ঘাস ফড়িং (১০ পর্ব_শেষাংশ)
———————–
মিনুর সঙ্গে দেখা করে আসার আজ তিনদিন হল। এই ক’দিন রোজ রাতে তাদের ফোনে কথা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই মিনুকে কল দেবার জন্য অপেক্ষায় থাকে নীলাভ। মিনু তখন টিউশনিতে। সেখান থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া করেই নীলাভকে কল দেয়। দীর্ঘক্ষণ তাদের ফোনালাপ চলে। শ্রেয়া পাশের বালিশে মাথা রেখে চোখবুঁজে। খাদিজা বেগমের চোখে ধূলো দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। রাতের খাবার শেষ করে আজও তারা নিজেদের রুমে চলে এসেছে। শ্রেয়া বিছানা ঠিকঠাক করছে। ভেতরে যাই-ই ঘটুক বাইরে সে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করে। শ্রেয়ার কাছে নীলাভকে আজ কেমন যেন অস্থির লাগে। কাউকে বারংবার কল দিয়ে বারান্দা থেকে রুমে পায়চারি করছে।

শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল,

— ‘কোনো সমস্যা নীলাভ?’

নীলাভ পিছু ফিরে তাকায়, তারপর বলে,

– ‘না, কি সমস্যা হবে?’

— ‘তোমাকে কেমন অস্থির দেখাচ্ছে।’

— ‘মিনু কেন যেন কল ধরছে না। অথচ এতোক্ষণে সে নিজেই কল দেবার কথা।’

— ‘কোনো কাজে ব্যস্ত আছে হয়তো।’

— ‘হ্যাঁ তা হতে পারে।’

নীলাভ বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টানে। খানিক পর আবার কল দেয়। এখন ফোনটাই বন্ধ দেখাচ্ছে।

মিনুর অসুস্থ মা হারিকেন হাতে বারংবার রাস্তায় এসে দেখেন মেয়ে আসছে কি-না। কিন্তু রাত অনেক হয়ে গেছে তবুও মিনুর আসার কোনো নামগন্ধ নেই। তিনি হারিকেন হাতে রাস্তার পাশে একটা গাছের শেকড়ে বসে অপেক্ষা করতে করতে ঝিমুতে লাগলেন।

মিনু বুঝতে পারছে না মুখোশধারীরা তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে কোনো এক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এনে নৌকায় তুলেছে। নৌকা এসে লেগেছে একটা বাড়ির পেছন দিকে। চারপাশে ঝোপঝাড়। মিনুকে ধরে মুখোশধারীরা একটা খুপরি ঘরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।
তাদের একজন হাঁক ছেড়ে বললো,

– ‘এই খলিল, খলিল।’
মিনু কেবল খুপরি ঘর থেকে সবকিছু শুনতে পায়।

খলিল জবাব দিল,

– ‘জ্বি ওস্তাদ।’

— ‘গোসত নিয়ে আয়। মদের লাইগা ভাজন লাগব। আর গোসত নিয়া আইসা এই মাইয়ারেও খাওন দিস।’

