#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২২)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ নিয়ে ইরফানদের দোতালার বড় লিভিংটায় বসে আছে মেহজা, অনা, প্রথি। মেহজা অনা আর প্রথিকে কল করে বলেছে ঊনিশ তলায় আসতে তাই তারাও এসেছে। দুজনে আসতেই কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়। আর তারা আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে মেহজার খোঁজ করতেই তাদের বলা হয় সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসতে। তারাও কোনো কথা না বাঁড়িয়ে উপরে চলে আসে। এখানে এসে প্রথমে আশপাশটা দেখে যা বুঝতে পারে এটাই ইরফানদের বাসা। বিয়েতে ইরফানকে দেখে যখন অনা মেহজাকে জিজ্ঞেস করে ইরফান এখানে কীভাবে, তখন মেহজা শুধু বলেছে তারা একই বিল্ডিং এ থাকে সেই সুবাদে তারাও স্বপরিবারে আমন্ত্রিত। তবে মেহজা এটা বলেনি যে তাদের উপর তলায় ইরফানরা থাকে।
অনা আর প্রথি দ্বিতীয় চমকটা পায় তখন যখন তারা মেহজাকে শাড়ি পড়িহিতা দেখে। অসময়ে, অন্যের বাসায় তাও আবার বধূ বেশেই বলতে গেলে সে কী করছে তারা তা ভেবে পায়না। অনা চমকিত কন্ঠে মেহজাকে বলে,
‘এসব কী মেহু? তুই এখানে কি করছিস! আমাদেরই বা কেন এখানে ডাকলি!’
‘বলব সব। আগে দুজনে এখানে এসে বস।’
মেহজার হাতের ইশারা অনুযায়ী দুজনেই মেহজার মুখোমুখি সোফায় বসে। অবাক চোখে মেহজাকেই পর্যবেক্ষণ করে চলছে দুজন। কেমন একটা ধাঁধাঁর মত লাগছে সব কিছু। কাজের মহিলাটি তিন কাপ চা এনে দিয়ে নিরবে চলে যায়। মেহজা অনা আর প্রথিকে অনুরোধ করে চা টা খাওয়ার জন্য। শত বিস্ময় নিয়ে তারাও চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল। একটা সাসপেন্সন এর মধ্যে ধোঁয়া ওঠা গরম চা-ই তো মোস্ট ইম্পর্টেন্ট!
‘আমি আজ আমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তোদের সাথে শেয়ার করব। যা আগে কখনও করিনি কিন্তু করা উচিত ছিল। সেটা সম্পূর্ণই আমার দোষ আমি মানছি। তবে এটাও জানি তোরা আমায় ক্ষমা করে দিবি পরিশেষে।’
অনা মেহজাকে চোখের ইশারায় বলছে ‘বল’ তাই মেহজা প্রথম থেকে বলা শুরু করে,
‘আমার তখন এস এস সির আর তিন মাস বাকি। হুট করেই অনেকদিন আগের কিনে রাখা ফ্ল্যাটটা তে আমাদের শিফ্ট হতে হয়। এখান থেকে আমার স্কুল আর রাফসানের স্কুল কাছে, ভাইয়ার অফিস কাছে, বাবার অফিস গোডাউন, শোরূম সব এদিকেই। দাদার বাড়ি, ফুফুদের বাড়ি, ছোট খালামণির বাড়ি সবই এদিকেই। তাই আমাদের জন্য ব্যাপারটা খুবই ভালো ছিল। আগে যেখানে থাকতাম সেটা তিন তলায় ছিল যার ফলে বড় বড় দালান গুলোর জন্য দিনের শহরই দেখতে পারতাম না রাতের কালো শহর তো দূরের কথা। আঠারো তলায় থাকব শুনে সে কি খুশি আমার! আনন্দে আত্নহারা আমি এখানে এসে আরো বেশিই উচ্ছাসিত হয়ে পড়ি। এর একটাই কারণ! আমাদের উপর তলার ইরফান ইয়াজিদ! লোকটাকে আমি যেদিন প্রথম দেখি সেই দিনটা আমি আজও ভুলিনি। শুধু দিন নয় সময়টাও জানি। নভেম্বরের ছয় তারিখ সকাল নয়টা দুই মিনিটে। স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিফ্টে