#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৭)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

প্রথি আর অনা একটি টেবিলে বসে জুস পান করছিল আর অল্প স্বল্প গল্প করছিল। তখনিই তাদের টেবিলে থাকা বাকি দুটো চেয়ার দখল করে নেয় নাজিম আর সিনান। সিনানের মুখই বলে দিচ্ছে এখানে এসে বসায় সে বিরক্ত। তাতে অনা প্রথি ভ্রুক্ষেপ করেনি। দেখেও না দেখার ভান করে নিজেদের মতো গল্প চালিয়ে যায়। সিনানের ভাব এমন মনে হয় যেন তারা তাকে ডেকে এনেছে। যেহেতু নিজ ইচ্ছায় এসেছে তাই মুখটা যেমনিই করে রাখুক তাদের কোনো আগ্রহ নেই সেদিকে। নাজিম কিছুটা হতাশ হয়ে প্রথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“কি ম্যাম! এতো ইগো কেন?”

প্রথি আকস্মিক নিজামের এমন কথায় চোখ বাঁকিয়ে তাকে দেখে নেয়। তারপর জুসে এক সিপ দিয়ে বলে,

“প্রথমত আমি আপনার ম্যাম নই। দ্বিতীয়ত! ইগো দেখাচ্ছি না আমার অরাটাই এমন।”

“চমৎকার কিন্তু।”

“হতে পারে।”

সিনান ওদের আলাপে আর মনোনিবেশ করেনি। প্রথির প্রতি চাপা রাগ জন্মেছে তার। সেই রাগ থেকেই এখন তার মন মেজাজ খারাপ। সিনান পাশের টেবিলে চোখ বুলাতেই দেখে একটা সুন্দর, ঝাকরা চুলের এক যুবক অনাকেই দেখছে। তার চোখে মুখে মুগ্ধতা, যা বলে দিচ্ছে অনাকে তার বেশ মনে ধরেছে। সিনানের ব্যাপারটা খুবই বিরক্তকর লাগে। অনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। তখনিই তার কানে ভেসে আসে নিজাম আর প্রথির আরো কিছু কথা না চাইতেও শুনতে হয় তাকে।

“আপনার নামটা তো বলুন!

“প্রথি, প্রথি মজুমদার।”

নিজাম আহত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলে,

“সনাতন ধর্মাবলম্বী?”

“না। খাঁটি মুসলিম। কেন? মুসলিমদের মজুমদার নাম শুনেন নি?”

“শুনেছি তবে প্রথি নামটাতেও একটা….

“একটা কী? আর আমি হিন্দু না মুসলিম তা নিয়ে আপনার এতো ইন্টারেস্ট কেন? আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন না।”

“জ্বি হ্যাঁ হ্যাঁ! বিয়েই তো করতে চাই।”

“পুরান পাগলে ভাত পায়না নতুন পাগলের আমদানি। শুনে রাখুন! আপনাদের মতো লাজ লজ্জাহীন গায়ে পড়া পুরুষদের প্রতি আমার খুব বেশিই এলার্জী। ছ্যাঁচড়া বললেও ছ্যাঁচড়া শব্দটির অপমান হবে। আপনি তার থেকেও দশ মাইল পেছনে।”

নিজাম অবাক দৃষ্টিতে প্রথিকে দেখছে। এমন মেয়ে সে আর কখনোই দেখেনি। দেখতে যতটা নম্র ভদ্র এবং বোকাসোকা ভেতরটায় সে এসবের ধারও ধারেনা যেন! সিনানও কিছুটা চমকিত হয়। তবে প্রথির কথার ধরনে না তার ধর্ম সম্পর্কে জেনে। এতদিন সেও তো তাকে বিধর্মী মনে করেছিল। আজকাল নাম গুলোই এমন যে ছেলে-মেয়ে, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এসবের পার্থক্য ধরা যায়না। এখানেও যেন সে খুব বিরক্ত হলো।
অনা একের পর এক প্রথির শান্ত মস্তিষ্কে করা অপমান গুলো উপভোগ করছে। মেয়েটাকে ধরে একটা চুমো খেতে ইচ্ছা করছে। এবং সে চট করেই প্রথির ডান গালে একটি চুমো খায়। প্রথি বুঝেছে কারণ কী তাই সে মৃদু হাসে। তবে ব্যাপারটা সিনান আর নিজামের কাছে কেমন একটা লাগে। সিনানের প্রথিকে ধরে চড়াতে ইচ্ছা করে। মেয়েটা তার ব্যক্তিগত চুমোতেও ভাগ বসাচ্ছে। ওদের দিকে থেকে মুখ সরিয়ে পাশের টেবিলে আবারও তাঁকায় সে। দেখে সেই সুদর্শন যুবকটি মুখ কুঁচকে আছে। সিনান মনে হয় মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেল। চট করে উঠে গিয়ে সেই ব্যক্তিটির পাশের একটি চেয়ারে বসে পড়ে। নিজামও থমথমে মুখ নিয়ে সে জায়গা ত্যাগ করে। প্রথি আর অনা আবারও গল্পে মশগুল হয়। সিনান সেই সুযোগটিই কাজে লাগায়। হালকা কেশে যুবকটির মনযোগ কাড়ে। ভদ্র যুবক কিছুটা মৃদু হেসে সিনানকে বলে,

“কিছু বলবেন মি.!”