খলিল ‘আচ্ছা ওস্তাদ’ বলে নৌকা নিয়ে যায়। ঘন্টা খানেক পরে গোসত নিয়ে এসে মাটির চুলোয় আগুন জ্বালে। এদেরকে তার একদম ভালো লাগছে না। এখানে তার সপ্তাহ খানেক হয়েছে। পাগল হয়ে কাজ খুঁজছিল। রেল স্টেশনে এদের সঙ্গে দেখা। ধরে নিয়ে আসে এ বাড়িতে। পালাতে চাইলে অবশ্য সে এখান থেকে যখন-তখন পালাতে পারে। কিন্তু অন্য কোথাও কাজ পাচ্ছে না। বাজারে গেলে মনে মনে কাজের ধান্ধা অবশ্য চালিয়ে যায়। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। এই বাড়িটা হচ্ছে মুখোশধারীদের আড্ডাখানা। নানান জায়গা থেকে ডাকাতি খুন-খারাপির টাকার ভাগাভাগি এবং সলা-পরামর্শ এখানেই করে। মেয়ে মানুষকে ধরে আনার ঘটনা অবশ্য আজ প্রথম দেখছে খলিল। মেয়েটির কপালে কি আছে কে জানে? সে এসব নিয়ে আর ভাবতে গেল না। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেবার অভ্যাস তার কোনো কালেই ছিল না। খলিল একটা বাটিতে গোসত নিয়ে গেল। মুখোশধারীদের অবশ্য এখন আর মুখোশ পরা নেই। গায়ের কাপড়ও খুলে ফেলেছে। সবাই মোটামুটি মধ্য বয়স্ক। মাথার চুল কাঁচা-পাকনা। খলিলের বয়স ওদের মতো এতো বেশি নয়। পঁচিশের কোটা বোধহয় পেরোয়নি। সে নিজের জন্ম সালটা ঠিক জানে না। মাথার চুল সব সময় কদম ছাঁট দেয়া থাকে। মাঝেমধ্যে তার মতো কাউকে পেলে দু’টাকার ব্লেড দিয়ে মাথাটা ন্যাড়াও করে নেয়। লম্বা চুলে তার চুলকায় ভীষণ। তাই লম্বা চুল সহ্য হয় না।
খলিল গোসতের বাটি মাঝখানে রাখে। সবাই গোল হয়ে বসে সিগারেট টানছে। গোসত খানিক ঠান্ডা হলেই সবাই আয়েশ করে মদ খাওয়া শুরু করবে। আজ তারা মনে মনে ভীষণ খুশি। যুবতী একটা মেয়ের মোমের মতোন মসৃণ শরীর তাদের কাছে আছে। মদ খেয়ে একজন একজন করে হায়েনার মতোন ছিড়েখুঁড়ে ফালাফালা করে ফেলবে।

খলিল চলে এলো রান্না ঘরে। নিজের জন্য একটা ডিম ভাজি করা ছিল। এইটাতে ভাগাভাগি করলে তার পুষবে না। ভাত পেট ভরে খেতে হয়। ক্ষিধে নিয়ে তার ছোটবেলা থেকে ভয়। এখন যে খাচ্ছি পরেরবার পাব কি-না। সুতরাং যখন পায় তখনই পেট ভরে খেয়ে নেবার অভ্যাস রক্তে মিশে আছে। তাড়াতাড়ি অযত্নে আরেকটা ডিম ভেজে নিল সে। এক হাতে প্লেট আর আরেক হাতে হারিকেন নিয়ে খুপরি ঘরের দিকে যায়। দরজা পা দিয়ে ধাক্কা দিতেই ক্যাচক্যাচ করে খুলে গেল। মিনু হাত-পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। নাক দিয়ে কেবল গোঙানি বেরুচ্ছে। আলো লাগায় সে চোখ মেলে তাকায়। কেউ একজন হাতের বাঁধন খুলছে বুঝতে পারে। তারপর যখন মুখের বাঁধ খুলতে লাগল খলিল। মিনু তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। খলিল তখনও চিনতে পারেনি মিনুকে। বাঁধ খোলার পরেই মিনু ‘খলিল ভাই’ বলে প্রায় একটা চিৎকারই দিতে দিচ্ছিল।
খলিল মুখ চেপে ধরে মিনুর। তারপর দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে ওরা মদ গিলতে ব্যস্ত। খলিল ফিসফিস করে বলল,

– ‘মোল্লা কাকার মেয়ে মিনু না তুই? এইখানে কী কইরা?’

মিনুর সমস্ত শারীরিক দূর্বলতা যেন খলিলকে দেখে কেটে গেল। সে আস্তে করে বলল,

– ‘ওরা ধরে নিয়া আসছে খলিল ভাই৷ শুনছি আমাকে মাইরা ফেলবে। কিন্তু তুমি ওদের লগে কেন?’