উঠি যখন তখন শুধু অনুভব করি আরও একজন আছে লিফ্টে। আমি অতোটা গুরুত্ব দেইনি। তারপর যখন সামনে থাকা মিররে পেছনের ব্যক্তিটিকে দেখে আমি বাকহারা হয়ে পড়ি, দিশাহীন হয়ে যাই, হুট করেই অসহায়ত্ব বোধ করি। আমার হাত পা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিল। লোকটি ধারালো চাহনীতে আমি মনে হয় কেটে কুটে কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিলাম। এত গম্ভীর আর সুপুরুষ আমি আগে দেখিনি। আমি সবসময় লম্বু নামে আখ্যায়িত ছিলাম। সেই আমিই সেদিন এক পুরুষের বুকের সমান হয়ে বড্ড আফসোস করেছিলাম কেন আর একটু লম্বা হলাম না। আমার বাবা আর ভাইও লম্বা কিন্তু সে অনেক বেশিই লম্বা ছিল তাই আমি প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম। আমি যে আরেকটি মানুষ লিফ্টে উঠেছি তাতে তার কোনো হেলদোল নেই। সে সোজা হয়ে আছে একটু চোখটাও ঘুরাচ্ছে না। জাস্ট লাইক আ রোবট! বুঝলি!’
মেহজা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলা শুরু করে,
‘আমার এই প্রেমটা লিফ্টেই গাঢ় হয়। লিফ্টটা আমার প্রেমের সবচেয়ে বড় সাক্ষী জানিস! তো সেদিনের পর থেকে আমি রোজ এই সময়ে বের হতাম আর সৌভাগ্যক্রমে প্রতিদিন তাকে লিফ্টে পেতাম। হুট করে আমার ক্লাস এর সময় একঘন্টা পিছিয়ে নেয়। তখন আমার দশটায় বের হতে হত আর আমি তার দেখাও আর পেতাম না। তবে এর মধ্যে প্রতিবেশি হিসেবে তার সাথে আমাদের পরিচয়পর্ব সমাপ্ত হয়। আমিও তাকে খুব বিরক্ত করতে লাগলাম। তাকে কোথাও দেখলেই মুঁচকি হাসি দেওয়া আর তার অগোচরে শত শত উড়ন্ত চুমো ছুড়া আমার রোজকাল কাজের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে কিন্তু একসময় আমার কার্যকলাপে আমার মনের ভেতরের ব্যাপারটা ধরেই ফেলে। আমিও একদিন তাকে দেখে ছোট ভাই রাফসানের সামনেই তার চোখে চোখ রেখে একটা চোখ মেরে দিলাম। ব্যাস! এটাই বয়ে আনে বিপদ। রাফসান বাবাকে জানিয়ে দেয় আমিও রিমি আপু মানে বর্তমানে যে আমার ভাবী পূর্বে সে আমার খুব পরিচিত এবং কাছের এক আপু ছিল। তো আমি তার কাছে যাই আর সবটা জানাই। বাবা বকবে বা মারবে এই ভয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।’
মেহজা মৃদু হেসে অনা আর প্রথির দিকে তাঁকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করে,
“সেদিন তাকে আবারও লিফ্টে পেলাম। সে আমাকে আর আমার ভালোবাসাকে সেদিন তুচ্ছ করেছিল আবেগের কাছে। অল্প বয়সের দোষ বলে আখ্যায়িত করেছে। যা আমার আবেগ বা দোষ কোনো কালেই ছিল না। তোরাই বল! থাকলে বুঝি আজও তাকে ভালোবাসতাম! ভালোবাসি এটাই তাকে বোঝানো দায়! রাগে দুঃখে একটা মাস আর তার দিকে তাঁকায়নি। নিজেও দেখা দিতাম না আর। তারপর একদিন হুট করেই তার মায়ের সাথে দেখা প্রথম পরিচয়েই তিনি তার বাসায় ডিনারে নিমন্ত্রণ করে। তার অনুরোধ ফেলতে পারিনি বিধায় আমি সেদিন যাই। সেই দিনটা আরো স্মরণীয় আমার কাছে। কারণ সেদিন একটা নোংরা ভুল বোঝাবোঝির জন্য আমি আর সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাই!”
