোঁজে ঘুরে মরা ওর।
মগ হাতে সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো জামিল। গলাটা একবার খাঁকারি দিয়ে সোহেলের উদ্দেশ্যে বললো, “সোহেল, কিছু কথা এইবার আমাদের মধ্যে খোলাখুলি হওয়া দরকার, ভাই। আরও আগেই হয়তো হওয়া উচিৎ ছিলো, কিন্তু বিষয়গুলো খুব আরামদায়ক তো না আলাপ করার জন্য! তার উপর আমি তোমাদের বাড়ির জামাই… সব ব্যাপার নিয়ে আমার কথা বলতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না… তোমার বোনকেও এই নিয়ে কিছু বলা খুব সহজ ছিলো না আমার জন্য, কিন্তু সুস্থতার একটা ব্যাপার তো আমাদের সবারই আছে, তাই না?…”।
মগে একটা চুমুক দিলো জামিল। বরাবরই খুব গুছিয়ে কথা বলে ও। সোহেল মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে। জামিল আবার বলতে শুরু করলো, “আমার মেয়ে এখনও ছোট… সমাজ, পরিবারের এই সমস্ত বিষয় আশয় বোঝার মতো বয়স এখনও তার হয় নি… কিন্তু আমি এখন থেকেই প্রতিটা পা মেপে ফেলি, যেন বড় হয়ে কোনদিন আমার কোনও কাজের রেশ ধরে তাকে লজ্জা পেতে না হয়!… সে তো একদিন বড় হবে, তাই না? হয়ে যদি কখনও শোনে যে তার বাবা অর্গান ব্ল্যাক মার্কেটিং-এর মতো কোনও কাজে জড়িত, বা কোনও রোগীর ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে টাকার বিনিময়ে, সেই লজ্জা সে ডিল করবে কেমন করে বলো তো?… দুইটা মানুষ শারীরিক ভাবে কাছাকাছি হলেই বাপ-মা হইতে পারে রে ভাই… কিন্তু বাপ-মায়ের দায়িত্ব পালন করা অতো সহজ না…”
হাতের মগটা সোফা থেকে একটু ঝুঁকে এসে ট্রে’র উপর রাখলো জামিল। সিমিনের উদ্দেশ্যে বললো, “এখনও গরম…”। বাকি কথাটুকু না বললেও সোহেল বুঝলো। ছোটবেলা থেকেই সিমিন খুব বেশি গরম কিছু খেতে পারে না। চা-কফি সবই সে হালকা গরম খায়। জামিল সেটাই বোঝালো, আরেকটু ঠান্ডা হলে যেন সিমিন নেয়। সিমিন একবার মাথা নাড়লো শুধু। সোহেলের পাশে বসেছে ও, থ্রি-সিটার সোফাতে। জামিল সিঙ্গেল সোফায় বসা।
একবার নিজের মুখের উপর দিয়ে ডান হাতটা বুলিয়ে নিয়ে বড় করে একটা শ্বাস নিলো জামিল। তারপর বললো, “যাই হোক, এগুলো আসলে এখন বলা সবই বেকার… বোঝার হলে আম্মা-আব্বা এগুলো আরও আগেই বুঝতেন… বাচ্চাকাচ্চা বখে গেলে, বা কোনও অন্যায় করে ফেললে বাপ-মায়ের উপর দিয়ে বহু ঝামেলা যায়… কিন্তু বাপ-মা তো তাও বাচ্চাকাচ্চারে শাসন করতে পারেন… আমরা এক্ষেত্রে করবোটা কি? … আমি তো তাও ভালো জায়গায় আছি… হসপিটালে মামাশ্বশুর আছেন সিনিয়র পোস্টে, নিজেও এতোদিন ধরে চাকরি করছি… দুই একজন বন্ধুবান্ধব গোত্রীয় লোকজন ছাড়া আর কেউ আমাকে তেমনভাবে কিছু শোনানোর সাহস পায় না, কাজের জায়গায় অন্তত ঝামেলা নাই আমার… পিছনে পিছনে ফিসফাস করে… সেগুলো তাও ইগ্নোর করা যায়… কিন্তু তুমি? তোমার