“জ্বি হ্যাঁ! আপনাকে সেই কখন থেকে দেখছি ঐ হোয়াইট ড্রেস পড়া মেয়েটির দিকে তাঁকিয়ে আছেন।”

যুবকটি যেন কিছুটা ঘাবড়ে যায়, মিনমিনে গলায় সিনানকে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কি মেয়েটির ভাই?”

সিনান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, দ্রুত গতিতে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে,

“কি যা তা বলছেন! ভাই হতে যাব কেন? রাদিফের ছোট বোনের ফ্রেন্ড হয় এই মেয়েটি। আমি সেই সুবাদেই চিনি তাকে।”

যুবকটি যেন স্বস্তি ফিরে পায়! মুখে অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে বলে,

“আসলে মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি রিমির ফুফাতো ভাই অর্ণব!”

“আমি রাদিফ ভাইয়ের ভাই ব্রাদার সিনান।”

“ওহ।”

“যেহেতু মেয়েটিকে আপনার মনে ধরেছে তাই ভদ্রতার খাতিরে আপনাকে একটা সত্য জানিয়ে বড় ভুলের হাত থেকে বাঁচাতে চাই।”

“মানে? কেমন ভুল!”

“ঐ যে মেয়েটি নাম হচ্ছে সুমনা। ও একটা এলবি।”

“হোয়াট! আর ইউ কিডিং!”

“নো! আপনি কী দেখেন নি সে তার পাশে থাকা তার বান্ধবী প্রিয়াকে চুমো খেয়েছে। তারা একে অন্যকে ডেট করছে।”

“আর ইউ শিউর!”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট! দেখেননি আমার ফ্রেন্ড একটু প্রিয়াকে ইমপ্রেস করতে গেছে সে সরাসরি বলে দেয় আই আম লেসবিয়ান এন্ড সুমনা ইজ মাই গার্ল!”

“তাই নাকি!”

“জ্বি হ্যাঁ। আমি মিথ্যে কেন বলব? আমি একজন ভদ্রলোক। মিথ্যা আমায় শোভা পায় আপনিই বলুন!”

“না তো, একদমই না। আজকালকার মর্ডান ছেলে মেয়ে গুলো দুনিয়া ধ্বংস করে ফেলবে দেখছি। এদের তো জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে ছাই করবে।”

“না না জাহান্নাম পর্যন্ত যাওয়া লাগবেনা। অভিশাপ দিয়ে আপনিও পাপের ভাগীদার হবেন না প্লিজ।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্ ব্রাদার। অনেক বড় লজ্জা এবং ভুলের হাত থেকে আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে সবসময়। এই নিন আমার কার্ড একদিন আমার অফিসে আসবেন। গল্প করব অনেক।”

“অবশ্যই।”

মুঁচকি হেসে সিনান কার্ডটি পকেটে পুরে নেয়। অর্ণবও টেবিল ত্যাগ করে যেতে যেতে ছিঃ ছিঃ করছে শুধু। সিনানের খুব হাসি পায় কিন্তু পাশে থাকা রমনীরা দেখে ফেলবে তাই মুখ টিপে রেখে মুখটাই লাল করে ফেলে। অনাকে সে সুমনা বানিয়ে দিয়েছে আর প্রথিকে প্রিয়া যাতে অর্ণব কাউকে ওদের সঠিক নাম বলে ওদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতে না ফেলতে পারে। শিষ বাজাতে বাজাতে সিনান নিজামের কাছে যায়। প্রথমবার কোনো মেয়েকে পটাতে গিয়েছিল সে আর প্রথমবারই কিনা রিজেক্টেড! তাও আবার ভরপুর অপমানে! আহ, কষ্ট।

————————————

চোখ খুলে নিজেকে গাড়িতে আবিষ্কার করে মেহজা। ইরফানকে খোঁজে তার অবচেতন মন, আর পেয়েও যায়। গাড়িতে নেই কিন্তু সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানের হাতে আইসক্রিম ছিল। যা দেখে লোভ সামলাতে পারেনা মেহজা। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ইরফানের সামনে গিয়ে দৌঁড়ায়। ইরফান একটুও চমকিত হয়না বরং মেহজাকে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে,

“উঠে গেছো? নাও ধর!মাত্রই কিনে আনলাম। তাড়াতাড়ি খাও নয়তো গলে যাবে।”

মেহজা ইরফানের হাতে থাকা কোণটি নিজ হাতে নেয় তারপর ইরফানকে বলে,

“আপনি খাবেন না?”