এবার চরম অবাক হয় অনা ও প্রথি দুজনেই। বিবাহ বন্ধন! মানে মেহজা বিবাহিতা? মেহজা ওদের দুজনের চেহারার রঙ বদলাতে দেখে বলে,
“আমি বিবাহিতা আর এটাই সত্যি। ঐ যে ইরফান ইয়াজিদকে তোরা স্বামী হিসেবে চাস! সেই ইরফান ইয়াজিদ আমার স্বামী। তিনি একান্তই আমার ব্যক্তিগত সম্পদ! যার ভাগ আমি আর কাউকে দেব না কখনও।”
দুজনকেই শকের মধ্যে দেখে মেহজা মিটিমিটি হাসে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলে,
“প্রথম দেখার এক্সাক্ট টাইমটা মনে আছে কেন জানিস? কারণ আমি মিররে তাঁকানোর আগেই হাতে থাকা ঘড়িতে তাঁকিয়ে সময় দেখেছিলাম। কয়েক সেকেন্ডে নিশ্চয়ই মিনিট পার হয়নি। সেকেন্ডের সংখ্যাও দুই তিনের বেশি তো নয়। আর তারিখ তো জানতামই।”
————————————
সেই কখন থেকে ইরফান আর ইমা মাহিমা বেগম আর আহনাফ মজিদের ঘরে বসে আছে। এর মধ্যে একবারও আসল কথাটি বলে উঠতে পারছেনা সে। কেমন একটা আড়ষ্টতা কাজ করছে তার মধ্যে। বলবে বলবে ভাবছে কিন্তু বলতে ভয় করছে। পরিস্থিতিটা অনুকূলে নেই মনে হচ্ছে।
ইমা ভাইয়ের ছটফটানির কারণ কি তা জানে। ইরফান তাকে সবটা জানিয়েই এখানে নিয়ে এসেছে। এখন সে যেহেতু বলছেনা তাই তাকেও চুপ করে থাকা চলবেনা তাই ইমা বলল,
“আব্বা! কিছু জরুরী কথা ছিল। যদি আপনি চান তো বলতে পারি।”
“হ্যাঁ বল।”
“বাবুর বিয়ের একবছর হতে চলল। মেহজার ও আঠারো হয়ে গেছে কয়েকমাস আগে। তো আমি বলছিলাম কী এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের বিয়ের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া দরকার। ইরফান তো এখন যেহেতু একা থাকে ওর পাশে ওর স্ত্রীর থাকাটা খুব জরুরী। তাই বলছিলাম আপনি অতি শীগ্রই কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।”
“আমিও তো দুদিন ধরে সেটাই ভাবছি। তোমার মাও কাল রাতে বলেছে এই ব্যাপারে। যেহেতু তার আর মেহজার সম্পর্ক এখন ঠিক হয়েছে তাই আর সমস্যা দেখছিনা। ইয়াজ! তুমি কি বল? অনুষ্ঠান করব এখন!”
“জ্বি যা ভালো মনে কর তাই কর।”
“আমাদের মনে করাটা এখন বড় বিষয় নয়। একসাথে থাকবে তোমরা তাই তোমাদের সমোঝতা করা দরকার বলে আমি মনে করি।”
“বাবা তুমি অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম চালু করতে পারো পরশু থেকে।”
“বেশ তা-ই হবে। তবে মেহজা!”
“সেও চায় বাবা। সামাজিক স্বীকৃতি তার প্রাপ্য।”
“ঠিক আছে আমি ওর বাবার সাথে বিকেলে বৈঠকে বসব না হয়।”
“আচ্ছা।”
ইরফান বেরিয়ে আসে তার বাবা মায়ের রুম থেকে। এখন চাপ একটু কম লাগছে। যাক! কিছু কাজ তো করা শেষ এবার মেহজার রাগ ভাঙাতেই হবে।
#চলবে।