বোন? কালকেও ওর কলিগ মারিয়া আপা ওকে ডেকে ওরই বাপের ভিডিও দেখিয়েছেন… উনি ফেসবুক চালান নতুন, তাই এতোদিন উনার কাছে খবর আসে নাই… উনার কলেজ-পড়ুয়া মেয়ে নাকি বের করে উনারে দেখিয়েছে, সেটাই উনি এখন কলিগদের সবার সাথে শেয়ার করছেন… মহিলা জানেনও না যে যার ভিডিও এতো উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছেন পুরুষ মানুষের চরিত্রের তুলোধুনো করতে করতে, তিনি সিমিনেরই বাবা। শেষে ওদের আরেক কলিগ, লুৎফা ম্যাডাম খেয়াল করে উনারে থামান… উনি জানতেন আগে থেকেই…”, হাউফফফ করে দম ফেললো জামিল।
সোহেল এখনও মাথা নিচু করেই আছে। সিমিনের চোখে পানি, কিন্তু পানিটা গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না ও। নাকটা লাল হয়ে আছে কান্না চাপার চেষ্টায়। সোহেলের যতো খারাপই লাগুক জামিলের কথা শুনতে, সোহেল জানে যে জামিল কটাক্ষ করে বা ওদের ভাই-বোনকে কথা শোনানোর জন্য কিছু বলছে না, বলছে একেবারেই পরিবারের প্রতি চিন্তা থেকে। খোঁচা মারা কথা বলার স্বভাব জামিলের একেবারেই নেই, ও যা বলার সরাসরি বলে, পেঁচিয়ে-খুঁচিয়ে কিছু বলে না। তবে এখন যদি খোঁচা দিয়েও বলতো কিছু, সোহেল বা সিমিনের কি আদৌ সেখানে কিছু বলার ছিলো?
জামিল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলা শুরু করলো, “এটা তো একটা ঘটনা মাত্র… এগুলো এখন আমাদের নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে… আমি ঠিক জানি না যে আমার শ্বশুরের কোনও ধারণা আছে কিনা যে এক উনার জন্য উনার পরিবার-পরিজন, আমরা প্রত্যেকে কি পরিমান হেনস্থা হচ্ছি সামাজিকভাবে। উনার যদি আজকের ঘটনায় কোনও দোষ না থাকতো, যদি হুট করে হয়ে যাওয়া একটা ভুলও হতো, তাহলে নির্দ্বিধায় উনার পাশে দাঁড়াতাম… অন্য কে কি বললো তাতে কিছুই যেতো আসতো না… কিন্তু উনার বিষয়টা তো সেটা না!… কিছু জিনিস মানুষকে ধরে বেঁধে শেখানো যায় না। তার নিজের বোধ থাকতে হয়…”।
জামিল থামলো। সোহেল বুঝতে পারছে জামিল চেষ্টা করছে ওদের আঘাত না করে কথা বলতে। বার বার কথা গুছিয়ে নিতে হচ্ছে ওকে। কিছুক্ষণ পর্যন্ত ঘরের মধ্যে শুধু ৩টা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ রইলো না। বাইরে থেকে ভেসে আসছে রাজধানীর রাতের রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলার আওয়াজ, অল্প বিরতিতে হর্ণ, তখনও খোলা থাকা দোকানপাটে ক্রেতা-বিক্রেতার টুকরো টুকরো তর্কবিতর্ক, পাশের প্লটের টিনশেড একতলা কোনও বিল্ডিং থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ আর তাঁর মায়ের উচ্চকন্ঠে বকা, আশেপাশের কোনও ফ্ল্যাট থেকে টেলিভিশনে জোর ভলিউমে চলতে থাকা অনুপমা সিরিয়ালের ডায়লগ। রাতের ঢাকা সত্যিই বোধহয় কখনও নীরব হয় না!