খলিল যা বুঝবার বুঝে গেছে। সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,

– ‘চুপ মিনু, বাঁচতে হইলে চুপ। ভাতটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি পানি এনে দিতাছি।’

মিনু কোনো কথা না বলে খেতে লাগল। খলিল ভাইকে সে চিনে। ছোট বেলায় এলাকার জাম্বুরা, নারিকেল, কলা সহ নানান ফল-ফলাদি চুরি করে তাদেরকে নিয়ে খেত। বাচ্চাদেরকে ঘুড়ি বানিয়ে দিত। তাকে এখান থেকে অবশ্যই খলিল ভাই পালাবে নিয়ে। খলিল পেটের ক্ষিধেকে ভয় পায়। হাজার বিপদ আসুক সে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। তারপর নিজের অল্প-সল্প যা কিছু আছে নৌকায় নিয়ে রাখে। স্টিলের গ্লাসে করে পানি এনে দিল মিনুকে। এক চুমুকে সব পানি খেয়ে তাকাল খলিল কিছু বলে কি-না।
খলিল কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

– ‘নাও কিন্তুক পেছনের দরজার সামনেই বাইন্ধা রাখছে। আমরা যাওনের লগে লগে ঢের পাইব ওরা। তাই চুপিচুপি গিয়া লাভ নাই। তুই নৌকার কাছে গিয়া লগি হাতে নিয়ে দাঁড়াবি। কেউ আসলেই মাথা ফাটাইয়া দিবি লগি দিয়া। আর আমি মেশিন স্টার্ট দিয়া দিমু লগে লগে। তারপর ফুরুত কইরা চইলা যাইমু।’

মিনু আবার ফিসফিস করে বলল,

– ‘মেশিন স্টার্ট না দিয়া লগি দিয়ে কিছুদূর গেলে তো ওরা বুঝতে পারবে না।’

— ‘আরে গাদি তোর দাদা একটা দরজার সামনেই চ্যাপ্টা লাইগা বইসা আছে। এভাবেই যাওন লাগব। সামনে আসার আগেই মাথায় মারবি। হালারা মাতাল আছে।’

মিনু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পুরো শরীরে ব্যথা। ভীষণ দূর্বল লাগছে। তবুও নিজেকে শক্ত করে বলল,

– ‘চলেন।’

দু’জন চুপচাপ নৌকার পাশে গেল। দরজার কাছে থেকে একজন বলল,

— ‘কে রে?’

— ‘ওস্তাদ আমি খলিল।’

লোকটি চোখ কচলে তাকিয়ে আচমকা লাফিয়ে উঠলো,

– ‘এই হালার পুত মাইয়ারে বাইরে নিয়া আইছস ক্যান?’

মাতালগুলো সঙ্গে সঙ্গে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বের হয়ে আসে। খলিল তাড়াতাড়ি স্টার্ট দিতে যেয়ে দেখে উঠছে না। এদিকে মিনু লগি তুলে মারতেও পারছে না কাউকে। ভয়ে ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। খলিল দৌড়ে এসে মিনুর কাছ থেকে লগি নিয়ে একজনের মাথায় বাড়ি মারে। ভেঙে যায় লগি। কিন্তু ভাঙ্গা অংশ ওদের হাতে যাবার আগেই মিনু চোখের পলকে হাতে নিল। সব কয়টা মদ খেয়ে মাতাল হওয়ায় শুধু অকথ্য ভাষায় গালাগালিই করতে পারছে৷ নিজের টাল সামলাতে পারছে না। একজন মিনুর দিকে এগিয়ে আসতেই মিনু লগি চালিয়ে দিল মাথায়। চিৎকার করে পড়লো লোকটি মিনুর পায়ের কাছে। এতোক্ষণে খলিল মেশিন স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে। লাফিয়ে উঠল নৌকা। চিৎকার করে বলতে লাগল,

– ‘মিনু আয়। তাড়াতাড়ি নাওয়ে উঠ।’

