সন্ধ্যে ঠিক সাতটা পাঁচে আনুমানিক বাইশ-তেইশ বছর বয়সের একটা মেয়ে হাতে এগারোটা গ্যাসবেলুন নিয়ে দোতলা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। তার সাদা পায়জামায় ছোপ ছোপ কাঁদা লেপ্টে রয়েছে। যদিও বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় গাড়ি নিয়েই বের হয়েছিলো সে।

মেয়েটির নাম অরণী…অরণী চৌধুরী। আজ সকাল সকাল ছোটফুপুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছিলো সে। মাঝরাস্তায় জ্যামে বসে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে তাকাতেই রঙবেরঙের বেলুনগুলো চোখে পড়লো তার। একমিনিট বেলুনগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়লো।
.
গাড়ির সামনের সিটে আরাফাত বসে ছিলো। আরাফাত হলো আতাহার সাহেবের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আতাহার সাহেবের অনুপস্থিতিতে বাসার বাইরে অরণীকে চোখে চোখে রাখাই হলো তার একমাত্র কাজ, যে কাজটা সে অন্তত প্রশংসার সাথেই পালন করছে। আরাফাত অরণীকে বেশ সম্মানের সাথেই দেখে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে অরণী তাকে প্রচন্ডরকম অপছন্দ করে। অরণী গাড়ি থেকে নামার প্রায় সাথে সাথেই আরাফাতও গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। অরণী অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো!
“আপনাকে আসতে বলেছি আমি আমার সাথে?”
“স্যার বলেছেন আপনার সাথে থাকতে!”
“আমি ওই সামনের অফিসের বাথরুমে যাবো, যাবেন আমার সাথে?”
.
আরাফাত মাথানিচু করেই দাঁড়িয়ে ছিলো। অরণীর কথা শুনে মাথা আরো নিচু করে ফেললো। আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ির সিটে গিয়ে বসলো।

অরণী বললো, “আমি না বলা পর্যন্ত খবরদার আপনাকে যেন আর আমার পিছু পিছু ঘুরতে না দেখি। আমার জিনিসগুলো ফুপির বাসার পৌঁছে দিলেই হলো! আমার পিছুপিছু আপনার ঘোরা লাগবেনা! বুঝছেন?”
.
অরণী উত্তরের অপেক্ষা না করে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। আরাফাত একবারের জন্যও গাড়ির কাঁচ দিয়ে বাইরে ফিরে তাকালো না, মাথা নিচু করেই বসে রইলো। রাস্তার জ্যাম ছাড়তে এখনো অনেক দেরী।
.
অরণী বেলুন হাতে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলো। গুনে গুনে বারোটা গ্যাস বেলুন কিনলো। এতগুলো বেলুন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসা সম্ভব না। ফুপুবাড়িও বোধহয় খুব একটা দূরে না এখান থেকে. জ্যামে আটকে ধীমগতিতে আগানোর চেয়ে হেঁটে গিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো সম্ভব। অরণী বেলুন হাতে ফুটপাত ধরে জ্যামপূর্ণ রাস্তাটুকু হেঁটে গিয়ে একটা রিক্সা নিলো। আরাফাত শূণ্যদৃষ্টিতে অরণীর হেঁটে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
অরণীর ফার্মগেট পৌঁছাতে পৌঁছোতে পাঁচটা বাজলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো, যখন তার মনে পড়লো, সে তার ফোনটা ভুলে গাড়িতেই ফেলে এসেছে। এমনকি ছোটফুফুর বাসার সঠিক ঠিকানা পর্যন্ত সে জানেনা। আরাফাতের কাছে ঠিকানা আছে! ভাগ্যিস বেলুন কেনার জন্য পার্সটা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলো। নাহলে রিকশাভাড়াটাও সে দিতে পারতোনা। রিকশা ছেড়ে দিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর বসে এদিকওদিক তাকাতে লাগলো সে। রিকশাওয়ালা কাছেই তার রিকশার সিটের ওপর আয়েশ করে বসে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে অরণীকে খুঁটে খুঁটে দেখছে! অরণীর কেমন অস্বস্তি হচ্ছে এখন। রাস্তার লোকজন তার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে! সে ফুটপাত থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পথ ধরে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলো। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে তার পায়জামা রাস্তার কাঁদায় লেপ্টে গেলো, একটা বেলুনের সুতা হাতছাড়া হয়ে উড়ে গেলো। এখন তার হাতে আর এগারোটা বেলুন পড়ে আছে!