জামিল মুখ খোলে, “সোহেল আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম আসলে… আমি যদ্দুর জানি তোমরা দুই ভাই-বোন কোনদিন বিষয়গুলো নিয়ে আব্বার মুখোমুখি হও নাই। আম্মা তো রেগুলারই এগুলো নিয়ে ঝামেলা করেন আব্বার সাথে, কিন্তু তাতে কাজ হয় কি কোনও? হয় না… এবারের ঝামেলা যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে… হতে পারে আব্বা এইবার অন্তত শিক্ষা নেবেন এই ঘটনা থেকে। কম অপদস্থ তো আর হলেন না! একে তো ভিডিও, তার উপর আবার ওই মহিলা বাড়ি বয়ে এসে সিন ক্রিয়েট করে গেলো… আব্বার কি হবে তা জানি না… আমাদের জন্যও তো সমস্যা!… তোমরা তো এখনও ভাড়া বাসায় থাকো তাই একদিক দিয়ে সুবিধা আছে, এলাকা চেঞ্জ করে ফেলতে পারবা… কিন্তু আমাদের এটা তো নিজেদের ফ্ল্যাট… আর আমরা তো এতো পয়সাওয়ালা লোকও না যে রাতারাতি নতুন ফ্ল্যাট কিনে উঠে যাবো… পাড়া-প্রতিবেশী দুই একজন যে আমার শ্বশুরকে নানান সময়ে দেখে নাই তা তো না!… এই সমস্ত ঘটনার রেশ যে কতো দিন বয়ে বেড়াতে হবে কে জানে! চেনা পরিচিত তো কম না… যাই হোক! আমি আসলে এইসব আফসোসের কথা বলতেই চাই নাই… এগুলো বলে কোনও লাভ নাই… আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো, তুমি এবং তোমার বোন… বিশেষ করে সোহেল তুমি… তোমরা একবার আব্বার সাথে সরাসরি কথা বলো… কারণ তোমরা দুই ভাইবোনের কেউই সুস্থ নাই… একে তো দুইজনেই চাপা… তার উপর এই অস্বাভাবিকতার জেরে দুইজনেই একদম ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছো… এটা খুব খারাপ জিনিস সোহেল… কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাগ-ক্ষোভ যা আছে তা বের করে দিতে হয়… তোমাদের দুইজনেরই রিলিজ দরকার… সিমিনের যতোটা না, তার চাইতে বেশি দরকার তোমার… সিমিন এখন ওই বাসা থেকে দূরে আছে, নিজের সংসার-বাচ্চা নিয়ে ওর একটা আলাদা জগৎ হয়েছে… কিন্তু তুমি আটকে গেছো সোহেল… আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তুমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছো… এখনও ৩০ হয় নি, অথচ তোমার হাই প্রেশার… চেহারা দেখলে মনে হয় ৪৫/৫০ বছর বয়স হয়ে গেছে… বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে করছো না… বিয়ের কথাও আগাতে পারছে না এই একই ঘটনার জেরে… কোনও বন্ধু-বান্ধব নেই, কোথাও ঘুরতে যাও না, কারও সাথে সেভাবে মেশো না… তোমার এই বয়সে ছেলেমেয়েরা কতো উচ্ছ্বল থাকে! কাজেকর্মে, উৎসাহে, আড্ডাবাজি, ঘোরাঘুরি-খেলাধূলায় সারাক্ষণ ছটফট করতে থাকে… আমি মেডিকেলে ছিলাম, পড়ার এতো চাপ নিয়েও তো তোমার মতো এমন কোণঠাসা হয়ে থাকি নি ভাই!… তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি? একটা সুদর্শন, উচ্চশিক্ষিত, জোয়ান ছেলে তুমি!