কিন্ত মিনু পা নাড়াতেই পারছে না। মাতালটা বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে মিনুর পা শক্ত করে ধরে আছে। কোনো ভাবেই ছাড়াতে পারছে না। এদিকে আরেকজন প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। লগির টুকরো অংশ হাতে যাওয়ায় বেশ সুবিধা হচ্ছে। মিনু চোখের পলকে লোকটির মাথায় চালিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় চিৎকার করে পড়ে যায় মাটিতে। কিন্তু এদিকে পা ছাড়াতেই পারছে না। মিনুর হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। ওর এক পা ধরে আছে মাতালটা আরেক পা তুলতে গেলে সে নিজেই পড়ে যাবে। তাই লগিতে ভর দিয়ে এক পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাতালটার চোখে লাত্থি মারে মিনু। চিৎকার করে পা ছেড়ে নিজের চোখ চেপে ধরে লোকটি। মিনু তাকিয়ে দেখে নৌকা কিছুদূরে চলে গেছে। চারদিকে অন্ধকার। লাফিয়ে পড়ে পানিতে। নৌকার আওয়াজ লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে থাকে৷ পেছনেও লাফানির আওয়াজ কানে আসে। মাতালগুলোও লাফিয়ে পড়েছে তাহলে। মিনু খলিল ভাই খলিল ভাই বলে চিৎকার করতে থাকে৷ অন্ধকারে চিৎকার শুনে খলিল নৌকা ঘুরিয়ে তড়িৎ গতিতে মিনুর দিকে নিয়ে আসে। হাল ছেড়ে সে হাত বাড়িয়ে মিনুকে তুলতে গিয়ে নিজেই পড়ে গেল টুপ করে পানিতে। ততক্ষণে মিনু নৌকা এক হাতে ধরে ফেলেছে। এদিকে ওরা প্রায় কাছাকাছি খলিলের। সে চোখের পলকে হাত বাড়িয়ে জাপ্টে ধরে নৌকা। ভর দিয়ে উঠে পড়ে। টেনে তুলে মিনুকে। অন্ধকারে নৌকা চলছে। কোথায় যাচ্ছে কোনদিকে যাচ্ছে মিনু বা খলিল জানে না। অনেকদূর যাবার পর একটা জঙ্গল পেল। খলিল উঠে মেশিন বন্ধ করে দেয়। মিনু আঁতকে উঠে বলল,

– ‘মেশিন বন্ধ করে দিলা কেন?’

— ‘আন্ধারে কিছুই দেখা যাইতেছে না মিনু। এই জঙ্গলে রাত কাটাইয়া ভোর হইলে চইলা যাইমু। মেশিন বন্ধ কইরা দিছি ওরা খুইজা পাইব না।’

তারপর দু’জন নীরব থাকে। মিনু আবার নীরবতা ভেঙে বলল,

– ‘পাঁচ-ছয় বছর পর তোমার লগে দেখা হইল খলিল ভাই। গ্রাম যে ছাইড়া আইলা আর যাওনি ক্যান?’

খলিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

– ‘গিয়া কি হইব মিনু কেউ তো নাই৷ এক নানী ভিক্ষা কইরা খাওয়াইয়ে বড় করছে সেও মইরা গেল। গ্রামের মাইনষে নানীর জানাজাও করলো না তোমার বাপ-চাচারাই ফতোয়া দিল মাগী বেটির জানাজা কি। ভিক্ষা করছে দেহ ব্যবসাও করছে। তারপর আমিও যখন এলাকায় ভিক্ষা কর‍তাম লোকে বলতো জোয়ান পোলা ভিক্ষে কিসের কাজকাম কইরে খেতে পারিস না? কিন্তুক কেউ আমারে কাজকাম আর দেয়নি৷ তারপর শুরু করলাম এলাকায় হাত গণনার ভণ্ডামি। তোমার বাপ-চাচাই তখন ভণ্ডামির জন্য এলাকা ছাড়া কইরা দিল। বের হইলাম রাস্তায় রাস্তায়। শহরে-বন্দরে। যা কাম পাই তাই করি। যখন কোনখানে কাজ পাই না তখন রেল স্টেশনে থাকি।’

