#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৫)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

আজ রবিবার এবং আজকে রিমির বউভাত অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই কাজে ব্যস্ত মেহজা। অনা আর প্রথিও তাকে যথেষ্ট সাহায্য করছে। ঈশিতা গতকাল বাসায় চলে গিয়েছে বলেছে কাজ আছে কিন্তু এখন আবার ফিরে এসেছে মেহজার মায়ের জোরাজুরিতে। তার মনটা এখন বড্ড খারাপ। সবকিছুতেই বিতৃষ্ণা দেখা দিচ্ছে। মায়ের সাথে অকারণেই কথা কাটাকাটি হয়েছে। এতে সে নিজেই বিরক্ত! প্রেম ভালোবাসায় জীবন নষ্ট হয়ে যাবে শিক্ষা জীবনে একটা প্রেমও করেনি। কত ছেলের প্রস্তাব নির্দয়ের মতো ফিরিয়ে দিয়েছিল তার হিসেব নেই। অথচ আজ! আজ সে নিজেকে বুঝদার মনে করে এখন প্রেম ভালোবাসার পথে পা বাড়িয়েছে কিন্তু ভালো কিছু কি হয়েছে? বরং সে তথাকথিত ছ্যাঁকা খেয়ে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়েছে। তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, বিচক্ষণতা হারিয়েছে। সেই রাগারাগি, কথা কাটাকাটি অযথা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নাও করেছে। কেন করেছে সে এসব? এতেই তো প্রমাণ পায় যে যত বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমত্তার অধিকারীই হও না কেন প্রণয় এর কাছে সবই ফিকে পড়ে যাবে। এই জন্যই তো গান রচিত হয়েছে,

‘ প্রেমে পড়া বারণ, কারণে অকারণ ‘
‘ আঙুলে আঙুল রাখলেও, হাত ধরা বারণ! ‘

আবার আরেকটি গানও আছে যা বন্ধুমহলে হাসি তামাশা করে একসময় গাইত সবাই।

‘ পিরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়েনা! ‘
‘ গোলেমালে গোলেমালে পিরিত কর না! ‘

এতসব সাবধান বাণী থাকার পরেও কেন যে প্রেমে পড়তে হয় তা-ই জানা নেই! আসলে কেউ কি জানে? প্রেমে পড়তে হবে কেন? নিজ থেকে ধ্বংস ডেকে আনতে হবেই বা কেন! এটা কোন নিয়ম? এ জীবনে প্রেমকে নিষিদ্ধ করা হোক! আইনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রেমে পড়া ব্যক্তির শাস্তি দেওয়া হোক! শাষিয়ে বলা হোক,
“আর কখনো প্রেমে পড়বিনা, কাউকে ভালোবাসবিনা। বিশেষ করে তাকেই যাকে তুই কখনোই পাবিনা।”

কিছুক্ষণ আগেই ইরফান বাসায় এসে পৌঁছায়। তার মনের অবস্থা মোটেও ভালো না। কাল দুপুরের পর থেকে মেহজা একবারও ইরফানের সাথে যোগাযোগ করেনি। সে ভেবেছে রাতে হয়তো কল করবে তাও করেনি। ইরফান ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে কি না! খাওয়া দাওয়া করেছে কি না কিচ্ছুর খবর নেয়নি পাষাণ মেহজা। হুহ! আচ্ছা সে কী জানে ইরফান কাল বাসায় ছিল না? জানবে কীভাবে! সে তো জানতেই চায়নি। তাছাড়া তার ওতো সময় কোথায়? সে তো ভাইয়ের বিয়ের আনন্দেই মত্ত হয়ে আছে। ইরফান মনে মনে পণ করে যতক্ষণ না মেহজা তার কাছে আসছে সে মেহজার কাছে যাবেনা। যোগাযোগও করবেনা কোনো প্রকার। থাকুক না সে তার মতো। ইরফান তো তার স্বাধীনতায় বাঁধা দেয়নি শুধু একটু য ত্ন চেয়েছে যা প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীকে করে থাকে।