… এ কিরকম জীবন কাটাচ্ছো বলো তো? … মরে যাবা তো!… আর সমস্যাটা তো মরে যাওয়াতে না!… যতোক্ষণ বেঁচে আছো ততোক্ষণ বাঁচার মতো বাঁচতে তো হবে!… মৃত্যুটা তো আমাদের হাতে না!… বেঁচে থাকাটা বরং আমাদের হাতে… মানছি যে, যে পরিস্থিতিতে আছো… জীবনের এতোগুলো বছর যেভাবে কাটিয়েছো, সেটা কোনও সুস্থ অবস্থা ছিলো না… কিন্তু এর জন্য তো দায়ী তুমি না!… তোমরা কেউই না… তাহলে নিজেকে এভাবে শাস্তি পেতে কেন দিচ্ছো?…”
জামিলের কথার মাঝেই সোহেল দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো। ভাইয়ের কান্নার আওয়াজে ঠোঁট ভেঙে কান্না করে দিলো সিমিনও। জামিল ওদের একটু সময় দিয়ে আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, “কাঁদো তোমরা… তোমাদের দুইজনেরই এটা দরকার আছে… সোহেল, তোমার বোনকে আমি বহু কষ্টে, বহু দিন ধরে চেষ্টা করে, কাউন্সেলিং করে আজকে এতো বছরে একটু ঠিক করে এনেছি… আমার তোমাদের দুইজনকে নিয়ে এখন বসার এটাও একটা কারণ… সিমিনের মধ্যে আমি আবার সেই বিয়ের আগের ডিপ্রেশন লক্ষ্য করছি… এখন কথা হলো, বিয়ের আগে সে যেমন ছিলো ছিলো… কিন্তু এখন সে আমার বউ, আমার পার্টনার, আমার বাচ্চার মা… তার ভালো-মন্দ এখন আমার দায়িত্ব… আমি তো কোনও পরিস্থিতিতে আমার সংসার, আমার পরিবার বরবাদ হতে দেবো না! আমার ঘরের পরিবেশ তো আমি কম্প্রোমাইজ করবো না রে ভাই… যা হচ্ছে, তাতে তুমি আর সিমিন এ্যাফেক্টেড হচ্ছো সব চাইতে বেশি, আর সেটার প্রভাব এসে পড়ছে আমার ঘরে… সিমিন আমার অংশ… আর তুমি সিমিনের একটা বড় অংশ… তোমাদের সুস্থতা এখন আমার স্বার্থ…”।
থামলো জামিল, সিমিন শান্ত হয়েছে দেখে ওর দিকে মগটা এগিয়ে দিলো, “দেখো… কান্নাকাটি করতে করতে হট চকোলেট কোল্ড চকোলেট হয়ে গেছে… এটা খেয়ে শেষ করো… সোহেল, তোমারটা শেষ করেছো?” সোহেল মাথা নেড়ে জানালো যে শেষ করেছে সে তারটা।
জামিল দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো, “দেখো আমি তোমাদের দু’জনের কাউকেই বলছি না যে আব্বার সাথে গিয়ে যুদ্ধ করো… উনি যা ঘটানোর অলরেডি ঘটিয়ে ফেলেছেন, এখন আর ব্লেইম গেম করে কোনও লাভ নেই… উনার কাছে কোনও কৈফিয়তও চাওয়ার নাই এ্যাজ আ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট… আমি তোমাদের শুধু বলছি যে যা কিছু তোমরা মনের মধ্যে বছরের পর বছর চেপে রেখেছো, সেগুলো তোমাদের অসুস্থ করে ফেলছে… তোমাদের উনাকে জানানো উচিৎ অন্তত যে উনার এই সমস্ত কর্মকান্ডে তোমার কিরকম ফিল করো… কি ইম্প্যাক্ট পড়ে তোমাদের উপর উনার ছেলেমেয়ে হিসেবে… আমার ধারণা সারাজীবন উনি যেভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন, উনার কখনও ভাবার সুযোগই হয় নাই যে উনার সমস্ত কাজের দায় কিভাবে তোমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছো… কেউ উনাকে বলেও নাই, আম্মার বিষয়টা উনি ধর্তব্যের মধ্যেই নেন নাই… আর উনি নিজের আনন্দ খুঁজতে গিয়ে এসব নিয়ে ভাবেনও নাই… সে যাই হোক!