মিনু চুপচাপ কেবল শুনে যায় খলিলের জীবনের গল্প। এই জগতে কোটি কোটি মানুষ থাকার পরও যার আপন বলতে কেউ নেই। যার মাথার উপরে ছাদ নেই। এবেলা ভাত খেলে ওবেলা কি খাবে তার ঠিক নেই। এই যে তার একমাত্র কর্মস্থল ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে তারপর কি কাজ পাবে কি করে খাবে কোথায় থাকবে সেসব নিয়ে আলাদা করে ভাবনা নেই। সে জানে, পৃথিবীতে কি এক রহস্যময় কারণে টিকে থাকলেই কীভাবে জানি খাবার জুটে, ঘুমানোর জায়গা মিলে। কেবল টিকে থাকতে হয়।

সকালে আবার কল দেয় নীলাভ। ফোন বন্ধ দেখায়। পাগলের মতো অবস্থা হয়ে যাচ্ছে তার। ফোন বন্ধ কেন! কি হয়েছে মিনুর। শ্রেয়া নাস্তা নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

— ‘কল কী ধরেছে?’

— ‘না, বন্ধ দেখাচ্ছে।’

শ্রেয়া খানিক ভেবে বলল,

– ‘বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখো, তবুও ফোনে না পেলে সিলেট চলে যাও, দেখা করো।’

নীলাভ বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না। শ্রেয়ার কাছে ভাড়ার টাকাটা চেয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পড়ল। সে পৌঁছে গেল দুপুরের আগেই। বস্তিতে গিয়ে দেখল মিনু বিছানায় শুয়ে আছে। নিচের ঠোঁট ফোলা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে। মিনুর পাশে অপরিচিত এক যুবক আর আন্টি বসা।
নীলাভ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘মিনু কি হয়েছে তোমার। কাল থেকে কল দিয়ে পাচ্ছি না কেন?’
খলিল যেন গল্প করার একটা সুযোগই পেল। সে আসন পেতে বসে বলল,

– ‘কি কইরা পাইবেন মিয়া ভাই মিনুরে৷ কি কান্ডটাই না ঘটেছিল বুঝলেন। আমি না হইলে মনে করেন মাইয়াটা এক্কেরে শ্যাষ আছিল….।

মিনুকে কিছুই বলতে হল না। সে কেবল খলিল ভাইয়ের আয়েশ করে গল্প বলা দেখে মুচকি হাসছে।
কিন্ত নীলাভ সবকিছু শুনে অস্থির হয়ে গেল। কে করল এসব, কেন করল? তাহলে আমি আর বাড়ি যাচ্ছি না তোমার সাথেই থাকব। এখানেই থাকব। তুমি টিউশনি পড়াতে গেলে আমি সঙ্গে যাব। মিনু মুচকি হেঁসে বলল,

– ‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা।’