চোখে সানগ্লাস দিয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিনান। অনাকে তার দুই চোখ সেই কখন থেকেই খুঁজে চলেছে কিন্তু তার দেখা মিলছেই না! মেয়েটা বড্ড অসভ্য! কোনো কথা শুনতে চায়না তার। সিনানকে সবসময় যা নয় তা ব্যবহার দেয়। অতি দ্রুতই সে এই মেয়ের ব্যবস্থা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

পার্লারে এসেছে মেহজা, রিমি, ঈশিতা, অনা, প্রথি, রুম্পা। এখানে থেকে আবার কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হবে। সেখান থেকেই রিমা তার বাবার বাসায় যাবে। তারা তিনদিনের জন্য কমিউনিটি সেন্টারটা নিলেও শুধুমাত্র দুইদিনই এসেছে। এক বিয়ে ও দুই বৌভাত। অবশ্য কিছু রিলেটিভস ছিল দু পক্ষের যারা রক্তের দিকে আত্নীয় নয় কাজের ক্ষেত্রে পরিচিত এমন অনেকেরই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানকার কিছু ভিআইপি রুমে।

গতকাল যখন অনা কেঁদে দিয়েছিল তখন সে সবটাই মেহজাকে আর প্রথিকে জানায়। তারা প্রথমে সিনানের ব্যাপারে এমন কথা বিশ্বাস করতেই পারেনি কিন্তু অনাও মিথ্যে বলছেনা তা স্পষ্ট। অনা তাদের মিথ্যে বলবে কেন? সে ওমন মেয়েই নয়। সিনানের উপর প্রচন্ড আক্রোশ জমা হয় মেহজার। ভেবেছে কালকেই কিছু করবে কিন্তু বাসায় গিয়ে জানতে পারে সিনান তার বাড়ি চলে গেছে। অগত্যা অতি মাত্রায় রাগ নিয়েও তাকে শান্ত থাকতে হয়।

পার্লার থেকে সেজে বের হওয়ার পর অনার চক্ষু যেন বেরিয়ে আসে। সামনে সিনান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে এখনো সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেহজা সিনানকে দেখে কিছুটা খুশিই হয়। কপট রাগ নিয়ে সিনানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

“আপনি এখানে কেন?”

“আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে ভাবিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাই এসেছি।”

“সিনান ভাই! আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

“কিন্তু আমার নেই।”

মেহজা সিনানের এমন খাপছাড়া জবাবে ভিষণ রেগে যায়। সে প্রতিটি জবাব এক ধ্যানে অনার দিকে তাঁকিয়েই দিয়েছিল তা মেহজার চোখ এড়ায়না। মেহজা আবারও কিছু বলতে যাবে পেছন থেকে রিমি বলে,

“সিনান ভাইয়া? আমরা ছয়জন তো! গাড়িতে তো জায়গা হবেনা।”

“আমি তো ছয়জনের জন্যই আসেনি ভাবি। আমি কেবল আপনার জন্যই এসেছি। এখন চাইলে আমি ঈশিতা আর রুম্পাকে সাথে নিতে পারি। এই তিন বান্ধবী তাদের রাস্তা মাপুক।”

সিনানের এমন কথায় অনা খুব লজ্জিত হলো। মেহজারও খুব খারাপ লাগে কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনা। তখনিই প্রথি বলে,

“ইয়াহ শিউর! আপনি ওনাদের নিয়ে যেতে পারেন। সি! আমাদের উবার এসে গেছে অলরেডী। আসলে আগেই জানতাম যে ভাবিকে নিতে ভাইয়া নিশ্চয়ই কোনো ড্রাইভার পাঠাবে। সেই হিসেব করলেও আমাদের এক্সট্রা গাড়ি লাগতোই। উপস্থিত বুদ্ধি আমার আবার একটু বেশিই। তাই আধ ঘন্টা আগেই উবার বুক করেছি।”