… উনি জানুক আর না জানুক… ইউ নিড টু ফ্রি ইয়োরসেলফ ফ্রম দিস ট্রমা… কথা বলো উনার সাথে… এরপরে উনি নিজেকে পরিবর্তন করলে ভালো… না করলে আর কারও কিছু করার নাই… আপাতত হয়তো এম্ব্যারাসমেন্ট থেকে উনি চুপচাপ আছেন, কিন্তু এটা কি সাময়িক নাকি এই জিনিসগুলো আবার চাপা পড়ে গেলে আবার উনার স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তা আমরা কেউই জানি না, আই এ্যাম স্যরি ফর মাই ল্যাঙ্গুয়েজ… তবে একবার চেষ্টা করতে দোষ কি? কেউ যদি জেনুইন স্বার্থপর হয় তার কথা আলাদা… কিন্তু মানুষ অনেক কাজই করে তার ফলাফল চিন্তা না করে, আর ইমপালসিভলি সে যখন কিছু করতে থাকে তখন সে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে না যে তার এই কাজে তার সাথে জড়িত মানুষগুলো কিভাবে ভুগছে… বলা যায় এটা একধরণের এস্কেপিস্ট মনোভাব, সে নিজেকে ওইভাবে ভাবতে দিতেই চায় না… কারণ ভাবলে সে আর ওই কাজগুলো করতে পারবে না… কিন্তু এটা তো বাস্তবতা না!… বাস্তবতা হলো আমরা সবাই কোনও না কোনও ভাবে এ্যাফেক্টেড হচ্ছি… বাট… একটা কথা আমি বলবো, ইউ নিড আ লিটল ডিস্ট্যান্স ফ্রম দিস নাউ, সোহেল… সোহেল, সিমিন তোমাদের দু’জনেরই দরকার একটু ডিস্ট্যান্স… বাপ-মায়ের প্রতি দায়িত্ব থাকবেই, সেটা আমি এড়াতে বলছি না কোনভাবেই… কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তোমাদের দু’জনের কাউকেই বাঁচানো যাবে না… স্পেশ্যালি তুমি, সোহেল… জীবন এভাবে চলতে পারে না ভাই… তোমার ফার্স্ট কাজ এখন ওই বাসা থেকে বের হওয়া… আম্মা-আব্বা দু’জনেরই একটু বাস্তবতার উপলব্ধি হওয়া দরকার আছে… সব কাজেরই যে একটা প্রতিক্রিয়া থাকে, সেটা উনাদের বোঝা দরকার… আর সোহেল, তুমি একটু নিজের দিকে এবার নজর দাও… চাকরি করছো, ক্যারিয়ার শুরু করেছো, এবার একটু সেদিকে মনোযোগ দাও… আর সেই সাথে বিয়েশাদী করো… সুস্থ একটা জীবনযাপন করার চেষ্টা করো… আমার কথাগুলো খুব হার্শ… খুব স্বার্থপরের মতো শোনা যাচ্ছে আমি জানি, কিন্তু সব সময় যদি একজনকে আমরা বাস্তবতা থেকে আড়াল করে রাখি, আর সে যদি সেই আড়ালটাকেই ব্যবহার করে ভুলের পরে ভুল করতে থাকে, তখন কিন্তু তার ভুল বা অন্যায়, যাই বলো না কেন, তার দায় কিছুটা আমাদের উপরেও এসে পড়ে…।”