সত্যি সত্যিই নীলাভ দু’দিন এখানে থাকে। খলিল আর নীলাভ মিনুর বিছানায় থেকেছে। আর ওরা সবাই এক খাটে৷ মিনুর মা নীলাভকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাড়িতে পাঠালেন। কিন্তু নীলাভ এর ভেতরে শ্রেয়ার কাছ থেকে বিকাশে টাকা এনে মিনুকে নতুন সিম আর মোবাইল কিনে দিয়ে গেছে। আগের মতোই আবার তাদের ফোনালাপ চলতে থাকে। কিন্তু ক’দিন পর আবার রাতে মিনুকে সে ফোনে পেল না। সকালেও না। ফোন বন্ধ। তার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে উঠে। তাহলে কী আবার মুখোশধারীরা মিনুকে তুলে নিয়ে গেছে? আগের পুরো ঘটনা সে শ্রেয়াকে বলেছিল। শ্রেয়া আঁতকে উঠেছে পুরো ঘটনা শুনে। নীলাভ বের হয়ে গেল রাতেই। শ্রেয়া আর বাসায় থাকতে পারলো না। সেও যাবে নীলাভের সঙ্গে। দু’জন রাত আটটার বাসে উঠে। বারোটার আগেই সিলেট পৌঁছে যায়। হেঁটে হেঁটে দু’জন বস্তিতে পৌঁছে দেখে কেউ নাই। মিনুর পুরো পরিবার উধাও হয়ে গেছে এখান থেকে। নীলাভ পাগলে মতো হয়ে গেল৷ বস্তিতে সবাইকে জিজ্ঞেস করে মিনুরা কোথায় কিছু জানে কি-না। সবাই বলল কোথায় গেছে জানি না। শুধু একজন যুবক আর মিনুরা ব্যাগ-প্যাক নিয়ে চলে যেতে দেখেছে। নীলাভ ফোন বের করে বারংবার কল দেয়। ফোন বন্ধ দেখায়। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। রাত এখানেই তারা কাটিয়ে দেয়। পরেরদিনও শ্রেয়া নীলাভকে নিয়ে বাসায় যেতে পারলো না। সে মিনুর রুমেই থাকবে৷ মিনু ফিরে আসবে। এখান থেকে সে যাবে না। শ্রেয়া রাতেই মা’কে সব জানিয়েছিল। তিনি নীলাভের বাবাকে নিয়ে সকাল দশটার দিকে চলে এলেন বস্তিতে। নীলাভের সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন ঠিক আছে তুমি কিছুদিন এই বস্তিতে থেকেই অপেক্ষা করো। আমি মালিকের সঙ্গে কথা বলে এখানে তোমার আর শ্রেয়ার থাকার এবং খাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
নীলাভ এসব কথা শুনে না। সে শুধু জানে মিনু ফিরে আসবে। আর সে মিনুর রুমে থেকেই অপেক্ষা করবে। খাদিজা বেগম ভ্যান ডেকে খাট, বিছানা-বালিশ সব আনিয়ে দিলেন। রান্না করার জন্য বস্তির লোকদের সঙ্গে কথা বলে বুয়া ঠিক করে দিয়ে চলে গেলেন। শ্রেয়া নীলাভের কান্না আর পাগলামি রোজ সহ্য করে সামলে নিচ্ছে। সেও মনে-প্রাণে চায় মিনু ফিরে আসুক। নীলাভের মুখ আবার হাসি-খুশিতে ভরে উঠুক। কিন্তু ওরা দু’জনের কেউ-ই জানে না মিনু আর ফিরবে না। সেও এখন চায় শ্রেয়াকে নিয়ে নীলাভ সুখে থাকুক। একটা বিবাহিত সংসার তার জন্য নষ্ট হয়ে যাক সে আর চায় না।

মিনু যখন মুখোশধারীদের থেকে উদ্ধার হয়ে গেল তখন খাদিজা বেগম পুরোপুরি হতাশ হয়ে যান। এদিকে নীলাভ বস্তিতে দু’দিন থেকে পড়ে আছে। তিনি ফোন দিয়ে ভাইকে সবকিছু খুলে বললেন।
সহজ-সরল জাবেদ মিয়ার বুকটা ভাগ্নীর জন্য বেদনায় হু-হু করে কেঁদে উঠল। এমন হলে শ্রেয়া মামণির কি হবে? আমার বোনটাও নীলাভকে কত ভালবাসে। জাবেদ মিয়া তখন খাদিজা বেগমকে বললেন মিনুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। সবকিছু বুঝিয়ে বলে দেখি কিছু হয় কি-না। খাদিজা বেগমও তাই ভেবেছিলেন। নীলাভ যেদিন ফিরে এলো। এর ক’দিন পরেই জাবেদ মিয়া এবং খাদিজা বেগম মিনুর কলোনিতে যান।
মিনু তাদের কাউকে চিনতে পারেনি। খাদিজা বেগম বললেন,