পাশেই একটি কালো গাড়ি এসে থামাতে সিনান আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। প্রথি তাকে অপমান করেছে ভাবতেই তার রাগ উঠে যায়। সে দ্রুত গাড়িতে বসে বাকিদের উঠার জন্য বলতেই সবাই গাড়িতে বসে পড়ে। সিনানও খুব জোরেই গাড়ি চালিয়ে চোখের আড়ালে চলে যায়। প্রথি সেদিকে তাঁকিয়েই মিটিমিটি হাসছে। মেহজা অবাক হয়ে তাকে বলে,

“এই তুই কখন উবার ডেকেছিস? দেখলাম না তো।”

“আরে না! উবার টুবার কিছুই ডাকিনি। আসলে গাড়িটি কার এবং কেন এসেছে আমি সেটাও জানিনা।”

“কি! তাহলে যে বললি এটা তুই ডেকেছিস।”

“আরে সে আমাদের বিন্দাস মস্তিষ্কে অপমান করতে পারে আর আমরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে ঠান্ডা মাথায় তাকে অপমান করতে পারব না! লোকটা যখন আমাদের হেয় করছিল তখনিই দেখি এই গাড়িটা এখানে পার্ক করতে চাইছে। আর ওমনি আমার মাথায় প্ল্যান চলে আসে। বাই দ্য ওয়ে! আমি কিন্তু এখন সত্যিই উবার ডাকছি। প্রে কর যাতে এইরকম একটা গাড়িই পাই। নাহলে ইজ্জত যাবে আবার।”

মেহজা আর অনা বিশ্বজয় করার মতো হাসি দেয়। এই না হলে তাদের ফ্রেন্ড! প্রথি লোকেশন দিলে দেখে তাদের অতি কাছেই একটি উবার আছে। সেই উবারটি ডাকলেই একটি নম্বর থেকে কল আসে গাড়িচালক তাদের কোথায় আছে জানতে চাইলেই সে পার্লারের নাম বলে। তখনিই সেই কালো গাড়ি থেকে একজন চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক লোক বেরিয়ে আসে। তাদের দিকে লোকটি এগিয়ে আসতেই মেহজা ভ্রু কুঁচকায়। লোকটি তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,

“আপনারাই কী উবার ডেকেছেন?”

মেহজা চমকিত স্বরে বলে,

“জ্বি!”

লোকটি হালকা হেসে বলে,

“আসুন আসুন আমার গাড়িতেই যাবেন। আমিই সেই চালক।”

তারা তিনজনই চরম অবাক হয়। আদৌ সম্ভব? এতোটা কো-ইন্সিডেন্স! আহ্! আল্লাহ্ যখন দেয় সবটা উজার করেই দেয়। খুশি খুশি নয়নে তারা একে অন্যের দিকে তাঁকিয়ে
“ইয়াহু” বলে মৃদু চিৎকার করে। বেচারা ড্রাইভার চকিত নয়নে চেয়ে রয় শুধু। তার মাথায় একটা কথা-ই বারি খাচ্ছে, “এদের মাথায় গন্ডগোল নাকি? সামান্য উবার ডেকে এত উচ্ছাসিত হওয়ার কি আছে?

কমিউনিটি সেন্টারে আসার পর থেকেই মেহজার দু চোখ ইরফানকে খুঁজে চলেছে। মাহিমা বেগম আর আহনাফ মজিদকে দেখে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে ইরফানের কথা জিজ্ঞস করতেই তারা বলে,

“ইয়াজ বাহিরে গেছে একটু। জরুরী ফোন কল এসেছে তা-ই এটেন্ড করতে গেছে।”

মেহজাও ছুট লাগায় বাহিরে। মেহজা কি আর জানতো লোকটা তার উপর অভিমানের পাহাড় তৈরি করে রেখেছে না জেনেই সে মস্ত বড় ভুল করে ফেলে।

#চলবে।

(রি-চেইক করিনি ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here