.
হঠাত পেছন থেকে কেউ তার ওড়না টেনে ধরতেই সে তড়িৎগতিতে পিছনে ফিরে তাকালো। একটা দশ-বারো বছরের ছেলে খালি গায়ে দাঁড়ানো। অরণী চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “এই ছেলে, তুমি আমার ওড়না টানতিছো কেনো?”
.
“আফা, সাতদিন ধরে না খায়া আছি, এক গেলাস ফানিও খাইনাই আফা! কেউ টেহা দিবার চায়না! দুডা টেহা দেন আফা! বাড়িত ছোড একনা বইনও না খায়া আছে, আফা….”
ছেলেটা গড়গড় করে কথা বলেই যাচ্ছে!
.
অরণী চোখ কপালে তুলে বললো, “কয়দিন থেকে না খেয়ে আছো?”

“সাতদিন, আফা…. সাআআতদিন!” টেনে টেনে বললো ছেলেটা।
.
অরণী আনমনে ভাবতে থাকলো, সে নিজেই দিনে ছয়-সাতবার খায়, আর এই ছেলে কিনা বলে সাতদিন ধরে পানিও খায়নি!
.
অরণী তার পার্সটা খুললো। অরণীর পার্সে কখনো টাকা থাকেনা। সে গাড়ি ছাড়া একা কোথাও যায়না বিধায় টাকা না থাকায় কোনো সমস্যা হয়না কখনো। কিন্তু আজকে বুঝতে পারছে, পার্সে টাকা না রেখে কি ভুলটাই না সে করেছে! পার্সে আজ হাতেগোনা অল্প কিছু পয়সা ছিলো। পার্সব্যাগের খুচরা পয়সা পাতি সব খরচ করে সে রিকশাভাড়া দিয়েছিলো। এখন একটা সুতাও নেই ব্যাগে।
.
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হেসে অরণী বললো, “আমিও ফকির, তুইও ফকির! ফকিরের কাছে কেউ ভিক্ষা চাইতে আসে?”
.
ছেলেটা হাঁ করে অরণীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। ভিক্ষা চাইতে এসে এমন মানুষ বোধহয় সে তার পুরো ভিক্ষুকজীবনে দেখেনি!
.
অরণী পিছনে ফিরে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা ধরলো। সে শুধু ফকির না; যাযাবরও বটে! কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই পিছন থেকে আবারো সেই ছেলেটা এসে ওড়না টেনে ধরলো। অরণী বিরক্ত হয়ে বললো, “বললাম তো, টাকা নাই!”
ছেলেটা বললো, “আফা হক্কাল থেকি একয় ট্যাহা ফাইছি! আফনেও খাননাই? আফনের লাগবো?”
.
অরণী তার জীবনে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কোনোদিন পড়েনাই! সে হতভম্ব চোখে ছেলেটার দিকে একবার, ছেলেটার ঝুলির দিকে একবার তাকাচ্ছে! হাসির চোটে বুক ফুড়ে কান্না বেড়োতে চাচ্ছে তার
.
এমন সময় রাস্তার পাশে তাদের কালো গাড়িটা এসে দাঁড়ালো। আরাফাত গাড়ি থেকে নেমে এসে বললো, “ম্যাম, আপনার ফোন গাড়িতে ফেলে এসেছিলেন। আর আপনার আত্মীয়ের বাড়ির ঠিকানাটাও আপনার জানা নেই। আপনি গাড়িতে উঠুন। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি!”
.
অরণী বললো, “আপনার কাছে পাঁচশ টাকা হবে?”
আরাফাত মানিব্যাগ খুলে, পাঁচশ টাকার একটা কচকচে নোট বের করে দিলো। অরণী টাকাটা নিয়ে ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো, “আরেকদিন তোমার সাথে খাবো। আজ তোমরা ভাইবোন মিলে খাও! আমি আসি কেমন?”
অরণী গাড়িতে উঠে বসলো! বেলুনগুলো গাড়ির পেছনে বেঁধে রাখলো।
.
.