– ‘আমি নীলাভের ফুপু আর এই হচ্ছে নীলাভের বাবা।’

মিনু আঁতকে উঠে। তারপর মাথায় ওড়না দেয়। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে ঘেমে যায়। তাদেরকে বসতে দিয়ে দৌড়ে গেল চুলোয় আগুন ধরাতে।
জাবেদ মিয়া ডাকলেন। চা বসাতে নিষেধ করে বললেন,

– ‘মা আমি কিছু দরকারী কথা বলতে আইছি। তুমি আমার এক্কান অনুরোধ রাখতে হইবে মা।’

মিনুর খুবই খারাপ লাগে। নীলাভের বাবা তার কাছে এমন কাতর হয়ে অনুরোধ করবেন সেটা তার কাছে অনেক লজ্জার।
মিনু জাবেদ মিয়ার হাত ধরে বলল,

– ‘চাচা আপনি শুধু বলেন কি করতে হবে আমাকে।’

জাবেদ মিয়া প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

– ‘আমার ভাগ্নিটা মরে যাইবে মা৷ আমার বইনের একমাত্র মাইয়া। তুমি যখন হারিয়ে গেলে তখন নীলাভ পাগল হওনের মতোন অবস্থা আছিল। তাকে বাঁচাতেই আমার বইনে শ্রেয়ার লগে নীলাভের বিয়া দিয়েছে৷ তাদের এই উপকারের প্রতিদান আমি কি এইভাবে দিব মিনু মা?’

খাদিজা বেগমও পায়ে পড়ে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। মিনু কি করবে ভেবে পায় না। তার পুরো শরীর ঘেমে গেছে। নীলাভ তাহলে শ্রেয়াকে বিয়ে করে নিয়েছে? সে কি অন্যের সংসার ভেঙে দিতে পা বাড়িয়েছে? এই অন্যায় তো শ্রেয়ার সঙ্গে সে করতে পারবে না। তা ছাড়া নীলাভের বাবা আর ফুপুর এমন অনুরোধ সে কীভাবে অমান্য করবে। মিনু

ধরা গলায় বলল,

— ‘কিন্তু আমাকে কি করতে হবে?’

খাদিজা বেগম এবার ভাইকে পাশ থেকে সরিয়ে বললেন,

– ‘মা, তোমার মা আর ভাইকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাও। নীলাভের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রেখো না। চট্টগ্রাম আমাদের পরিচিত লোক তোমাদেরকে স্টেশন থেকেই নিতে আসবে। সেখানে তোমাদের থাকা-খাওয়া এবং কাজের ব্যবস্থা ওরাই করে দিবে।’

মিনু ঝিম মেরে বসে রইল। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। খাদিজা বেগম আবার ইশারা করেন জাবেদ মিয়াকে। জাবেদ মিয়া এবার মিনুর পায়েই পড়ে গেলেন।
‘দয়া করো মা, তুমি শ্রেয়াকে বাঁচাও। একটা বিবাহিত সম্পর্ক তুমি নষ্ট কইরা দিও না।

মিনু পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। খানিক পর বলল,

– ‘ঠিকাছে আমি চট্টগ্রাম চলে যাব।’

তারপর তারা সবাই রাতের ট্রেনেই চট্টগ্রাম রওয়ানা দেয়। সাথে আছে খলিলও। সে নানান গল্প করে যাচ্ছে মিনুর সঙ্গে। মিনুর সেদিকে মনযোগ নেই। জানালার বাইরে তাকিয়ে অতীত স্মৃতি ভাবতে ভাবতে গোপনে বারংবার চোখের জল মুছে নিচ্ছে।