সিমিন কথা বললো এবার, খুব মৃদু ওর স্বর, “আব্বা এবং আম্মা… দুইজনেরই একটু রিয়ালাইজেশন হওয়া দরকার আছে, সোহেল!… জামিল বলার আগে আমি বিষয়গুলো নিয়ে সেভাবে কখনও ভাবিই নাই… এই পরিবারের মধ্যে থেকে কিভাবে আব্বা-আম্মার বিষয়গুলো ডিল করবো, কিভাবে লজ্জা এড়াবো, কিভাবে লোকের সামনে থেকে সবকিছু লুকাবো, এতোগুলো বছর ধরে সেটাই ভেবে যাচ্ছি… আব্বা তো আম্মারে কোনদিন গোণাতেই ধরে নাই… আর নিজের পরিবাররেও পাত্তা দেয় নাই… দাদীর সাথে গলা তুলছে এসব নিয়ে দাদী কথা বলতে গেলে… ফুফুদের সাথে শীতল সম্পর্ক তার… আর আমাদের মামাবাড়ির দিকের লোকজনরে সে ধরেই নিসে যে তাদের মেয়ে যতোদিন উনার সাথে আছে, ততোদিন পর্যন্ত উনাদের কিছু করার নাই… আর সত্যি কথা বলতে গেলে মামারা কম চেষ্টা তো করে নাই!… কিন্তু তাদের বোনই যদি চিৎকার করে বলতে থাকে যা তার সংসারে উনাদের নাক গলানোর দরকার নাই, তাহলে উনাদের আর কি করার থাকে, বল? … সবারই তো মানসম্মান বলে কিছু আছে!…”, বিদ্রূপের হাসিতে ঠোঁট বেঁকে গেলো সিমিনের, বললো, “মামাদের আম্মা বলে যে তার সংসারে যেন উনারা হস্থক্ষেপ না করে, অথচ সেই সংসার চালাতে আবার উনাদের কাছেই তার হাত পাততে হয়!… “।
জামিল মৃদুস্বরে বললো, “ওইসব কথা থাক সিমিন… আপাতত যেটা জরুরী সেটা নিয়েই আলাপ করো নাহয়!…”
সিমিন ঢোক গিলে যেন কষ্টটা গেলার চেষ্টা করলো, “সব কথাই একটার সাথে আরেকটা জড়ানো, জামিল… একটা টানলে আরেকটা আসবেই… যাই হোক, যেটা বলছিলাম,… আম্মা-আব্বারে একটু নিজের মতো করে ছেড়ে দেয়া দরকার এখন আমাদের… আমরা থাকবো, উনাদের প্রয়োজনে যাতে আমাদের কাছে পায় সেটা ঠিক থাকলেই হলো… একসাথে, একেবারে পরিবারের সবার সাথে সবার বিশাল ভালো সম্পর্ক আমাদের, এই ফেইক বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসা দরকার… আমাদের এটা মেনে নেয়ার সময় আসছে যে আমরা আর ১০টা পরিবারের মতো পরিবেশ কোনদিন পাইও নাই… পাবোও না… যেটা না সেটা না… এটা মেনে নিয়ে আমাদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবার দরকার… এফোর্ট এক তরফা দিয়ে কখনও কোনও সম্পর্ক টিকায় রাখা যায় না… ব্যালান্স থাকে না… একজন খালি নিয়েই যাবে আর বাকিরা শুধু তার ভুল-অন্যায় সবকিছুর ভরপাই করতে করতে হাবুডুবু খাবে, এভাবে তো চলে না!… আর তাছাড়া তুই বা আমি, আমরা যে কেউই আব্বারে কোনদিন জানতে দেই নাই যে উনার কারণে আমরা বাইরে কি ফেস করি, কি পরিমাণ সাফার করি… উনার সাথে আমাদের দুইজনের কারোই ক্লোজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি, এটা যেমন একটা কারণ, লজ্জা আর এম্ব্যারাসমেন্ট থেকেও আমরা এই নিয়ে কিছু বলতে পারি নাই উনারে, সেটাও সত্যি… কিন্তু এটা ঠিক করি নাই আমরা… দোকানের মাসুম কি বলে, দীপ্তির সেই কাজিন তোকে কি বলে গেসলো, বা আমার কলিগদের কাছে আমি কিভাবে মুখে চুনকালি মাখি… এসব কোনকিছুই তার জানা নাই… না আমরা কোনদিন তারে গিয়ে বলছি, না আম্মা কোনদিন আমাদের কিছু বলতে দিসে… বাট হি শ্যুড ফেইস দীজ থিংস… হতে পারে এগুলো জানার পরেও তার কোনও পরিবর্তন হবে না… কিন্তু এগুলো তার জানা দরকার… অভিযোগ হলে অভিযোগ… কিন্তু উনার যদি নিজের জীবনে হাজার রকমের সুখের জন্য সব কিছু করার অধিকার থেকে থাকে, তাহলে এই অভিযোগ করার অধিকারও আমাদের আছে… আমাদের জীবন, মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তারও নাই…”।