ধানমন্ডির ২৬ নং এ বিশাল কম্পাউন্ডের একতলা বাড়ি অরণীদের। উঁচু লোহার গেট পেরিয়ে কেউ এবাড়িতে ঢুকলে প্রথমেই হকচিয়ে যায়। বাড়ির সামনের সুইমিংপুলের মাঝের পাথরের ঝর্ণা, সাদা গোলাপে ভরা বাগান, দোতলার দক্ষিণ দিকের হুলুস্থুল বারান্দা যে কারো নজর কাটে। এতদিন অরণী এবাড়িতে তার ছোটখালার সাথে থাকতো। ছোটখালার সাথে তার বয়সের পার্থক্য পাঁচবছরের। অরণীর যখন এগারো বছর বয়স, তখন তার মা মারা যায়। প্রথম প্রথম নানী থাকতো ওদের সাথে। ছোটখালা ভার্সিটিতে উঠলে নানী গ্রামে চলে যায়!অরণীর সাথে তখন থেকেই ছোটখালা থাকে। গতবছর নভেম্বরের সাতাশ তারিখ ছোটখালার বিয়ে গেলো। অরণীর বাবার বারো মাস সমুদ্রের জলে ভেসে ভেসেই কেটে যায়। বর্তমানে তিনি চেক জাহাজ এনরিও কর্ণির প্রধান নাবিক… তাই স্বাভাবিকভাবেই অরণীর খালা যাওয়ার পর অরণী পুরোপুরি একা হয়ে গিয়েছে।
.
অরণীর ছোটখালার বিয়ের পর থেকে এতবড় বাড়িতে সে একাই আছে। একা বললে অবশ্য ভুল হয়। দারোয়ান, রাধুনী, মালি, ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, কাজের মেয়েসহ বারোজন এবাড়িতে থাকে। কিন্তু এদের কারোরই দোতলায় প্রবেশের অনুমতি নেই। দোতলাটা শুধুমাত্র পারিবারিক লোকজনের জন্য!
.
অরণী এখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। ভার্সিটি ফার্মগেট থেকে কাছে হওয়ার অযুহাতে অরণীর বাবা, আতাহার সাহেব কোনোরকম জোর করেই তাকে ফুপুবাড়িতে থাকার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। অরণীর খালামণির বিয়ের পর তাকে কোনো আত্মীয়ের বাসায় রাখার জন্য খুব জোর করেছিলেন তিনি। কিন্তু অরণী কোনোভাবেই রাজি হয়নি। নিজের বাড়িতে নিজের মতো থাকার মতো স্বাধীনতা কে হারাতে চায়! কিন্তু শেষ পর্যন্ত আতাহার সাহবের জোড়াজুড়িতে অরণীকে বাধ্য হয়ে মানুষের বাড়িতেই গিয়ে উঠতে হচ্ছে!
.
এখন সে সেই ফুপুবাড়ির সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। দোতলা বাড়িটা বিশাল এলাকাজুড়ে! চারদিকে বড় বড় গাছপালা ঘেরাও করা। বিশালদেহী কোনো গাছ হেলে আছে বাড়ির ওপড়। বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা ক্রিস্টমাস ট্রি আকাশ ছুঁইছুঁই। অফহোয়াইট বাড়ির দেয়ালে কালচিটা পড়েছে; যেনো বিগত দশবছরে দেয়ালগুলো রঙ করা হয়নি! অরণী হা করে তাকিয়ে দেখছে বাড়িটা! কালচে খয়েরী রঙের ধুলাবালি, আর বিভিন্ন ভোটের কাগজ আঁটানো বিশাল গেট পেরিয়ে বাড়ির উঠানে আসতেই সদর দরজার সামনের সিঁড়িতে দাঁড়ানো প্রায় পাঁচফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা সুঠাম গড়নের ফর্সা ছেলেটাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো অরণী। হালকা নীল রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট, গলায় কালো টাই- একদম ফর্মাল ড্রেসাপে বড় গোলগোল চশমা পড়া ছেলেটা ফোন টিপতে টিপতে হেঁটে এসে উঠানে রাখা বাইকে চেপে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। অরণী তাকিয়েই রইলো। আচমকা মধ্যবয়স্কা এক মহিলার আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো অরণী…..
.
চলবে…
.
#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here