পরিশিষ্ট: শ্রেয়া আর নীলাভ জানে না মিনুকে কে কিডন্যাপ করিয়েছিল। মিনুরা এখন কোথায় আছে। আর কখনও ফিরবে কি-না। নীলাভ আজও অপেক্ষা করে মিনুর। শ্রেয়া তার কাগজ-কলমের স্বামীকে পরম যত্নে বুকে আগলে রাখে। কে জানে মিনু আর ফিরবে কি-না। কে জানে শ্রেয়ার ভালবাসা আবার ধীরে ধীরে নীলাভকে স্পর্শ করে ফেলে কি-না। শ্রীমঙ্গলে কোলে করে লেক দেখার জন্য সেই পাহাড়ে তোলার দিনগুলি আবার শ্রেয়ার জীবনে ফিরে আসবে কি-না। আবার সে বলতে পারবে কি-না আমার ভীষণ আদর পাচ্ছে নীলাভ।
আজ এক সপ্তাহ হল তারা এখনও বস্তিতে অপেক্ষায় আছে মিনুর। রাতে নীলাভ ঘুমের ঘোরে ‘ঘাস ফড়িং ঘাস ফড়িং’ বলে বিড়বিড় করে।
শ্রেয়া একদিন জিজ্ঞেস করল, ‘ঘাস ফড়িং ডাকার কারণটা আজও বললে না যে।’

নীলাভ আনমনে বলতে লাগে,

– ‘কলেজের বাংলা স্যার খুবই মিশুক ছিলেন।
প্রায়ই তিনি গল্প করতেন।
একদিন আমাদেরকে বললেন সবার একটা করে পছন্দের কাজ বলো।
কেউ বলল মুভি দেখা, কেউ গান শোনা, কেউ ভ্রমণ করা, কেউ বই পড়া।
একমাত্র মিনুর পছন্দের কথা শুনে সবাই হু-হু করে হেঁসে উঠলো। কারণ ওর উত্তর ছিল ঘাস ফড়িং ধরা। নানান রঙের ঘাস ফড়িং না-কি ছিল তাদের লেবু বাগানের কচু গাছে। ফড়িংয়ের রঙ যে কত ধরনের আছে। ফড়িংও যে কত রকম হয় এমন গল্প শুরু করলে মিনুর শেষই হতো না। আমি তখন থেকেই বুঝতে পারি ঘাস ফড়িং মিনুর খুবই পছন্দের। তাই অনেক খোঁজাখুঁজি করে অসংখ্য ঘাস ফড়িং কাঁচের বোতলে ভরে তাকে দিয়ে বলেছিলাম,

– ‘আমি তোমাকে ভালবাসি ঘাস ফড়িং।’

সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলেছিল,

– ‘আমিও অনেক ভালোবাসি ঘাস ফড়িংকে।’

আমি বোতলটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিলাম,

– ‘তুমি ভালবাসো এই ঘাস ফড়িংকে আর আমি বাসি তুমি ঘাস ফড়িংকে।’

মিনু বিস্মিত হয়ে বোতলটা হাত থেকে ছেড়ে দেয়। টুংটাং করে গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ঘাস ফড়িং সব কয়টা সেদিন মিনুকে ছেড়ে উড়ে গিয়েছিল। আমার ঘাস ফড়িংও উড়াল দিয়েছে শ্রেয়া। ফড়িং হলো পাখি। পাখিদের ধর্ম হলো উড়াল দেয়া।

—-সমাপ্ত—
লেখা: MD Jobrul Islam

বি:দ্র: এটা ছিল আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। দুই-তিন বছর আগের লেখা। এর আগে অবশ্য ছোট ছোট গল্প লিখতাম। আর এটা দিয়েই উপন্যাসের শুরু ছিল। কিন্তু কি এক কারণে এই উপন্যাস পাঠকদের প্রচন্ড ভালো লাগার ছিল। আইডি হারিয়ে যাওয়ার পর অনেকেই রি-পোস্ট করতে বলতেন। এডিট করে রি-পোস্ট করার ইচ্ছা থাকলেও তেমন করা হয়নি। যেভাবে ছিল আবার পোস্ট করে দিয়েছি। আগের লেখা এবং প্রথম উপন্যাস ছিল যেহেতু, তাই ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here