“আমি এতক্ষণ খেয়েছি।”

“এতক্ষণ খেয়েছি মানে?”

“আইসক্রিম নিয়েছি চারটা সব তোমার জন্যই। কিন্তু গরম লাগছিল তাই আমি একটা খাই, খেতে ভালো লাগছিল তাই তিনটাই খেয়ে ফেলেছি। এটাও খেয়ে নিতাম যদি না তুমি চলে আসতে।”

“কি সাংঘাতিক! আপনি আমার তিনটে আইসক্রিম খেয়ে আমায় একটা স্বান্তনা পুরুষ্কার দিচ্ছেন! মিথ্যে বললেন কেন? মাত্র কিনে আনেন নি তারমানে। আরো আগেই কিনেছেন।”

“ঠিক ধরেছ। আমি আরো আগেই কিনেছি।”

“না! আমি একটা খাব না। আরো খাব আপনি আমার গুলো কেন খেয়েছেন?”

“আচ্ছা ফেরার সময় কিনে দিব।”

“আমরা এখন কোথায়?”

“মাঝ রাস্তায়, দেখছ না?”

“এখানে কেন?”

“এমনিই।”

“কমিউনিটি সেন্টারে চলুন। সবাই খোঁজ করছে হয়তো।”

“আইসক্রিম!”

“পরে এক বক্স না না চার বক্স কিনে দিবেন তাহলেই হবে।”

“পেটুক।”

“আপনার মতো।”

ইরফান মুঁচকি হাসে। মেহজ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয় ইরফানকে সে উচ্চস্বরে হাসতে খুব কমই দেখেছে, উহু! দেখেই নি। এমনিতে তো হাসে না তেমন একটা আর হাসলেও শব্দহীন মুঁচকি হাসি হাসবে। যা সহজেই যেকোনো নারীকে ঘায়েল করতে সক্ষম।

মেহজা আগামীকাল হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে। রাদিফের বৌভাতের পরদিনই ইরফান তার ফ্ল্যাটে চলে যায়। আজ সাতদিন হতে চলল মেহজা ইরফানকে দেখেনা। মনটা কেমন বিষিয়ে উঠছে বারবার। ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে রাখছিল তখনিই অনার কল আসে। রিসিভ করে মোবাইল কানের কাছে আনতেই শুনতে পায় অনা আর্তনাদ করে বলছে,

“মেহজা? আমার আজকে এংগেজমেন্ট! হুট করেই আয়োজন করে ফেলেছে। বাবার মুখের দিকে তাঁকিয়ে না করতে পারছিনা। বিয়েও আমি করতে চাইনা। তুই বল এখন আমি কি করব?”

“বিয়ে করে ফেল।”

“কী! এটা বলতে পারলি?”

“এখনিই তো নিশ্চয় বিয়ে হয়ে যাচ্ছেনা। ইটস্ জাস্ট এন এংগেজমেন্ট।”

“অন্য কেউ হলে করতাম কিন্তু একে তো জীবনেও না।”

“কাকে?”

“ঐ বেয়াদব সিনান।”

“ভালোই তো। মেজর সাহেব! করেই ফেল। ভালোই হবে।”

“ভালো নয় মন্দ হবে। তুই আমার পক্ষে নাকি তার!”

“ভালোবাসার পক্ষে।”

অনাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে মেহজা কল কেটে দেয়। বিড়বিড় করে বলল,

“সিনান ভাই পারেও বটে।”

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মেহজার ফোনে একটি মেসেজ আসে। ইরফানের হাস্যজ্জ্বল ছবিটি স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই সে উচ্ছাসিত হয়ে পড়ে। মেসেজটি খুলতেই তার হার্টবিট মিস হয়ে যায় যেন! তার মনে ছিল না কিন্তু ইরফানের মনে আছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে,

“প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা প্রিয়তমা!”

খুশিতে কান্না করে দেয় মেহজা। তখনিই আরেকটি মেসেজ আসে,

“নিচে আসো,আমি অপেক্ষা করছি।”

এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুট লাগায় সদর দরজার দিকে। রিমিকে দেখতে পেয়ে বলে,

“ভাবি উনি এসেছে আমি গেলাম।”

মেহজার ছটফটানি দেখে রিমি হা হা করে হেসে ওঠে তারপর দরজা লাগিয়ে দেয়।

#চলবে।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here