একটু থেমে দম নিয়ে আবার বললো সিমিন, “দু’টো কারণে কথা বলা দরকার আব্বার সাথে… এক, আব্বা যদি একটুও বোঝে যে তার কাজের ফলাফল আসলে কি বা কতদূর পর্যন্ত তা আমরা ভোগ করতিসি… যদি একবারের জন্যেও ফিরতে চায়… তাহলে সেটাই আমাদের বিরাট পাওয়া… আর দুই, জামিল যেটা বললো, তোর এবং আমার, আমাদের দুইজনেরই রিলিজ দরকার… তুই তো মরছিস রোজ… দেখতে পাচ্ছি সেটা… কিন্তু এই স্ট্রেস আমিও আর নিতে পারছি না সোহেল”, গলা বুজে গেলো কান্নায় সিমিনের, বলতে থাকলো, “নিজের ভেতর নিজে রোজ রোজ মাথা কুটে মরি… আব্বার উপর, আম্মার উপর কি পরিমাণ ক্ষোভ আমার জমে আছে তা শুধু আমি জানি আর আমার চিন্তারা জানে… অথচ আমার তো এখন মরারও সুযোগ নাই… একটা বাচ্চার মা আমি!… আরেকজন আসবে শিগগিরই… এই স্ট্রেস নিয়ে চলতে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে আমার নিজের, আমার সংসারের… আমার বাচ্চারা ভেসে যাবে!”
চুপচাপ সিমিনের কথা শুনছিলো সোহেল। সিমিনের কণ্ঠে বেদনার সুরে এমনভাবেই ডুবে ছিলো যে প্রথমে খেয়ালই করে নি যে কি শুনলো। তারপরেই চমকে তাকালো সিমিনের দিকে। চোখ তুলতেই নজরে এলো সিমিন কান্নাভেজা মুখটা আর এবং জামিলের মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত চেহারা। হঠাৎ করেই যেন সোহেলের চারপাশটা আলোকিত হয়ে উঠলো! একবার সিমিন, একবার জামিলের দিকে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করে ফেললো, “সত্যি?” জামিল মাথা নেড়ে সায় দিলো। সিমিন হয়তো এভাবে এখন ভাইকে এই খবরটা দিতে চায় নি, কিন্তু কষ্টের তোড়ে বের হয়ে এসেছে পরম সুখের এই সংবাদ।
সোহেলের মনে হলো পাজরের খাঁজে খাঁজে জমে থাকা ব্যথাগুলো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে ওর। হঠাৎই মনে হলো ওর যে বেঁচে থাকাটা এখনও সুন্দর! যে প্রাণটা এখনও পৃথিবীতে আসে নি, তাকেই ভীষণ আপন মনে হচ্ছে ওর! মনে হচ্ছে ওই ছোট্ট একটা মানুষের আগমনী বার্তা ওকে জীবনের দিকে ঠেলে দিলো আলতো হাতে! পরক্ষণেই মনে পড়লো কি পরিস্থিতিতে দাঁড়ানো ওর পুরো পরিবার! আনন্দ আর বেদনার মিলন উচ্ছ্বাসে পাশ থেকেই বোনকে জড়িয়ে নিলো সোহেল দুই হাতের বেড়ে। শরীর কেঁপে উঠছে নরম কান্নায়। জামিলের হাসিটা চওড়া হয়েছে তখন আরও একটু। দুই চোখ ভর্তি পানি নিয়েও শব্দ করে হেসে ফেললো সিমিন ওকে জড়িয়ে থাকা ভাইয়ের বাহুর উপর আলতো হাত রেখে।
***
(শেষ অংশ আগামীকাল)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here